ঘুরে আসুন সৌন্দর্যে ঘেরা সেন্টমার্টিন

ঢাকা: বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে দক্ষিণে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করলে মায়ানমারের উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় এটি অবস্থিত। আয়তন ১৭ বর্গ কিলোমিটার। টেকনাফ থেকে ট্রলারে লঞ্চে কিংবা জাহাজে যেতে লাগে দুই থেকে সোয়া দুই ঘণ্টা। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে এই দ্বীপকে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়। এর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ধান এই দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। আর অধিবাসীদের প্রায় সবারই পেশা মৎস্য শিকার। তবে ইদানীং পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে অনেকেই রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল কিংবা গ্রোসারি শপের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে।

কবে প্রথম এই দ্বীপটি মানুষ শনাক্ত করেছিল তা জানা যায়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে কিছু আরব বণিক প্রথম এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। উল্লেখ্য এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় দ্বীপটি বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। সেই থেকে চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের মানুষ দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামে চিনতো। ১৮৯০ সালের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। তারা ছিল মূলত মৎস্যজীবী। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩ টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। তারপর দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়।

দ্বীপ আবিষ্কারের শুরু থেকেই কেয়া এবং ঝাউবন ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলের কষ্ঠ এবং ক্লান্তি দূর করতে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ লাগায়। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় ‘নারিকেল গাছপ্রধান’ দ্বীপে পরিণত হয়। সেই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। ১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরিপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম দেন। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে।

প্রকৃতির সৌন্দর্য বিচারে সেন্টমার্টিনকে রূপের ধারক বলা যায়। পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি। সে পানিতে কোথাও নীলাভ, কোথাও হালকা সবুজ আভা। যতদূর চোখ যায়, পানির নিচের সবকিছুই স্পষ্ট। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। কখনো বা বিভিন্ন রঙের ডোরাকাটা রঙিন মাছ দেখা যাচ্ছে, কখনো সবুজ কোরালের ডানা মেলে ঢিলেঢালা চলন, ব্রেইল কোরাল উঁকি দিচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। ভাগ্য ভালো থাকলে বাংলা চ্যানেলের আশপাশে ডলফিন কিংবা জেলি ফিশের দেখাও মিলে যেতে পারে। নভেম্বর থেকে মার্চ, এই সেন্ট মার্টিনেই কচ্ছপের ডিম পাড়া দেখা যায়। দ্বীপের মূল অংশেই ছোট ছোট কচ্ছপের খুদে পায়ে সাগরের দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখতে পাবেন। তবে এ সময় ধৈর্য ধরে চুপ হয়ে থাকতে হবে। সময়টা হলো খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যায়। হাতে সময় থাকলে শীতের শুরুর এই সময়টাতে ঘুরে আসতে পারেন সৌন্দর্যে ঘেরা সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে। ভ্রমণবিলাসী যে কেউ বা নবদম্পত্তিদের জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এক কথায় অসাধারণ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার আর দ্রুত হাতে ক্লিকে যারা সদা ব্যস্ত থাকতে চান তারাও পেয়ে যাবেন নজর জুড়ানো চিত্র।

স্কুবা ডাইভিং ও স্নোরকেলিং দুটোই করা যাবে এখানে। পানির গভীরে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে তবেই স্কুবা ডাইভিং করা যাবে। এ জন্য সাঁতার জানতেই হবে। অন্য দিকে স্নোরকেলিং এর জন্য অতটা প্রস্তুতির দরকার নেই। লাইফ জ্যাকেট এবং চোখ ও নাক ঢাকার মাস্ক হলেই চলবে। পানির খুব একটা গভীরেও যেতে হবে না। হেঁটেই পানির নিচে সব কিছু দেখতে পারবেন। সাঁতার না জানলেও চলে। তবে স্নোরকেলিং এর জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো ছেঁড়াদ্বীপ। এর জন্য সেন্ট মার্টিন থেকে ট্রলারে করে যেতে হবে ছেঁড়াদ্বীপে।

