শোষণের মাধ্যমেই সমাজে শ্রেণীবিন্যাস ঘটে। একদল মানুষের শোষন করার ক্ষমতাঁকে অন্য দল মানুষ যাদের শোষন করার ক্ষমতা নেই তারা মেনে নেয়। ফলে সমাজে ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ইত্যাদি শ্রেনীর সৃষ্টি হয়। প্রেমের ক্ষেত্রে একজন শোষিতের ছেলে সব সময় একজন শোষকের মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর কারণ হলো শোষিতের ঘরের অভাব অনটন আর টানপোড়েনে অস্থির থাকে মন । ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায় তখন সে সেই মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় যার মধ্য অভাবের চিহ্ন নাই। একজন শোষিতের মেয়ে স্বাভাবিকভাবেই সুন্দরভাবে সেজেগুজে থাকার মত অবস্থা আছে। ভাল পরিবেশে জন্ম ও মানুষ হবার কারণে তার ভেতর যে গ্লামার থাকে তা একজন গারমেন্টস শ্রমিক মেয়ের মধ্য থাকেনা। একজন শোষকের মেয়ের শরীরে ঝড়, বৃষ্টি, রোদ লাগেনা। শোষনের মাধ্যমে করা উপার্জন শোষকের মেয়ের শরীরকে নানা রকমের মূল্যবান বর্ম দিয়ে রক্ষা করে। শোষিতের ছেলে যা দেখে মুগ্ধ হয় এবং শোষকের মেয়ে একটু হেসে কথা বললেই শোষিতের ছেলে প্রেমে পড়ে যায়, কৃত্জ্ঞ হয় এই ভেবে যে দেখো কত বড় লোকের মেয়ে আমার মত একজন তুচ্ছ দরিদ্র ঘরের ছেলের সাথে কত সুন্দর করে কথা বলছে, একেবারেই অবহেলা করেনি, মেয়েটা বড় লোকের হলেও অনেক ভদ্র আর খুব ভাল । প্রেম করার সময় একজন দরিদ্র ঘরের ছেলের সাথে একজন ধণীর মেয়ে কোন সময় ঝগড়াঝাটি করেনা কারণ মেয়েটি জানে যে সে শুধু প্রেমের সময় পর্যন্ত এই ছেলের সাথে থাকবে, সে এই সময়টা উপভোগ করবে, ঝগড়া করে সময় নস্ট করবে কেনো? দরিদ্রের ছেলের সাথে তো সে ঘর করবেনা বা ভবিষ্যৎ কাটাবেনা তাহলে কেনো শুধু শুধু ঝগড়াঝাটি করে সময় নস্ট করা! একজন শোষকের মেয়ে কেনো একজন শোষিতের ছেলের সাথে প্রেম করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ – একজন শোষিতের ছেলে একজন শোষকের মেয়েকে যেভাবে ভালবাসবে বা যত্ন করবে সেভাবে একজন শোষকের ছেলে একজন শোষকের মেয়েকে ভালবাসবেনা বা যত্ন করবেনা।
একজন শোষকের মেয়ে একজন শোষিতের ছেলের সাথে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক। শোষকের মেয়ে হলো শোষিতের ছেলের কাছে প্রভুর সমান। সুতারাং ধনীর দুলালী যদি একটু তু তু করে ডাকে অমনি দরিদ্রের ছেলে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে যেয়ে হাজির হবে। ওর পা দুইটা চেটে দিবে। প্রেমের সময় বেশ কিছু সময় ধরে শোষিতের মেয়ে এইরকম সেবাযত্ন আদোর সোহাগ সব উপভোগ করে কিন্তু যখন বিয়ে করার কথা উঠে তখন শোষিতের ছেলেকে অগ্নীপরীক্ষা দিতে বলে। ধণীর মেয়ে বলে — আমার সমাজের সাথে উঠাবসা করার মত ক্ষমতা তোমার নাই। সেই ক্ষমতা তৈরি করে উঠে এসো তারপর বিয়ে করবো। অর্থাৎ আমার বাপদের শোষনের মাধ্যমেই তোমার বাপ, মা ও চোদ্দ গুষ্টি শোষিত । আমার বাপের মত শোষন করার ক্ষমতা অর্জন করে শোষণের মাধ্যমে আমার বাপের মত ধনি হইলেই তুমি আমাকে সেই সব সুখ দিতে পারবে যে সুখের পরিবেশে আমি জন্মগ্রহন করেছি। আমি সেই ঘরেই বিয়ে করবো যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় না। গাড়ী, বাড়ী, গহনা, খাবার, ব্যাঙ্ক বালান্স আছে, না চাইতেই সবকিছু পায়ের কাছেে এসে হাজির হবে। তখন দরিদ্র প্রেমিক আহত হয়। তার দরিদ্র অবস্থাকে সে দুর্ভাগ্য মনে করে আর ধনীর মেয়ের প্রেমে হাবুডূবু খেয়ে আজীবন নিজের সমাজের নিজের মানুষজনের সাথে দুর্ব্যবহার করে আর ক্রমাগত এইভাবে আত্মপ্রবঞ্চনা করে।
