ধারা ৫৭ – বহিছে বাংলাদেশে

রেসপেক্ট শব্দটির ইংরেজী বর্ণমালাতে উচ্চারণ হয় respect… এর সজ্ঞা হইলঃ a feeling of deep admiration for someone or something elicited by their abilities, qualities, or achievements. শ্রদ্ধাবোধ একজনের জন্য বা কোন কিছুর জন্য গভীর প্রশংসার অনুভূতি আর এই অনুভূতি অনুভত হয় সেই ব্যক্তি বা জিনিষের ক্ষমতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও অর্জনের জন্য। তাইলে দেখা যাচ্ছে শ্রদ্ধা একটি অর্জন করার বিষয়। আমার কাজের জন্য, আমার অবদানের জন্য, আমার গুনের জন্য, আমার ভেতরে আল্লাহর দেওয়া যে ট্যালেন্ট আছে তার ব্যবহারে আমি অন্যদের জন্য এমন কিছু অবদান রেখে যাচ্ছি যাতে আরো ট্যালেন্ট বিকোশিত হতে পারে আর আল্লাহ্ সৃষ্টি সমৃদ্ধ হতে পারে, পৃথিবী সুন্দর হতে পারে আর এই কারণেই অন্যরা আমাকে প্রসংশা করে সেটাই শ্রদ্ধা বা রেসপেক্ট।

অনেকেই লিখতে দেখি সন্মান না করলে আপনি সন্মান পাবেন না। সন্মান বা শ্রদ্ধা শব্দটা বৃটিশ আমলে বা তার আগে হিন্দু রাজাদের আমলে কিভাবে অনুভূত হতো? রাজা – এই শব্দটি কি একটি শ্রদ্ধার শব্দ? সন্মানের শব্দ? রাজা কে? রাজা শব্দ শুনলেই কি মনে হয়না একজন ডাকাতের কথা ? একজন লুটেরার কথা ? অতীতে রাজারা প্রথমে মানুষের জমিজমা লুট করতো তারপর নিজেকে রাজা ঘোষনা করতো তারপর প্রজারা নিজেদের জমিজমা হারিয়ে লুটেরাকে রাজা বলতে বাধ্য হতো সাথে খাজনাও দিতো। রাজারা কিছু গোপাল ভাঁড় রাখতো যারা ছিল রাজাদের দালাল বা রাজা ও প্রজার মাঝে এক সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করতো – এক কমিউনিকেশন ব্রিজ – এই ব্রিজের মাধ্যমে রাজার নির্দেশে প্রজাদের মগজ ধোলায়ের জন্য নানা রকমের নিয়ম কানুন বানিয়ে এক দিকে রাজার কাছে দালালী করতো আর প্রজাদের কাছেও বন্ধু সেজে মনোরঞ্জন করতো আর প্রজাদের মগজ ধোলাই, অবশ, ও ঘুম পাড়ানী মলম লাগিয়ে রাখতো।

প্রজারা রাজাকে ডাকতো হুজুর। রাজারা ধর্ম আবিস্কার করলো তাতে নানা রকমের জাত পাত পৃথক করে দিলো – লুটেরা যে তার নাম রাজা, রাজার গু যে পরিস্কার করবে তার নাম মেথর। মেথরের সাথে রাজার মেয়ের বিয়া হতে পারবেনা। মেথর গু পরিস্কার করার পরে রাজ্যের সব চাইতে দূরে নিজেকে সমাজ থেকে পৃথক রাখবে কারণ সে রাজার গু পরিস্কার করে। গু হইল খাবারের সেই অংশ যা শরীরের জন্য দরকার হয়না। এইভাবে মানুষের ভেতরে শ্রেণীবিন্যাস করা হইল। রাজার পরে আসিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী । ইংরেজ বাহাদুর। লাট সাহেব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – ভারতের ভাগ্যবিধাতা। এরা এসে আমলা প্রথার সৃষ্টি করলো । আমলারা সব “স্যার” বা হুজুর বা সন্মানী ব্যক্তি। অনেককেই বলতে শোনা যায় – জানো, হেতির বাপে বৃটিশ আমলে সেক্রেটারি আছিল। হেতি অনেক সন্মানী। বৃটিশ আমলে আমলা হবার জন্য ইংরেজী জানা লাগতো (হয়তোবা আমার সঠিক জানা নেই) তখন তো চারিদিকে মিশনারী স্কুল খোলা হয়েছিল । ভারতের সর্বত্র অনেক ইংরেজী স্কুল আছে ভারতের পাবলিক ভাল ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। ইংরেজীতে কথা বলতে পারলেই কি তাকে সন্মান করতে হবে ? একজন চাষী বা একজন মেথর যিনি চাষ করে ফসল ফলাচ্ছেন যা আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি এবং জীবন ধারণ করছি সেই চাষীর শ্রম কি ফেলনা ? আমাদের পেটে যে খাদ্য যাচ্ছে আমাদের সেই খাদ্য বাঁচিয়ে রাখছে সেই খাদ্য যিনি ফলাচ্ছেন তাকে আমরা সন্মান করিনা। আমরা সন্মান করি তাকে যে আমাদের খাদ্য ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গুদামে ভরে রাখছে আর আমরা যখন না খেয়ে মরছি তখন আমাদের কাছ থেকেই ছিনিয়ে নেওয়া সেই খাদ্য আমাদের কাছেই বেশী দামে বিক্রি করে মুনাফা করছে আর আমরা তাঁকে “হুজুর” বা “স্যার” ডাকছি।

