আমরা আর তুচ্ছ হতে রাজি না

দেশের আত্মা শুধু দেশের মাটিতেই থাকে না, বিদেশেও তার বসত থাকে। আমাদের উদিত দুঃখের দেশ, বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করা আমাদের স্বদেশ সেদিন বিদেশের মাটিতে নিজের স্বভাবে ফিরতে পেরেছিল।
ইংল্যান্ডকে দুর্দান্ত দাপটে হারিয়ে লাল-সবুজ পতাকা মাথায় বেঁধে তরুণ অধিনায়ক মিডিয়া-মঞ্চে এলেন। তাঁকে দেখে জীবনে প্রথম অদ্ভুত সুখ আর বেদনায় বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল কত পরবাসী ভাই-বোন-বন্ধু। তাদেরই বয়সী এক মাশরাফি কী আবেগ আর গৌরব উপভোগ করে; যা তাদের অনাস্বাদিত? সেদিনই প্রথম বুকের ভেতর প্রেমের কুলকুল জলধ্বনি বেজেছে অনেকের। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, লোকে যাকে দেশপ্রেম বলে। কি নবীন কি প্রবীণ—সব দেশের দেশিই যে প্রেমে কখনো না-কখনো মাতেন। রাজনীতি বিমুখ করলেও খেলা আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। আমরা সেদিন বাংলাদেশ এবং খেলাকে একসঙ্গে উদ্যাপন করেছি। যখনই ওপর থেকে বিপদ আসে, তখনই দেখা যায় অন্য কোনো দিক থেকে আশা আসছে। খেলা তাই খেলার চেয়েও বেশি কিছু।
সেদিনই অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জীবনে প্রথম নিজের জন্য বাংলাদেশের একটি পতাকা খুঁজেছে। তাদেরই একজন সামি। বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর ছেলে। আবেদ চৌধুরী লিখছেন প্রথম আলোর ছুটির দিনে, ‘ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম ও বড় হওয়া। অস্ট্রেলিয়া দলের দুর্দান্ত সমর্থক। কিন্তু ক্যানবেরায় বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের খেলা দেখার পর থেকে তার মধ্যে লক্ষ করতে শুরু করেছি অনেক পরিবর্তন। বিশেষ করে খেলার শেষে মাশরাফি, সাকিবেরা দৌড়ে এল দর্শকদের কাছে; তখন দেখলাম, সামির চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। বুঝলাম, সে বাংলাদেশ দলকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।’
রাজনীতিবিজ্ঞানের তুমুল সাড়া জাগানো বই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ইমাজিনড কমিউনিটি। তিনি বলছেন, কারও পক্ষেই সমগ্র জাতিকে চিনবার বা জানবার সুযোগ হয় না। জাতি, জাতীয়তার ধারণা তাদের কল্পনা করে নিতে হয়। ভাবতে হয় জাতি মানে সীমান্তের সীমার মধ্যে অসীম সংহতির ভাইবেরাদর। এই কল্পনাই প্রতীক খুঁজে পায় পতাকায়, মানচিত্রে, জাতীয় সংগীতে আর জাতির ঐতিহাসিক স্মৃতির ভেতর। এই প্রতীকগুলোকে পরিচিত করানোয়, দেশের ধারণা সব নাগরিকের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার কাজ করে গণমাধ্যম, যোগাযোগব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তক। আজ সংবাদপত্রের জায়গায় টেলিভিশন, রেলের জায়গায় ইন্টারনেট আর পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে শক্তিশালী আবেদন জাগাচ্ছে খেলা: বাংলাদেশের ক্রিকেট।
জাতীয়তাবাদ জাতিকে তরুণের আদলে কল্পনা করে ও করায়। সেই কল্পনা আশ্রয় করে অতীতের বীর সংগ্রামী কিংবা শহীদ নায়কের ওপর। কিন্তু এগারো নামের এগারো তরুণ যখন বুক বেঁধে একসঙ্গে দাঁড়ায়, তখন আর ঐতিহাসিক কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না, তরুণ জাতির ভাব তখন তাদের বাস্তব চেহারাতেই ফুটে ওঠে। জাতির কল্পনার সঙ্গে জাতির বাস্তব প্রতিনিধিরা তখন একাকার।
বিশ্বায়িত পৃথিবীতে জাতির সব সন্তানই যে দেশের মাটি কামড়ে থাকতে পারবে, এমন নয়। তাহলেও মানবজাতির মহাসমুদ্রে তাদের দরকার আছে একটা সাংস্কৃতিক নোঙরের। এই কাজ করে ভাষা; সঙ্গে থাকে সংগীত, সিনেমা ও সাহিত্য। বহুজাতিক ভারতের ঐক্যের তিন রসায়ন হিন্দি ভাষা, বলিউডি চলচ্চিত্র আর ক্রিকেট। আমাদের ভাষা আছে ভাষার জায়গায়, সিনেমা দুর্বল, রাজনীতি নেতিবাচক শক্তিক্ষয়ের মারণযন্ত্র। এ অবস্থায় ক্রিকেটই আপাতত জাতীয় কল্পনার সহায়। মাগুরার সাকিব, নড়াইলের মাশরাফি, বগুড়ার মুশফিক, ময়মনসিংহের রিয়াদ, সাতক্ষীরার বিজয়সহ মফস্বল থেকে উঠে আসা ছেলেরা যে বাংলাদেশের ছবি তৈরি করে, তা–ই কি দেশের উৎসভূমি নয়? যখন প্রবাসে দৈবের বশে বাংলাদেশ না-দেখা কোনো তরুণ বা তরুণী সরল মুখের ১১ বাংলাদেশির যৌথ সংগ্রাম দেখে, তখন তার মনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ছবি জেগে উঠতে বাধ্য। এভাবেই সে দীক্ষিত হয় বাংলাদেশিত্বে, বাঙালিত্বে, স্বজাতিত্বে। পশ্চিম বাংলার অজস্র মানুষ যে বাংলাদেশের সাফল্যে উদ্বেলিত হয়, সে–ও কি ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের সুপ্ত ভালোবাসার শতজলঝরনাধ্বনি নয়? এটাও সত্য, বাংলাদেশের আদিবাসীদের আমরা এখনো এই সুখের ভাগিদার করতে পারিনি।

