যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি শাক-সবজী, মাছ, মসলার প্রথম দোকান এটি। কোনোদিন যদি ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ইতিহাস লেখা হয় তাহলে সেখানে তাজ স্টোরসের নাম থাকতেই হবে। আগামী আগস্টে তাজ স্টোরস ৮০ বছর পূর্ণ করবে। বর্তমানে পারিবারিক এই ব্যবসাটি যিনি দেখাশোনা করছেন তিনি জামাল খালিক। তাজ স্টোরসের পত্তন তার বড় চাচার হাতে। ৮০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও এটি স্বমহিমায় টিকে আছে।
জামাল খালিকের বড় চাচা আব্দুল জব্বার কাজ করতেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে। তিরিশের দশকে যে জাহাজে তিনি কাজ করতেন সেটি ইংল্যান্ডের একটি বন্দরে নোঙর করার পর জাহাজ থেকে নেমে পড়েছিলেন তিনি। তারপর ঘুরতে ঘুরতে পূর্ব লন্ডনে আসেন। সে সময় পূর্ব লন্ডন থাকতো ইহুদি এবং আইরিশরা। অনেক চামড়া এবং পোশাকের কারখানা ছিলো। বছর দুয়েক ওইসব কারখানায় কাজ করেন আব্দুল জব্বার।
তাজ স্টোরসের প্রেরণা আইরিশ নারী
সেখানে কাজ করার সময় আব্দুল জব্বারের সঙ্গে পরিচয় হয় স্থানীয় আইরিশ তরুণী ক্যাথলিনের সাথে। প্রথম দেখায় প্রেম। শেষে নীলনয়না বিদেশিনীকেই জীবন সঙ্গিনী করেন বাংলাদেশি যুবক। ক্যাথলিন ভীষণ ভালোবাসতেন জামাল খালিকের চাচাকে। ১৯৩৬ সালে ওই নারী প্রেয় স্বামীকে ব্রিক লেনে ছোটো একটি মুদিদোকান খুলে দেন। এতদিন পরও সেই বিদেশিনীর অবদান স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না জামাল খালিক। তিনি বিবিসিকে বলেন,‘তাজ স্টোরসের পেছনে আমার সেই আন্টির অবদানই বেশি।’
দোকানটিতে প্রথমদিকে আলু, পেঁয়াজ সহ স্থানীয় আইরিশ ও ইহুদিরা ব্যবহার করে এমন কিছু পণ্য বিক্রি হতো। সত্তরের দশকে যখন বাংলাদেশিরা ব্রিক লেন এবং আশপাশের এলাকায় বসতি গড়তে থাকে, বাংলাদেশ থেকে শাকসবজি, মাছ, মসলা আনা শুরু করে তাজ স্টোরস। তবে এখন আরো বহু দেশের পণ্য বিক্রি হয় তাজ স্টোরসে। তাইতো তাজ স্টোরস এখন আন্তর্জাতিক একটি সুপার মার্কেট।
জামাল খালিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রিক লেনে । ৪৫ বছর ধরে সেখানেই আছেন। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন যে সুন্দর ঝকঝকে ব্রিক লেন দেখছেন, আমার ছেলেবেলায় তা ছিলো না। নোংরা, গন্ধ, অন্ধকার। এরওপর প্রতি রোববার ন্যাশনাল ফ্রন্টের (বর্ণবাদি দল) লোকজন এসে হামলা করতো। বোতল, পেট্রোল বোমা ছুড়তো।’
তারা থাকতেন তাজ স্টোরের ওপরেই। ওইসব হামলার সময় তারা ভয়ে অস্থির থাকতেন। যদি ওরা ওপরে উঠে আসে! সেজন্য তারা বোতল, লাঠি জড় করে রাখতেন।
তাজ স্টোরস বনাম শাহরুখ খান
তাজ স্টোরস থেকে ব্যবসা অনেক বাড়িয়েছেন জামাল খালিক ও তার ভাইয়েরা। কনস্ট্রাকশন কোম্পানি খুলেছেন। বাংলাদেশে এনআরবি ব্যাংক নামে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন অংশীদার তিনি। জামাল খালিকদের ব্যবসা বড় হওয়ার পিছনে নাকি বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের অবদান রয়েছে। এই তারকার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিশ বছরেরও পুরনো। এ সম্পর্কে জামাল খালিক বলেন,‘শাহরুখ যখন বড় তারকা হননি তখন লন্ডনে তার সঙ্গে পরিচয়। লন্ডনে এলেই তিনি আসতেন আমাদের দোকানে। এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’ ২০১০ সালে ঢাকায় কনসার্টে যাওয়ার সময় শাহরুখ খান তাকে সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
আজীবন টিকে থাকুক তাজ
জামাল খালিকদের পৈতৃক বাড়ি মৌলভিবাজার। ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে যেতেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার কোনো বন্ধু ছিলোনা। এখন অবশ্য ঢাকায় কিছু বন্ধু হয়েছে তার। এজন্যই তার বাংলাদেশে কিছু করার ইচ্ছা। উদ্দেশ্য দেশের সঙ্গে নিয়মিত একটা যোগাযোগ রাখা।
নির্মাণ কোম্পানি কিংবা ব্যাংকের মালিক হওয়ার পরও তাজ স্টোরসের জন্যই টানটা বেশি জামাল খালিকের। এজন্য লন্ডন থাকলে প্রতিদিনই তাকে দোকানে দেখা যায়। এ নিয়ে তার দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তি,‘ আজ আমি যা কিছু করেছি তার ভিত্তি কিন্তু তাজ স্টোরস। ছোটবেলায় স্কুল থেকে আসার পর বাবার সাথে দোকানে ঝাড়মোছা বা জিনিস সাজানোর কাজ করতাম। খুব ভালো লাগতো।’ এছাড়া কাস্টমারদের সঙ্গে প্রতিদিন মুখোমুখি দেখা ও কথা বলতেও খুব ভালো লাগত তার। এরকম নির্ভেজাল ভালোবাসার কারণেই আশি বছর ধরে টিকে আছে লন্ডনের এই বাংলাদেশি দোকানটি। জামাল খালিকের আশা, আরো অন্তত একশ বছর পূর্ণ করবে তাজ স্টোরস। আর আমরা চাই শুধু একশ নয়, হাজার বছর ধরে টিকে থাকুক ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি।
সৌজন্যে বিবিসি
Moin Ahmed liked this on Facebook.
Mehedi Hasan Chowdhury liked this on Facebook.