কে প্রথম ধরবে হাল ?

গতকাল ফেসবুকে কিছু ছবি দেখলাম – বিদেশীরা ঢাকার রাস্তা পরিস্কার করছে। চারিপাশে বাংলাদেশীরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । কেউ লজ্বিত না। সবাই বেশ উপভোগ করছে। মনে মনে ভাবছে — তোমরা পরিস্কার করতে থাকো আমরা ময়লা করতে থাকবো। দেখি কে হারে!! কে জেতে!!

আমার শৈশব, কৈশর, তারুন্যের কিছুটা সময় কেটেছে বস্তীবাসীদের পাশাপাশি বসবাস করে। শৈশবে আমি বস্তির ছেলেমেয়েদের সাথেই খেলা করে বড় হয়েছি। একবার আমাদের এলাকাতে মুভির সুটিং হচ্ছিল সেখানে নায়ক আর নায়িকা কারা ছিলেন নাম মনে নেই। আমরা বস্তিবাসী পোলাপাইনেরা সবাই গেছিলাম দল বেঁধে। সেই নায়িকা হাতকাটা ব্লাউজ পড়া, বেশ মোটাসোটা, কানের উপরে বিশাল একটি অপরাজিতা ফুল লাগিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যাচ্ছিল তখন আমরা বস্তির ছেলেমেয়েরা হাফপান্টস আর ফ্রক পরে, কেউ কেউ খালি গা এবং সবারই খালি পা – আমরা সবাই সেই নায়িকার পিছে পিছে হাটছিলাম। আমি জীবনে সেই প্রথম অপরাজিতা ফুল দেখেছিলাম। আমি নায়িকাকে তেমন খেয়াল করিনি। ফুলের দিকে হা করে তাকিয়েছিলাম। সম্ভবতঃ ফুলের নীল রং আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। নীল রঙ্গের সাথে আমার সম্পর্ক গভীর। আমি আকাশ ভালবাসি আর নীল রং। ঘরে ফিরে সোজা রান্নাঘরে যেয়ে মাকে পুরা ঘটনা বললাম তারপর জিজ্ঞাসা করলাম – মা, জানো, নায়িকার কানের কাছে একটা নীল ফুল। মা বললেন ও তো অপরাজিতা। ব্যাস সেই থেকে চিনে গেলাম অপরাজিতা। আমার মা সেখানে ছিলেন না উনি কেমন করে জানলেন যে সেটা অপরাজিতা ফুল সেটা আমি জানিনা। পরে যখন আমি আরো অনুসন্ধান করলাম তখন মনে মনে ভেবেছি আমার মা ছিলেন একজন বিশ্বজ্ঞানকোষ আমার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় । যাক আমার মা আর অপরাজিতা ফুলের প্রসঙ্গে পরে লিখব। এখন আসি বস্তির ছেলেমেয়েদের প্রসঙ্গে। যারা স্কুলে যায়না। সাড়া দিন হয় মানুষের বাসায় টুকটাক কাজ করে, বাবামাকে কাজে সাহায্য করে নয়তো সারাদিন খেলা করে বা পথে নতুন কিছু দেখলে কৌতূহলী হয়ে পিছে পিছে ছোটে।

বিদেশীরা ঢাকার রাস্তা পরিস্কার করছে সেই দৃশ্যে ফেসবুকে দেখে, আশে পাশে বস্তীর ছেলেমেয়েদের দেখে, মনে পড়ে গেল শৈশবের কথা। এই ছবির নীচে অনেক মানুষে অনেক মন্তব্য করেছে। সব মন্তব্যগুলোকে এক করে আমি যদি এক কথায় প্রকাশ করি তাহলে সেটা এমন হবেঃ

“দেখো বিদেশিরা রাস্তা পরিস্কার করছে আর আমরা তা চেয়ে চেয়ে দেখছি”

এই “চেয়ে চেয়ে দেখা” ছাড়া আমরা কি বা করতে পারি?

