দুঃখ একটি বুমেরাং প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে

দুঃখানুভুতি নিয়ে অনেকেই অনেক তামাশা করে। অনেকেই দুঃখানুভুতিকে পূঁজি করে প্রতারণার জাল বিছায়।  একজন মানুষের দুঃখ অন্য একজন মানুষের সুখের সিঁড়ি হতে পারে। একজন মানুষের জীবনের সংগ্রাম, যুদ্ধ, কস্ট, বেদনা, অন্য একজন মানুষের জন্য প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেবার কৌশলের মালমশলা হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। তাহলে কি আমরা আমাদের দুঃখানুভুতি কারু সাথে শেয়ার করবোনা ? তাহলে কি আমরা সব সময়ই সুখে থাকার ভান করবো।

ইসলামিক অনুশাসন অনুসারে অতীতের কথা বলার জন্য একজন স্বামী তার স্ত্রীকে চাপ দিতে পারেনা। স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় বলে তাহলে বলতে পারে। স্বামী সেইসব কথাগুলো পূঁজি করে স্ত্রীকে ব্লাকমেইল করতে পারেনা। ইসলামে বহু বিবাহ অনুমোদন করে এবং স্ত্রীকে তার নিরাবতা রক্ষা করার জন্য অনুমতি দেয়। ইসলামের বহু বিবাহ তখনই সম্ভব যখন অন্য স্ত্রীরা অসুস্থ এবং অসুস্থতার কারণে স্বামীকে অন্য বিবাহ করার অনুমতি দেয়। স্ত্রীর ভরণপোষন না করতে পারলে পুরুষের বিবাহ করার অনুমতি দেয়না । স্ত্রীর কাছ থেকে বা স্ত্রীর পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেওয়া ইসলাম অনুমোদন করেনা। তাই যৌতুক প্রথা ইসলাম বিরোধী।

ফিরে আসি দুঃখানুভুতি প্রসংগে। ছোটবেলাতে শরতচন্ত্রের উপন্যাস থেকে আমরা বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, ও বিধবাদের উপরে নিপীড়নের কথা জানতে পেরেছি। বাল্যবিবাহের মুল কারণ ছিল পাত্রীর মাবাবার আর্থিক অনটন। মেয়ে হলেই বোঝা। সেই বোঝাকে যত তারাতারি ঘাড় থেকে নামানো যাবে তত তারাতারি ঘাড়ে বাতাস লাগার ব্যবস্থা হবে। ছেলেরা উপার্জন করে ঘরে আনে তাই ছেলেরা বোঝা নয়। ছেলে ও মেয়েকে যথাক্রমে “সম্পদ” ও “দায়” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আজকাল মেয়েরা তারাতারি কাজ পায়। ছেলেরা বেকার থাকে। একজন উপার্জনক্ষম মেয়েকে সব ছেলে বিয়ে করতে চায়। একজন চাকুরে মেয়েকে “বোঝা” বলে কেউ মনে করেনা। সেজন্য মেয়েরা মনে করে চাকুরী করাতে তাদের “স্বাধীনতা” নিহিত আছে। আমরা সবাই টাকার চারিপাশে ঘুরছি। টাকা, টাকা, টাকা, টাকা।

যার টাকা আছে তার মূল্য আছে।
যার টাকা আছে সে যদি গুম হয়, সে যদি গ্রেফতার হ্‌য়। সে যদি খুন হয়, তাহলে সমাজের সবাই মিলে তার জন্য যেভাবে কান্নাকাটি করে সেভাবে কান্নাকাটি একজন দরিদ্রের জন্য করেনা।
যার টাকা আছে সে যেকোন সমাজে মোটামুটি নিরাপদ
যার টাকা আছে তাকে সবাই ভয় করে কারন টাকা থাকলে ক্ষমতা কেনা যায়। খুনী কেনা যায়। নিরাপত্তা কেনা যায়। পুলিশ কেনা যায়। আইন আদালত বিচার সব কেনা যায়।
যার টাকা আছে তার অসুখ আছে, দুঃখ আছে, টাকা দিয়ে অনেক কিছুই কিনতে না পারার হাহাকার কাছে। সে টাকা দিয়ে তার শৈশবের স্বপ্ন কিনতে পারেনা। টাকা দিয়ে সে অতীতের চাকা ঘুড়িয়ে বর্তমানে এনে ফেলতে পারেনা। টাকা দিয়ে সে সারাজীবন বেঁচে থাকার জন্য সময় কিনতে পারেনা। টাকা দিয়ে সে যৌবন ধরে রাখতে পারেনা। টাকা দিয়ে সে সময় কিনতে পারেনা। টাকা দিয়ে সে অনেক কিছুই কিনতে পারেনা। একটি শহরে যদি সাইক্লোন হয় বা সুনামী হয় আর সেই শহরের ভ্রমনকারীরা যদি বহু টাকার মালিক হয় তাহলে তারা এই সুনামী থেকে বাঁচতে পারেনা। ঝর বা সাইক্লোন কার টাকা আছে আর কার টাকা নেয় সেসব কিছু দ্যাখেনা। সামনে যা কিছু পায় সব উড়িয়ে নিয়ে যায়।

