https://bookkeepingnexus.com/Fraud_Anwar_Parvez/FraudBangladesh.html
জীবনের একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি হলো মৃত্যু। কারু মৃত্যু হলে জীবিতেরা কেন শোক করে? কারণ সেই জীবিত মানুষটিকে আর কষ্ট দিতে পারবেনা সেজন্য আফসোস করে অথবা সেই মৃত ব্যক্তিটি তাদের ধরা ধোঁয়ার বাইরে সেজন্য সবাই শোক করে। সেই জীবিত মানুষটি থেকে আর কিছু পাওয়া যাবে না বলে সবাই শোক করে। জীবন হলো একটি ব্যবসায়িক লেনদেন কেন্দ্র। যে জীবনের কোন উপযোগীতা নেই কেউ সে জীবন চায়না। একটি জীবন থেকে মানুষ অনেক কিছু আশা করে । আশা করে দেহ, মন, শ্রম, টাকা, ভোগ, সুখ ইত্যাদি।
আমি আমার কথা বলতে পারি। ক্রমশঃ আমি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । শোক করার মত আমার তেমন কেউ নেই। সেটা আমার জন্য পরিতাপের বিষয় নয়। আমি বিশ্বাস করি মৃত্যু হলো একটি বাহন । একটি জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশ করার বাহন। আমার মৃত্যু হলে সব চাইতে বেশী যারা আফসোস করবে তারা হলো যারা আমার থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। অর্থাৎ প্রতারকেরা। তারা মনে মনে ভাববে – ইস! মরে গেলি তো গেলি আরো কিছু টাকা কেন হাতিয়ে নিতে দিলিনা!!
টাকা খুব গুরুত্বপূর্ন কাগজ। জীবনের চাইতে অনেক অনেক অনেক দামী হলো এই টাকা নামের কাগজ। রক্তমাংসের দেহ, মন, প্রেম, ভালবাসা থেকে টাকা অনেক অনেক অনেক বেশী মূল্যবান। আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার খুব ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর আগে কিছুদিন অবসর নেওয়া তারপর ঘুরে বেড়ানো । তারপর একদিন অজানা এক দেশে নির্জন এক হোটেল রুমের শান্ত বিছানায় খুব একাকী সুন্দর এক ঘুমের ভেতর মৃত্যুবরণ করা।
সেই স্বপ্ন পূরণ হয়তো হবেনা।
পরিবার থেকে বাইরে বের হবার পরে আমি দেখেছি চারিদিকে শুধু রক্তচোষা দ্বিপদ প্রানী।
সবাই কিছু না কিছু চায়। দিতে না পারলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাকে আর কোন দরকার ছিলনা তাদের।
লেনদেন চারিদিকে। এত বাণিজ্য দেখে দেখে আমি অনেক ক্লান্ত।
আমি পাখির কাছে গেলাম। শুধিয়েছি অনেকবার । ওরাও কি বাণিজ্য করে? উত্তর পাইনি।
অনেক উঁচুতে উড়ে উড়ে ওরা একদিন ঠিক আমার স্বপ্নের মত মরে যায়।
আমি গাছের কাছে প্রশ্ন করেছি। দেখেছি ওরা প্রতি বছর মরে যায় আবার জীবিত হয়। পাতা ঝরে যায়, উড়ে যায় অন্য কোথাও বাতাসে মিলিয়ে যায়। ধুলো হয়ে হারিয়ে যায়। আবার নতুন পাতা আসে। কত কত বছর পরে উইপোকা লেগে গেলে ওরা গাছের গুঁড়ি ধূলো করে উড়িয়ে দেয়। একদিন গাছের মৃত্যু হয়। গাছের জীবন আমার জীবনের চাইতে অনেক কষ্টের।
আমি একবার এক নদীর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম সে কিভাবে মরে গেছে। পানিতে ধুয়ে ধুয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাটি এসে এসে নদীর কবর রচনা করেছে। নদী স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্রোত হারিয়ে মরে গেছে।
ফুলেরা সকালে ফুটে সন্ধ্যায় মরে যায়। প্রকৃতিতে জীবন আর মৃত্যুর আসাযাওয়া চলে আলো আর বাতাসের মাঝে স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন কেউ কোন শোক পালন করেনা। কোন বাণিজ্যিক লেনদেন চলেনা। কোন মিলাদ দোয়া দরুদ ব্যবসা বাণিজ্য জিলাপি দলিল দস্তাবেজ কাড়াকাড়ি মারামারি নেই। বহতা নদী মরে যাচ্ছে চুপচাপ। বিশাল বৃক্ষ মরে যাচ্ছে অবিচার অনাচারে আগুনে বা কুড়ালের ঘায়ে বা করাতের ভাঁজে ভাঁজে অথবা গভীর অন্ধকারে নিঃশব্দে পোকার দাঁতে দাঁতে।
চারিদিকে জীবন মৃত্যু আসেযায় শুধু উৎসব নেই তেমন । আমার জীবনের মত নিঃশব্দ। উৎসবহীন প্রাণবন্ত । উদাস আর একাকী। বিষন্ন অথচ সাবলীল । আলোকিত এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্বিত। স্বপ্নহীন অথচ আগামীকালের সুন্দর ভোরের প্রত্যাশায় বিভোর।
আমি ধীরে ধীরে আমার সুন্দর মৃত্যুর বাহনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
ভাবছি আমি যদি বাসে মরে যায়। হঠাৎ আসা ঘুমের ভেতর। তাহলে বাস থেমে যাবে। সব যাত্রিরা নেমে যাবে। এমবুলেন্স আসবে। আমার দেহ মর্গে নেবে। আমার পায়ের আঙ্গুলে আমার নাম লিখে মর্গের শীতলে সেলফে আমাকে রেখে দেওয়া হবে।
তারপর আমার ব্যাগে রাখা আইডি থেকে আমার খোঁজ নিয়ে ছেলেদের খবর দেবে।
ভাবছি আমার কোন ছেলে আগে খবর পাবে? বড় ছেলে? না ছোট ছেলে? ওরা কি দুঃখ পাবে?
