খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল

ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আদালত। মামলাটির অপর আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অনুপস্থিতিসহ আসামিপক্ষের অন্য চারটি আবেদন নথিভুক্ত রেখেছেন আদালত। এর ফলে গ্রেফতারি পরোয়ানাটি বহাল থাকলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

রাজধানীর বকশিবাজারে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদারের অস্থায়ী আদালত বুধবার (০৪ মার্চ) এসব আদেশ দেন।

বুধবার দুই ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ওই দুই দুর্নীতি মামলায় নানা বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে মোট সাতটি আবেদন করেন আসামিপক্ষ। এসব আবেদনের বিষয়ে বেলা সোয়া এগারটা থেকে দুপুর সোয়া একটা পর্যন্ত শুনানি শেষে আদেশ দেন আদালত।
খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এজে মোহাম্মদ আলী। তাকে সহায়তা করছেন অ্যাডভোকেট সানাহউল্লাহ মিয়া, মহসিন মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ বিএনপির আইনজীবীরা।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল। তাকে সহায়তা করেন মীর আব্দুস সালামসহ অন্য আইনজীবীরা।
আবেদনগুলোর নিষ্পত্তির পর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেন আদালত। ফলে রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী আদালতে উপস্থিত থাকলেও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

দুই দুর্নীতি মামলায় প্রধান আসামি খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রয়েছে। অন্য দু’জন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি। তারা হচ্ছেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে শুনানিতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

খালেদা জিয়ার পক্ষে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, আদেশ সংশোধন ও জামিন বহালের আবেদন জানিয়েছিলেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল বিদেশে চিকিৎসাধীন বলে আদালতে উল্লেখ করে একই আবেদন জানান তার আইনজীবী। এসব আবেদনের ওপর কোনো আদেশ না দিয়ে নথিভুক্ত রেখে দিয়েছেন আদালত।

তারেক রহমানকে বুধবার আদালতে হাজির করাতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তার আইনজীবী ‍অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। তবে তারেকের পক্ষে হাজিরা দিয়ে তার জামিন বহাল রেখে আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন জানান সানাউল্লাহ মিয়া। শুনানি শেষে এ আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি মোট ছয়জন। অন্য দু’জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা ছাড়া অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন- খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান জামিনে আছেন। বুধবার তাদের জামিন স্থায়ী করার আবেদন জানান তাদের আইনজীবীরা। মনিরুল ইসলাম খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ আবেদনটিও নথিভুক্ত করেছেন আদালত। হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

বুধবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণেরও দিন ধার্য ছিল। এ সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত রাখতে সময়ের আবেদন জানান তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। আবেদনে তিনি নিরাপত্তাহীনতার কারণে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির থাকবেন না এবং আইনজীবীরা তার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ আদালতের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আদালত পরিবর্তনের জন্য হাইকোর্টে করা খালেদার করা আবেদনের শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) দিন ধার্য আছে। এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত রাখা হোক।

অন্যদিকে খালেদার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন বলে তালিকা দিয়েছেন দুদকের আইনজীবীরা। সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজিরও ছিলেন সাক্ষীরা।

সাক্ষীরা হচ্ছেন- দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার বাদী হারুন-অর রশিদ, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার হারুনুর রশিদ, অফিসার (ক্যাশ) শফিউদ্দিন মিয়া, আবুল খায়ের, প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা নাজমা পারভীন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আফজাল হোসেন।

সাক্ষীদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন বাদী ও প্রথম সাক্ষী দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে কোনো আসামি না থাকায় আসামিপক্ষের জেরা বাতিল করেছিলেন আদালত। তারেক রহমানের পক্ষে আগামী ধার্য তারিখে হারুন-অর-রশিদকে জেরা করার সুযোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।

এদিকে খালেদা জিয়া আদালতে না গেলেও আদালত প্রাঙ্গনসহ আশেপাশের এলাকায় নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রচুর সংখ্যক বিজিবি-ৠাব-পুলিশ ছাড়াও সাদা পোশাকে ও গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়েন ছিল আদালত চত্বরে। পুরো বকশিবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোকেও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়।

২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।

অন্যদিকে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।

দুই মামলারই বাদী হলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।

জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।

গত বছরের ১৯ মার্চ দুই দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ঢাকা তৃতীয় ও বিশেষ জজ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে চার্জ গঠন করা হয় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর আট আসামির বিরুদ্ধেও।

গত বছরের ৭ মে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঢাকার মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আদালত ভবনের পরিবর্তে ঢাকা মহানগরের বকশীবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালত ভবনে চালানোর আদেশ জারি করে।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে আইন মন্ত্রণালয় এ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়ের বদলে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ হিসাবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু আহমেদ জমাদারকে। আগের বিচারকের প্রতিও অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানানো ছাড়াও তার আদালতে বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে এজলাসকক্ষেই বিশৃঙ্খলা ও হই-হট্টগোল এবং বিচারকের প্রতি কটূক্তি করে আসছিলেন খালেদার আইনজীবীরা।

এ পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক বদল করা হয়।

নানা কারণ দেখিয়ে মামলা দু’টির শুনানির জন্য নির্ধারিত ৬৩ কার্যদিবসের মধ্যে ৫৬ কার্যদিবসই অনুপস্থিত থেকেছেন খালেদা জিয়া, হাজির হয়েছেন মাত্র ৭ দিন।

৬ thoughts on “খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল

Leave a Reply to Imran Ali Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.