বস্তীর ছেলেমেয়েদের বিনোদন বলে কিছু নেই। ওদের স্কুল নেই। ওদের জীবনে কিছুই নেই। রাস্তায় ঘটতে থাকা নতুন নতুন ঘটনা থেকেই ওরা পৃথিবীকে জানে, চেনে, বুঝতে শেখে, রাস্তা ও রাস্তার মানুষ হলো বস্তির ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়। রাস্তায় ফেলা গার্বেজ থেকেই ওরা নানা রকমের সুস্বাদু খাবারের সাথে পরিচিত হয়। বিভিন্ন বাসাতে কাজ করে ওরা বিভিন্ন চরিত্রের মানুষের সাথে পরিচিত হয়। বিভিন্ন মানুষের দুর্ব্যবহার থেকেই ওরা নির্মমতার সাথে পরিচিত হয়। বিভিন্ন মানুষের নির্যাতন থেকেই ওরা জানতে পারে সমাজের মানুষ মানুষের মধ্য শ্রেণীবিন্যা্সের কথা। নায্য মজুরী থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা বুঝতে পারে শোষন কাকে বলে। জানতে পারে ন্যায় অন্যায়, অনুভব করে ব্যাথা, বেদনা, তারপর সব কিছু হাসিমুখে সহ্য করে অবিরত বেঁচে থাকে।

এছাড়া আর কি করার আছে ওদের?

সমাজে যারা সুপ্রতিষ্টিত তাদের চাহিদার সীমা পরিসীমা নেই। ওদের আকাশ ছু’তে হবে তাই ওরা বহুতল ভবন তৈরি করেছে। কিন্তু আকাশ তো অনেক দূরে তাই ওরা ছুটতে থাকে। সমাজের অবস্থাপন্ন মানুষের সময় কোথায় আর কারু কথা ভাবার ? সময় কোথায় রাস্তা পরিস্কার করার ? উঁচু উঁচু ভবন থেকে ওরা যদি গার্বেজ ছুঁড়ে পথের উপরে ঢিবি না করে তাহলে অনেক মানুষ অনাহারে মরে যাবে। যেমন মরে গেছিল ১৯৭৪ সালে।সবাই এক বাটি ফ্যানের জন্য ধুক পুক করবে তারপর হাড্ডিসার মরে পড়ে থাকবে কাতারে কাতারে। বাংলাদেশের সমাজের যারা অবস্থাপন্ন তাদের অনেক কাজ। এইসব কিছু ভাববার তাদের সময় নেই তাই বিদেশীরা রাস্তা পরিস্কার করে আর বস্তীর ছেলেমেয়েরা চেয়ে দ্যাখে আর ফেসবুকের মহজনেরা নানান রকমের মন্তব্য করে। ব্যাস গল্প শেষ।

ফেসবুকে আরো দেখা যায় আওয়ামীলীগের পাবলিকে সরকারকে তোষন করছে আর বিরোধীদলে সরকারকে গালি দিচ্ছে। এটা চলতেই থাকে। যে যখন বিরোধি দলে থাকে সে তখন ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যায় আর যে যখন সরকারে থাকে সব দোষই তার হয়ে যায়। রাস্তা পরিস্কারের দায়িত্ব মিউনিসিপ্যালিটির। বিদেশীদের নয়। বস্তির ছেলেমেয়েদের নয়। রাস্তা পরিস্কার রাখার দায়িত্ব সমাজের সবার। সরকারের একার নয়। সরকার যদি ময়লা পরিস্কারের জন্য কোন পদক্ষেপ না নেয় তাহলে সমাজের অবস্থাপন্ন মানুষের কি আর করার আছে??

