প্রসঙ্গ – রেট কত ?

আজ সকালে ফেসবুকের একটি পোস্টে চোখ গেল। আমি বিস্তারিত পড়িনি। ভাল লাগেনি।  তবে পোস্টের সাথে ছাত্র ইউনিয়নের লাকি আক্তারের ছবি ছিল আর সে ছবি দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছি ব্যাপারটা। খবরটা পড়িনি কারণ পড়তে ইচ্ছা হয়নি। গণজাগরণমঞ্চ সাজানো হয়েছিল ৫ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩। সম্ভবত ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ –  ছাত্র ইউনিয়নের লাকি আকতারকে দেখা যায় জামা তে ইসলামের কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী করতে। এই মঞ্চ কে বা কাহারা তৈরি করেছে সে প্রসঙ্গে যাবোনা। আমার আজকের প্রসঙ্গ – রেট কত?

১৯৭৪ সাল। ছাত্র ইউনিয়নের লাকি আক্তারের তখন সম্ভবত জন্ম হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হবার ৩৯ বছর আগে বেইলীরোড দিয়ে আমি হেঁটে বাসায় আসছিলাম। একদল ছেলের ভেতর একটি ছেলে চিৎকার করে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল – ঐ ছেমড়ি তোর রেট কত?

১৯৭৭ সাল। প্রেসক্লাবের সামনে একটি লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ ঐ মাগী তোর রেট কত?

১৯৮৩  সাল। ইস্কাটন রোড দিয়ে আমি হেঁটে বাসায় আসছিলাম। একটি রিকশা আমার পাশে থেমে গেল। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই রিকশাতে বসা এক মধ্যবয়সী লোক আমাকে প্রশ্ন করলো – তোর রেট কত?

এছাড়া আরো অনেক সময় ঢাকা বা যশোরের অনেক পথেই আমাকে নানা রকমের যৌন হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। আমার চোখে দেখা অনেক নারীকেই একইভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।  ২০১৪ সালে ফেসবুকে আমি এই প্রসঙ্গে লিখেছিলাম তখন ভুয়া আইডিতে এসে কক্সবাজারের প্রতারক আনোয়ার পারভেজ আমাকে বেশ্যা হিসাবে সন্মোধন করে একটি পোষ্ট দিয়েছিল

আমি কখনো দেহ বিক্রি করিনি। দরকার হয়নি। তবে যারা দেহ বিক্রি করে তাদের আমি অশ্রদ্ধা করিনা। যেহেতু তার বিক্রি করার আর কিছু নেই সেজন্য সে দেহ বিক্রি করে। আমি সেই সমাজকে ঘৃণা করি যে সমাজ একজন নারীকে যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। আমি সেইসব মানুষকে ঘৃণা করি যারা নারীকে যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। আমি সেইসব মানুষকে ঘৃণা করি যারা টাকার বিনিময়ে দেহ ক্রয় করে। ঘৃণিত সে যে দেশ বিক্রি করে। ঘৃণিত সে বা তারা যারা বিদেশীদের দালালি করে। ঘৃণিত তারা যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষন করে আর দেশের মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

গণজাগরণ মঞ্চ লাকী তৈরি করেনি। ১৭ কোটি বাংলাদেশীর মত লাকিও ভারতের অঙ্গরাজ্য বাংলাদেশের ক্যানসার আক্রান্ত আর্থসামাজিকরাজনৈতিকসাংস্কৃতিক অবস্থার শিকার। যে ব্যক্তি কারুকে অসন্মান করে সে ব্যক্তি নিজেই একজন ঘৃণিত ব্যক্তি আর সেকারনেই সে অন্যদের অসন্মান করে।

নয়মাসের গণহত্যা শেষে ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হানাদার বাহিনী যখন পূর্ন নিরাপত্তার সাথে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রন ভারতের হাতে সপে দিয়ে ভারতের নিরাপত্তাই আরামে প্লেনে চড়ে পাকিস্তানে ফিরে যায় তখন পরোক্ষ উপনিবেশ হিসাবে আগরতলা চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতের মনোনিত ভারতের রাজ্যসরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও তার রাজনৈতিক দল – ১৯৭১ এর শুরুতে অনুষ্টিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তান আওয়ামীলীগকে।

