দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কবি কমরেড আল মাহমুদ

ভাবতে অবাক লাগে বাংলাদেশের মত একটি আজীব দেশে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। দুই পরাশক্তির মাঝখানে পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ নিলামে উঠে, ব্যর্থ হয়, ভুয়া স্বাধীনতার ছেলেভুলানো গালগল্পে পূর্ব বাংলার সম্পদের লুটপাট চলতে থাকে। দুর্বৃত্তের চেহারা বদল হয় শুধু পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তি সোনার হরিন অবাস্তব স্বপ্নের মত চোখ খুললেই অদৃশ্য হয়। পুঁজিবাদী প্রপোগান্ডা চলতে থাকে। চলতে থাকে মগজ ধোলায়। পূর্ব বাংলাকে উৎপাদনমূখি না করে মানব সম্পদকে বিদেশে পাঠানো হয় দাস হিসাবে , তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে বহুজাতিক পুঁজিপতিদের পন্য  আমদানী করা হয় লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া  আমদানী লাইসেন্সের মাধ্যমে। চোর ডাকাত অসাধু ব্যবসায়ীরা সব তাদের চেহারা দেখাতে সুরু করে। দেশ বিক্রির এজেন্টের কাজ শেষে বিদেশের পন্য বিক্রির এজেন্টের কাজ সুরু হয়। দাসেরা সব প্রভুর জন্য কাজ করে । প্রভুর কৃপাতেই জীবিকানির্বাহ আর জীবনযাপন। প্রতিবেশী দেশের বেকারের হার হ্রাস পায়, উৎপাদন বৃদ্ধি পায় আর বিদেশের খাদ্য সাহায্য নির্ভরশীলতা বিলুপ্ত হয়।

ভুয়া স্বাধীনতার গালগল্পে আর প্রভুসেবাতে কে কোন পদ নিবে সেই লড়াইয়ে পূর্ব বাংলার মানুষ নিজেরা নিজেরা হানাহানি করিতে থাকে। এই মগজ ধোলাইয়ে অংশ গ্রহণ করে দেশের বুদ্ধিজীবি, কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, নায়ক, সেলিব্রিটিরা যারা মুক্তিযুদ্ধের মত বোকামী করেনি।

যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের হত্যা করা হয়। অথবা জেলে পচে মরে।  সাড়া দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাতে ছেয়ে যায়।  মুক্তিযোদ্ধা শব্দটিকে কলঙ্কিত করা হয়।

কবি আল মাহমুদের জন্ম হয় ১১ই জুলাই, ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী লেখক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।  ।  গণকন্ঠের সম্পাদক হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা কবি সাংবাদিক আল মাহমুদকে জেলে থাকতে হয়েছিল ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে শেখ মুজিবের বিরোধীতা করার ফলে যারা জেলে ছিলেন তাঁরা মুক্তি পান।

কেউ প্রশ্ন করেনা একজন মুক্তিযোদ্ধা কেন জেলে যায় ?
কেউ প্রশ্ন করেনা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন তথাকথিত স্বাধীন দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়?
কেউ কারু পথ রোধ করে দাড়ায়না, বিক্ষুব্ধ হয়না, প্রশ্ন করেনা – বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কেনো ফাঁসিতে হত্যা করা হয়?
একজন কাপুরুষ যে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেয়ে হানাদারের ঘরে আশ্রয় নেয় সে কিভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়? আর যে মানুষ দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে সে কিভাবে জেলে যায় সেই মানুষের দ্বারা যে নাকি যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কাপুরুষের মত পালিয়ে গিয়েছিল। শুধু পালিয়েই যায়নি পালিয়ে যেয়ে হানাদারের আস্তানাতে আশ্রয় নিয়েছিল। এইসব প্রশ্ন কারু মাথায় আসেনা। খুব স্বাভাবিক । যারা চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষ খুনের লাইভ এপিসোড উপভোগ করে যারা তাদের মাথায় স্বাভাবিক মানবিক কোন প্রশ্ন আসতে পারেনা।

দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদ কেন জেলে ছিলেন?
এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর গরুর রচনা লিখেছেন বেশ কিছু সাংবাদিক । সাড়া ইন্টারনেট ভর্তি প্রলাপে লেখা আছে রাস্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল । রাষ্ট্র বিক্রি করার জন্য প্রভুরা রাজ্যসরকার বানিয়েছিল যাদের তাদের রাস্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের বিরোধিতা করার জন্যই কবি আল মাহমুদ জেলে গেছিলেন – সেটা কেউ লিখেনি সেজন্য আমি লিখছি।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ কোপানি দ্যাখে যারা ওরা মানুষ মরে যাবার ত্রিশ বছর পরেও সেই মানুষের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালন করে কারণ এগুলা করাতে কোন ঝুঁকি নেই। নিরাপদ। বদ্বীপটিতে হিজড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চোরডাকাত ধর্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন ডাকাতের ঘরে ডাকাতি হবে। চোরের ঘরে চুরি হবে। খুনীর ঘরে খুন হবে। ধর্ষকের ঘরের মামেয়েবোনেরা ধর্ষিতা হবে। সবই ঘর কি বাত।

কবি আল মাহমুদ

সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে
আজ তুমি আসবে ।
সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে । যদিও উত্তরের বাতাস
হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে , তবু আমি ঠান্ডা পানিতে
হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম,
আজ তুমি আসবে । সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগরেটের
আগুন ধরিয়ে দিল । বলল , বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন
দেখবেন , বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে ।
দেখো , সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে ।
আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে । ক্ষুধার্ত মানুষ
হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে । সংবাদপত্রগুলোও

না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয় ।
রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে
আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি
চেপে ধরেছি ।

হায় স্বাধীনতা , অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা
সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম ।
আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি
যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায় । যাতে
আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই ।

কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি ? আমি পাষাণ কারার
চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি ।
শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে
জাগিয়ে রাখতাম ।

চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে ।
আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম।
এক চিলতে বাগান

ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামা ভিজিয়ে
চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুললাম ।
বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো ।
তারপর গেলাম গোলাপের কাছে ।
জেলখানার গোলাপ , তবু কি সুন্দর গন্ধ !
আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না , ছিঁড়তেও দেয় না

কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম ।
আজ আর সময় কাটতে চায়না । দাড়ি কাটলাম । বই নিয়ে
নাড়াচাড়া করলাম । ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে ।

গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানে আসছে ।
চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসের কড়াই ফুটছে ।
আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে
গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে ।

না বাইরে এখন আকাল । মানুষ কি খেতে পায় ?
দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে ?
অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই না আনতে পারে ।
আ , পাখিরা কত স্বাধীন । কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে
জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম ।
আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে ।
সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয় ।
আমি কতবার তোমাকে বলেছি , দেখো
মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না ।

এর অন্য ব্যবস্থা দরকার , দরকার সামাজিক ন্যায়ের ।
দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে ।

আ , যদি আমার কথা বুঝতে ।
প্রিয়তমা আমার ,

তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে । আর
উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে ।
দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষের কোলাহল ।
যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে ।

যারা ঠেলে ।
চালায় ।
হানে ।
ঘোরায় ।
ওড়ায় ।
পোড়ায় ।
আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায় ।
সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী ।
কোনদিন শুকোয় না । শোনো , তাদের কলরব ।
বন্দীরা জেগে উঠছে । পাশের সেলে কাশির শব্দ
আমি ঘরে ঘরে তোমার নাম ঘোষণা করলাম
বললাম , আজ বারোটায় আমার ‘দেখা’ ।

খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো ।
সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে ।
যেন তুমি সংবাদপত্র ! যেন তুমি
আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা !
সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে
মাঝ আকাশে টেনে আনলো
ঠিক তখুনি তুমি এলে ।

জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম , তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে
চুপচাপ বসে আছো ।
হাসলে , ম্লান , সচ্ছল ।
কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না ।
সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমি খাবার দিতে শুরু করলে ।

মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে ,
আবার ধরপাকড় শুরু হয়েছে ।
আমি মাথা নাড়লাম ।
মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে
অমুক বিপ্লবী আর নেই
আমি মাথা নামালাম । বললে , ভেবোনা ,
আমরা সইতে পারবো । আল্লাহ , আমাদের শক্তি দিন ।
তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম ।
যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের
মাঝখানে থামলো ।

অন্যান্য প্রকাশনা

• লোক লোকান্তর (১৯৬৩)
• কালের কলস (১৯৬৬)
• সোনালী কাবিন (১৯৬৬)
• মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬)
• আরব্য রজনীর রাজহাঁস
• বখতিয়ারের ঘোড়া
• দিনযাপন
• দ্বিতীয় ভাংগন
• একটি পাখি লেজ ঝোলা
• আল মাহমুদের গল্প
• জিবরাইলের ডানা
• পানকৌড়ির রক্ত
• সৌরভের কাছে পরাজিত
• গন্ধ বণিক
• ময়ূরীর মুখ
• না কোন শূণ্যতা মানি না
• নদীর ভেতরের নদী
• পাখির কাছে , ফুলের কাছে
• বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ
• উড়াল কাব্য

 

 

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

৬ thoughts on “দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কবি কমরেড আল মাহমুদ

Leave a Reply to Watch basketball online free Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.