ভাগ্য বদলের যুদ্ধে ভাগ্যই ওদের ভরসা

ঢাকা: যৌতুক দিতে না পারায় স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিন বছর আগে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে ওমানে গিয়েছিলেন কুমিল্লার জুমা খাতুন (২৬)। অল্প বেতনে অমানবিক পরিশ্রমের কাজ করতে না পেরে গতবছর দেশে ফিরে আসেন তিনি। ওমান যেতে যে টাকা জুমার ধার করা লেগেছিল, সুদে-আসলে তা ফুলে-ফেঁপে এখন বিশাল। আর এই বোঝা যেন বাবার ঘাড়ে না পড়ে তাই আবার সেই বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত জুমার।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কথা হয় জুমা খাতুনের সঙ্গে।

কেন বিদেশ যাওয়া সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবারও যাচ্ছি সম্পূর্ণ কপালের উপর ভর করে। দেখি আল্লায় ভাগ্যে কী রাখসে। তাছাড়া বাড়িতে সেই রকম কোনো কাজ নাই, যার দ্বারা আগের দেনা-পাওনা শোধ করতে পারমু। তাই এবারও যেতে হচ্ছে।’

সামনের কঠিন পথের কথা জেনেই জুমা ও তার মতো আরো অনেক নারী বিদেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজের জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত কেমন গৃহকর্তার হাতে পড়তে হবে, এ উত্তর তাদের নিজেদেরও জানা নেই।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে জুমা খাতুন আরো জানালেন, তার বিয়ে হয়েছিল চট্টগ্রামে। স্বামীকে যৌতুক দিতে না পারায় দুই সন্তানকে নিয়ে উঠতে হয়েছে মা-বাবার অভাবের সংসারে। বাবার সংসারের বোঝা হিসেবে না থাকার জন্য ছোট দুই সন্তান রেখে ২০১২ সালে প্রাইভেট এক এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিলেন ওমানে।

ওমানে গিয়ে কী কাজ করতে হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি গিয়েছিলাম ওমানের চরমট নামে এক প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায়। সেখানে এমন কোনো কাজ নেই করতে হতো না। কৃষি কাজ যেমন ভেড়া-ছাগল-দুম্বার জায়গা পরিষ্কারসহ সবই করতে হতো। সেই গৃহকর্তার আবার ১২টা সন্তান ছিল। তাদের পোষাক পরিষ্কার ও খাবার রান্নাসহ সবই করতে হতো আমাকে। বলতে পারেন ঘুম ছাড়া সব সময়ই কাজের মধ্যে থাকতে হতো।

বেতন কত পেতেন? প্রশ্ন করলে জুমার জবাব, সেই তুলনায় বেতন কিছুই দিতো না। প্রথমে যাওয়ার পর মাসে দিতো ৫০ রিয়াল বা ১০ হাজার টাকা। পরে বাড়াতে বললে, এক বছর পর দিত ৬০ রিয়াল বা ১২ হাজার টাকা। সর্বশেষ ১৪ হাজার পর্যন্তু পেয়েছিলাম। ওষুধ ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতেই যা শেষ হয়ে যেত। বাড়িতে আর কী পাঠাবো?

তাই ওমান যেতে যা ধার হয়েছিল, তা শোধ করা যায়নি বলেও জানালেন এই নারী।

জুমার পাশের আসনেই বসা ছিলেন সাথী নামে আরেক নারী। ভাগ্য বদলের আশায় কেবল ভাগ্যকেই সহায় করে তিনিও যাবেন বিদেশ। সাথীর বয়স ২৩, বাড়ি খুলনা। জুমার মতো তারও স্বামীর সঙ্গে থাকা হয়নি। সাথী এবারই প্রথম বিদেশ যাবেন। তাই জুমাদের মতো তিনিও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

সাথী শুনেছেন বিদেশে নারী নির্যাতনের নানা রোমহর্ষক কাহিনী। তবুও অভাবকে ছুটি দিতে যেতে হবে তাকে দূরদেশে।

এতো নির্যাতনের কথা শুনেও কেন যেতে চাচ্ছেন? উত্তরে সাথী বলেন, ভাগ্যে যা আছে, তা তো হবেই। যতই কষ্ট হোক কিছু টাকা পাঠাতে পারলেই আমাদের উপকারে আসবে। তাছাড়া আমার আরো একটা ছোট বোন আছে। তাকে কিছু দিনের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে। আমাদের ভাই নেই। বৃদ্ধ বাবা আর কত করবে আমাদের জন্য। তাই আমি চাই, আমার মতো যেন আমার ছোট বোনটির ভাগ্য খারাপ না হয়। এজন্যই ভিন দেশে যাওয়া।

সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়ার জন্য গাবতলীর প্রশিক্ষণ সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বরিশালের মেয়ে মিতু জাহান (২৫)। মিতুর প্রশ্ন, মেয়েরা কী আর ইচ্ছা করে নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে চায়?

জুমা-সাথীর জীবনের যে গল্প, মিতুর জীবনেও সেই একই গল্পের কালো ছায়া। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিয়ে, তারপর বিচ্ছেদ, তারপর বাবার বোঝা হওয়ার ভয়। আর সে কারণেই নিজের পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে বিদেশযাত্রার অপেক্ষা এখন মিতুর।

এই মিতুর সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয়া আরো ৫৫ জন নারীর গল্পও প্রায় একই।

শুক্রবারের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেইমে লাল বা সবুজ শাড়ি পড়ে আসা শত শত নারীর ভাষ্য ও চাহনী ছিল একই রকম। লিখলে যা দাঁড়ায়- সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি, জানি না কপালে কী আছে….

৪ thoughts on “ভাগ্য বদলের যুদ্ধে ভাগ্যই ওদের ভরসা

Leave a Reply to ফেমাস আয়ুর্বেদিক ঔষধালয় Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.