৫৩তম পর্ব
বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম
১ম কিস্তি
অতীতের সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকবাদ বর্তমানে বিশ্বায়নের নামে এক নতুন রূপধারণ করেছে। এর জন্য শক্তিধর দেশগুলোর প্রণীত বিভিন্ন অসম চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য করা হচ্ছে পশ্চাদপদ অনুন্নত সদস্য দেশগুলোকে তাদের অনুগত জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। তাদের এই চক্রান্তের নাগপাশে দেশ ও জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার জন্য বিশ্বের অনুন্নত প্রতিটি দেশের তাদেরই সৃষ্ট সেবাদাস কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে।
তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য অগ্রগতিও ঘটানো হয়েছে তাদের এই চক্রান্তকে সফল করার জন্যই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই অগ্রগতির কোনো সুফলই সমভাবে ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে অতি সতর্কতা এবং কৌশলে অনুন্নত দেশগুলোর অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে।
তাদের চক্রান্তের ইস্পিত লক্ষ্য অর্জনে প্রচার মাধ্যম বিশেষ অবদান রাখছে। আধুনিকতার নামে নিজস্ব ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে মিথ্যা এবং ভ্রান্ত প্রচারণার মরীচিকার পেছনে ছুটে চলেছে তরুণ প্রজন্ম। একই সাথে সেবাদাসরা জনগণকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না তাদের সংঘাত, সংশয়, ত্রাস ও অমানবিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা সৃষ্টি করে ন্যূনতম বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বিভিন্ন নামের তত্ত্ব এবং গণতন্ত্রের নামে কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকার। শাসকগোষ্ঠী এবং সমাজপতিদের একটাই লক্ষ্য দেশের জনগোষ্ঠীকে তাদের মুখাপেক্ষী করে তুলে ক্ষমতার কুক্ষিগতকরণ।
এর জন্যই, গড়ে তোলা হয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অনুকূলে গণবিরোধী রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রশাসন, আইন বিভাগ এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। প্রণীত হয় দেশের সংবিধান প্রয়োজনে যার কাটছাঁট করা হয়ে থাকে তাদেরই স্বার্থে। যেকোনো অনুন্নত দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে জাতীয় ক্ষমতাশালী সেবাদাস এবং তাদের বিদেশী মোড়লদের হাতে। ফলে সঠিক তথ্য জনগণঅব্দি পৌছায় না। সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টাও হারিয়ে যায় মিথ্যা প্রচারণার দাপটে। এর ফলে সবচেয়ে মারাত্মক যে অবস্থার উদ্ভব হয়, তা হলো অপ্রতিহত মিথ্যার রাজত্ব।
বাংলাদেশে বর্তমানে ওয়েস্টমিনস্টারের আদলের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা চলছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘গণতন্ত্র‘ শব্দটির মানে হচ্ছে, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের সব সিদ্ধান্তে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের নিশ্চিতকরণ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করার কতগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন সহনশীলতা, ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সব দ্বন্দ্বের সমাধান যুক্তিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে করা, প্রশাসন এবং আইন বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ ভাবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ রাখা, সংঘাত কিংবা প্রতিহিংসা পরায়ণতা পরিহার করা, সর্বসম্মতি সাপেক্ষে গৃহীত সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার বাধ্যবাধকতা, সংবিধানে কোনও পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সরকারি এবং বিরোধী দলের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য সংসদে নিরসন করা অসম্ভব হলে গণভোটের মাধ্যমে সেই মতপার্থক্যের নিরসন করা, সর্বোপরি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করা, এইসমস্ত পূর্বশর্তগুলো যেসব সমাজে বর্তমান সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অবশ্যই সফল হবে।
কিন্তু এই পূর্বশর্তগুলো যে সমস্ত সমাজে অবর্তমান সেখানে স্বচ্ছ এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র কখনই কার্যকর হতে পারেনা।সেখানে গণতন্ত্রের নামে চলে স্বৈরাচার এবং সেটা ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় পরিবারতন্ত্রে।
জনাব উসলেন, প্রখ্যাত রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানীর রিসার্চে দেখা গেছে শক্তিশালী উন্নত দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি স্বচ্ছ এবং ক্রিয়াশীল। তাই সেখানে নির্যাতন ও দুর্নীতি নেই বললেই চলে। এর প্রধান কারণ হিসাবে জনাব উসলেন বলেছেন
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এবং তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাদপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মানে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। এই ব্যবধান রাজনীতিবিদদের মননশীলতায় প্রভাব ফেলে। উন্নত দেশগুলোতে সমাজপতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উপবিষ্ট রাজনীতিবিদরা বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠী যাতে আত্মমর্যাদার সাথে সার্বিকভাবে স্বচ্ছল জীবনযাত্রার মান ও অধিকার সুনিশ্চিত হয় সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পক্ষান্তরে, অনুন্নত দেশগুলোর সমাজপতি এবং রাজনীতিবিদরা জনসংখ্যার অতিক্ষুদ্র একটি অংশ হয়েও জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে তাদেরকে মূলত শাসককুলের দাসে পরিণত করে রাখে। জনগণের মেধা, উদ্যম, সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতাকে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে সুখী, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল জাতি এবং দেশ গড়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীস্বার্থে তাদের জীবনী শক্তিকে ব্যবহার করে ক্রমশ তাদের বোধশক্তিহীন নিস্তেজ জিন্দা লাশে পরিণত করে রাখার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে।
প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়, বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের সুখীই মনে করেন! স্তম্ভিত হতে হয় এই ধরনের বিবেক বর্জিত মিথ্যা প্রচারণায়!
বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই অভিজাত শ্রেণী থেকে আগত কবি-সাহিত্যিকরা ‘দারিদ্রকে খৃস্টের সম্মান’ দিয়ে থাকবেন। এই প্রেক্ষিতে একটি ঘটনা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। ঘটনাটি সাধারণ হলেও এর তাৎপর্যঅনুধাবন করা প্রয়োজন আমাদের সমাজের মোড়লদের চরিত্র এবং মন মানসিকতা বোঝার জন্য।
ছোটবেলায় দেখলাম, পাড়ার এক বহুল পরিচিত ধনাট্য ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে ভিক্ষে করতে এসেছেন সবাইকে হতবাক করে দিয়ে।
জানা গেলো, তিনি নিজেকে ‘ফকির’ ঘোষণা দিয়ে তাঁর সব ধনদৌলত, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার উত্তরসুরিদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে একটি থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছেন।
এতেই নাকি তিনি পরম ঐশ্বরিক সুখ অনুভব করছেন! নিজে ‘ফকির’ হলেন বটে, কিন্তু ধনসম্পদ রয়ে গেলও তাঁরই প্রজন্মের কাছে।
বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে গণতান্ত্রিক অধিকার। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও মিশে ছিলো গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রত্যাশা। কিন্তু বিদেশী শক্তিসমুহের সৃষ্ট পরভৃততথাকথিত সুশীল সমাজের মাথা এবং শাসকগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা গড়ে তোলা হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে। এই বৈপরীত্যের ফলেই আজঅব্দি নানা কৌশলে গণতন্ত্রের পূর্বশর্তগুলো পূরণ না করে জনগণকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের লেবাসে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার।
জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাসক-শোষকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে জোর মিথ্যা প্রচারণাও চালানো হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাতে রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের একই সাথে কোনো স্থান পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই জঘন্য অপপ্রচারের বরখেলাপে ঐতিহাসিক সত্য হলো, কালের আবর্তে প্রতিটি সভ্যতাকেই প্রভাবিত করেছে বা করছে ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। বিশ্বের অনেক উন্নত এবং অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশেই রাষ্ট্রধর্ম আছে এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলও আছে। আমাদের নিকটেই অবস্থিত গণতান্ত্রিক দেশ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। রাষ্ট্রধর্ম আছে ইংল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের মতো গণতান্ত্রিক দেশে।
এসব দেশের মানুয বাংলাদেশীদের মতোই ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু এদের মাঝে কাজ করে চলেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। যে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, সংবিধান এবং আইনসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের মূল্যবোধের ভিত্তিতে। আর বিশ্ব পরিসরে ধর্মবিশ্বাস হলো এখনো মানুষের মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস।উল্লেখিত এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎপ্রজন্মকে সঠিক মুক্তির পথের সন্ধানে।
বিশ্বায়নের দাপটে স্বকীয় ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ আজ বিলীয়মান প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীর। বিশেষ করে শোষণ এবং অপশাসন জীবন ব্যবস্থাকে এমন পর্যায় নিয়ে এসেছে যেখানে বাঁচার তাগিদে শাসক-শোষক গোষ্ঠীর মিথ্যাকেও সত্য হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণ। তাদের অপকর্মের বোঝা না বয়ে সাধারণ ভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সর্বক্ষেত্রে পশুশক্তির শাসনই আজ আইনি শাসন আমজনতার জন্য।
চারিদিকের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিটি দিনকে ক্রমেই অর্থহীন করে তুলছে বোদ্ধাজনদের কাছেও। এমন একটি দিন নেই যেদিন হৃদয় বিদারক, অমানবিক, অনৈতিক ঘটনা ঘটছে না। গুম, খুন, সহিংসতা, সংঘর্ষ, ধর্ষণ, জবর দখল, অন্যায়-অবিচার, মিথ্যাকহন, অপপ্রচার, ব্যভিচার, মাদকাসক্তিসহ এমন কোনো বর্বরতা নেই যা ঘটছে না অহরহ।
এই সমস্ত অঘটনের প্রণেতা সমাজের চিহ্নিত স্বল্পসংখ্যক মানুষ নামের অমানুষ। এরা এমনটি করতে পারছে কারণ তারা বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান। তাদের নেই কারো কাছে জবাবদিহিতার কোনোও দায়বদ্ধতা। এই সমস্ত লোমহর্ষক ঘটনাবলী নিরীহ দেশবাসীদের শুধু ভীত সন্ত্রস্তই করছে তা নয়, তাদের চেতনা ও বোধ শক্তিরও বিলুপ্তি ঘটাচ্ছে। ফলে প্রতিবাদী না হয়ে সব কিছুকেই নিয়তির বিধান হিসেবেই মেনে নেয়া হচ্ছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তার জন্য একদিকে জনগণকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে নাভিশ্বাস অবস্থায় দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন প্রতিরোধ সংগ্রাম সংগঠিত করতে না পারে।