সব কথা সাহিত্যিকরাই তাদের উপন্যাসে দূ;খানুভুতি নিয়ে খেলা করেছে। একবার এক উপন্যাসে পড়েছিলাম এক দরিদ্র ঘরের মেয়েকে এক জমিদার বিয়ে করে আনে কিন্তু বিয়ের পরে জমিদারের দেখা পাওয়া যায়না। জমিদার সব সময়ই যৌনকর্মীদের সাথে সময় কাটায়। জমিদারের পরিবার গরিবের মেয়ের সাথে জমিদারের বিয়ে দিয়েছে অনেক কারণে – সব চাইতে বড় কারণ হলো আনুগত্য। একজন দরিদ্রের মেয়ে বাবার বাসাতে যে দুবেলা ঠিকভাবে খেতে পেতোনা সে যখন জমিদারের ঘরে আসবে তখন ভাল ভাল খাবার, ভাল ভাল পোষাক, গহনা ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। জমিদার যেখানেই যাক না কেনো শর্ত হলো জমিদারের স্ত্রীকে কুমারী হতে হবে। অনুগত, কুমারী, ভীতু, ইত্যাদি ছিল গরীবের মেয়েকে বিয়ে করে আনার মূল কারণ।

এক খানে বীর্যপাত ঘটাবে প্রফেসনলিজম বা অভিজ্ঞতা উপভোগের জন্য আর অন্যখানে বীর্য ফেলবে বংশধরের জন্য। সব গর্তই এক কিন্তু গর্তের উপরে মলাট আলাদা। একটি গর্ত শুধু একজনের বীর্য ফেলার জন্য রিজার্ভড অন্য গর্তে বারোয়ারী বীর্য ফেলার জন্য উন্মুক্ত। একজন যৌনকর্মী যেমন যৌনকর্ম উপভোগ করেনা তেমনি একজন নারী যার স্বামী যৌনকর্মীদের সাথে থাকে সেও সেই পুরুষের সংগ উপভোগ করেনা। অথবা সংগ পায়না। ফলে সে বিষন্নতায় ভোগে। অনেক চাকর বাকরের ভিড়ে অনেক শাড়ি, খাবার, গহনার মাঝখানে সে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। বড় ঘরে বিয়ে করে সে সব পায় শুধু এক জাগাতে ফাঁকা থেকে যায়। এক চরিত্রহীন মানুষের পত্নী হয়ে সে দুঃখের সাথেই জীবন কাটিয়ে দেয়।

কুরবানীর সময় যখন গরু জবাই করা হয় তখন চারিপাশে মানুষেরা অনেক গভীরভাবে দ্যাখে এই নিরীহ পশুর গলা কাটার দৃশ্য। উপভোগ করে। কোন পশু বা মানুষের গলা কাঁটা দেখা কি উপভোগের বিষয় ? এখানে কি কি উপভোগ করে? কিছু মানুষের ভেতরে পশু বাস করে। নিরীহ পশু কথা বলতে পারেনা। সবাইকে মেরে পালিয়ে যেতে পারেনা। সে পড়ে থাকে, যন্ত্রনা সহ্য করে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে তা দ্যাখে উপভোগ করে। সেই নিরীহ পশুর মাংস টুকরো করে খায় । আনন্দ করে। ঠিক একইভাবে মানুষ মানূষের দুঃখ উপভোগ করে।

অনেকে মিথ্যা দুঃখের কথা বানায়। গল্প বানায়। গল্প বলে । দুঃখী মানুষের নাড়িতে টান দেয়। সেই গরুর গলা কাটার মত । ধীরে ধীরে শুইয়ে ফ্যালে তারপর ছুরি চালিয়ে দেয়। রক্ত দ্যাখে উল্লাস করে। উপভোগ করে। দুখী মানুষ ভাবে – এ বুঝি তার প্রতি সহানুভুতিশীল। তার  মত একজন দুখী মানুষ । তখন সেই দুখী মানুষ তার মনের সব দুঃখের কথা উজার করে খুলে ধরে। সেই কসাই সেটার অপেক্ষায় করছিল। সেই প্রতারক, কসাই এসেছিল অন্য কাজে। এই দুঃখি মানুষের আবেগকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা মারার জন্য এসেছিল। যখন সে কাতর হবে তখনই সাফাই করে নিয়া যাবে সব কিছু। তারপর  সেই দুঃখি মানুষের দুঃখের কথা গুলো মাল মশলা মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করে তামাশা করবে। সেই গরু মরা গরুর মত যাতে সেই দুঃখী মেঝেতে পড়ে থাকে শিরদাঁড়া ভেঙ্গে । সে যাতে কোন দিন আর উঠে দাড়াতে না পারে। তাঁকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় সে। একজন মানুষ দুখী হলে তাঁকে ভেঙ্গে দেওয়া অনেক সহজ। অর্ধেক কাজ হয়েই আছে। বাকী অর্ধেক করতে পারলে উদ্দেশ্য সফল হবে।

অনেকেই বিয়ে করে, বউয়ের বাচ্চা হলে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। একজন মেয়ের বাচ্চা হলে, সেই বাচ্চা নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করা তার জন্য অনেক কঠীন হয়ে যায়। মাবাবার বোঝা হবার কারণে সেই মেয়ের যদি বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে তার স্বামী বাচ্চা দিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেলে সে অনেক বেশী অসহায় হয়ে যায়। সমাজের বিভিন্ন মানুষের ভোগের পন্য হয়ে যায়। বিভিন্ন প্রতারকেরা শকুনের মত তাঁকে ছিড়ে খুড়ে খেতে চায়। নানা মানুষে নানা ভাবে তাকে আরো দুঃখ দেয়। সে বারোয়ারী গর্তে রুপান্তরতি হয়।

দুঃখ একটি পন্য। যার দুঃখ তার পন্য নয়। যার দুঃখ সে এই দুঃখের কথা বলে তার দুঃখের মার্কেটিং বা বাজারজাত করে কিন্তু এই দুঃখের কথা বের করার জন্য যারা মিথ্যা বা ভুয়া দুঃখের কাহিনী লিখে বা বলে এই দুঃখগুলোকে মুখ থেকে বের করে আনছে তারা হলো বিনিয়োগকারী। দুঃখের গল্প হলো বিনিয়োগ। আর যে দূঃখের কথা বলবে সে নিজের দুঃখের কথা বলে এই দুঃখকে দ্বিগুন করে, তিনগুন করে, চতুর্গুন করে এই দুঃখ তার কাছে ফিরে আসে। একজন সুখী মানুষের সাথে সবাই তার সুখ শেয়ার করতে চায়। বা সুখ কেড়ে নিতে চায়। একজন দুখী মানুষের দুঃখ কেউ শেয়ার করতে চায়না। এই দুঃখ ব্যবহার করে এই দুঃখী মানুষকে ধংস করে দেবার জন্য, এই দুঃখী মানুষের উদ্যোম, অনুপ্রেরনা, গুন, দক্ষতা, যা কিছু ভাল সব কিছু ধবংস করে তাঁকে সেই নিরীহ পশুর মত করে মাটিতে ধরাশায়ী করার জন্য তার দুঃখ ব্যবহার করে।

আপনার কথা শুনলে বোঝা যায় আপনি অনেক দুঃখি — এটা শুরু ।
আপনার চোখ দেখলে মনে হয় আপনি অনেক দুঃখি —– এইভাবেই শুরু হয় খোচাখুচি
একজন দুঃখি মানুষকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা সহজ। তাঁকে ধবংস করা সহজ। দুঃখের গান, দুঃখের কবিতা, দুঃখের গল্প উপন্যাস এইসব লিখে, পড়ে, শুনে চারিদিকে দুখী মানুষকে আরো বেশী নাজেহাল করে চালাক মানুষেরা যার যার কাম সাড়ে। দুখীরা শুয়ে থাকে পরাজিত, ধরাশায়ী সেই নিরীহ পশুর মত ।

দুঃখগুলোকে শক্তিতে রুপান্তির করতে হবে। আর যারা এই দুঃখকে নিয়ে ব্যবসা করতে চায় তাদেরকে এমন দুঃখ দিতে হবে যাতে তারা সেই একই অনুভূতি অনুভব করে যা একজন দুঃখী মানুষ আজীবন অনুভব করেছে।

৩ thoughts on “দুঃখ একটি বুমেরাং প্রতারণার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে

Leave a Reply to Shoton Biswas Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.