আমি ওদের জীবনের জন্য দরকারী কিছু নই আর। আমার থেকে নেবার বা আমাকে দেবার কিছু নেই আর। খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনার মত সেদিন কেটে যাবে। কিছু ঝামেলা থাকবে তাই দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলোতে ব্যাঘাত ঘটবে। সেই প্রতিদিন জীবনের কিছু রুটিনে ব্যাঘাত ঘটার মত। দাঁত ব্রাশ করা মশারি টাঙ্গানো আলো নিভিয়ে সুলতান সুলেমান শো দেখাতে দুই মিনিটের ব্যাঘাত ঘটবে হয়তো। হয়তো নয়।
মায়ের মৃত্যু এক বাধার মত। গুরুত্বপূর্ন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিঘ্ন ঘটে গেলে হয়তো বিরক্তি সৃষ্টি করবে। তবে আমি তো রোজ রোজ মরছিনা। সবার একটাই মা হয় । একটা মা একবারই মরে। তারপর একবারই দাফনকাফন ঝামেলা।
আর কেউ নেই আমার। তবে আমার বেড়ালেরা আমাকে খুঁজবে। ক্ষুধা পেলে অথবা আদোর পেতে ইচ্ছা হলে। অথবা প্রতিদিন একজন মানুষ ফিরে এসে দরজা খুলতো । সে আর আসছেনা। আসছেনা অনেকদিন হলো। বিড়ালেরা মানুষের সাথে খুব মিলেমিশে যায়। আমার বড় ছেলের বিড়াল ছিল কসমো । আবার বড় ছেলে স্কলারশিপ পেয়ে দূরের এক শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পরে কসমো ধীরে ধীরে খাওয়া ছেড়ে দিলো । প্রতিদিন অপেক্ষা করতো জানালায় । দরজাতে । একদিন ঘরে ফিরে দেখি দরজার কাছে কসমো মরে পড়ে আছে। আমি যেমন একদিন কোথাও না কোথাও মরে পড়ে থাকবো । এমন হতে পারে রাস্তা পাড় হতে যেয়ে গাড়ীর ধাক্কা লেগে রক্তাক্ত হয়ে মরে যাবো সেই রাকুনের মত। পথের মাঝখানে পশুর থেঁৎলানো দেহ দেখা যায় মাঝে মাঝে। রাস্তা পেরুতে যেয়ে গাড়ীর নীচে মরে গেছে তারপর অনেক গাড়ী ওর দেহ থেঁতলে চলে গেছে। এভাবে যদি অনেক গাড়ী আমার দেহ থেঁতলে চলে যায় তাহলে আমাকে চেনা যাবেনা। রক্তাক্ত থেঁৎলানো দেহ কাপড়ের ভেতরে টূকরো টুকরো দলা পাকানো ঝুলবে । অনেকেই বমি করে দেবে আমার মৃত্যু দেখে।
অথবা কেউ জানবেনা কারু জীবনের প্রতিদিনের কোন রুটিনে ব্যাঘাত করবেনা আমার মৃত্যু। মৃত্যু এসে চুপচাপ টেনে নিয়ে যাবে নতুন জীবনে। কেউ নেই কোথাও। যেমন ছিলনা জীবনে ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরেও থাকবেনা। মৃত্যুর আগে আমি আমার জীবনের সব কষ্টদের দাফন করে যাবো যদি হাতে সময় থাকে। যদি মৃত্যুর সময়টা কিছু আগে জানতে পারি। মৃত্যু সবসময়ই সুন্দর । আর যদি সময় না পাই আমি আমার সারাজীবনের কষ্টদের সাথে করে নিয়ে যাবো তারপর আমার কবরের চারিপাশে নানা রকমের পশু আর প্রানী, পোকা আর মাকড়ের মাঝে বন্টিত করে দেবো আমার মাংসের সাথে। মানুষ মরে গেলে দেহ রক্তশুন্য হয়ে যায়। আমি এমনিতেই রক্ত শূন্যতাই ভুগেছি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। রক্ত না পেয়ে পিশাচেরা কষ্ট দিয়েছে। সেজন্য এত এত কষ্ট জমে গেছে জীবনের চড়াই উৎরাইয়ে উঠানামা করতে করতে।
স্বাগতম মৃত্যু। বিদায় জীবন। আমার ভালবাসাহীন দীর্ঘ জীবনের সাথী অগাধ কষ্টেরা আমার সাথে আছে। থাক ওরা । হোক কষ্ট তবু তো কিছু ছিল।
আয়শা মেহের।
সম্পদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা ।