রিভিউ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি নয়

ঢাকা: পূর্ণাঙ্গ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা যাবে না বলে দাবি করেছেন তার প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে আমরা রিভিউ করবো। ওই আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর রায় কার্যকরের বিষয় আসবে।

কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌছানোর পর বৃহস্পতিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান রিভিউ আবেদন না করলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে।

তিনি বলেন, আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করা যাবে। তাহলে কি করে রিভিউয়ের ১৫ দিন সময় অতিক্রম হওয়ার আগে ফাঁসি কার্যকর হবে?

রিভিউ আবেদনের দিন গণনা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকেই শুরু হয়েছে- অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিন শুরু হবে।

তিনি বলেন, আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে পারবেন।  রিভিউ নিষ্পত্তির পর যদি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে, তাহলে আসামির রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ থাকবে।

তিনি প্রশ্ন করেন, ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করার সুযোগ থাকার পরও রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা কিভাবে এসব কথা বলেন?

খন্দকার মাহবুব বলেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি, খামখেয়ালি এবং আইন কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা। তা না হলে তারা সরকারকে এভাবে পরামর্শ দিতে পারতেন না।

রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হবে যে, কিভাবে তা কার্যকর হবে। সেখানে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে, নাকি যাবজ্জীবন হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই রিভিউ আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপিলের রায় কার্যকর যাবে না বলে দাবি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।

তিনি বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা আসামির আইনগত অধিকার।

ট্রাইব্যুনালের মৃত্যু পরোয়ানা জারির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারি করাটা ঠিক আছে। কিন্তু আইনের বরখেলাপ করে মৃত্যু পরোয়ানা কার্যকর করতে পারবে না।

রিভিউ নিষ্পত্তি করার পর কামারুজ্জামানকে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না। তিনি যদি ক্ষমা চাইতে রাজি হন, তাহলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত তা কার্যকর করা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন আসামিপক্ষের এই আইনজীবী।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও শিশির মো. মনির।

শিশির মনির বাংলানিউজকে বলেন, আসামিপক্ষের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিনের কাছে রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বলে আমরা শুনেছি।

এর আগে বেলা দেড়টার দিকে কারাগারে পৌঁছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জারি করা কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা। লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানার সঙ্গে আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপিও পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আইন অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ এখন মৃত্যু পরোয়ানাটি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পড়ে শোনাবেন। এরপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না অথবা রিভিউ আবেদন করবেন কি-না তা আসামির কাছে জানতে চাওয়া হবে।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। ক্ষমা না চাইলে ফাঁসি কার‌্যকর করার শেষ ধাপগুলো সম্পন্ন করা হবে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বুধবার জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় পাচ্ছেন আসামিপক্ষ। তারা যদি এ সময়ের মধ্যে রিভিউ করেন তাহলে ফাঁসি কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে। রিভিউ নিষ্পত্তির পর বা রিভিউ খারিজ হলে এ প্রক্রিয়া ফের শুরু হবে।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি(বর্তমান প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন বিচারপতি আব্দুল ওহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। গত বছরের ৩ নভেম্বর কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে চূড়ান্ত এ রায় সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

মুক্তিযুদ্ধকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন কামারুজ্জামান। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে এই বাহিনী ওই অঞ্চলজুড়ে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা মোট ৭টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মধ্যে সোহাগপুর গণহত্যার (৩ নম্বর অভিযোগ) দায়ে চূড়ান্তভাবে ফাঁসির আদেশ হয়েছে তার। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি। এ অভিযোগে ট্রাইবুন্যাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। দারাসহ ছয় হত্যার (৭ নম্বর অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন ও অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের (২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া এ সাজাও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

তবে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার (১ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে আপিল বিভাগ তাকে খালাস দেন। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন কামারুজ্জামান। এছাড়া ৫ নম্বর (১০ জনকে হত্যা) ও ৬ নম্বর অভিযোগে (টুনু হত্যা ও জাহাঙ্গীরকে নির্যাতন) ট্রাইব্যুনালের রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে আপিল বিভাগও খালাস দিয়েছেন।

৮ thoughts on “রিভিউ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি নয়

Leave a Reply to M.a. Azad Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.