দুই.
এটা এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। এটা সেই সময়, যখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে আসতেও ভয় পাচ্ছেন। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে অনেকেরই বুক কাঁপছে। এটা সেই সময়, যখন কোথাও কোনো সুবাতাস নেই। কোনো দেশ যখন রাজনৈতিক কারণে ভীত ও দিশাহীন বোধ করে, তখন তারা মন্দ বাস্তবের বাইরের কোনো প্রতীকের ওপর ভর করে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য ফিরে পেতে চায়। ক্রিকেট এখন সে রকমই এক জাতীয় প্রতীক।
ক্রিকেটীয় আত্মবিশ্বাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর বিচ্ছিন্ন মনগুলোকে জোড়া লাগিয়ে আত্মমর্যাদাবান করে তুলেছিল। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়েরা প্রেরণা হয়ে উঠেছিল। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল তাদের ক্রিকেট দল। বাংলাদেশেরও এখন এ রকম ঐক্যসূত্রের দরকার আছে। নিপীড়িত দেশের মানুষের জন্য জাতীয়তাবাদ এখনো প্রাসঙ্গিক, যদি তা অহংকারী না হয়ে গ্রহণবাদী হয়। রবীন্দ্রনাথের কথা, বিনয় সামর্থ্যবানের পরিচয়।
যে দেশ বহুদিন ধরে বৈশ্বিক দুঃসংবাদ প্রেরণকেন্দ্র, সেই দেশ যখন ক্রিকেটের অভিজাত, বিশ্বশক্তি এবং সাবেক ঔপনিবেশিক শোষক ইংল্যান্ডকে ক্রিকেটের মাঠে পরাজিত করে; তখন দেশটার কথা নতুন করে ভাবতে হয়। তখন অনেকেরই মনে পড়ে আমির খানের জনপ্রিয় লাগান ছবির কথা, যেখানে গ্রামীণ যুবকেরা ইংরেজ অত্যাচারীদের তাদেরই আমদানি করা ক্রিকেট খেলায় পরাজিত করেছিল। লাগান-এর গল্প আজকের কোনো ভারতীয় অঞ্চলের ঘটনা নয়। এই সুখকর অঘটন ঘটিয়েছিল ঢাকার তরুণেরা। ১৮৮০-এর দশকে পূর্ব বাংলার তরুণেরা প্রথম পেশাদার ক্রিকেট দল গঠন করে ইংরেজ টিমকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হারিয়েছিল। বাংলা সিনেমার নায়কের মাথায় যেমন বাড়ি না পড়লে হারানো স্মৃতি মনে পড়ে না, তেমনি ধাক্কা খেয়েই আমাদেরও মনে পড়েছে: পূর্ব বাংলার এক মফস্বলী যুবক ছিলেন ভারতবর্ষীয় ক্রিকেটের জনক! উপমহাদেশে ক্রিকেট ও জাতীয়তাবাদের রাখিবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জমিদারপুত্র সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী—সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ, সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই। সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের পরাজয়ের অন্ধকারে ভারতবাসী মুষড়ে পড়েছিল। গায়ের বল তো চূর্ণই, মনের বলও তলানিতে। সে সময় সারদারঞ্জন কিশোরগঞ্জ থেকে পড়তে এসে ভাইদের নিয়ে বানিয়ে ফেললেন ঢাকা কলেজকেন্দ্রিক ঢাকা ক্রিকেট ক্লাব। তাঁর দল বেশ কয়েকবার ব্রিটিশদের হারিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের পর প্রথম খেলার মাঠেই নতুন বাঙালি মধ্যবিত্ত জাতীয় ঐক্য অনুভব করতে পেরেছিল। একে আধুনিক জাতীয়তাবাদের অসচেতন সূচনাও বলা যায়।