কিছুই করার নেই। বস্তির ছেলেমেয়েদের মত অবস্থাপন্ন লোকেরাও এই ব্যাপারে অসহায়।

রাস্তা দিয়ে সবাই হেটে যায়। গাড়ী হাকিয়ে চলে যায়। কিন্তু রাস্তা পরিস্কারের দায়িত্ব কেউ পালন করেনা। যার যার বাড়ীর সামনের রাস্তা যদি সে সে পরিস্কার করে তাহলে সাড়া দেশই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে । ভারতের পন্য না কিনে যদি দেশের চাহিদা অনুযায়ী পন্য উৎপাদন করার জন্য দেশেই কলকারখানা তৈরি হয় তাহলে কাজ সৃষ্টি হবে এবং বস্তির ছেলেমেয়েদের বাবামায়েরা কাজ করতে পারবে এবং বস্তীর ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে পারবে । তখন ওদের বাবামায়ের কাজ থাকবে, উপার্জন থেকে খাদ্য কিনে খেতে পারবে তখন আর রাস্তায় জমা গার্বেজ থেকে খাবার খেতে হবেনা। চুরি করে টাকা কামায় সেই টাকা দিয়ে দরকারের অতিরিক্ত খাবার কিনে তা অপচয় করে উঁচু দালান থেকে গার্বেজ ফেলে নীচে না ফেলে চুরি করা টাকা থেকে কিছু টাকা খরচা করে গার্বেজ ফেলার জাগা করলেই হয়। অপচয় বন্ধ করলে হয় । অনেক কিছুই রিসাইকেল করা যায় এবং তা পুনঃরায় ব্যবহার করা যায় রিমোডেলিং করে উতপদানের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে।

এই দায়িত্ব সমাজের সবার। সরকারের একার নয়। সরকার বদল হবেনা।

চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকেন। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই আপনাদের।
রাস্তায় চেয়ে চেয়ে দ্যাখেন মানুষেরা সব গার্বেজ খাচ্ছে।
রাস্তায় চেয়ে চেয়ে দ্যাখেন বিদেশিরা আপনাদের ফেলা গার্বেজ পরিস্কার করছে।
ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করে সবাই মিলে নানা রকমের মন্তব্য করে বাহবার লেনদেন করেন।
এছাড়া আর কি করতে পারেন ??

কিছু ইসলামিক ট্যাগ লাগান। জাহান্নামের আগুনের ছবি আকেন ফটোসপে। জাহান্নামের আগুনের স্যাম্পল পাওয়া যাচ্ছে ফটোসপে। জাহান্নামে যাওয়ার দরকার কি ? বাংলাদেশ তো একটা জাহান্নাম। এই জাহান্নামের অভিজ্ঞতা থাকলে আর জাহান্নামের ছবি লাগবে কেনো??

বাংলাদেশের অলস ও অবিবেচক মানুষেরাই দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়েছেন। এছাড়া আর কি করতে পারেন?

কিছুই করার নাই। কিছু লোক বসে আছে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ওদের এক ঝুড়ি “গনতন্ত্র” দিবে সেই আশায়। রোজার মাসে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের রাস্ট্রদূতেরা সবাই ইফতারী করতে করতে হয়্ররান । ইফতারী সন্ধ্যা আর সেহরী মাঝারাতে কেটে গেলো ত্রিশ দিন — ঝুড়ি থেকে “গনতন্ত্র” বাহির হইলনা।

কিছু করার নাই। কিছুলোকে বসে আছে বাংলাদেশ সিংগাপুর হবে সেই আশায়।

বাংলাদেশ সিংগাপুর হবে। বিদেশিরা ময়লা সাফ করে বাংলাদেশকে সিংগাপুরের মত তৈরি করে দেবে আপনেরা সবাই মজা করে বসবাস করবেন সেজন্য। ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে অপেক্ষা করেন। বিরতির পরে আসছে ক্রসফায়ার। বাংলাদেশের “একমাত্র পুরুষ” বলেছেন – ক্রসফায়ার বৈধ। খালেবিলে এখন মাছের বদলে লাশ পাওয়া যাবে। মাছ রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে হচ্ছে পদ্মা সেতু তৈরির জন্য। মাছের বদলে লাশ উঠান। কি আর করার আছে?

আর কিছু করার নাই। – সবই বাংলাদেশের “একমাত্র পুরুষের” দোষ [বাকীরা অন্যকিছু]। এই “পুরুষ” বদল না হইলে আর কিছু করার নাই। আকাশ থেকে টপ করে ফেরেস্তা এসে রাতারাতি বাংলাদেশকে সিংগাপুর বানিয়ে দিবে, বিদ্যুতের তার কেটে দিয়ে পয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতরে বাংলাদেশ হয়ে যাবে সিংগাপুর আর ভোরবেলা চোখ খুলে দেখবেন সারা বাংলাদেশ সিংগাপুর হয়ে গেছে। আর কিছু করার নাই।




৪ thoughts on “কে প্রথম ধরবে হাল ?

Leave a Reply to Yeasin Nazrul Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.