যেদিন আওয়ামী লীগ আর কখনো বিরোধী দলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেছে, সেদিন থেকেই এদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ এদেশে বিরোধীদলের জন্য কোনো রাজনীতি রাখেনি। বিরোধীদলকে তারা যে পরিণতির সম্মুখীন করেছেন সে পরিণতি শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক জীবদ্দশায় ভোগ করবেন না। আজকের এই শেষ গন্তব্যের শেষে বাংলাদেশের একটি অন্যতম রাজনৈতিকদল আওয়ামী লীগ হয়তো হয়ে যাচ্ছে গন্তব্যহীন, অগ্রহণযোগ্য, জনবিচ্ছিন্ন।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে মোকাবেলা এবং গণতন্ত্রের শত্রু এরশাদের সঙ্গে হিসাব নিকাশের রাজনীতির ছকে সাজিয়ে বিএনপি’কে টার্গেট করে বিভিন্ন কৌশল নিতে থাকেন। সেইরকম একটা কৌশলে ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করে এরশাদকে স্থায়িত্ব প্রদান করেন। সেখানে আওয়ামী লীগ কিছু না পেলেও এরশাদ টিকে যায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত।
২৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৯১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর শুরু হয় দলীয় হতাশা। হতাশা থেকে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং দলীয় গৃহদাহ থেকে কর্মীদের দ্বারা ড. কামাল হোসেন পর্যন্ত লাঞ্ছিত হন।
অনেক নাটকীয়তার পর শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বিএনপি সরকারকে একদিনও শান্তিতে না থাকতে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আবার রাজনীতিতে ও রাজপথে সক্রিয় হন।
পরবর্তীতে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করলে শেখ হাসিনা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথের আন্দোলনে সফলতা অর্জন করেন।
১৯৯৬ সালে আন্দোলন পরবর্তী ১২ জুনের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। ২৩ জুন নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর ২৪ জুন সকল পত্রিকায় লাল হরফে ব্যানার হেডলাইন হয় ‘হাসিনা প্রধানমন্ত্রী’। ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এর পর এটাই ছিল আওয়ামী লীগের স্বপ্ন পূরণ ও শেখ হাসিনার রাজনীতির সর্বোচ্চ সফলতা।
এর পর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা মেয়াদ পূর্ণ করেন। তার শাসনামলের শেষ বছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মত দুর্নীতিতে প্রথম হয়, সামাজিকভাবে সন্ত্রাস বেড়ে যায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আসে। এসব কারণে ২০০১ এর সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয় এবং ২১বছর পর ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ আবার বিরোধীদল হয়ে যায়।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কেন্দ্রিক বিতর্কে ২০০৬ এর শেষে দেশে অরাজকতা তৈরি হয় এবং এই অবৈধ সরকারকে আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঘোষণা করে। সেই সুযোগে সেনাসমর্থিত মইনুদ্দীন -ফখরুদ্দীন সরকার দুইবছর জরুরি শাসন করে সংসদ ভবনকে জেলখানা বানিয়ে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০০৮ এর নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয় এবং আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে।
কিন্ত ১৯ জুন ২০১০ চট্রগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ২০১১ সালে সারাদেশে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্রম হ্রাসমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জনগণের ভোটে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের জন্য অনিশ্চিত হয়ে যায়। কিন্ত এবার আর শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রী হয়ে রাজনীতিতে থাকতে চান না।
প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন যে, ৬০ বছর বয়স হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তবে তিনি আর কখনোই বিরোধীদলের রাজনীতি করবেন না, যতদিন রাজনীতিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী হয়েই থাকবেন।
রাজনীতির বাকি দিনগুলো প্রধানমন্ত্রী থাকার ইচ্ছা থেকেই শেখ হাসিনা অনেকগুলো সফল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংসদীয় কমিটির সাথে মতামত প্রদানে মাত্র একজন বাদে সকলেই এবং সকল পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
প্রতিটি জনমত জরিপ এবং এদেশের প্রায় সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে থাকলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই। পঞ্চদশ সংশোধনী এই পরিকল্পনারই মাষ্টার প্লান। যতদিন বর্তমান সংবিধান এবং প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচন হবে ততদিন প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধীদলীয় নেত্রী হতে হবে না, এটা এখন নিশ্চিত হয়েছে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে বর্তমান সংবিধান থেকে তিনি একচুলও নড়বেন না, তিনি কথা রেখেছেন। রাজনীতির বাকি দিনগুলোতেও তিনি বর্তমান সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরিবর্তনের বিপক্ষে অবিচল থাকবেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীত্বের বাইরে তিনি আর কোনো রাজনৈতিক পদবী গ্রহণ করবেন না।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতির এই শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর কারণে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। জনগণের ভোটাধিকার ও বিরোধীদল দুটোই এখন নির্মূল হওয়ার পথে এবং নির্বাচন ছাড়াই সরকার গঠন সম্ভব হয়েছে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সরকার হওয়া ও সরকারে টিকে থাকার সাথে সাথে সেখানে, জনগণের প্রয়োজন এবং সম্পর্ক কোনোটাই নেই। আবার উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আগামীতে সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এরূপ বিজয় অব্যাহত থাকবে।
যেদিন থেকে শেখ হাসিনা বিরোধীদলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন সেদিন থেকেই এদেশের রাজনীতির সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগ আর কখনোই বিরোধীদলে যাবে না, কারণ তিনি এদেশে বিরোধীদলের জন্য কোনো রাজনীতি রাখেননি।
আবার বিরোধীদলকে তিনি যে পরিণতির সম্মুখীন করেছেন সে পরিণতিও তিনি রাজনৈতিক জীবদ্দশায় ভোগ করবেন না। তাই তিনি যতদিন রাজনীতি করবেন গণভবন, বঙ্গভবনে থেকেই করবেন, মিন্টো রোডে কখনোই নয়।
তবে আজকের আওয়ামী লীগের এই শেষ গন্তব্যের শেষে বাংলাদেশের একটি অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ হয়তো হয়ে যাচ্ছে গন্তব্যহীন ও অগ্রহণযোগ্য।
পারভেজ আহমেদ : আইনজীবী, কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ahmed_parvez@yahoo.com