ডিপ্লোমেটিক জোনে ‘জঙ্গি’ হামলা

‘জঙ্গি’ হামলায় রক্তাক্ত হলো ঢাকা। রাজধানীর কূটনৈতিক জোন গুলশানে নজিরবিহীন এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিদেশি নাগরিকদের পছন্দের একটি রেস্টুরেন্টে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি। রাত নয়টার দিকে হামলা শুরুর পর থেকে রাতভর অপেক্ষা করা হয় রেস্টুরেন্টে জিম্মি লোকজনকে উদ্ধারের। তবে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযানে যেতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোরে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এর আগে ঘটনায় হতাহতের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন তথ্য জানানো হয়নি। হামলা শুরুর কিছুক্ষণ পর থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের অনুরোধ করে পুলিশ। এরপর থেকে ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় টেলিভিশনগুলো। রাত সাড়ে চারটায় এ রিপোর্ট লেখার সময়ও জিম্মি থাকা লোকজনকে উদ্ধারে কোন অভিযান শুরু হয়নি। ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে, মার্কিন সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ। আইএসের মুখপাত্র বলে পরিচিত আমাক এর বরাত দিয়ে সাইট জানায়, হামলায় বিভিন্ন দেশের ২০ জন নাগরিক মারা গেছে বলে আইএস দাবি করেছে। রেস্টুরেন্টে হামলাকারীদের সবাই ছিল বন্দুকধারী। এছাড়া তাদের কাছে বিস্ফোরকও ছিল। কূটনৈতিক জোনে এ ধরণের হামলার ঘটনা মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। রাত থেকে তামাম দুনিয়ার গণমাধ্যমে উঠে আসে গুলশান হামলার ঘটনা। ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ঢাকা থেকে পরিস্থিতি জানানো হয়েছে ঢাকাস্থ দূতাবাসের পক্ষ থেকে। ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে হোয়াইট হাউস। ঘটনার সূত্রপাত গতকাল রাত নয়টার দিকে। গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কে অবস্থিত হলি আর্টিজেন রেস্তোঁরায় তখন বিদেশি নাগরিকরা অবস্থান করছিলেন। খাবার তৈরি ও পরিবেশনে ব্যস্ত ছিলেন রেস্টুরেন্টের কর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অন্তত সাত থেকে আট জনের সন্ত্রাসী দল সেখানে প্রবেশ করে গুলি করতে শুরু করে। তারা মুুহুর্মুহু বিস্ফোরণ ঘটায়। হামলার খবর পেয়ে গুলশান ও বনানী থানার পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে হামলাকারীরা তাদের দিকে গুলি ও গ্রেণেড ছুড়তে থাকে। এতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। তখন পুলিশও বিচ্ছিন্নভাবে গুলি চালায়। তবে অবস্থা বেগতিক হওয়ায় তারা পিছু হটে আসে এবং অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে। আহতদের মধ্যে বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার রবিউল ইসলামকে গুরুতর আহত অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাদের মৃত্যু হয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ওই হাসপাতালে অন্তত ২০ জনকে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। আহত দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৯টার দিকে অন্তত ৮জন দুর্বৃত্ত রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকে। ঢুকেই তারা অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে। এক পর্যায়ে রেস্টুরেন্টের বাতি নিভিয়ে দেয়। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আগত বেশ কয়েকজন দেশি ও বিদেশিকে। ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশি নাগরিককে জিম্মি রয়েছে বলে রেস্টুরেন্টের কর্মী সুমন রেজা বাইরে এসে জানিয়েছেন। তিনি জানান, হামলার সময় তিনি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে আসেন। তার সঙ্গে আরও একজন নিচে নামেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালানোর জন্য রেস্টুরেন্টটির দিকে এগিয়ে যান। কাছাকাছি গেলে বন্দুকধারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। নিক্ষেপ করে গ্রেনেড। এতেই পুলিশ সদস্যরা আহত হন। রাত সোয়া ৯টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চলে এই জিম্মি দশা। সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত থেকে থেকে গুলির শব্দ হলেও এর পরে ভেতর থেকে আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। অন্তত অর্ধশতাধিক গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির বিপুল সংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তারা পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। গুলশান এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। হলি আর্টিজেন রেস্টুরেন্টর সুপারভাইজার সুমন বলেন, নয়টার দিকে ৮ থেকে ১০ জন যুবক অতর্কিতে ঢুকে পড়ে। তাদের একজনের হাতে ছিল তলোয়ার, বাকিদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র। ঢুকেই তারা কয়েকটি ফাঁকা গুলি করে এবং আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করে। তখন ভেতরে ২০ জনের মতো বিদেশি নাগরিক ছিলেন। এ সময় সুমনের সঙ্গে ইতালির নাগরিক আর্টিজেনের অপর এক নাগরিকও দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন। সুমন বলেন, আমি ছাদে ছিলাম। ওরা যখন বোমা মারছিল, তখন বিল্ডিং কাঁপছিল। ওরা ১০ থেকে ১২টা বোমা মেরেছে। ওরা সামনের দিকে এগুচ্ছিল বলে মনে হয়েছে। তখন ছাদ থেকে লাফ দিই। সুমন আরও বলেন, ভেতরে থাকা আমাদের কর্মীরা ফোন ধরতেছে না। আমাদের স্টাফদের মধ্যেও দুজন বিদেশি। সর্বশেষ রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ভেতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র?