এই স্বল্পসংখ্যক কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর একটাই লক্ষ্য, তা হচ্ছে সীমাহীন সম্পদ এবং বৈভব অর্জন। আর এর জন্যই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। একি সাথে তারা বিশেষভাবে সচেতন থাকে যাতে করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশাল জনগোষ্ঠী কোনক্রমেই অন্যায়-অবিচার ও তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে হক আদায়ের লক্ষ্যে কোনো প্রকার সংগ্রাম কিংবা আন্দোলন সংগঠিত করতে না পারে। অঙ্কুরেই তেমন কনওউদ্যোগকে বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার সাথে উপড়ে ফেলা হয় মিথ্যা প্রচারণার আড়ালে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
আদিকাল থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিলো মানুষের কল্যাণের জন্যই। তাদের জীবনধারণ করার প্রক্রিয়া সহজ ও নিরাপদ করে তোলার জন্য। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে আমরা কি দেখছি? লোভী, মুনাফাখোরী শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করছে সমাজ এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের অধিকারটাই হলো তাদের শোষণ ও অপশাসনের মূল হাতিয়ার। তাই বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ভাওতার আড়ালে সারা দুনিয়ায় সৃষ্টি করা হচ্ছে ত্রাসের রাজত্ব। কারণ, তারা জানে, ভীতসন্ত্রস্ত এবং যন্ত্রণাক্লিষ্ট জনগণ অতি সহজেই আত্মসমর্পণ করে।
মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী করি রবিন নিউইয়র্কের জ্যাকবিন সাহিত্য ম্যাগাজিনে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিয়ার, সিকিউরিটি এন্ড মডার্ন পলিটিক্স’ নিবন্ধে এইসব মুনাফাখোরদের সম্পর্কে একটি চমৎকারবর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন
এরা অনেকটাই আন্তর্জাতিক, নানাবর্ণে বিস্তৃত এবং একে অপরকে এই বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। এদের কাছে সবচেয়ে ফায়দা দায়ক উপাত্তটি হল ‘নিরাপত্তা’ কেন্দ্রিক। এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সমাজের নিরাপত্তা অথবা জাতীয় নিরাপত্তার নামে অভাবনীয় সব ঘটনা বিশ্বপরিসরে ঘটিয়ে চলেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের যেন কোনও অধিকারই বলবত না থাকে। তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ যেকোনো নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী হউক না কেনও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো‘নিরাপত্তার’ বিষয়টি তারাই নির্ধারণ করছে। এর সংজ্ঞা নিরুপণে জনগণ এমনকি বোদ্ধাজনদেরও কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারাই একতরফাভাবে ঠিক করছে কোন বক্তব্য কিংবা ঘটনা ‘নিরাপত্তার’ প্রতি হুমকি! জনগণ সেই সমস্ত বক্তব্য এবং ঘটনাকে হুমকি কিংবা বিপদজনক মনে করছে কিনা তাদের কাছে সেটা একেবারেই গৌণ এবং ধর্তব্যের বিষয় নয়। এই লোভী এবং স্বার্থপর মুনাফাখোররা কখনো শাসক রূপে কখনো তাদের দোসর হয়ে এই ‘নিরাপত্তার’ নামে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে জনজীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। করি রবিন এদের মানসিকতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আরও বলেছেন
এরা ‘নিরাপত্তা’ বলতে বোঝে তাদের শাসন ও শোষণের সুরক্ষিত স্থায়িত্ব। তাই তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যারাই সোচ্চার হবে বা প্রতিবাদী হবে তাদেরকেই চিহ্নিত করা হবে তাদের সংজ্ঞায়িত ‘নিরাপত্তার’ প্রতি হুমকি হিসাবে এবং এদের নির্মূল করার জন্য প্রয়োগ করা হয় রাষ্ট্রীয়, দলীয় এবং গোষ্ঠী সন্ত্রাস। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধারীরা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে প্রণীত করে উদ্ভট আইন কানুন। সাম্প্রতিক কালের খণ্ডিত সোভিয়েত ইউনিয়ন, রেজা শাহ পেহলভির ইরান, সাদ্দামের ইরাক, গাদ্দাফির লিবিয়া, মোবারকের মিশর, আসাদের সিরিয়া তার এই বিশ্লেষণের জ্বলন্ত উদাহরণ।
তবে তিনি বলেছেন
বাস্তবতার নিরিখে বিভিন্ন দেশে এই সন্ত্রাসের রূপ হয় ভিন্ন প্রকৃতির। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত দেশগুলোতে এই সন্ত্রাসের রূপ হয় ক্রূর এবং বর্বরোচিত যেমন, গুমখুন বা বহুল আলোচিত ‘এনকাউন্টারে’ বন্দী অবস্থায় বিরোধীদের হত্যা করা। অনেক সময় সংঘাত এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি করে নির্বিবাদে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। করি রবিন তার অনুসন্ধানে দেখিয়েছেন, এই ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে পৃথিবীব্যাপী নৈরাজ্য, ধ্বংস, বিনাশ ক্রমে বেড়েই চলেছে। এই মাত্রার ধ্বংসযজ্ঞের নজির মতাদর্শের ভিন্নতা এবং ধর্মীয় কারণে অতীতের মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন ড্যান এবং বার্নার্ড উইলিয়ামস বলেছেন
