‘ঐশীকে নয়, সমাজকে ঝোলানো হোক ফাঁসিতে’

ঢাকা: কফিতে চেতনানাশক মিশিয়ে, ছুরিকাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে মা-বাবাকে হত্যার অভিযোগে ঐশী রহমানকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। অনেকেই বলছেন, ঐশীর এ কাণ্ডের জন্য শুধু ঐশী একাই দায়ী নন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা এমনকি তার মা-বাবাও এর দায় এড়াতে পারেন না। তারা বলছেন, সমাজকেই ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত।

কবি সুমী সিকানদার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘বাবা-মা হত্যায় ঐশীর ফাঁসির রায় হয়েছে। রায় হয়তো যথাযথই হয়েছে, কিন্তু মনটা খারাপ লাগছে। ঐশী কি একদিনেই এতটা ডেসপারেট হয়েছে? আরো কিছুটা সময় তার পাওনা ছিল মা বাবার কাছ থেকে, যা সময়মতো পেলে সে হয়তো এতটা অ্যাগ্রেসিভ হবার সুযোগ পেত না।’

সুমীর স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেন বিনু মেহবুবা। তিনি লেখেন, ‘সময়ের চেয়ে বেশি দায়ী সমাজে মাদকের অগাধ অবাধ চলাফেরা। এদের গতি রোধ না করা। আমার আপনার অনেক সময় দেয়া সন্তানও ঢুকে যেতে পারে এদের খপ্পরে। তেজগাঁও রেল লাইনের পাড় ধরে একদিন দেখে এসেছিলাম কী অবাধে গাঁজা বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। এদের লাগাম ধরবার কেউ নেই আবার কেউ কেউ ক্ষমতাবান ও অভিজাত এলাকায় প্রকাশ্যে শীষা নামক দ্রব্যের কথা বহুদিন লেখা হচ্ছে কিন্তু বন্ধ হচ্ছে কি? কেন হয় না?’

যে কোনো হত্যা গর্হিত কাজ হলেও এর জন্য সে একা দায়ী থাকে না। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, শিক্ষা শুরু হয় পরিবারের মাধ্যমে। একজন মানুষ হঠাৎ করেই খুনি হয়ে উঠতে পারে না। এর পেছনের কার্যকারণ, ভূমিকা বিশ্লেষণ করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন অনেকে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, তার বাবা এত রাজকীয় জীবন চালাতেন কোন পন্থায়? এত টাকা তিনি কোথায় পেতেন?

তটিনী আচার্য লিখেছেন, ‘ঐশীর ফাঁসি হলো। আইন আইনের গতিতে রায় দিল। এ সবকিছুর জন্য কি ওর পরিবার একেবারেই দায়ী ছিল না? একজন মানুষ কি হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে যায়? নষ্ট হওয়াতে কি আর কারো ভূমিকা থাকে না? ঐশী যা করেছে তা খুবই অন্যায় ছিল, ক্ষমা করার মতো না। আচ্ছা আমাদের অবিভাবকের কি কোনো দোষ থাকে না? অবিভাকদের অবচেতনে কত সন্তান বখে যাচ্ছে! কত সন্তান আকাম-কুকাম করছে পথেঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অভিভাবক আপনি শুধু পয়সার পেছনে ছুটলেন! আর একটু বেশি মমতায় আগলে নিন না বুকে।’

পৃথু স্যান্যাল লিখেছেন, ‘ঐশীকে নয়, গোটা সমাজটাকেই ফাঁসিতে ঝোলানো হোক।’

তরুণ চলচ্চিত্রকার শ্যামল শিশির লেখেন, ‘ঐশী কি খুনি হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল? ঐশীর খুনি হয়ে ওঠার জন্য দায়ী কে?’

ঐশীর ফাঁসিতে অনেকেই ব্যথিত হয়েছেন। ঐশীর স্থলে নিজ মেয়ের মুখ কল্পনা করে আতঁকে উঠছেন অনেকেই। ফারহানা আনন্দময়ী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ঐশীর ফাঁসি আমাকে ব্যথিত করেছে। ওর মুখে আমার মেয়েটার মুখ কল্পনা করে কষ্ট লাগছে। সময় থাকতেই পরিবার এবং সমাজের দায়িত্ব ছিল ঐশীকে সময় দেয়া।’

ঐশীর বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। যদিও মেডিকেল পরীক্ষায় তার বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বলা হয়েছে। তবু এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। হজরত বিনয় ভদ্র ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘বৃদ্ধ হিসেবে গু আযমকে ( গোলাম আযম) ফাঁসি দেয় না আদালত কিন্তু অল্পবয়সী ঐশীকে ঠিকই ফাঁসি দিলু’।

একই প্রসঙ্গের ইঙ্গিত করে নীলাঞ্জনা অদিতি লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে রাজাকারদের বয়স বিবেচনা হয়, ঐশীদের না!’

কবি সরদার ফারুক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘সন্তানের হাতে খুন হয়েছে মা-বাবা, আর তাদেরকে হত্যার দায়ে ফাঁসি হবে সন্তানের। হায় পরিবার! হায় মানবসমাজ! এ জন্যেই বোধহয় বাউল-সাধকেরা বিন্দু ধারণের সাধনা করেন।’

তবে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইছেন না কেউ। অ্যাডভোকেট রাজেশ পাল লিখেছেন, ‘পিতামাতা হত্যা মামলায় পুলিশ দম্পতির কন্যা ঐশীর মৃত্যুদণ্ড। এই ধরনের সন্তান যেন এই পৃথিবীর মানুষকে আর দেখতে না হয়। আর সেই সাথে এই প্রত্যাশাও করি, সন্তান কোন পথে যাচ্ছে, পিতামাতারাও যেন সেই বিষয়টি খেয়াল রাখেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ঐশীদের তৈরির দায়ভার এড়াতে পারেন না।’

জ্ঞানেন্দ্র চন্দ লিখেছেন, ‘ঐশীর ফাঁসি নিয়ে কিছু বলা মানে আদালতের সমালোচনা করা। আর আদালতের সমালোচনা মানে আইনকে অবজ্ঞা করা। তাই কিছু বলা মানে বিচারককে বিব্রত করা। কোনো কিছু না বললেও রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না কারণ রাষ্ট্রে ও সমাজের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বসবাসরত মানুষের আচরণের মধ্যদিয়ে।’

প্রসঙ্গত, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের একমাত্র মেয়ে ঐশী রহমানের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন।

২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগে নিজের বাসা থেকে এই পুলিশ দম্পতির ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর পরদিন ঐশী গৃহকর্মী সুমীকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন।

৩০ thoughts on “‘ঐশীকে নয়, সমাজকে ঝোলানো হোক ফাঁসিতে’

Leave a Reply to Yousuf Mozumder Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.