প্রেমের সময়টাকে পুরাপুরি উপভোগ করে ধনীর দুলালী নানারকম অজুহাত দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বড়লোকের ছেলেকেই অর্থাৎ নিজেদের সমাজেই বিয়ে করে কারণ দরিদ্রের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে সে জন্ম নেয় নাই ফলে সেই দরিদ্র ঘর সম্পর্কে আর সেখানকার অভাব অনটন সম্পর্কে তার কোন ধারণা নাই বা ধারণা করার ইচ্ছাও নাই। সে সুখে শান্তিতে শোষণের মাধ্যমে অর্জিত আরাম আয়েশে বড় হয়েছে । যাদের শোষন করে দরিদ্র করে সে নিজে আরামে আছে তাদের মাঝে আবার কেনো সে ফিরে যাবে ? একারনেই একজন ধণীর মেয়ে একজন দরিদ্রের ছেলের সাথে প্রেম করে কিন্তু বিয়ে করেনা বা দরিদ্রের ছেলের কোন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনা।
দরিদ্র ঘরের ছেলেরা নিজেদের দারিদ্রতার কারণ সে “বড়লোকেদের শোষন” এটা স্বীকার করেনা। উলটা নিজে নানাভাবে বড়লোক হবার ভান করে এবং নিজের সমাজের মানুষজনকে অবহেলা করে বা এড়িয়ে চলে। যখনই সে ধনীর মেয়ের সাথে প্রেম করে যখনই বড়লোকের ছেলে হবার অভিণয় করে এবং দারিদ্রের কষাঘাত লুকিয়ে ক্রমাগত অভিনয় করে আত্মপ্রবঞ্চনা করে। দরিদ্রের ছেলের সাথে ধনীর দুলালীর প্রেম – ধণীর দুলালীর জন্য বোনাস আর দরিদ্রের ছেলের জন্য আত্মপ্রবঞ্চনা।
পুঁজির মালিকের সাথে প্রেম এভাবেই পুঁজির উপাদানের জন্য আত্মপ্রবঞ্চনা হয়ে কষাঘাত করে।
বাংলাদেশের দরিদ্র জনগন নিজেদের দারিদ্র অবস্থা লুকিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত আর এভাবেই এরা আজীবন আত্মপ্রবঞ্চনা করে। সাড়া বাংলাদেশে পুলিশ/র্যাবের গুলিতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে – এই ব্যাপারটা বাংলাদেশের মানূষ খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। ঢাকার গুলশান, বনানী, ধানমন্ডী এলাকাতে বাংলাদেশের বেশীরভাগ ক্রিমিনাল বা অপরাধীরা বা শোষকেরা বাস করে। সেদিন গুলশান এলাকাতে সাজানো জঙ্গি নাটকে সুপরিকল্পিতভাবে কিছু দেশীবিদেশী মানুষকে হত্যা করা হলে এই প্রথম জানা গেলো ” বাংলাদেশে কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে”। কারন “মানুষ” বলতে শোষক বুঝায়। আর কুকুর শেয়াল বলতে “শোষিত” বুঝায়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পাশে ভারতের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করে এই সুন্দরবনকে ধবংস করার পরিকল্পনা চুড়ান্ত করা হয়েছে । এই ঘটনাতেও বাংলাদেশের মানুষেরা চুপচাপ আছে কারণ — একজন ধণীর দুলালী যেমন একজন দরিদ্রের ছেলের কাছে প্রভু তেমনি বাংলাদেশের কাছে ভারত হলো প্রভু। প্রভুর ইচ্ছাই কৃতদাসের ইচ্ছা। প্রভুর উপরে কৃতদাসেরা কথা বলার সাহস রাখেনা।