যেহেতু জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী মুনাফার জন্য এই ‘নিরাপত্তা’ বিষয়টি জনগণকে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার লক্ষ্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সবচেয়ে সহজপন্থা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। সুপরিকল্পিতভাবে বিদেশী প্রভুদের সাহায্যে প্রতিপক্ষকে ‘নিরাপত্তার’ হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের অতি নিষ্ঠুর ভাবে নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাধর স্থানীয় তল্পিবাহক দালালরা। প্রকাশ্যেই তারা ‘নির্মূল’ শব্দটি প্রচার করার ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করে। ‘নিরাপত্তার’ নামে অতিকৌশলে তারা লোমহর্ষক ত্রাস এবং ভীতির রাজত্ব কায়েম করে জনগণের মানবিক অধিকার হরণ ও প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে চলেছে যেই শুভংকরের ফাঁকিটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহজ সরল জনগণের পক্ষে ধরাটা সম্ভব হয় না। সবদেশেই জনগণের যেকোনো দাবি ভিত্তিক আন্দোলনের চরম পর্যায়েই এই হাতিয়ারটি বিশেষ বর্বরোচিত ভাবে ব্যবহার করা হয় শেষরক্ষার জন্য। যখন ক্ষমতাবানরা বুঝতে পারে জনগণ তাদের তথাকথিত দেশভক্তি মূলক খিস্তি-খেউড় আর ‘নিরাপত্তার’ কপচানো বুলিকে সন্দেহ করছে তখন তারা বিচারের প্রহসনের মাধ্যমেও প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয় তাদের সহচর এবং অনুগত বিচার বিভাগের সহায়তায়।
সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচারবিভাগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে যারা আপোষহীনভাবে সত্য, নৈতিকতা, মানবিক এবং সামাজিক অধিকারের জন্য কথা বলে, জানবাজি রেখে লড়ার মত চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করে তাঁদের ফাঁসির মঞ্চে চড়িয়ে, কারাগারে ‘ডেথ সেল’-এ দীর্ঘকাল নারকীয় মানবেতর পরিস্থিতিতে আধমরা করে ফেলে রেখে একদিকে ভীতির রাজ্য কায়েম এবং অন্যদিকে কায়েমী স্বার্থের পথের কাঁটা সরানোর এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে সর্বত্র।
বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরপরই মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকারের অঙ্গুলি হেলনে দেশদ্রোহী কাদের সিদ্দিকীর ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ সদস্যরা ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রকাশ্য দিবালোকে একইভাবে বাংলা এবং উর্দুভাষী শতশত বাংলাদেশী নাগরিককে দালাল অভিহিত করে বিনা বিচারে বেয়নেট দিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। দেশ-বিদেশের নামিদামি পত্র-পত্রিকায় এই বিভৎসহত্যাযজ্ঞের ছবিসহ প্রতিবাদী প্রতিবেদন লিখেছিলেন সাহসী সাংবাদিকরা। তাদের অনেককেই পরিণামে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। এ ধরণের বর্বরতায় সমর্থন দিয়ে একটি বীরের জাতির মুখে কালিমাই লেপন করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব।
২০১০ সালের ২৭/২৮ জানুয়ারি একদলীয় স্বৈরশাসন বিরোধী ঐতিহাসিক ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদেরকে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য অসাংবিধানিক ও বেআইনিভাবে সাজানো মামলার মাধ্যমে জাতির এবং বিশ্বজনমতের কোনও তোয়াক্কা না করেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বিরোধী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার মৌন সম্মতি সাপেক্ষে। এরপরও কি বলা যুক্তিসঙ্গত নয় যে মুজিব এবং হাসিনার মতো জেনারেল জিয়া এবং খালেদা জিয়াও ভারতের সাথে আঁতাতের মাধ্যমেই রাজনীতি করছেন। তবে অবশ্যই বলতে হবে পদলেহি হিসেবে বরাবরই যুক্তিসঙ্গত কারণেই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছেন মুজিব ও হাসিনা।
এর আগের বছর ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি প্রত্যক্ষ সরকারী চক্রান্তের ফলে ঘটে তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের নাটক যার ফলে ঐতিহ্যধারী এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই সশস্ত্র বাহিনীটিকে বিলুপ্তই করা হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের নিযুক্ত আইও অবসরপ্রাপ্ত এএসপিআখন্দ এবং সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করেই আরও কয়টা বিচারের সাজানো নাটকের মাধ্যমে ভারতের পালিত এবং পদলেহি হাসিনা সরকার ভারতের স্বার্থেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে শত শত বিডিআর সৈনিককে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয় অসংখ্য বিডিআরসৈনিককে। এর জের ধরে সেনাবাহিনীতে ত্রাস সৃষ্টি করে সেনা সদস্যদের সচেতনাকে অবচেতন করে ফেলার লক্ষ্যে এবং প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য চাকুরিচ্যুত করা হয় বিবেকবান বিভিন্ন র্যাং কের প্রায় ২০০ অফিসারকে।
জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিন, জায়েরের মবুতু, ইরানের শাহ্, ইরাকের সাদ্দাম, মিশরের হোসনি মোবারক, সিরিয়ার আসাদ প্রমুখ স্বৈরশাসকরা একই নীতি প্রয়োগ করেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। সংবাদ মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন বিভাগ, শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন করে সব স্বৈরশাসক তা সে যে লেবাসেই হউক না কেনো তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে প্রচার মাধ্যম, বিচার বিভাগ, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রতিরক্ষা ও শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর গোষ্ঠীস্বার্থে অপপ্রয়োগের ধারাবাহিকতায়।
ক্ষমতাসীনরা অতি সহজেই তাদের সব বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডকে বৈধ করে নেয় তাদেরই প্রণীত সংবিধান এবং পদানত আইন বিভাগের মাধ্যমে।
