প্রবাসের গল্প ২

যারা প্রবাসে থাকে তারা প্রবাসে কেমন থাকে তা দেশের মানুষকে জানতে দেয়না। ফলে দেশের মানুষে যার যেমন খুশী ধারণা করে নেয়। দেশে যারা না খেয়ে থাকে বা অর্থনৈতিক কস্টে থাকে তারা কারুকে জানতে দেয়না যে তারা কস্টে আছে। দেশে বা প্রবাসে সব খানেই আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করি তা হলো মানুষে কেন যেন সত্য কথা বলতে চায়না। ১৯৯০ সালের দিকে আমি অন্য একটা শহরে বেড়াতে গেছিলাম। ঘুরে ঘুরে শহর দেখতে দেখতে এক সময় অনেক ক্ষুধা পেলো। তখন পথের ধারে একটা রেস্টুরেন্ট পেলাম । নাম – বোম্বে বিরিয়ানি।

ভেতরে গেলাম । দেখি এক বাংলাদেশী ভাই সেই রেস্টুরেন্টের মালিক। ভেতরে সবাই বাংলাদেশী। আমি তো মহা খুশী হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলো – আপা আপনি কোথায় পড়ালেখা করেছেন। বললাম। রেস্টুরেন্টের মালিক আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করেছি। স্বাভাবিকভাবেই রেস্টুরেন্টের মালিক অন্যান্য বাংলাদেশী নারী পুরুষের মত নিজেকে বাচ্চা ছেলে বলে দাবী করে আমাকে আপা ডাকা শুরু করলো। আমার কোন অসুবিধা নাই। আপা বা খালা বা নানী ডাকলে। ডাকে কি এসে যায়!! যাই হোক খেতে খেতে আমি প্রশ্ন করলাম – ভাই আপনেরা সবাই বাংলাদেশী অথচ আপনাদের রেস্টুরেন্টের নাম – বোম্বে বিরিয়ানি। এইটা কেন, ভাই?

সেই ভাই বলে – আপা, বাংলাদেশকে চিনে কয়জনা বলেন!! বোম্বে সবাই চিনে। ইন্ডিয়াকে সবাই চিনে। ওদেরকে আমি বলি আমি ইন্ডিয়ান। আমি যদি লিখি বাংলাদেশ বিরিয়ানি তাহলে কেউ আমার দোকানে খেতে আসবেনা।

তখন আমার দেশপ্রেম জাগ্রত হয়ে উঠলো আমি সাথে সাথে বললাম – আপনে নিজেকে ইস্ট ইন্ডিয়ান বলে কেনো পরিচয় দেন? আপনি তো বাংলাদেশী। আপনি যদি এখানকার মানুষের সাথে বাংলাদেশের পরিচয় করিয়ে না দিয়ে ইন্ডিয়ার নীচে লুকিয়ে থাকেন তাহলে তো কেউ বাংলাদেশকে চিনবেনা। একদিন এক লোক আমাকে বলে ও, বুঝছি তুমি ইস্ট ইন্ডিয়ান। আমি বললাম – ইস্ট ইন্ডিয়া শব্দটা বৃটিশদের নিজেদের বুঝার সুবিধার জন্য প্রচলন করেছিল। আমি বাংলাদেশী। বাংলাদেশে একটি দেশের নাম। সেই দেশের মানুষে বাংলা ভাষায় কথা বলে। তখন বলে – ও বেঙ্গলী!! আমি বললাম, না – বেঙ্গলী শব্দটাও ইংরেজদের উচ্চারণ। ওরা বাংলা বা বাঙ্গালী শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনা তাই বেঙ্গলী বলে। কিন্তু আমি কেনো বলবো? আমি তো বাঙ্গালী। আমি বেঙ্গলী বলবো কেনো ? আমি ভাল ইংরেজী বলতে পারিনা। কারণ ইংরেজী আমার ভাষা না। বৃটিশরা ভাল বাংলা বলতে পারেনা যেহেতু বাংলা ওদের ভাষা না। এটা ঠিক আছে কিন্তু আমি নিজের ভাষা বৃটিশদের উচ্চারণে বলবো কেন?

তখন সেই ভাই বলে – না হলে ওরা বুঝবেনা।
আমি বললাম – ওরা তাহলে একটা জিনিষ বুঝবে । তাহলো , আমরা ওদেরকে এখনও আমাদের মাথার উপরে স্থান দিয়ে থাকি। ওদের উচ্চারণে আমরা আমাদের ভাষা উচ্চারণ করি। যাইহোক রেস্টুরেন্টের মালিককে বুঝাইতেই পারলাম না “বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ভিন্নতা” । খেয়ে দেয়ে বাসায় আসার সময় রেস্টুরেন্টের মালিক বলে – আপা, আজ আমার অনেক মন খারাপ।
জিজ্ঞাসা করলাম – কেনো ভাই, কি হয়েছে ?
বলে – আমার এক কাজের লোক বিনা নোটিশে কাজ ছেড়ে দিয়েছে।
বললাম – হায়! হায়! কি বলেন। আমি কাজ করুম।
বলে – সত্যি!! আপা, আপনে কাজ করবেন?
বললাম – অবশ্যই। কাল থেকেই কাজে লেগে যাচ্ছি।