্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, জিম্মিদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছি। হামলাকারীদেরও আমরা জীবিত আটক করতে চাই। এদিকে ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলের আশাপাশের সড়কগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে গুলশান-২ এলাকার সংযুক্ত সড়কগুলোতে যানজট সৃষ্টি হয়। আর ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসার অনেক পুরুষ তখন ছিলেন মসজিদে। এশার ও তারাবির নামাজে ব্যস্ত ছিলেন তারা। নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখে এলাকাটি এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপত্তার স্বার্থে ৭৯ সড়ক দিয়ে বাসায় যেতে বাধা দেন। এদিকে প্রথম দফা চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শক্তি বাড়াতে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চলে অভিযানের প্রস্তুতি। সাজোয়া যান ও আলোর ব্যবস্থা করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দফায় দফায় পরামর্শ করেন। শেষতক দিনের আলো ফোটার আগে অভিযানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। রাত চারটার কিছু আগে ঘটনাস্থলের কাছে কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। অভিযানে যাওয়ার আগে পুলিশের পক্ষ থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। এমন অবস্থা চলার মধ্যে রাত আড়াইটার পর ওই রেস্টুরেন্টের দুই কর্মী সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তবে তারা কোথায় আটকা ছিলেন তা জানান যায়নি। আইএসের দায় স্বীকার: গুলশানে হামলায় দায় স্বীকার করেছে আইএস। কট্টরপন্থী গোষ্ঠীদের অনলাইন তৎপরতা নজরদারি করা মার্কিন সংগঠন সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ তাদের টুইটারে গতকাল রাত দেড়টায় আইএসের দায় স্বীকারের কথা জানায়। পরে সাইটের বরাত দিয়েছে বিবিসি জানায়, হামলায় ২০ জন বিদেশী নাগরিক হত্যার কথা স্বীকার করেছে আইএস। অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারেননি এসি রবিউল: অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারেননি পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর গুলশানে দুর্বৃত্তদের গুলিতে পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম নিহত হন। একই ঘটনায় নিহত হয়েছেন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন। বনানী থানায় যোগ দেয়ার আগে মিরপুর মডেল থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সালাহউদ্দিন। এসি রবিউলের মৃত্যুর খবর পেয়ে রাতেই গুলশানে ছুটে যান তার স্বজনরা। রবিউল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তরের মাদক প্রতিরোধ টিমে কর্মরত ছিলেন। তিনি পুলিশের বিসিএস ৩০ তম ব্যাচের সদস্য। সাত বছর বয়সী ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থাকতেন এসি রবিউল। গুলশানে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে গুণিবর্ষণের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সংবাদটি স্বজনদের জানানো হয়। রবিউলের স্বজনরা জানান, তারা পথেই জানতে পারেন রবিউল আর নেই। হাসপাতালের রবিউলের লাশ দেশে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী ও শিশু সন্তান। ‘তোমার সন্তান এখন কাকে বাবা ডাকবে। তুমি কেন এভাবে চলে গেলে..।’ বলে চিৎকার করে কান্না করছিলেন রবিউলের স্ত্রী। গুলশানে হামলার ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান এসি রবিউল। তার সহকর্মীরা জানান, ঘটনাস্থলে পৌঁছে রবিউল সাহসি ভূমিকা পালন করছিলেন। একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রবিউলের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের কাটিবাড়ি। র‌্যাবের অনুরোধে টিভির লাইভ সম্প্রচার বন্ধ: রাজধানীর ডিপ্লোমেটিক জোন গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানে আগত দেশি-বিদেশি নাগরিকেদের অস্ত্রের মুখে জিম্মির কিছুক্ষণ পর থেকে সেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে কয়েকটি টিভি চ্যানেল। র‌্যাবের মহাপচিালক বেনজির আহমেদ ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর রাত ১০ টার দিকে সরাসরি সম্প্রচার না করার জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে অনুরোধ জানান। এর কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থল থেকে লাইভ সম্প্রচার বন্ধ রাখে টিভি চ্যানেলগুলো। র‌্যাবের মহাপরিচালক টিভি চ্যানেলগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অনেকেই টিভি দেখছে। জাতীয় স্বার্থে কন্টিনিউয়াস লাইভ দেবেন না। আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তা প্রয়োজন। আপনাদের নিরাপত্তার জন্যও তা দরকার। এ বিষয়ে আপনাদের সহযোগিতা চাই। এরপর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলেও ঘটনাস্থল থেকে টেলিভিশনগুলো ধারাবাহিকভাবে সংবাদের আপডেট দিয়ে যাচ্ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *