হবিগঞ্জ : ছাত্রী লাঞ্ছিতের ঘটনায় হবিগঞ্জসহ আলোড়ন সৃষ্টি হয় দেশব্যাপী। ওই ছাত্রের প্রতি ঘৃণাভরে ধিক্কার জানায় দেশবাসী। এমন ঘটনা সত্যিই লজ্জার। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটালো রুহুল আমিন রাহুল? এর নেপথ্যে বেরিয়ে এসেছে চমকপদ তথ্য। যেভাবে অপরাধী হয়ে উঠে নম্র রাহুল হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের ৯ম শ্রেণীর বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র রুহুল আমিন রাহুল। রাহুল নামটি তার নিজের দেয়া। বাবা-মা’র রাখা নাম রুহুল আমিন। লেখাপড়া শুরু রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় প্রাইমারি স্কুলে। বাবা ফজল মিয়ার রয়েছে মুদি মালের ব্যবসা। সেই সুবাদেই সেখানে থাকা রাহুলের। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত মধ্যবাড্ডা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া তার। পরে তার বাবা তাকে পাঠিয়ে দেন হবিগঞ্জে। এরপর হবিগঞ্জের উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি করা হয় রাহুলকে। বসবাস শহরের রাজনগরে মামা মোবারক হোসেনের বাসায়। পাশের বাসার শাহজাহান মিয়ার শিশুকন্যা অর্ণা সে সময় ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন অর্ণার সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়া রাহুলের। এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন, শিশু বয়সেই প্রেম নিবেদন চলে রাহুল ও অর্ণার। রাহুল ভর্তি হয় হবিগঞ্জ উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে, আর এক বছর পর হবিগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। দুই স্কুলের দূরত্ব একটি রাস্তা আর একটি ছোট পুকুর। যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না তাদের। মোবাইল বা ফেসবুকের মাধ্যমেও যোগাযোগ। এরই মধ্যে বিষয়টি দুই পরিবারের মধ্যে জানাজানি হয়। এ ঘটনায় ৮ম শ্রেণীতে উঠার পর রাহুলকে ফের ঢাকায় নিয়ে যান তার বাবা। কিন্তু ঢাকায় মন বসে না রাহুলের। পরিবারের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, সে আর অর্ণার সাথে যোগাযোগ রাখবে না। তবুও সে হবিগঞ্জেই পড়তে চায়। বাধ্য হয়ে রাহুলকে হবিগঞ্জে পাঠান তার বাবা। আবারো ভর্তি হয় একই স্কুলের ৯ম শ্রেণীতে। বাণিজ্য বিভাগই বেছে নেয় সে। শনিবার দুপুর ১টার দিকে কোর্ট হাজত খানায় রাহুল গণমাধ্যমকে জানায়, দ্বিতীয়বার হবিগঞ্জে আসার পর অর্ণার সাথে সে কোনো যোগাযোগ করেনি। অর্ণাই তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো। একপর্যায়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেয় রাহুল। সে জানায়, একাধারে ২০ দিন সে স্কুলে যাওয়া হয়নি। শ্রেণীশিক্ষক বদরুল আলম খন্দকার খবর দিয়ে রাহুলকে স্কুলে নিয়মিত ক্লাস করতে বলেন। স্যারের নির্দেশে আবারো স্কুলে যাওয়া শুরু করে রাহুল। সে জানায়, ঘটনার কয়েকদিন আগে অর্ণা একটি কালো ব্যাগে করে কাপড়-চোপড় সাথে নিয়ে তার কাছে চলে আসে। বিয়ে করার চাপ দেয়। বয়স না হওয়ায় এখনই সম্ভব নয় জানালে তীব্র অভিমান করে অর্ণা। রাহুলের কাছ থেকে ফিরে গিয়ে অর্ণা হৃদয় নামের এক কিশোরের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে। হৃদয়ের বাড়ি শহরের উমেদনগরে। বিভিন্ন কারণে অর্ণার সাবেক প্রেমিক রাহুলের প্রতি হৃদয় ক্ষুব্ধ হয়। অর্ণাই হৃদয়কে তার প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলে, দাবি রাহুলের। একদিন হৃদয় তার বন্ধুদের নিয়ে রাহুলকে স্কুলে যাওয়ার পথে অর্ণার স্কুলের সামনেই মারধর করে। ঘটনাস্থলেই পাশেই ছিল অর্ণা। অর্ণা তার বান্ধবীদের নিয়ে রাহুলকে নির্যাতনের কাহিনী প্রত্যক্ষ করে, হাসিঠাট্টা করে। এতে চরমভাবে লজ্জিত হয় রাহুল। প্রতিশোধ নেয়ার শপথটা তখন থেকেই। সুযোগ খুঁজতে থাকে রাহুল। সেই সুযোগটি আসে ২৬ আগস্ট বিকেলে। এবার বান্ধবীদের সামনেই অর্ণাকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে রাহুল। দৃশ্যটি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে তার বন্ধ নোমান ও শাকিল। নোমান ও শাকিল ভিডিওচিত্রটি তাদের নিজেদের ফেসবুকে আপলোড করে ১ সেপ্টেম্বর। বিষয়টি জেনে সাথে সাথে তা ডিলিট করে দেয় রাহুল। কিন্তু এরই মধ্যে নোমান ও শাকিলের ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কেউ কেউ দৃশ্যটি শেয়ার করে। ফেসবুক হোল্ডার শিশু হওয়ায় তাদের ফ্রেন্ড সংখ্যাও ছিল কম। এতে তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে ৪৮ ঘণ্টা। ৩ সেপ্টেম্বর সেই দৃশ্যটি চলে আসে সাংবাদিকদের কাছে। ১ ঘণ্টার ব্যবধানে দৃশ্যটিতে শেয়ার করে ৩ হাজারেরও বেশি ফেসবুক হোল্ডার, যার ভিউয়ার ছিল তখন ৪৮ হাজার। এরপর সেটি চলে যায় টিভি মিডিয়ায় ও ইউটিউবে। স্কুলছাত্রীকে প্রকাশ্যে চড়-থাপ্পড় মারার দৃশ্যটি ডিজিটাল দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ৪ ভাইয়ের মধ্যে রাহুল ৩য়। বড় ভাই তারেক থাই অ্যালুমোনিয়ামের দোকানে কাজ করে, ২য় ভাই কাউছার বেকার, ৩য় রাহুল, ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। রাহুলের গ্রামের বাড়ি বড়ইউড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক বদরুল আলম গণমাধ্যমকে জানান, রাহুলের বাবা ফজল মিয়া দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে আসেন না। তিনি কোথায় থাকেন তাও গ্রামের অধিকাংশ মানুষ জানে না। কয়েক বছর পর পর তারা বাড়িতে আসেন। বাড়িতে বসতবাড়িঘরও নেই বললেই চলে। রাহুলের স্কুলের ৯ম শ্রেণীর ক্লাস টিচার বদরুল আলম খন্দকার জানান, রাহুল অত্যন্ত ভদ্র নম্র ছেলেদের একজন। সে ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আমাদের স্কুলে পড়েছে। ৮ম শ্রেণীর পর সে ঢাকায় চলে যায়। পরে ঢাকা থেকে আবার একই স্কুলে এসে ভর্তি হয়। তার আচার আচরণ ছিল মার্জিত। কেন এতোটা দুঃসাহসী হয়ে উঠলো বুঝতে পারছি না। তিনি জানান, যেহেতু ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য সে দায়ী, স্কুল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তই নেবে। নির্যাতিতা কিশোরী অর্ণা ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে। এরপর থেকে মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলেনি অর্ণা ও তার পরিবারের কেউ। শনিবার দুপুর ১টার রদিকে রাহুলকে নিয়ে হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিয়িাল ম্যাজিষ্ট্রেট নিশাত সুলতানার কোর্টে আসেন ওসি নাজিম উদ্দিন ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক। সাথে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন। শিশু-কিশোর অপরাধ দমন আইনে জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। আইনি জটিলতায় কেটে যায় আরো কয়েক ঘণ্টা। দুপুর ৩টার দিকে রাহুলকে নিয়ে যাওয়া হয় কিশোর অপরাধ দমন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত জজ হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মাফরোজা পারভিনের আদালতে। এ বিষয়ে এক আইনজীবী জানান, ছাত্রটি যেহেতু শিশু, তাই শিশু-কিশোর অপরাধ দমন আদালত ছাড়া অন্য কোনো আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। হবিগঞ্জ সদর থানার ওসি নাজিম উদ্দিন জানান, আইন অনুযায়ীই সবকিছু হবে। ঘটনার সাথে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। স্থানীয়রা জানান, কিশোরী দোষ করলেও প্রকাশ্যে এভাবে নির্যাতন হবিগঞ্জে কখনো হয়নি। রাহুল আটকের পর তার বাবা ফজল মিয়া ঢাকা থেকে আসেননি। খোঁজ-খবর নেননি তার মা-ও। তার ভাইয়েরাও আসেনি থানায় বা কোর্টে। খোঁজ-খবর রাখছে রাহুলের মামার বাড়ির লোকজনই। প্রসঙ্গত, রাহুলের মামী মার্জিয়া বেগমকে আটক করার পরই তার স্বজনরা রাহুলকে পুলিশে সোপর্দ করে। এর আগে অন্তত ১৫ ঘণ্টা আত্মগোপন করে থাকতে সক্ষম হয় রাহুল। পুলিশও তাকে গ্রেফতার করতে রাতভর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। গতকাল শুক্রবার দুপুরে সদর মডেল থানায় ওই ছাত্রীর বাবা শাহজাহান মিয়া বাদী হয়ে রাহুলের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন। রাহুলের বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার বড়ইউড়ি গ্রামে। সে শহরের রাজনগরে মামা মোবারক হোসেনের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতো।
Related Posts
অবরোধের মধ্যেই এসএসসি পরীক্ষা হবে
- Ayesha Meher
- জানুয়ারি ২৮, ২০১৫
- 1 min read
২০ দলের অবরোধ প্রত্যাহার না হলে নির্ধারিত সময়েই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে বলে…
নতুন বছরে নতুন সংকল্প
- Ayesha Meher
- ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
- 1 min read
অনেক প্রতিকূলতা পেড়িয়ে শেষ করতে যাচ্ছি আর একটি বছর। প্রবাসনিউজ২৪ কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। এই…
গ্যাস – মাটির নীচে থাকলে মহামূল্যবান আর পেটের ভেতর থাকলে চরম বিরক্তিকর
- Ayesha Meher
- অক্টোবর ১৭, ২০১৮
- 1 min read
https://bookkeepingnexus.com/Fraud_Anwar_Parvez/FraudBangladesh.html ইন্টেস্টিনাল বা অন্ত্রের গ্যাস অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন এবং মিথেন দিয়ে গঠিত হয়।…
১২ thoughts on “লাঞ্ছিত ছাত্রী, যেভাবে অপরাধী হয়ে উঠে নম্র রাহুল”
Leave a Reply to Gmk Mizan Khan Cancel reply
This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.
Mohammed Kamal Hussain liked this on Facebook.
Neel Akasher Tara liked this on Facebook.
Rezina Akhter liked this on Facebook.
S M Rumman Azfar liked this on Facebook.
Shaiful Islam Jcd liked this on Facebook.
Mehedi Hasan Chowdhury liked this on Facebook.
Sabbir Ahamed liked this on Facebook.
Shihab Dipu liked this on Facebook.
Gmk Mizan Khan liked this on Facebook.
Feardaous Hasan Roney liked this on Facebook.
MadZy Anik MoLlick liked this on Facebook.
Redqanul Hoque liked this on Facebook.