ভাতের মাড় খেয়ে বস্তির ছেলে চয়ন সেরাদের সেরা

ঢাকা : কলকাতার শিলিগুড়ির নেতাজী হাই স্কুলের ছাত্র চয়ন বিশ্বাস। বাবা থেকেও নেই, চয়নের চার বছর বয়সেই তাদের অথৈ সাগরে ফেলে তিনি চলে যান। মা পেশায় একজন গৃহ পরিচারিকা। অভাবের সংসার, যেদিন ঘরে চাল থাকতো সেদিন ছেলের জন্য ভাত রান্না হতো। আর না থাকলে প্রতিবেশীদের ভাতের মাড় খেয়ে স্কুলে যেতে হতো চয়নকে। এর মাঝেও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছেন তিনি।

চয়ন উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছেন ৪৬৭ নম্বর। তাও আবার কলা বিভাগে। ইংরেজিতে তার নম্বর ৯২। এছাড়া বাংলায় ৯০, দর্শনে ৯৯, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৯৪ এবং ইতিহাসে ৯২ নম্বর। অতিরিক্ত বিষয় ভূগোলে পেয়েছেন ৮৭ নম্বর। এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়তে চান তিনি।

মা রিনা বিশ্বাস নিরক্ষর, অতশত বোঝেন না। শুধু বোঝেন ছেলে মানুষ হোক। শিলিগুড়ির জেলখানা লাগোয়া জ্যোতিনগর কলোনির বাসিন্দা তারা। ওই বস্তির একটি ঘরেই মা-ছেলের বসবাস।

স্থানীয়রা জানান, চয়নের বয়স যখন চার বয়স তখন তার বাবা তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। মা গৃহ পরিচারিকা। সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে পড়েন তিনি। স্বল্প আয়ের সংসার। মাসের বেশ কয়েকটা দিন ফাঁকা থাকে তাদের চালের পাত্র। সকালে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ভাতের মাড় চেয়ে নিতেন তিনি। তাই খেয়েই স্কুলে যেতেন চয়ন। দুপুরে স্কুলের মিড ডে মিল। সেটাই ছিল তার সারাদিনের খাবার।

তবে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হওয়ায় খাতায়-কলমে স্কুলের মিড ডে মিল তার বরাদ্দ নয়। কিন্তু শিক্ষকদের কৃপায় দুপুরের খাবার জুটে যেত মেধাবী ছেলেটির। রাতে কোনো দিন খাবার জুটতো, কোনো কোনো দিন আবার না খেয়েও থাকতে হতো।

চয়ন জানান, তার এই ভালো ফলাফলের জন্য মা ও স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের অবদান অনেক বেশি। কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও আজ যেটুকু সাফল্য পেয়েছেন তা তাদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাই তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

মা রিনা বিশ্বাস জানান, গৃহ পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান তিনি। যেদিন ঘরে চাল থাকতো সেদিন ছেলেই ভাত রান্না করত। না থাকলে লোকের বাড়ি থেকে ভাতের মাড় চেয়ে এনে খেয়ে স্কুলে যেত। তারপরও এতো ভালো ফল করায় অনেক খুশি তিনি। তবে মাধ্যমিক পাস করার পর চয়ন নিজেও কলোনির ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে সামান্য কিছু আয় করেছেন।

ছেলে কলেজে কী নিয়ে পড়বে তা ঠিক করার দায়িত্ব স্কুলের শিক্ষকদের উপরই ছেড়েছেন নিরক্ষর মা। বললেন, ‘এতো বোঝার মতো বিদ্যা আমার নেই। এতোদিন শিক্ষকরাই সবকিছু করলেন। তাদের পরামর্শেই ছেলেকে চলতে বলেছি।’

স্কুলের শিক্ষক সৌমিক মিত্র বিনা পারিশ্রমিকেই পড়িয়েছেন চয়নকে। গর্বিত শিক্ষক বলছেন, ‘চয়ন যে লড়াইটা করেছে, তা ভাবা যায় না। আমাকে যদি ওই পরিস্থিতিতে লড়াই করতে বলা হতো, আমি হয়তো পারতাম না। একদিকে অর্থনৈতিক সমস্যা, তার উপর বস্তির ওই পরিবেশে পড়াশোনা করা এতো সহজ নয়। স্কুলের সব শিক্ষকরা ওর পাশে ছিলেন। ভবিষ্যতেও আমরা ওর পাশে থাকবো।’

প্রতিবেশী কুট্টি কুণ্ডু বলেন, ‘ছেলেটাকে আমরা ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। বহুবার খাতা-কলম কিনে দিয়েছি। বস্তিতে আরো অনেক ছেলেমেয়ে আছে। এবার ওকে দেখে অন্যরা হয়তো অনুপ্রাণিত হবে।’

৯ thoughts on “ভাতের মাড় খেয়ে বস্তির ছেলে চয়ন সেরাদের সেরা

Leave a Reply to Bulbul Chowdury Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.