একজন মেথর যিনি গু পরিস্কার করেন আমাদের শরীর থেকে বের হওয়া অপ্রয়োজণীয় খাদ্য। গু পরিস্কার করা একটা মহান কাজ কিন্তু মেথর এই মহান কাজ করে কোন সন্মান পায়না। যে সাড়া শহরের গু ঘাড়ে করে নিয়া শহরকে পরিস্কার রাখে সেই ব্যক্তিকে আমরা সব চাইতে অপরিচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসাবে সমাজের এক কোনে নির্বাসিত করে রাখি। এইভাবে শ্রমের বিভাগ ও মূল্যায়ন করা হয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে শ্রমের সাথে সন্মানের কোন সম্পর্ক নেই। যোগ্যতা, দক্ষতা, অবদানের সাথে সন্মানের কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা “সন্মান” করি তাকে যে আমাদের “অসন্মান” করে। আমরা “সন্মান” করি একজন “অসন্মানী”কে নিজেদের “অসন্মান” করে।

বাংলাদেশে এখন একটি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে । এই ধারার নাম ধারা ৫৭। শেখ মুজিবের পরিবার সম্পর্কে কেউ বাজে কথা বললে এই ধারাতে তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং জেল ও জরিমানা হতে পারে বা হবে। এই ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে আমি গুগুল করলাম জানার জন্য যে এই শেখ মুজিব কে? জানলাম – শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক নেতা। ইংরেজ বাহাদুর যখন পাক ভারত উপমহাদেশ থেকে তাদের তপ্লিতপ্লা গুটিয়ে চলে যান যাবার সময়ে তাদের আদোরের বারিস্টারদের হাতে এই উপমহাদেশ শাসনের দায়িত্ব দিয়ে যান। তারপর পাকিস্তান দুইভাগে ভাগ হয় নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন দাবী করেন। অর্থাত পূর্ব পাকিস্তানের একটি আলাদা সরকার থাকবে যা নাকি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব মিলিশিয়া বাহিনী থাকবে যা নাকি প্রতিবেশী ভারতের আক্রমণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব কারেন্সি থাকবে। শেখ মুজিব হবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।

01-280শেখ মুজিব সম্পর্কে আরো জানতে পারলাম যে উনি ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অধীনে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু এক বিশাল জলোচ্ছাসে ভোলাতে ৫০০,০০০ মানুষ নিখোঁজ হয় বা মারা যায় ফলে এই নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়। এই নির্বাচন অনুষ্টিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী। সেসময়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাথে আরো যেসব রাজনৈতিক দল ছিল তার ভেতরে সব চাইতে জনপ্রিয় ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। এই ন্যাপ সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অস্বীকার করে। ন্যাপের নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যিনি নাকি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্টাতা পরে দল থেকে বের হয়ে যেয়ে ন্যাপ প্রতিষ্টিত করেন তিনি এই নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে অস্বীকার জানালে শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ট ভোটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দিতে না চাইবার ফলে এক বিশাল জনসভাতে ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব তার ভাষনে বলে – ইয়াহিয়া খান আমার কথা রাখলেন না।

তারপর ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান এবং ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে যখন পূর্ব বাংলাতে নয় মাস গনহত্যা শেষে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের হাত ধরে পাকিস্তানে ফিরে যায়।

এইভাবেই আমি জানি শেখ মুজিবকে। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাস্ট্রপ্রধান থাকাকালীন অবস্থায় শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয় । শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা একটি ভিডিও ক্লিপে সাক্ষাতকারে বলেন যে শেখ মুজিবেরই দলের অন্যান্য লোকেরা খন্দকার মুস্তাক আহমেদের সাহায্যে উনার বাবাকে হত্যা করে। এইভাবেই শেখ মুজিবের আমল শেষ হয় এখন চলছে শেখ হাসিনার আমল।