১৯৭১ সালের নয় মাস শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে ছিল। আর পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সদস্যরা সব ভারতে ছিল। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় । ভারতের মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে সব মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই ভারতের দালাল শেখ মুজিবের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সবগুলো গ্রন্থেই এর উল্লেখ রয়েছে। যেসব মুক্তিযোদ্ধারা শেখ মুজিবের বশ্যতা স্বীকার করেনি ভারতের সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করে। পূর্ব বাংলার মানুষ তখন ছিল শাঁখের করাতের উপর। পূর্ব বাংলাতে ছিল হানাদার বাহিনী আর ভারতে ছিল সম্প্রসারনবাদ প্রতিক্রিয়াশীল ইন্দিরা সরকারের ভারতীয় সৈন্যবাহিনী আর রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং এর গোয়েন্দারা “ইসলামিক” নামের বিভিন্ন দলে খুনী নিয়োগ করে সাড়া বাংলাদেশে হত্যা, অগ্নীসংযোগ, ধর্ষন কার্য চালিয়ে যাচ্ছিল হানাদার বাহিনির পাশাপাশি।  কবি সুফিয়া কামাল, লেখিকা জাহানারা ইমাম (যার ছবির নীচে মোমবাতি জ্বেলে লাকি আক্তার চিৎকার করেছিল ), কবি সামসুর রহমান প্রমুখ কেউই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় নাই। একাত্তরের দিনগুলিতে ওরা সবাই হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল। দিন শেষে বাহাত্তরের দিনগুলিতে ওরা ভারতের অঙ্গরাজ্যে ভারতের রাজ্যসরকারের সাথে একাত্ততা ঘোষনা করে আরাম আয়েসে জাতীয় পদক নিয়ে ভুয়া স্বাধীনতার গালগল্পে মগ্ন হয়ে লুটপাটখুন ধর্ষন চুরি ডাকাতি করে সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল।

যখন জনগনের প্রতিনিধি একটি দেশের রাস্ট্রপ্রধান না হয় তখন সে দেশের আপামর মানুষের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কোন কর্মসূচী গ্রহন করা হয় না। সেজন্যই অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা।

পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবকে নির্বাচিত করেনি সুতারাং শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য কিছু করেনি। ভারতের ইন্দিরা সরকার শেখ মুজিবকে ভারতের অংগরাজ্য বাংলাদেশের রাস্ট্রপ্রধান মনোনিত ও নিযুক্ত করেছিল সেজন্য মুজিব ভারতের সাথে পচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি করে এবং বাংলাদেশের পানি, জমি, আলো, বাতাস, মানুষ সবকিছুই ভারতের হাতে সপে দিয়ে চুরুট টানতে থাকে। শান্তনা হিসাবে পূর্ব বাংলার মানূষ একটি লাল সবুজ পতাকা নেড়ে চেড়েই সুখী হবার চেষ্টা করছিল । লাল সবুজ পতাকা নেড়ে চেড়ে খাবার পড়েনি সেজন্য প্রথম চার বছরেই অনাহারে মরে দশ লাখ মানুষ। সেই দশ লাখ মানুষের মৃত্যুতে কেউ শোক করেনা বা শেখ মুজিবকে দায়ী করেনা। সেই দশ লাখ মানুষের মৃত্যুর শোকে কেউ কোন চিৎকার বা কান্নাকাটি করেনি। কেউ কোন উপন্যাস লেখেছি। কোন শহীদ মিনার গড়ে উঠেনি।

পাকিস্তান মূসলিম আওয়ামীলীগ ওরফে আইয়ূব  সামরিক সরকারের প্রিয় মুসলিমলীগ ও জামাতে ইসলামের বন্ধু প্রতিম পাকিস্তান আওয়ামীলীগ ওরফে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সমর্থক পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭৩-৭৪ সালে ধারাবাহিক খবরে প্রকাশিত হয় দশ হাজারের বেশী বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মৃত্যুর খবর। তাদের নাম এবং কোথায় কিভাবে রক্ষীবাহিনী ও  মুজিব বাহিনী দ্বারা তাদের হত্যা করা হয় সেইসব বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হতে থাকে আরো একটি পত্রিকাতে। পত্রিকাটির নাম ছিল গণকন্ঠ।

