প্রবাস জীবন বড়ই জটিল আগে জানলে প্রবাসী হতাম না

প্রান বন্ধুর লাগিয়া আমার অঙ্গ জ্বলে যায়
অকূলে ভাসিয়ে আমায় ঘাটে এসে নাও ভিড়ায়।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ একটি বিস্ময়কর জীবনের অধিকারী হতে চায়। মানুষ যা ভালোবাসে, যা আশা করে, তা পেতে চায়। কিন্তু সব সময় কি তা পাওয়া হয়ে উঠে ? মানুষের চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে বিস্তর ব্যবধান। এ ব্যবধান কিছু শ্রষ্টা প্রদত্ত আবার কিছু মনূষ্যসৃষ্ট। একজন মানুষ এক জীবনে অনেক কিছুই আশা করে তা কি সব সময় সে পায় ? যদি সে তার প্রাপ্য মর্যাদা, প্রাপ্য সন্মান, প্রাপ্য অংশীদার যোগ্যতা থাকা সত্বেও না পায় তবে না পাওয়ার হতাশা থেকে সৃষ্টি হয় অভিমান, অভিমান ঘনিভূত হয়ে রূপ নেয় প্রতিহিংসায় আর প্রতিহিংসা থেকে জন্ম নেয় প্রতিশোধের। এই প্রতিশোধ নেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একজন সাধারন মানুষ ধ্বংসাত্মক কাজ করতে বাধ্য হয়।না পাওয়ার ব্যর্থতা আর হতাশা থেকেই মানুষ অনেক সময় আপনজনকে ভুলে থাকতে বাধ্য হয়। নিকটজনকেও দূরে সরিয়ে দেয়।দেশে থাকতে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা উপলদ্ধি করতে পারতাম না।এখন প্রতি মূহুর্তে অনুভব করি পরিবারকে কাছে না পাবার সীমাহীন যন্ত্রনা। এ যন্ত্রনার কথা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। এটা একান্তই নিজের।

প্রত্যক মানুষই তার আপন পরিবার, পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সুখের কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকতে চায়। এ চাওয়া কি অন্যয় ? প্রত্যেকেই সুখের জীবন গড়তে অজস্র ধন-সম্পদের অধিকারী হতে চায়। কিন্তু সবাই কি সফল হয় ? সফল হতে না পারলে তখন জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ ও যন্ত্রণাময়।তাই মাঝে মাঝে ভালবাসাকে অহেতুক মনে হয়। এ পৃথিবীতে কোনো জিনিস ভালবাসলে ভালবাসাতেই যে তার চরম ও পরম সার্থকতা, এটা বোধহয় কোন প্রবাসী ছাড়া বুঝতে পারে না। প্রবাসী হয়ে সম্পদের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু ভালবাসা, স্নেহ, মমতা হ্রাস পেয়েছে এটা সকল প্রবাসীই স্বীকার করবে।একজন প্রবাসীর মনের অবস্থা, তার একাকিত্ত্ব, তার আবেগ, তার কষ্ট, তার উদাসীনতা, তার নিরব কান্না কেউ বুঝতে পারে না। এটা সত্য যে এই অনুভূতি গুলো অনুভব করাও কারো পক্ষে সম্ভব না। প্রবাসী জীবনে প্রবাসীরাই এই গুলো বেশি অনুভব করেন।প্রবাস জীবনে কেউ দুঃখ পায় না, কারন দুঃখ পেতে আপনজন প্রয়োজন হয়। আপনজন ব্যতীত অন্য কেউ দুঃখ দিতে পারে না। প্রবাস জীবন এমনই যে এই জীবনে দুঃখ পাওয়া যায় না। তবে প্রবাস জীবনের সঙ্গী হয় কষ্ট এবং এমন ভাবে লেগে থাকে যে পিছুই ছাড়তে চাই না। দুঃখ এবং কষ্টের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান তা প্রবাসীদের মতো অন্য কেউ অনুভব করতে পারে না। প্রবাসে প্রবাসীরা যা অর্জন করেন সেটা অর্থ কিংবা শিক্ষা যাই হোক না কেন সেটা তার অতুলনীয় কষ্টের ফসল ছাড়া কিছুই না। প্রবাস মানে জীবনের সাথে যুদ্ধ, শুধু অজানাকে জানার আর অচেনাকে চেনা নয়, জীবিকা ও জীবনের তাগিদে, সোনালী স্বপ্নের হাতছানিতে মানুষ প্রবাসী হয়। হাজার কষ্ট মেনে নিয়েও দেশে প্রিয়জনের মুখে হাঁসি ফোটাতে চায়।

