তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে

“তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।” [তালগাছ]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ তালগাছ সবার চেনা। গ্রামের পথে কিংবা পুকুরের ধারে অথবা মাঠের কিনারে সেই ছোটবেলা থেকে চোখে পড়ে এই পরিচিত গাছটি। এক পায়ে ভর করে যেন মেঘ ছোঁয়া উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই গাছটি। এই তালগাছকে বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায় ‘চির উন্নত শির’ও বলা যায়।

আজকাল তালগাছ আগের মতো এতোটা অহরহ চোখে পড়ে না। চিরচেনা তালগাছ এখন যেন দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। দিগন্তজোড়া মাঠে তালগাছের সারিও আগের মতো নেই। অথচ এই গাছটি অত্যন্ত লাভজনক। পরিকল্পিতভাবে ক্ষেতের আইলে তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নিলে আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও সহায়ক হবে।

সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের (৩ কি. মি.) নলাম গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে- আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি তালগাছ, গাছে গাছে ধরে থাকা তাল, পাতার সঙ্গে লেপ্টে থাকা বাতাসে দোল খাওয়া বাবুই পাখির কারুকাজ করা বাসার সঙ্গে তাদের মিষ্টি মধুর কলতান।

শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে নয়, তালগাছ আমাদের অনেক উপকারে আসে। এ গাছের শক্ত কাঠ যেমন নানা কাজে লাগে তেমনি রয়েছে ঔষধি গুণও। তাল উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় গাছ, কারণ এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরি হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না। বাংলাদেশের সব স্থানে কমবেশি তালগাছ চোখে পড়ে। তবে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে ভালো তাল উৎপাদন হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতে তালগাছ জন্মে।

তাল ফল ও তালগাছের বহুবিধ ব্যবহার ও পুষ্টি গুণাগুণ বিবেচনায় দেশীয় ফলের মধ্যে তালের অবস্থান অনেক ওপরে। গুচ্ছমূলী বৃহৎ অশাখা বৃক্ষ তাল। গাছের গোড়ার দিক মোটা, উপরের অংশ তুলনামূলক চিকন, কাণ্ডের মাথায় বোঁটা ও পাতা গুচ্ছভাবে সাজানো থাকে ও বোঁটার দু’ধারে করাতের মতো দাঁত থাকে। কোটা শক্ত ও পুরু। গাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং ১৪০ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তুলনামূলকভাবে রোগ-বালাই কম।

তাল পুরুষ ও স্ত্রী উভয় লিঙ্গের গাছ। একই গাছে দু’রকম ফুল ফোটে না। পুরুষ গাছে ফুল হয়, ফল হয় না, ফুল জটা নামে পরিচিত। মঞ্জুরির রঙ হলুদ, লম্বা আকৃতির, বসন্তে গাছে ফুল ধরে। পুরুষ তাল গাছের রেণু বাতাসে ভেসে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে পরাগায়ণ ঘটাতে সক্ষম।

কষ্ট সহিষ্ণু তালগাছ রোপণ করা খুবই সহজ। একটু মাটি খুঁড়ে আঁটি পুঁতে রাখলেই গাছ জন্মে। পরিচর্যা না করলেও (ছোট থাকতে একটু দেখে রাখতে হয়) সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, রেল লাইন, পুকুর পাড়, খালের পাড়, নদীর পাড়, জমির আইল, পতিত জমি ও বসত বাড়ির শেষ সীমানায় তালগাছ রোপণ উপযোগী স্থান। তালের পাতা দিয়ে হাত পাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা, লাকড়ি তৈরি করা হয়। গাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন রকমের সৌখিন সামগ্রী তৈরি হয়। যেমন- টুপি, ঝুড়ি, ব্রাশ পাপোশ, ছোট বাস্কেট ও মাছ ধরার চাইয়ে। পুরুষ গাছের ফুল বা জটা হতে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, পিঠা, বড়া, লুচি, পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