পরের দিন রেস্টুরেন্টে কাজে গেলাম। ভাই বলে – আপা আপনে প্রতিদিন বাসায় যাবার আগে বাথরুম সাফ করবেন। পুরা রেস্টুরেন্টের মেঝে পরিস্কার করবেন। আর আমাদের জন্য ভেতরে আলাদা রান্না হয়, অন্যান্য স্টাফদের সাথে সেটা খাবেন। আর সামনের দরোজার কাঁচ পরিস্কার করবেন। গ্লাস, থালাবাসন সব মেশিনে পরিস্কার হলে কাপড় দিয়ে মুছে সাজিয়ে রাখবেন। ড্রিঙ্কস কিভাবে বানাতে হয় শিখবেন তারপর সার্ভ করবেন। গেস্টরা যখন আসবে তখন অর্ডার নিবেন তারপর বাবুর্চীর কাছে সেটা দিবেন। বাবুর্চী রান্না করে আপনাকে খাবার দিবে। আপনি গেস্টদের সেই খাবার সার্ভ করবেন। তারপর খাওয়া শেষ হলে জিজ্ঞাসা করবেন ওরা ড্রিঙ্কস, ডেজার্ট, কফি, চা ইত্যাদি খাবে কিনা। তারপর এঁটো থালাবাসন সব এনে এখানে জমা করবেন পরে। এঁটো গার্বেজ বিনে ফেলে দিয়ে মেশিনে ধুইতে দিবেন। আর গেস্টরা যে টিপ আপনাকে দিবে সেটা আপনি আমাকে এনে দিবেন। আপনার টিপ আপনে পাবেন না। আপনের ধরা বাঁধা বেতন। সেটাই আপনে পাবেন।

মাথা ঝিম ঝিম শুরু করলো। আমি এর আগে আট বছর হিসাব রক্ষক হিসাবে কাজ করেছি। কোন দিন রেস্টুরেন্টে কাজ করিনি। এত কিছু করবো কিভাবে ভেবেই পেলাম না। তবু মাথা নাড়লাম। কাজ একটা দরকার। মনে মনে ভাবলাম – সব কিছুই করা সম্ভব । এটা এমন কি রকেট সায়েন্স!!। যাই হোক শুরু কাজ শুরু করে দিলাম। সকাল দশটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত। এগারোটার সময় ট্রেনে করে বাসা ফেরা। আমার বাসা থেকে সেই রেস্টুরেন্ট অনেক দূরে । অন্য এক শহরে। যেতে এক ঘন্টা সময় লাগে । এক্সপ্রেস ট্রেনে। তারপর ট্রেন থেকে বাসে যেতে হয় । গেস্টরা এলো – আমাকে দেখে বুঝলো আমি নতুন। মেনু দেখে অর্ডার লিখে নিলাম। ওরা আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো আমি স্প্যানিশ কিনা। আমি বললাম না আমি বাংলাদেশি।

রেস্টুরেন্টের মালিক বলে – আপা, আপনে বলবেন আপনে ইস্ট ইন্ডিয়ান। ওরা বাংলাদেশী বুঝেনা। আমি বললাম — আমি কোন দেশের নাগরিক সেটা কি আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে অন্যদের বলবো ?? আপনে একটা রেস্টুরেন্টের মালিক হয়ে কি আমার মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি। আজীব! তখন বলে – আপা, রাগ করেন না। আমার গেস্টরা কনফিউজ হবে সেটা আমি চাইনা। আমি বললাম আপনের গেস্টদের খাবার ঠিকমত দিলেই ওরা খুশী হবে কারণ ওরা আমার নাগরিকত্ব জানার জন্য আপনাকে টাকা দিচ্ছেনা । খাবার কেনার জন্য টাকা দিচ্ছে।

তারপর আমার একটা সমস্যা আছে সেটা হলো আমি বাথরুম পরিস্কার করতে পারবোনা।
আমি সামনের দরোজা, জানালার কাঁচ পরিস্কার করতে পারবোনা। আর ময়লা রান্নাঘরে বাবুর্চীদের সাথা সোল মাছ দিয়া ভাত খেতে পারবোনা। আমি ষোল মাছ, অ্যাঁইড় মাছ এইসব মাছ জীবনেও খাইনি। যদি হয় কন কাজ করুম না হলে ভাই আমি বাড়ি যাই । আল্লাহ্‌ হাফেজ!!

বলে – আপা, কিযে কন !! থাকেন আপনে আচ্ছা সামনে কাচ পরিস্কার করতে হবেনা। আর গেস্টরা যে খাবার খায় সেটাই খাইবেন। কোন অসুবিধা নাই।

রেস্টুরেন্টে আমি তিন সপ্তাহ পরে রিজাইন করি। এঁটো থালা বাসন উঠানো আর টেবিল মোছা একটা ব্যাপক বমি বমি ভাব এনে দিতো ।

৩ thoughts on “প্রবাসের গল্প ২

Leave a Reply to Mozibur Rahman Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.