এ ভাবেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সর্বযুগেই সম্ভব হয়ে এসেছে সব অন্যায়, সংঘর্ষ এবং অরাজকতার দায় প্রতিপক্ষের উপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বিবাদে তাদের স্বার্থ হাসিল করা। এই ঘৃণ্য কারসাজির ফলেই বর্তমান পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা এবং সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে সক্ষম হচ্ছে।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ ঘটলেও এখনও ক্ষমতাধর শাসকশোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুরতা লাগামহীন ভাবে বেড়েই চলেছে বিশ্বজুড়ে।
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ এবং বধির করে তোলে। ইতিহাস থেকেও ক্ষমতাবানরা শিক্ষাগ্রহণ করে না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, সেই সত্যটাকেও অস্বীকার করে থাকে তারা। তাই ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে ক্ষমতাবানরা থাকে নির্লিপ্ত। বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষমতাবানরা মুখে স্বৈরচারের বিরুদ্ধে যতই খিস্তি-খেউড়ই করুক না কেনও অন্তরে তারা সবাই স্বৈরচারের পূজারী। একেই বোধকরি প্রবাদে বলা হয়, ‘চোরের মার বড় গলা’।
উল্লেখিত বিষয়গুলোর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন মার্কিন সহকারি অর্থমন্ত্রী পল ক্রেইগ রবার্টস। তার প্রতিবেদনটি যদিও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে লেখা তবুও তার প্রতিবেদন বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য তাৎপর্যবহন করে।তিনি লিখেছেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের কি কনও ভবিষ্যৎআছে? এমনটি তিনি লিখেছিলেন কয়েকজন সত্য কথকদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে। তিনি লেখেন
যারা উইকিলিক্স এর মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় মার্কিন অপকর্মের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয় এদের উপর পরিণামে অত্যাচারের যে খড়গ নেমে আসে তা অকল্পনীয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের বিশ্বস্তজনদের কেউও যদি কোনো সত্য বলেন তাকেও ছাড় দেয়া হয় না। যেমন মেজর জেনারেল আন্তনিয় তাগুবার কথাই ধরা যাক। বিশ্ব সমালোচনার প্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো আবু গ্রাইব জেলে কয়েদীদের উপর অত্যাচার করা হয় কিনা সেই বিষয়ে তদন্ত করে মার্কিন সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করার। সরকার আশা করেছিলো জেনারেল হিসেবে তিনি সেখানে ঘটিত সব অপকর্মের কাহিনী চেপে যাবেন। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ জেনারেল তাগুবা একটি চমৎকারবস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট দেন। রবার্টস অনুশোচনা করে লিখেছেন, এমন ভালো কাজের জন্য তাগুবাকে পদোন্নতি না দিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমনটি বর্তমানে অহরহ ঘটছে। এভাবে প্রতিভাবান মানব সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ধরনের সত্যকহনে মানবতা ও রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। কারণ, মানব সম্পদ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য বলতে অভ্যস্ত। রবার্টস আরও লিখেছেন
এই ধরণের অনৈতিক আচরণের ফলে সব সরকারের আমলেই সত্য বলার লোক কমে যাচ্ছে। কারণ, সত্য বললে পদ, যোগাযোগ, সামাজিক জীবন এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। আল জাজিরার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, এর শুরু হয়েছিলো সত্যকহনের মাধ্যমে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যে সমস্ত গল্প ফাঁদে সেগুলোর অসত্যতা উন্মোচিত করার লক্ষ্যে। দেখা গেলো অতি অল্পসময়ে সেই দেশের সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তল্পিবাহক সরকারগুলো আল জাজিরাকে ধমকাচ্ছে, সেন্সর করছে এবং এক পর্যায়ে এর কাবুল ও বাগদাদের দফতরে হামলা চালানো হয় এবং তাদের সাংবাদিকদের টার্গেট কিলিং-এর মাধ্যমে হত্যা করা হতে থাকে। এ ভাবেই আল জাজিরাকে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিকৃতিকে অনুসরণ করে চলতে বাধ্য করা হয়েছিলো। রবার্টস তার প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, কেমন ভাবে সত্য অনুসন্ধানী তথ্যভিত্তিক রিপোর্টগুলো সরকার বস্তাবন্দী করে অনাচারের রাজ্য কায়েম রাখে। তিনি আর একটা উদাহরণ দিয়েছেন।
যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করার জন্য মামলা করা হয়, তখন দেখা যায় এই চ্যারিটিটি ইউএসএইডএবং জাতিসংঘের অনুমোদিত হয়েই মানবিক কারণে প্যালেস্টাইনের দুস্থ মানুষের সাহায্য করছে, এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টেরও সম্মতি ছিলো সেই কর্মকাণ্ডে। তাই প্রথম বারের মামলায় সরকার পক্ষ হেরে যায়। ইসরাইলের চাপে মামলাটি পুনরায় আদালতে উত্থাপন করা হয়। এবার কোর্ট এই সংস্থার বিরুদ্ধে গোপন এবং অজ্ঞাত এক বিশেষ ব্যক্তির ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের অভিমত’ গ্রহণ করার অনুমোদন দিলো। একইসাথে কোর্ট রায় দিলো, সেই ‘বিজ্ঞ ব্যক্তি’কে কোর্টের সামনে পেশ হতে হবে না! তেমনই একজন ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের’ জমাকৃত ‘সাক্ষ্য প্রমাণের’ ভিত্তিতে কোর্ট হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেবার হুকুম জারি করে। রবার্টস লিখেছেন, এভাবেই মানবিক উদ্যোগের মৃত্যু ঘটিয়ে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীস্বার্থে মিথ্যা বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা হলো।