কচি ও কাঁচা তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর। তাল কাঠের গোড়ার অংশ দিয়ে ডিঙি নৌকা তৈরি, ঘরের খুঁটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙলের ঈশ ইত্যাদি তৈরি করা হয়। গাছ শক্ত মজবুত গভীরমূলী বলে ঝড় তুফান, টর্নেডো, বাতাস প্রতিরোধ এবং মাটি ক্ষয় রোধে তালগাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে তালগাছের ঐতিহ্য অন্যতম। গল্প, ছড়া, কবিতা ও উপন্যাসের বহু জায়গা দখল করে আছে তালগাছ। ঐতিহ্যবাহী সেই তালগাছ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তালগাছ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই আস্তে আন্তে এর ব্যাপকতা দিনদিন কমতে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রক্ষার নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও গ্রাম-বাংলা ঐতিহ্যের বাহক নানা উপকারী এই তালগাছ রক্ষার কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ক্রমেই এটি বিলীন হতে চলেছে।

এক সময় জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত পল্লীর আনাচে কানাছে এবং সড়ক এবং মহাসড়কের পাশে সারি সারি তালগাছ শোভা পেতো। কিন্তু সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। এখন হয়তো কোনো গ্রামের ঝোপ ও জঙ্গলের পাশে দু-একটি তালগাছ চোখে পড়ে। যে দু-একটি চোখে পড়ে সে সব কারো লাগানো নয়, এমনিতেই এসব গাছ ঝোপ-জঙ্গলে বেড়ে উঠেছে।

কেউ তাল খেয়ে তালের আঁটি ফেলে রেখে গেছে সেই আঁটি থেকেই মূলত হয়ে উঠেছে এসব তাল গাছ। অতীতে অপরিচিত মানুষদের বাড়ির নিশানা ঠিক করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তালগাছের সাহায্য নেয়া হত। ওমুকের বাড়ী কোথায়, পুকুর কোথায়, মসজিদ কোথায়, স্কুল কোথায় এসব ক্ষেত্রেও বলা হত উঁচু ওই তালগাছটির পাশে।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুজন আহমেদ জানান, বজ্রপাতের কারণে দিন দিন এর সংখ্যা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তালগাছ ঘর-বাড়ি ও সাঁকো তৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। কৃষি ও অর্থনীতির দিক থেকে এই গাছ খুবই দরকারি।

এছাড়া তালগাছ সঙ্কটে দেশে বাবুই পাখির অস্তিত্ব এখন মহাসংকটে। তালগাছের অভাবে বাবুই পাখির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে দীর্ঘ দিন থেকে। ভবিষ্যতে এই পাখি বিলুপ্তি হতে পারে বলে পাখি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

গ্রামের সাধারণ মানুষ জানান, মানুষের কল্যাণে বহুমুখি কাজে লাগে তালগাছ। কিন্তু অযত্ন অবহেলায় ও গুরুত্বের অভাবে তালগাছ এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য এই গাছ বাঁচাতে ও টিকিয়ে রাখতে বন অধিদপ্তরের নানামুখি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এখন অবশিষ্ট থাকা তালগাছগুলো একশ্রেণির কাঠ ব্যবসায়ী কেটে উজাড় করে চলেছেন। যে হারে কাটা হচ্ছে তারচেয়ে অনেক কম পরিমাণে তালগাছ রোপন করা হচ্ছে বলে গ্রামের বাসিন্দারা জানান।

সাভার উপজেলার নলাম গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আবুল মুন্সী বাংলামেইলকে বলেন, ‘আগের দিনে মুরব্বিরা প্রচুর পরিমাণে তালগাছ রোপণ করতেন। এই গাছের জন্য কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অনাদরে বেড়ে উঠে এই গাছ। এখন আর আগের মতো কেউ তালগাছ রোপন করে না।’ কুড়িটি পূর্ণ বয়স্ক তালগাছের আয় থেকে একটি ছোট পরিবার সারা বছর চলতে পারে বলেও জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *