জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শরিফুল হক ডালিম

৭ম পর্ব

বঙ্গভবনে কি হচ্ছিল রাত ১২ টায়!

ঘটে গেছে বিপ্লব। বঙ্গভবনে তখন নব্য চীফ জেনারেল খালেদ মোশাররফ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। তার সাথে রয়েছেন তার বিশ্বস্ত অফিসারবৃন্দ। ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল রউফ, কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর মালেক, কর্নেল মুন্নাফ, কর্নেল নাজমুল হুদা, মেজর হায়দার, মেজর হাফিজ এবং খালেদের ভায়রা ভাই কে কিউ হুদা।
হঠাৎ জেনারেল খালেদের পাশে রাখা টেলিফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরলেন খালেদ। ফোনটি সম্ভবত করেছিলেন রুবি ভাবী।
খালেদ জানতে পারলেন ক্যান্টনমেন্টের সব ইউনিটগুলো বিদ্রোহ করেছে। অস্ত্রধারী সেনারা পুরো ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশ আলোকিত হচ্ছে ট্রেসার বুলেটে, সব দিকেই ফায়ারিং এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে গগন বিদারি খালেদ-চক্র বিরোধী বিভিন্ন বৈপ্লবিক স্লোগান। খবর শুনে ঘাবড়ে গিয়ে শংকিত হয়ে পড়লেন খালেদ। উপস্থিত সঙ্গীদের জানালেন কাউন্টার ক্যু করার চেষ্টা করছে কেউ। নির্দেশ দিলেন মেজর হাফিজকে সরেজমিনে অবস্থা দেখে আসতে।
কিন্তু মেজর হাফিজ তখন দোটানায়। ইতিমধ্যে চলন্ত ট্যাঙ্কের আওয়াজ শুনতে পেলেন খালেদ ও উপস্থিত অফিসাররা।
মেজর মালেক কালক্ষেপ না করে ক্যান্টনমেন্টে তার স্ত্রীকে ফোন করলেন। ভীতসন্ত্রস্ত বেগম সাহেবা কান্নার সাথে কাঁপা গলায় জানালেন –
সর্বনাশ! এখানে তো সাংঘাতিক গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এই কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল মেজর মালেকের মুখ। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঝুলতে থাকল টেলিফোনের হ্যান্ডসেট। সবাই উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন কি খবর? প্রাণভয়ে মেজর মালেক তখন কাঁপছিলেন। বললেন, সেনা বিদ্রোহ ঘটেছে। তার কথা শেষ হতেই সবাই বুঝতে পারলো পাশা উল্টে গেছে। তাই মরি কি বাঁচি অবস্থায় যে যেদিকে পারল ছুটে পালাতে লাগলো।

জেনারেল খালেদ তার একান্ত বন্ধু কর্নেল হুদা, মেজর হায়দার, কে কিউ হুদাকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে করে বঙ্গভবন ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। তারা কলাবাগানে খালেদ মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সবাই সিভিল ড্রেস পরে নিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইং ক্লাবের একটি উড়োজাহাজ নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাবেন। কে কিউ হুদা তখন ফ্লাইং ক্লাবের একজন পেশাদার প্রশিক্ষক। কিন্তু ফার্মগেটের কাছে পৌঁছতেই তারা দেখতে পেলেন বিদ্রোহীদের ট্রাক, ট্যাংক-এর সাথে রাস্তায় হাজারো জনতার ঢল!
হতাশায় সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন তারা। এবারের গন্ত্যবস্থল শেরে বাংলা নগরের ১০ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইউনিটটি ‘কে’ ফোর্স-এর অধীনে ছিল। তাই তারা মনে করেছিলেন সেখানে তাদের নিরাপদ আশ্রয় মিলবে। কিন্তু বিধি বাম।

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশ ও জাতীয় স্বার্থই তাদের কাছে ছিল প্রাধান্যের বিষয়।
আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের ভূমিকম্প ভেঙ্গে দিয়েছিলো সমাজের মধ্যে মানুষ সৃষ্ট শ্রেণীবিভেদ। শ্রেণিগত অবস্থান ভুলে গিয়ে সমগ্র জাতি সমবেত হয়েছিলো এক কাতারে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই সবাইকে চিনতো।
যুদ্ধের সময়ে কার মূল্য কতটুকু সেটা যাচাই হতো না পদমর্যাদার মাপকাঠিতে। সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তি চরিত্র, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সাহস, সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিক সহমর্মিতার আলোকে।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধর্ষ কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, বীর গেরিলা কমান্ডার মেজর হায়দার, সাবসেক্টর কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদা আজ সৈনিকদের আক্রোশ থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের হাতেই করুণ ভাবে নিহত হন খালেদ ও তার সহযোগীরা। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস!
রাত ১ টার মধ্যেই বঙ্গভবন দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দ্বারা তাড়িত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে মেজর হাফিজ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল আহত অবস্থায় পলায়ন কালে ধরা পড়েন। ভিআইপি গেস্ট হাউসে অবস্থানরত যারা ফরমেশন কমান্ডারদের মিটিং-এ অংশগ্রহণের জন্য এসেছিলেন গুলির শব্দ শোনামাত্র আচমকা জেগে উঠে লুঙ্গি, গেঞ্জি কিংবা শুধু আণ্ডারওয়্যার পরা অবস্থাতেই যে যেদিকে পারলেন ছুটতে থাকলেন প্রাণের ভয়ে। ক্যান্টনমেন্টের অনান্য অফিসাররা যারা বাতাস বুঝে খালেদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তারাও বাসা ছেড়ে বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটোছুটি করতে লাগলেন দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে।

মেজর মালেক তার স্টাফ কার নিয়ে বঙ্গভবন ছেড়ে ছুটে চললেন সাভারের দিকে ১০ম ইস্টবেঙ্গলে আশ্রয়ের প্রত্যাশায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মালেক এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছিলেন, ১০ম ইস্টবেঙ্গল সাভারে নয়, অবস্থান করছে শেরেবাংলা নগরে।
সাভারের কাছাকাছি এসে তার মনে পড়েছিলো সেই কথা। কিন্তু সেখানে ফিরে যাবার মতো সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন জাঁদরেল মেজর মালেক। তিনি ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন তার গ্রামের বাড়ির দিকে ধাবিত হতে। গন্তব্যস্থল থেকে ৩ মাইল দূরে অপ্রত্যাশিত ভাবে গাড়ি থেমে গেলো। উদ্বিগ্ন মেজর মালেক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন,
ড্রাইভার গাড়ি থামালে কেন? জোরে চালাও। ড্রাইভার জানালো- পেট্রোল শেষ।
মেজর মালেক পকেট থেকে কিছু টাকা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন, তুমি পেট্রোল এর ব্যবস্থা করো, আমি এগুচ্ছি। বলেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ছুটে চললেন তার গ্রামের বাড়ির দিকে। আচমকা গাড়ি থেমে যাওয়ায় মেজর মালেক মনে করেছিলেন তার অস্ত্রধারী ড্রাইভারই তাকে মেরে ফেলবে। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি অনুভব করছিলেন তার প্যান্ট ভিজে উঠেছে নিম্নাঙ্গ থেকে নির্গত গরম পানিতে।
এভাবেই, প্রায় আধমরা ক্লান্ত মেজর মালেক পৈত্রিক ভিটা মানিকগঞ্জে পৌছে প্রাণে রক্ষা পান। পরে তিনি এলাকাবাসীর চাপে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

যে ধরনের প্রোপাগান্ডা আজঅব্দি চালানো হয়ে আসছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা সত্য অস্বীকার করার অবকাশ নেই।
স্বাধীনতা উত্তরকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেই সামরিক বাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিলো সেখানে মেরুদণ্ডহীন এবং দুর্বল চরিত্রের জেনারেলদের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ও আনুগত্য ছিল না।

বিশেষ করে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে এক ধরনের কৌলীন্যবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হতো প্রশিক্ষণকালেই শ্রেণিস্বার্থে। যার ফলে তারা নিজেদের আর সৈনিকদের মধ্যে একটা ব্যবধান বজায় রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের অনেকেই সেই মানসিকতা বর্জন করতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যরা মন থেকে তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো না।
জেনারেল এরশাদ যখন রাষ্ট্রপতি তখন একবার তিনি আমাকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

মেজর মালেকের সাথে একই সাথে কোয়েটাতে চাকুরী করেছি। ফলে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো। তিনি আমাদের পলায়নের ব্যপারে কিছুটা সাহায্যও করেছিলেন। এই বিষয়ে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’-তে বিস্তারিত লিখেছি।
তখন তিনি কর্নেল এবং জেনারেল এরশাদের কৃপায় ঢাকার মেয়র। তিনি জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট আমাকে ঢাকায় ডেকে এনেছেন। তাই হয়তো বিশেষ আগ্রহের সাথে তিনি আমাকে সস্ত্রীক দাওয়াত করলেন তার বাড়ীতে। সে রাতে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ৭ই নভেম্বরের অভিজ্ঞতার কাহিনী নিজমুখেই আমাদের শুনিয়েছিলেন কর্নেল মালেক।

চলবে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.