শেখ হাসিনার আমল সম্পর্কে পড়া করে দেখলাম বলা হচ্ছে যে শেখ মুজিব নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। এদিকে মিনা ফারিয়ার একটা লেখা পড়লাম তাতে উনি লিখেছেন বাংলাদেশে নাকি স্বাধীনতা আসেনি।

শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার কাহিনী পড়ার সময়ে আমি বিভিন্ন জাগাতে “গনতন্ত্র” শব্দটাতে যেয়ে থেমে গেছি। গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা – এই চারটি স্তম্ভের উপরে আওয়ামীলীগ প্রতিষ্টিত।

তখন আমি এইসব শব্দের সংজ্ঞাগুলোকে ভাল করে পড়ে দেখলাম আর ভাবলাম যদি শেখ মুজিব বাংলাদেশে স্বাধীনতা এনে থাকে তাহলে ধারা ৫৭ লাগবে কেনো? তাহলে মিনা ফারিয়ার লেখার নীচে এত গালিগালাজ কেনো ? স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করবে। শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনাকে “সন্মান” করানোর জন্য আইন, আদালত, জেল, জুলুম, পুলিশ, র‍্যাবের কি দরকার??

ধারা ৫৭ দিয়ে গ্রেফতার করে, রিমান্ডে নিয়ে, নির্যাতন করে সবাইকে ভয় দেখিয়ে “সন্মান” আদায় করতে হবে?

রেসপেক্ট “অর্জন” করার জিনিষ। শ্রদ্ধা “অর্জন” করতে হবে মানুষের সেবা করে। “স্বাধীনতার” অর্থ কিন্তু হাতকড়া নয়। “স্বাধীনতার” অর্থ কিন্তু গ্রেফতার নয়। ঘরে ঘরে ঢুকে গ্রেফতার ও গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা তো হিটলার করেছে জার্মানীতে, ইন্দিরা গান্ধী করেছে পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে, শেখ হাসিনা করছে বাংলাদেশে। ইন্দিরা গান্ধিকে যিনি হত্যা করেন তিনিও একজন সিক ইন্দিরাগান্ধীর দেহরক্ষী ছিলেন। নক্সাল পার্টির কেউ ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করেনি। শেখ মুজিবের বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তানেই আদালতে ফাঁসি দেওয়া হয় দেশদ্রোহীতার জন্য।

সন্মান “অর্জন” করার জিনিষ। বন্দুকের নলের মুখে সন্মান “অর্জন” করা যায়না। বাংলাদেশের মানুষ যদি শেখ হাসিনাকে ভালবাসে, বাংলাদেশের মানুষ যদি শেখ মুজিব পরিবারকে ভালবাসে তাহলে সেই ভালবাসা আসতে হবে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর থেকে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যদি পুলিশ ঢুকে মানুষকে গুলি করে আর গ্রেফতার করে তাহলে সবাই যার যার জান বাঁচানোর জন্য শেখ হাসিনাকে ভালবাসবে বা ভালবাসার অভিনয় করবে । সেটাই কি ধারা ৫৭ এর উদ্দেশ্য ?

স্বাধীনতা শব্দের সাথে ধারা ৫৭ বেমানান।
যদি ধারা ৫৭ থাকে তাহলে মিনা ফারিয়ার লেখাই সত্য।

আর যদি স্বাধীনতা থাকে তাহলে ধারা ৫৭ এর প্রয়োজন নেই।

ভালবাসা অন্তর থেকে আসে।
বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ক্ষমতা পাকিস্তান থেকে হস্তান্তরিত করে ভারতের হাতে সপে দেওয়া যায় – স্বাধীনতার গালভরা গল্প বলে নিরীহ মানুষকে জেলে ভর্তি করে রাখা যায় কিন্তু কেউ তো ঘাস খায়না
ভয়ে ভয়ে সবাই চুপ
কেউ মুখ হা করলেই ঢুকে যাচ্ছে ধারা ৫৭
এই যদি স্বাধিনতা হয় তাহলে আমার মনে হয় ধারা ৫৭ এর মতই স্বাধিনার একটি নতুন সংজ্ঞা লেখা উচিৎ যা বাংলাদেশসহ সাড়া বিশ্বে প্রয়োগ করা হবে।



One thought on “ধারা ৫৭ – বহিছে বাংলাদেশে

Leave a Reply to Moin Ahmed Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.