প্রবাসের ব্যস্ত সময় বয়ে যাচ্ছে সময়ের নিয়মে শ্যামল সবুজ বাংলার বহতা নদীর মত। সময়ের সাথে জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, শুধু যার গেছে সেই জানে কিভাবে গেছে। আমি অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করি আমার আমিত্বকে, আমার জীবনে যাকে না পেলে পুরো জীবনটা অসমাপ্ত রয়ে যেত যাকে উপলব্ধি করি আজো নিদ্রাহীন রাতে, একাকী নিঃঝুম দুপুরে, বিষন্ন সন্ধ্যায়। উপলব্ধি করি একসাথে থাকার দীর্ঘ দিবস রজনী, এখনও অনুভব করি পাশে না থাকার অশেষ যন্ত্রণা। এখনও মাঝ রাতে হঠাৎ নিজেকেও খুব একা মনে হয়, কেউ যেন কোথাও নেই। অপ্রতিরোধ্য এক চিন্তা বাতিকগ্রস্থের মত মগজে ধাক্কা দিতে থাকে-কখন কি হারিয়ে যায় আমার , দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অনেককে হারিয়েছি। জানিনা আবার কাকে হারাব ? একটা সুপ্ত আশঙ্কার আবেগ নতুনমাত্রায় তোলপাড় করে আমাকে। প্রবাস জীবনের সত্যিটা বড় কঠিন, বড়ই নির্মম। জীবনের নিয়মেই জীবন চলে, একে থামিয়ে দেয়ার শক্তিতো কারো হাতেই নেই। তারপরও শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজেকে বের করতে হয় বেঁচে থাকার নতুন কৌশল, বের করতে হয় একাকী থাকার তীব্র ভারী পাথরটাকে বুক থেকে আস্তে আস্তে টেনে নামানোর করুণ প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টায় কেউ সঙ্গী থাকেনা, কেউ দেখিয়ে দিতে পারেনা আপন জন বিহীন জীবনটা চলার সহজ সরল পথ। শোকের দগদগে লাল রং ক্ষতে নিজেকেই বুলাতে হয় ফ্যাকাশে আচড়। সবকিছুই ঘটতে থাকে বেচে থাকার অমোঘ শর্তে। সময়ের ব্যবধানে জীবনের দায়বদ্ধতার খাতিরে আপনজন থেকে দূরে থাকলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে নেই দেশের উজ্জল, ভাস্বর অসংখ্য সব স্মৃতি। কিছুদিন ধরে আমার আদরের সন্তান সায়েম এবং ঠিক মত ফোনে কথা বলছে না। ফোন রিসিভ করে তার আম্মু দিয়ে বলে আব্বার ফোন। তাদের সবা্র আব্বা বাড়ীতে আমার আব্বা কেন বাড়ীতে নেই। এটা যে একজন প্রবাসী পিতার জন্য কতটা কষ্ট আর বেদনার সেটা কিভাবে বুঝাব ?

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়…
রইল না, রইল না
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি……

আমার প্রবাস জীবনে যে ব্যপারটি বুঝেছি তা হচ্ছে বন্ধুর উপস্থিতির চাইতে তার অনুপস্থিতি বেশি উপলব্ধি করা যায়।বন্ধু হচ্ছে ছায়াদানকারী বৃক্ষের মতো। বৃক্ষ যেমন কর্মক্লান্ত পথিককে তার শীতল ছায়া দিয়ে পথিকের ক্লান্তি দুর করে তেমনি বন্ধুও তার ভালবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে বন্ধুকে আগলে রাখে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় আর আনন্দ বেদনায়।’বন্ধুত্ব’ শব্দটিই এমন, যার কোনো নির্দিষ্ট অর্থ হয় না, একক কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। বন্ধু বন্ধুই।এর কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর সব স্বার্থের উর্ধ্বে বন্ধুর স্থান। যাকে বিশ্বাস করে সবকিছু বলা যায়, বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সবসময় ছায়ার মতো পাশে পাওয়া যায়_ সেই তো প্রকৃত বন্ধু। জীবনে এমন বন্ধুর বড় বেশি প্রয়োজন।এখন নির্জন প্রবাসে বড় বেশী অনুভব করি বন্ধুর শূন্যতা।প্রবাস জীবনে যাদের পেয়েছি তাদের অবদান হয়তো কখনো পরিশোধ করতে পারব না। আমার প্রতিটি কর্মে যার সরব উপস্থিতি প্রতিনিয়ত আমাকে অনুপ্রেরনা দেয়, যে আমার জীবনের প্রতিটি রক্তকনিকায় প্রবাহমান, যার ঋন আমার শরীরের রক্ত দিয়ে হলেও শোধরাতে পারব না সেই বন্ধু গোলাম মোস্তফা খবির।আর একজন আবদুস সাত্তার যার কাছে এখনও ঋনী।

আজ প্রবাসে একাকী নির্জন রাতের আকাশে হাজার তারার ভিড়ে আজও হারিয়ে বন্ধুদের শূন্যতা অনুভব করি।প্রকৃত বন্ধুদের শূন্যতা প্রতি মূহুর্তে আহত করে প্রবাসী মন।ভরা সন্ধ্যায় উতলা হাওয়ায় মন ছুটে যায় বন্ধুদের খোজে। তখন আমার এলোমেলো ভাবনাগুলো ক্লান্ত হয়ে মিশে যেতে চায় হারানো অতীতে।সময়ের পরিবর্তনে মনও বদলে যায়, বদলে যায় ধ্যান-ধারণা। জাগতিক পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা বুঝে যাওয়ার পর এখন আর নতুন করে বন্ধু খুজি না।তারপরও বন্ধুত্বের জন্যে মনটি হাহাকার করে।কারন জীবনকে সার্থক করতে একটি ভাল বন্ধুর বড় বেশী প্রয়োজন। বন্ধুত্বের আসল পরীক্ষা হল যে বন্ধুত্বের কোন বাহ্যিক প্রদর্শন ছাড়া একসাথে থাকতে পারা – কারণ জীবনের ছোটখাট বিষয়ও তাদের সাথে উপভোগ করা যায়। কিছু বন্ধু আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই গভীরভাবে দাগ কাটে তাদের সাথে কথা বলতে একসাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি সেটাই বন্ধুত্ব।প্রবাস জীবনে এই সুখ নেই। দেশে অনেকদিন থেকে যাদের জীবনের পরবর্তী সময় প্রবাসে কাটে, তাদের সেখানে অনেক চেনামুখ জোটে, বন্ধু জোটে না। বন্ধুদের জন্যেই ফিরে আসতে হয় স্বদেশ।

প্রবাস জীবনের আলো আধাঁরীর বিষন্ন ছায়া আর চাপধরা এক কঠিন নীরবতা হাহাকার হয়ে মাঝে মাঝে আমাকে গ্রাস করে। অসহনীয় এক শুন্য একাকীত্ব মাঝ রাতেও আমাকে জাগিয়ে রাখে।কমপিউটারের মনিটরে বেজে চলা গানটা যেন বাস্তবতায় ধরা দেয় নিজের জীবনের ফ্রেমে……..

গভীর নিশিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়
কে যেন আমারে ডাকে, সে কি তুমি ?
কার স্মৃতি বুকে পাষানের মত ভার হয়ে থাকে;
সে কি তুমি ?

১৪ thoughts on “প্রবাস জীবন বড়ই জটিল আগে জানলে প্রবাসী হতাম না

Leave a Reply to Tuhin Bmb Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.