এই তো সেদিন দেখলাম ফেসবুকে একটি ছবি। কবি, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও তখনকার বামপন্থি এখনকার জামাত সমর্থক আল মাহমুদের জন্মদিন পালিত হলো কিন্তু কেউ লেখেনি এই বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধাকে জেল খাটতে হয়েছিল মুজিবের আমলে। আর তছনছ করে ফেলা হয়েছিল গণকন্ঠের অফিস।  সবাই শেখ মুজিবের মেয়ের পায়ে সালাম করে বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে কাপড়চোপড় ছিড়ে রক্তাক্ত দেহে হায় হায় করে তারপরেও সমগ্র বাংলাদেশে লাশ বিছানো থাকে।  সেই দেশের নতুন প্রজন্মের লাকি আক্তারের রেট কত জিজ্ঞসা করা হলে আশ্চর্য হইনা কারণ বিদেশের দালালেরা জনগনের প্রতিনিধি নয় তাই জনগনের নিরাপত্তার কথা তারা চিন্তা করেনা। দরকার নেই সেজন্য। বিদেশীরা জিজ্ঞাসা করে বাংলাদেশের রেট কত ? আর বাংলাদেশীরা জিজ্ঞাসা করে লাকী আক্তারের রেট কত? কথা একই। সব কিছুই বিক্রি হয়। দেশ, দেহ, মা, মাটি, মেয়ে, বোন আর বিবেক।

সেজন্যই আমি ঢাকা বা যশোরের পথে যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছি।
সেজন্যই লাকি আক্তারের রেট কত সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়।

সেজন্যই হাতুড়ি দিয়ে দেহের হাড্ডি ভেঙ্গে দেওয়া হলে একদল লোক সেটা নিয়ে উল্লাস করে। সেজন্যই আর্মড পুলিশ নিরস্ত্র আলেমদের ঘেরাও করে হত্যা করলে সবাই উল্লাস করে।

কোথায় এখন সিরাজ সিকদার – কাপুরুষের আস্ফালন  থেকে রং মেখে শুয়েছিল বেহাগের সুর শোনা যায়।

তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ আর সীতাকুণ্ড থেকে সাতক্ষীরা লাশ বিছাতে এখন আর বিদেশ থেকে হানাদার বাহিনীকে ডেকে আনা লাগেনা। দেশের ভেতরেই এখন ঘরে ঘরে হানাদার বাহিনী ঘরে ঘরে লাশ ফেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে আর সীমান্তে আছে ভারতের বিএসএফ। ভেতরে ভারতের দালাল সীমান্তে ভারতের ফৌজ।  এখন বাংলাদেশ আর সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা নেই। উত্তাল পদ্মার হাটু পানির নীচে লাখো কৃষকের লাশ পচেগলে মিশে গেছে সেই কোনকালে। ১৯৬৬-৭০ এর রপ্তানীকারক দেশ বাংলাদেশ এখন ইয়াবা পাচার করে যে টাকা আয় করে তা দিয়া বহুজাতীক কোম্পানী থেকে পন্য আমদানী করে খায়। আর পথে ঘাটে লাকী আক্তারকে দেখলে  — “রেট কত “? সেটা জেনে নেয়।

একটি পরাধীন দেশের মানুষেরা হয় দাস নয় বেশ্যা
হাতুড়ি, গুম, খুন, ধর্ষন, পথের মাঝে কাপড় খুলে নেওয়ার আলোকচিত্র প্রদর্শনী
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পাচার আর কার্বনে কালো করে ফ্যালে বনবাদাড়
কার্বন ফেসিয়াল দিয়ে রুপচর্চা করে ভারতের রাজ্যসরকার ভারতীয় প্লাস্টিকের বালতিতে পানি নিয়ে গোসল করে লাশ গোনে।

শুধু আমি বা লাকী আক্তার নয় – বাংলাদেশের সব দাসেরই রেট আছে।
রাজ্যসরকার থেকে সুরু করে দেশের সব পেশার জনগনেরই রেট আছে। সবার রেটের তালিকা প্রস্তুত করুন এবং তা প্রকাশ করুন ।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা।

২ thoughts on “প্রসঙ্গ – রেট কত ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *