প্রবাসের গল্প ৬

আমি একজন অসামাজিক মানুষ। ঢাকাতে বা কানাডাতে আমার পরিচিত জগত খুব সীমিত। আমি কারুকে চিনিনা। কেউ আমাকে চেনেনা। বিভিন্ন কর্পোরেশনে কাজ করে এবং বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বা প্রফেশনাল ইন্সটিটিউশনে পড়ার সময় বহু মানুষের সাথে পরিচিত হই। এইভাবেই আমি মানুষকে জেনেছি। কানাডার একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি যখন ব্যাচেলর ডিগ্রী নিতে যাই তখন একজন মহিলার সাথে আমার খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় হয়। উনার নাম মোক্তার মাই। মোক্তার মাই ইংরাজী বা উর্দু বলতে পারেন না। তিনি পাঞ্জাবী ভাষাতে কথা বলেন।

আমি যে বছর গ্রাজুয়েশন করি সেবছর উনাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনারারী ডিগ্রী দেওয়া হয়। উনার হাতে এই ডিগ্রী তুলে দেবার আগে উনি মঞ্চে এসে উনার বক্তব্য রাখেন যা তিনি পাঞ্জাবী ভাষাতে বলেন। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশী মানুষ হয়তো পাঞ্জাবি ভাষা বোঝেন না। কিন্তু তবুও উনার সন্মানে উনাকে প্রথমে উনার বক্তব্য রাখতে দেওয়া হয় এবং পরে অন্য একটি মেয়ে তা ইংরেজীতে অনুবাদ করে আমাদের শোনায়।

বক্তব্য হলো এই রকমঃ

ভদ্রমহিলার নামঃ মোক্তার মাই।
মীরওয়ালা, পাঞ্জাব, পাকিস্তান।
পঞ্চায়েতের শাস্তির রায় ছিলঃ মোক্তার মাইকে গনধর্ষন করা হবে।
মোক্তার মায় এর অপরাধঃ তার ভাই অন্য এক উপজাতীয়ের মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। ভাইয়ের সম্পর্কের কারনে বোনের শাস্তি।
শাস্তির মাধ্যমঃ গনধর্ষন।

মোক্তার মাইয়ের বিবৃতিঃ

সেটা ছিল ২০০২ সাল। সেইদিনের কথা আমি কোনদিন ভুলবোনা। প্রতিটি মুহুর্ত আমাকে তাড়া করে ফেরে। আমি ভুলিনি। ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারবোনা। সেদিনের সেই ঘটনা আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে আছে। আমি আমার বাবার বাসাতে ছিলাম যখন ওরা আমার ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি আমাকে ভোগ করার জন্য বেছে নেয়। আমি চাইনি আমার ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি আমার অন্য কোন বোন ভোগ করুক। সেই ঘটনার পরে আমি দুইবার আত্মহত্যা করার চেস্টা করেছি।

মান-সন্মান বা ইজ্জ্বত – একটি বিষাক্ত শব্দ। ইজ্জ্বতের মালিকানা পুরুষের হাতে। আমি দেখেছি ঘরে যখন রান্না হয় তখন পুরুষেরা আগে তা খায় পরে মেয়েরা খেতে বসে। পুরুষেরা খাবার পরে যা কিছু খাবার বাচে তা মেয়েরা ভাগ করে খায়। মা খান সবার শেষে। যদি কিছু না থাকে তাহলে মা না খেয়ে থাকেন। মা হিসাবে সন্তানের জন্য ত্যাগ পরে সেটা পুরুষের জন্য “অধিকার” হয়ে যায়। নিয়ম হয়ে যায়। ট্রাডিশন হয়ে যায়। মেয়েরা পরে । অনেক দূরে। প্রথমে পুরুষ। আমার ভাই অপরাধ করেছে তার শাস্তি আমার ভাইকে দেওয়া হয়নি আমার ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি আমাকে পেতে হয়েছে কারণ আমার ভাই পুরুষ আর আমি মেয়ে।

আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে মানুষ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্‌ নারী পুরুষকে তাদের যার যার অধিকার দিয়েছেন কিন্তু পুরুষেরা নারীদের কাছ থেকে সে অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসাকে দুর্বলতা হিসাবে দেখা হয়েছে। স্বামীর জন্য স্ত্রীর ভালবাসাকে দুর্বলতা হিসাবে দেখা হয়েছে। ভাইয়ের জন্য বোনের স্নেহ দুর্বলতা হিসাবে বিবেচনা করে উলটে বোনকে এসে আঘাত করেছে। বোনকে যদি গন ধর্ষন করা হয় ভাইয়ের অপরাধের শাস্তি হিসাবে তাহলে সেটা কি ন্যায় বিচার হলো? সেটা অন্যায়। সেটা হয়েছে যেহেতু আমি মেয়ে সেজন্য । আমার ভাই পুরুষ তাই সে অপরাধ করেও কোন শাস্তি পায়নি। আমার ভাইয়ের অপরাধ সে অন্য জাতের মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। সেই সম্পর্কে সেই জাতের মেয়ের কি অপরাধ ছিলনা ? একজন পুরুষ আর একজন নারীর সম্পর্ক গড়ে উঠে দুইজনের ইচ্ছাতে সেখানে সেই ছেলের বোন কি দোষ করলো ? তবু আমাকেই দোষি হিসাবে এবং শাস্তি ভোগ করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।