যেভাবে যাবেন

বর্তমানে দ্বীপটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশের যে কোনো স্থান থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য আপনাকে প্রথমে যেতে হবে কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে প্রথমে জিপে চড়ে টেকনাফ, টেকনাফ থেকে সি-ট্রাক, জাহাজ কিংবা ট্রলারে চড়ে পৌঁছাবেন সেন্টমার্টিনে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যায় দূরপাল্লার বেশ কিছু গাড়ি। বাসে ভাড়া লাগবে এসি ৬৫০ থেকে৭০০ এবং নন-এসি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। কক্সবাজার তো গেলেন তারপর বাসে ২৫ থেকে ৩০ টাকা, ট্যাক্সিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা অথবা রিজার্ভ মাইক্রোবাসে সেন্টমার্টিন যেতে ভাড়া লাগবে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা (৮ থেকে ১০ সিট)। প্রতিদিন সকাল থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে চলাচল করে এসব গাড়ি। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন সকাল থেকে আসা-যাওয়া করে সি-ট্রাক, কেয়ারি সিন্দাবাদ এবং নাফসি হাজাজ। চমৎকার এসব জাহাজের পাশাপাশি ট্রলার ও চলাচল করে এই সমুদ্র রুটে। পছন্দসই বাহনে যেতে পারেন। তবে নিরাপদ জলযান হিসেবে কেয়ারি সিন্দাবাদ ও নাফসি জাহাজই নির্ভরযোগ্য। এসব জাহাজে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। অন্যদিকে প্রতিদিনই বিকাল ৩টায় এসব সাহাজ সেন্টমার্টিন ছেড়ে আসে। শীত মৌসুমে সমুদ্র শান্ত থাকে এবং গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল থাকে, তখন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ।

কোথায় খাবেন

যারা স্বল্প সময় বা সন্ধ্যার আগে সেন্টমার্টিন থেকে বিদায় নিতে চান তারা অবশ্যই ৩টার আগে ফিরতি জাহাজে আরোহণ করবেন। ছোট এই দ্বীপ এলাকা ঘুরে দেখতে ৩ ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট। তবে প্রধান দ্বীপ ও ছেড়া দ্বীপে যারা যেতে চান তাদের হাতে বেশ খানিকটা সময় থাকা দরকার। পর্যটকদের খাবারের জন্য রয়েছে এখানে বেশ কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁ। তারমধ্যে কেয়ারি মারজান রেস্তোরাঁ, বিচ পয়েন্ট, হোটেল আল্লার দান, বাজার বিচ অন্যতম। এছাড়া আসাম হোটেল, সি বিচ, সেন্টমার্টিন, কুমিল্লা রেস্টুরেন্ট, রিয়েল রেস্তোরাঁ, হাজী সেলিম পার্ক, সেন্টমার্টিন টুরিস্ট পার্ক, হোটেল সাদেক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

থাকবেন কোথায়

সেন্টমার্টিনে থাকার জন্য বেশ উন্নতমানের কয়েকটি হোটেল ও কটেজ রয়েছে। ১৬টি হোটেলসহ বেশ ক’টি কটেজে প্রতিরাতে কমপক্ষে ৫০০ জন পর্যটক থাকতে পারেন। অনেক বাড়িতেও আছে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা। ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, শীত মৌসুমে চাপ বেশি থাকায় ইচ্ছামতো ভাড়া নেয় মালিকরা। তবে কয়েকটি হোটেল-মোটেলের নাম ও ঠিকানা জেনে রাখতে পারেন-

সীমানা পেরিয়ে

দশ রুম বিশিষ্ট হোটেলে প্রতি রুমে ৪ জন থাকার ব্যবস্থা আছে। রুম প্রতি ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, তাঁবুতে ৪ জন করে ৩০০ টাকা। খাবার খরচ জনপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা।

প্রিন্স হেভেন

রুম সংখ্যা ১৮টি, ডাবল রুমের ভাড়া ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। একসঙ্গে ৪ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। সিঙ্গেল রুমে থাকার ব্যবস্থা দু’জনের ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। যোগাযোগ : ০১৮৯৩০৮০৫৮। ব্ল–মেরিন রিসোর্ট-৩৪টি অতিথি রুমসহ ১৮টি ডাবল বেডরুম। ট্রিপল রেডরুম ১৩, ছয়জনের বেডরুম ৫টি এবং কটেজ ২টি। ভাড়া ডাবল ১০০০ টাকা, ট্রিপল ১২০০ টাকা, ৬ বেড ১৫০০ টাকা, ৫ বেডের কটেজ ২৫০০ টাকা।

সমুদ্র বিলাস (লেখক হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি)

৪ রুমের এই বাড়িতে প্রতি রুমের ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।

এছাড়াও আছে বিচ ক্যাম্প, হোটেল সাগর পাড়, রিয়াদ গেস্ট হাউজ, হোটেল স্বপ্ন প্রবাল, শ্রাবণ বিলাস, সরকারি ব্যবস্থাপনায় মেরিন পার্ক। পর্যটন মৌসুমে প্রায় প্রতি বাড়িতে আবাসিক সুবিধা পাওয়া যায়। সরাসরি এসব বাড়িতে গিয়ে আলাপ করে থাকা যায়।

৩ thoughts on “ঘুরে আসুন সৌন্দর্যে ঘেরা সেন্টমার্টিন

Leave a Reply to MadZy Anik MoLlick Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.