চলমান আন্দোলনে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজধানী ঢাকা। এই ‘ঢাকা অচল’-এর জন্য শর্ট টাইম টার্গেট নিয়েছে বিএনপি। আন্দোলনের দ্বিতীয়ধাপ হিসেবে বেছে নিয়েছে আগামী দুই সপ্তাহ। তবে এর মধ্যে বড় ধরনের অঘটন বিশেষ করে দলীয় শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারের পথে হাঁটলে নির্ধারিত সময় কাটছাঁট করা হবে। এদিকে আন্দোলনের পথে আঘাত এলে প্রতিরোধের নির্দেশনা ইতিপূর্বে দেয়া ছিল না। তবে গেল দুইদিন আগে কৌশলী হওয়ার জন্য দলীয় নেতাদের কাছে বার্তা দেয়া হয়েছে। যারা আত্মগোপনে আছে তারাও আরো সক্রিয় ও সতর্কতা অবলম্বন করছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রমতে, অভ্যন্তরীণ দলীয় রাজনীতিতে পরস্পরের সম্পর্ক সাপে নেউলের মতো বিরাজ করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে একাট্টা হয়েছে আব্বাস-খোকা ও সোহেলের সমর্থকরা। খোকা বিদেশে এবং আব্বাস আত্মগোপনে থাকলেও কাজ করছেন দুই মেরুর কর্মী-সমর্থকরা। তারা দুই নেতার সিগন্যালের অপেক্ষায়। যে কারণে বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন খোকা। আর ভেতরে ভেতরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে রাজপথের পরিচ্ছন্ন ও খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত সৈনিক হাবীব-উন নবী খান সোহেল।
এদিকে আন্দোলনে পিছু হটাতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের মাধ্যমে যে ধরনের প্রস্তাবনা দেয়ার চাউর বাজারে আছে সেটাও হালে পানি পাচ্ছে না। কারণ গ্রেফতারকৃতরা আন্দোলনের চালিকা শক্তি নন। বক্তব্য প্রচার-প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দিক-নির্দেশনা আসছে দেশের বাইরে থেকে।
গত ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলছে। মাঝে দেয়া হচ্ছে ইস্যুভিত্তিক হরতালও। ইতোমধ্যে সারা দেশে ৪ হাজার ঘণ্টার বেশি হরতাল পালিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের আন্দোলনে তৎকালীন আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগ যেমন পাবলিক পরীক্ষায় ছাড় দেয়নি এবার বিএনপিও ছাড় দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যেমন বলেছিলেন, কিসের পরীক্ষা আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপি নেতৃবৃন্দের মুখেও একই সুর কিসের এসএসসি পরীক্ষা আগে গণতন্ত্র। এমন পরিস্থিতিতে জনজীবন অচলপ্রায়। তবে দায়ভারটা আন্দোলনকারীদের বদলে সরকারকেই দায়ী করছে বেশি। কারণ ইতোমধ্যে বিএনপি জোটের লাখো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় ১৫ দিন। তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে ২০ ঘণ্টা পরে সংযোগ দিলেও বাকি সকল যোগাযোগ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে। পুত্রশোকের দিনই কাতর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অর্ধডজন, দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৮০ মামলা। কারো কারো বিরুদ্ধে মামলা সেঞ্চুরি। গ্রেফতার করা হচ্ছে দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ’ নেতাকর্মী। আর অব্যাহত কথিত বন্দুকযুদ্ধ (ক্রসফায়ার) ও মামলা-হামলায় আন্দোলনের গতি কমার বদলে বেড়েছে। অবশ্য এটা ঢাকার বাইরের চিত্র। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের মতো আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা অচলের প্রস্তুতি নিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরী বলেছেন, ঢাকা সারা দেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাইরের অধিকাংশ জেলা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। তা নিয়ে সরকারের ভাবনাও নেই। সরকার শুধু পুলিশ দিয়ে ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকার এখন ঢাকা কেন্দ্রিক। সংবিধান প্রণেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, যা চলছে সেটি স্বৈরতন্ত্র। এভাবে দেশ চলতে পারে না।
খালেদা জিয়ার কার্যালয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, বিনা নোটিশে এভাবে কোন নাগরিকের অধিকার হরণ করা উচিত হয়নি। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠিন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার মন্তব্য, দমন পীড়নের মাধ্যমে চলমান আন্দোলন দমানো যাবে না। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরীর মতে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মূলত ঢাকায় বন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে ঢাকার পুলিশের দৃষ্টিতে রাজধানীর জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। এই স্বাভাবিক অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, র্যাব, পুলিশ এবং বিজিবি সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ না করে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকলে তিরিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকাকে আওয়ামী মুক্ত করা সম্ভব। এর জন্য আমাকে সশরীরে ঢাকায় ফেরারও প্রয়োজন হবে না। একটি ফোনই যথেষ্ট।
তিনি বলেন, সরকারকে বলতে চাই, এখনো সময় আছে সংলাপের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর প্রত্যাশিত নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারিদের মতো করুণ পরিণতি আপনাদেরও বরণ করতে হবে।
এদিকে যুক্ত বিবৃতিতে মির্জা আব্বাস ও হাবীব-উন নবী খান সোহেল বলেছেন, সরকারের কোন অশুভ পরিকল্পনাই ফলপ্রসূ হবে না। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গন্তব্যে পৌঁছা না পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরে যাবে না। গুলি, মামলা-হামলা-গ্রেফতার করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কোনদিনই বন্ধ করা যায়নি। এবারো যাবে না।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল, যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহম্মেদ, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে গ্রেফতার এবং একস্থানে নিয়ে কিছু সময়ের জন্য একত্রে রাখার বিষয়টি নিয়ে মহল বিশেষ গুঞ্জন শুরু হয়েছে। চাউর আছে তাদের মাধ্যমে সমঝোতা বা আন্দোলনে পিছু হটার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়টিকে বিভ্রান্তি হিসেবে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা। কারণ আন্দোলনের চাবি-কাঠি দেশে নয়; বিদেশে। সরকারের খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তা স্পষ্ট করেই বলেছেন, খালেদা জিয়া কাঠের পুতুল আন্দোলন তারেক রহমানের হাতে। বিদেশে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।সুত্র,ইনকিলাব
আতিক/প্রবাস