এর কারণ ছিল অজ্ঞতা। মূর্খতা। আমাদের সমাজের মানুষ স্কুলে যায়না। লেখাপড়া করেনা । সেজন্য ওরা ওদের নিজেদের মাথায় যা আসে তা দিয়ে বিচার করে এবং এইভাবে মেয়েদের উপরে অবিচার করে। মেয়েরা যদি বিয়ের জন্য নিজেরা তাদের জীবন সাথী বেছে নেয় তাহলে আমাদের সমাজে সেটা অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে শাস্তি হিসাবে সেই মেয়েকে হত্যা করা হয়। আট বছর ধরে আমি ন্যায় বিচার পাবার আশায় আদালতে যাচ্ছি। আদালত বলেছে তুমি চারজন সাক্ষী আনো। চারজন না, সাড়া গ্রাম আমার উপরে হওয়া অপরাধের সাক্ষী আছে। আদালত পুরুষের, আইন পুরুষের, পঞ্চায়েত পুরুষের। শারিয়া আইনের নিয়ম অনুযায়ী যখন কেউ ধর্ষিতা হবে তখন সেই ধর্ষন প্রমান করার জন্য চারজন সাক্ষী হাজির করতে হবে। মোক্তার মাইকে তো গ্রামের পঞ্চায়েত “গণ ধর্ষনের সাজা” দিয়েছে। পঞ্চায়েতের সামনে সাড়া গ্রামের সবার সামনে তাকে গন ধর্ষন করা হয়েছে। এখানে সাক্ষী হিসাবে পুরা গ্রামবাসী সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মোক্তার মাই বিচার পাননি।

মোক্তার মাই এখন গ্রামে গ্রামে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন। এবং প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পুরুষের রোষানলের মাঝে এই কাজ করে যাচ্ছেন। মোক্তার মাইয়ের বক্তব্য হলো – আমার হারাবার কিছু নেই। সাড়া গ্রামের মানুষ যদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি অপরাধ হতে দেখতে পারে এবং কোন রকম বাধা দেবার চেস্টা না করে তাহলে ধরে নিতে হবে সেই গ্রামের সবাই অন্ধ। বোবা। কালা। পশু।

এভাবেই মোক্তার মাইয়ের বক্তব্য শেষ হয়।

পরে আমি নিজে কিছু রিসার্চ করলাম। গুগল করে মোক্তার মাই সম্পর্কে অনেক আর্টিকেল পড়লাম। মোক্তার মাইয়ের সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে হয়েছে। এত চুপচাপ ভাল মানুষ একজন মহিলা। শান্ত নদীর মত। কি প্রগাঢ় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। শান্ত  মিস্টি হাসি। আল্লাহ্‌ তাঁকে অনেক সহনশীল করে অমন একটি সমাজে পাঠিয়েছেন। মোক্তার মাই “গনধর্ষন” কে একটি অসুখ হিসাবে ভেবে নিয়েছে। গ্রামের মানূষজনকে পশুর মত ভেবে নিয়েছেন। এই পাশবিকতার নাগপাশে এইসব মানুষেরা বন্দী। মোক্তার মাই এইসব পশুদের সাথে থেকে অসুস্থ হয়েছেন এখন মোক্তার মাই তার জীবন বাজি রেখে এইসব পশুদের পাশবিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য শিক্ষিত করে তুলছেন । পশুরা প্রতিবাদ করেনা। পশুরা আক্রমণ করে। রোগ আক্রমণ করে। ধরাশায়ী করে। অসুস্থ করে । ভোগায়। এই রোগ থেকে মুক্ত হবার জন্য ওষুধ খেতে হয়। শিক্ষা হলো সেই ওষুধ। সেটাই মোক্তার মাই মনে করেন। মোক্তার মাইয়ের শক্তি আমাকে বিমোহিত করেছে। বর্বরদের দেশে যেমন আল্লাহ্‌র নবী (সাঃ)কে পাঠানো হয়েছিল ইসলামে্র আলো দিয়ে অন্ধকার থেকে বর্বরদের আলোতে আনার জন্য, পথ দেখাবার জন্য, ঠিক তেমনিভাবে পাঞ্জাবের পশুদের গ্রামে মোক্তার মাইকে আল্লাহ্‌ পাঠিয়েছেন অসীম শক্তি, ধৈর্য, ও সহনশীলতা দিয়ে।

মোক্তার মাই আমার জীবনের অনুপ্ররণা হয়ে আছেন।

৪ thoughts on “প্রবাসের গল্প ৬

Leave a Reply to Md Sohail Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.