তিন.
কদিন পর প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত মহারণ। মনে পড়ছে ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে মিরপুর ট্র্যাজেডির কথা। সেবার পাকিস্তানের মুখোমুখি বাংলাদেশ। আমরা যেন কৌরব, ওরা যেন পাণ্ডব। জয়ের কাছাকাছি এসে রানের গতি আটকে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে দেখে কেবলই কর্ণকে মনে পড়ছিল। মহাভারতের ট্র্যাজিক বীর কর্ণ পাণ্ডবকুলপতি অর্জুনের বিরুদ্ধে লড়ছেন ন্যায়ের জন্য, জয়ের জন্য নয়। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে তাঁরই কিনা রথ আটকে যায় কাদায়! কৃষ্ণ তাঁর প্রতি বিরূপ, তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন গুরু পরশুরাম, বসুন্ধরা দেবীর হিংসারও শিকার তিনি। অনভিজাত বলে তাঁকে শিক্ষা দেননি গুরু দ্রোণাচার্য। নিয়তিরও নির্দেশ, অর্জুনই কুরু ময়দানে জয় পাবেন; কিন্তু মানবজমিনে যিনি বিজয়ী, তিনি কর্ণ।
মিরপুর মাঠে যেন সেই কর্ণ-কাহিনিরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। নইলে পুরো ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে শেষ মুহূর্তে রানের চাকা কঠিন মাটিতে আটকে যাবে কেন? পরাজয়ের পরেও কেন ক্রিকেট বিশ্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ দলের ভাবমূর্তি? কেন হৃদয় উথলানো নীরব কান্নায় সিক্ত সাকিবকে ট্র্যাজিক বীরের মতো দেখাবে, কেন তাঁকে মনে হবে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণের মতো? কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা বলবেন, ‘কাপ ছাড়া আর সবই জিতেছে বাংলাদেশ। সাবধান, বাংলাদেশ আসছে!’
তার পর থেকেই সব বড় দলকে কাঁপানোর মতো খেলা বাংলােদশ অনেক খেলেছে। কর্ণের ভূমিকা ছেড়ে জয়ীর ভূমিকায় এসেছে। বাংলাদেশ–ভারত খেলার আগের আবহ জমে উঠেছে। দেখা যাক কী হয়। তবে বাংলাদেশকে আর তুচ্ছ করা যাবে না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

৫ thoughts on “আমরা আর তুচ্ছ হতে রাজি না

Leave a Reply to Mamun Ahmed Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.