এই চিত্রগুলো যেন একান্তভাবে বাংলাদেশেরই নিজস্ব ঘটনাসমূহ, হিসাবেই প্রতিফলিত হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে! বিশেষভাবে নির্বাহী সরকারের পদানত আইন বিভাগের শোচনীয় অবয়ব বাংলাদেশে জন্মলগ্ন থেকেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত। আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গভর্নমেন্ট এন্ড পলিটিক্স’-এর অধ্যাপক এরিক এম উসলেনার তার এক রিসার্চ পেপারে দেখিয়েছেন
আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের ব্যাপক অপব্যবহারে শুধুই স্বৈরাচারের জন্ম হচ্ছে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে। এই স্বৈরশাসন শুধু দুর্নীতি এবং তার থেকে সৃষ্ট পেশিশক্তির উপর নির্ভরশীল। দুর্নীতিমুক্ত গণতন্ত্রে স্বৈরাচার, অসাধু ও পক্ষপাতপুষ্ট বিচার বিভাগ, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, পরাধীন, বিশৃঙ্খল সংবাদ মাধ্যম এবং নির্বাচন ব্যবস্থা থাকতে পারে না। উসলেনার আরও দেখিয়েছেন, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে কখনোই দুর্নীতিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তিনি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য দুইটি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক মানসিকতা, ব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। যখনই নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবহার থেকে সরে এসে স্বৈরচারী শাসন পদ্ধতির আশ্রয় নেয় তখনই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। তখনই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পর্যায়ে দুর্নীতিসহ নানা রকম অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের উদ্ভাবন ঘটে। শুরু হয় ত্রাসের রাজত্ব এবং সংঘাত। উসলেনার অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, সত্যিকার অর্থে স্বৈরাচারের চেয়ে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার অধিক ভয়াবহ। এর প্রধান কারণ হলো, গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণের পরমুহূর্তেই বিচার বিভাগ এবং প্রচার মাধ্যমকে কুক্ষিগত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলে। ফলে আইন বিভাগের পক্ষে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনোও আইনী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না। গ্রহণকরলেও আদালতের রায় কার্যকর করা হয় না। এমনকি অসহায় বিচার বিভাগের সহায়তায় আইনী ফাঁক-ফোকরের মাধ্যমে অনায়াসে সাজাপ্রাপ্ত ক্রিমিনালদের সাজাও মওকুফ করিয়ে নেয় ক্ষমতাসীনরা।এ ভাবেই অন্যায় অবিচারের ক্যান্সার ছড়িয়ে দেয়া হয় রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণতন্ত্রের খোলসে। উসলেনার তার অনুসন্ধান মূলক প্রতিবেদনের উপসংহারে লিখেছেন
শুধু একটিমাত্র উপায়েই দুর্নীতিসহ সব অন্যায়, অনাচার, অপশাসন এবং সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে, যদি রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে সমভাবে দেখে। সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব হলেও এইসব অনাচার এবং দুর্নীতির মূল উৎপাটনসম্ভব নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি একদা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার বোতসোয়ানা রাষ্ট্রের উল্লেখ করে বলেন, জাতীয় নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা এবং কঠোর নীত-আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত করার ফলে দেশ দু’টি স্বাধীনতার পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দুর্নীতিমুক্ত হয়ে বর্তমানের উন্নত বিশ্বের কাছে অভূতপূর্ব বিস্ময়কর আদর্শ রাষ্ট্রের নিদর্শন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। উসলেনারের মতে, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হচ্ছেরাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার চর্চা করতে হবে।
উসলেনারের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চলমান অবস্থার দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়গণতন্ত্রের কি করুণ হাল। জনগণের সমঅধিকার এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার কোনোও তোয়াক্কা না করে দেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের মাথা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেরক্রিয়ানকগণ শুধুমাত্র ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, দলীয় স্বার্থে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন স্লোগানের ঢালের আড়ালে যেভাবে ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় পালাবদলের রাজনীতির বেসাতি করে চলেছে তাতে জিঘাংসা পরায়ণ সহিংস সঙ্ঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে জাতি জীবনীশক্তি হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়ছে। এ ভাবেই সময়ে দেশ এবং জাতিকে পরিণত হতে হবে বলির পাঁঠায়। ক্ষমতাবানদের এই বিষয়ে কোনোই ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো ক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ। এর জন্য শেষ অস্ত্র হিসাবে তারা ঘৃণাকেও ব্যবহার করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে কুণ্ঠিত হয় না। কারণ, যুগে যুগে এই ঘৃণাকে ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক উন্মাদনা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাটা সেন্টার ফর ননভায়োলেন্স’-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাইকেল নেগলার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন
ঘৃণা সম্মোহনী উন্মাদনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি প্রচণ্ড শক্তি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবেএই ঘৃণাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেও ভেতর থেকেই ধ্বংস করেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান বিশ্বের মুনাফাখোর ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী একজোটে তাৎক্ষণিকফায়দার জন্য এই ঘৃণাকেই অতি অমানবিক ভাবে ব্যবহার করছে মাত্রা ছাড়িয়ে। প্রাচীন গ্রীকপ্রবাদ এখন সবাই ভুলতে চাইছে, ‘কোনো সাম্রাজ্য বা শক্তি যদি তাদের শেষ সময়ে পৌছায় তখন সবাই পাগল হয়ে যায়। গোষ্ঠীগতভাবে ক্ষমতাবানরা এই পাগলামিতে মাতলে সাধারণ জনগোষ্ঠী ভুক্তভোগী হয় ঠিকই, কিন্তু প্রাকৃতিক বিধানে ক্ষমতাবানদের পতন অবধারিত হয়ে ওঠে।’
দার্শনিক এবং সমাজবিজ্ঞানীরা অভিমত পোষণ করেন,ধর্ম, গোত্র, এবং ভাষা এই তিনটি স্পর্শকাতর বিষয়কে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হলে যেকোনো রাষ্ট্র এবং জাতিকে দিতে হয় চরম মূল্য। কারণ, যেকোনো দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাস করে বহু জাতি, বিভিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী। সেইক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয়কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলে জাতীয় ঐক্যের বিপরীতে বিভাজনই সৃষ্টি হয়। জাতীয় ঐক্য ছাড়া কনও দেশ বা জাতি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থায়ী হয়ে প্রগতির পথে কখনোই এগুতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই তিনটি বিষয়কে মূলধন করেই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার জন্য ব্যবহার করে চলেছে যার পরিণতিতে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্ন ভিত্তিক যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিলো সেই ঐক্যকে নস্যাৎকরে জাতিকে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। এই বিভক্তির ফলেই ক্রমান্বয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভূরাজনৈতিকভাবে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থটাই মুখ্য। অপসংস্কৃতির রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দেশ ও জাতি আজ এসে পৌঁছেছে এক অনিশ্চিত ঘোর অমানিশার দ্বারপ্রান্তে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং মা-বোনদের ইজ্জতের আহূতির ফলে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্ন, স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আজঅব্দি কেনও বাস্তবায়িত হলো না, সেই কারণগুলো ইতিহাসের আলোকেই অনুসন্ধান করতে হবে চেতনাকে শাণিত করার জন্য। নতুবা তারুণ্যের আবেগ সাহসিকতায় জ্বলে ওঠা স্ফুলিঙ্গ আলেয়ার মতই সাময়িকভাবে প্রজ্বলিত হয়ে মিলিয়ে যাবে ব্যর্থতার অন্ধকারে কিংবা ছিনতাই হয়ে যাবে ক্ষমতাসীনদের হাতের মুঠোয়। রাজনৈতিক ধারায় গণজোয়ার, আন্দোলন কিংবা গণবিস্ফোরণ কখনোই সফলতার মুখ দেখতে পারে না যদি সেটা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং নীতি-আদর্শ ভিত্তিক না হয়।
অধুনা ঘটে যাওয়া ‘শাহবাগ মঞ্চের’ ঘটনাবলীর কিছুটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলেই অতি সহজেই বোঝা যাবে কি করে ধূর্ত শৃগালের মতো কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তারুণ্যের আবেগ, রোমাঞ্চ, সাহস ও তাদের উদ্যমকে ব্যবহার করে থাকে নিজেদের স্বার্থে তরুণ প্রজন্মের অজান্তেই।
বাপ্পাদিত্য, থাবা বাবা, ইকবাল, রাজিব নামের কয়েকজন ব্লগারের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগ চত্বরে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এক জমায়েত ঘটে। দৃশ্যটির সাথে চারদলীয় ঐক্য জোটের বিরুদ্ধে ম.খা. আলমগীরের নেতৃত্বে পেশাজীবী আমলাদের নিয়ে সংগঠিত ‘জনতার মঞ্চ’ এর কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও উদ্দেশ্যের দিক থেকে ছিলো ভিন্ন। শাহবাগ থেকে দাবি ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার প্রতি আদালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় তারা মানবে না, তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। দাবিটি যুক্তিসঙ্গত না হলেও স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই স্বাধীনতার পর থেকেই প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে এসেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীর সেই ন্যায়সঙ্গত দাবিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি আত্মসমর্পণকারী পাকহানাদার বাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৭ হাজার পরাজিত সেনাসদস্য ও তাদের দোসরদের ‘সিমলা চুক্তি’ মোতাবেক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে তুলে দিয়ে গর্বের সাথে দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে জানান দিলেন বীরের জাতি হিসাবে ক্ষমা প্রদর্শনের মতো উদারতাও বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে।’ দেশের জনগণ তার সেই দম্ভোক্তিতে দুঃখিত হলেও তার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ ওঠেনি। এরপর, তিনি এক সাধারণ ক্ষমার আইন জারি করে সব যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেন। যুক্তি হিসাবে বলা হলো, ‘জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে অতীতের সব তিক্ততা, বিভেদ ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে হবে’। তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি সেই সময়। অদৃষ্টের পরিহাস! বর্তমানে তারই সুপুত্রী হাসিনা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসীন হয়েই তার পিতার যুক্তি খণ্ডিত করে ১৯৯৬ সালে তার মিত্র দল জামায়াত-এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দণ্ডিত করে বিশ্বপরিসরে দেশবাসীর মুখে কালিমা লেপন করে দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জাতীয় ঐক্য নস্যাৎকরছেন কার স্বার্থে? ফিরে চলি শাহবাগ চত্বরে।
শাহবাগ চত্বর আমাকে মনে করিয়ে দেয় একটানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মৌন গণজমায়েত হচ্ছিলো লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারের পাশেই অবস্থিত সাউথ আফ্রিকা ভবনের সামনে নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি এবং এপারথেইড বা বর্ণবাদের অবসানের দাবিতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষেসেই ঘটনার কথা। আমিও নিম্মিকে সাথে নিয়ে যখনই লন্ডন গিয়েছি তখন উপস্থিত হতাম আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে। দু’একবার আমাদের শিশু কন্যা সস্তিকেও নিয়ে গেছি। তার কচি মনে জেগে ওঠা প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমাকে বোঝাতে হয়েছে ঐ গণজমায়েতের তাৎপর্য।শীত, বরফগলা বৃষ্টি, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে এই গণজমায়েত চলেছিল দীর্ঘ ৩৫ বছর। রোবেন আইল্যান্ড ও পলস্মুর কারাগারে ২৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড কাটিয়ে ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পান বিশ্ব মানবতার চাপে। ১৯৯৪ সালে সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে। ট্রাফালগার স্কোয়ারের মৌন গণজমায়েতেরও অবসান ঘটেছিলো লক্ষ্য অর্জিত হবার পর।
পক্ষান্তরে, শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যদিও সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিলো লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ী ফিরবে না। কিন্তু তারা লক্ষ্য অর্জনের আগেই বাড়ি ফিরে যায়। শুধু তাই নয়, মাত্র ১৭ দিন ফাঁসির দাবির আন্দোলন করে বাড়ি ফেরার আগে নেতারা যে ৬টি দাবি পেশ করে সেখানে ফাঁসির দাবীটিই রহস্যজনক ভাবে বাদ দেয়া হয়।
ট্রাফালগারের আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলো জানা দরকার।
১। আন্দোলনটি ছিলো নির্যাতনকারী একটি ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে।
২। একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী নেতার মুক্তির জন্য।
৩। ঘৃণিত বর্ণবাদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য।
এই সমস্ত দাবিগুলোর ভিত্তি ছিলো নৈতিক এবং মানবিক। তাই বিজয়ের সাথে আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিলো।
সূচীপত্র [প্রতিটি পর্বে্র নীচে ক্লিক করলেই সেই পর্বটি পাঠ করতে পারবেন]
১ম পর্ব “জিয়া থেকে খালেদা তারপর” – লেখকের কথা
২য় পর্ব শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানীর সাথে শেষ সাক্ষাত
৪র্থ পর্ব – কিছু বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের জবাব
৭ম পর্ব – বঙ্গভবনে কি হচ্ছিল রাত ১২ টায়!
৮ম পর্ব – বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হলো জেনারেল জিয়াকে
৯বম পর্ব – “সংঘর্ষের পথে জিয়া”
১০ম পর্ব – খন্দকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে এলেন সাদ্রে ইস্পাহানী
১১তম পর্ব – শিশু ভাই এলেন ব্যাংককে
১৩তম পর্ব ১ম কিস্তি – রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
১৩তম পর্ব – ২য় কিস্তি- রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
১৪তম পর্ব – বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জমির এলেন সস্ত্রীক
১৬তম পর্ব – শিশুভাইকে বেনগাজীতে আসার অনুরোধ
১৭তম পর্ব – ১ম কিস্তি – জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে
১৮তম পর্ব – বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস
১৯তম পর্ব – জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক
২০তম পর্ব – লন্ডন হয়ে ফিরলাম বেনগাজীতে
২১তম পর্ব – ঢাকা হোয়ে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা
২২তম পর্ব – বাংলাদেশে নীতি বিবর্জিত কুটুম্বিতার রাজনীতির রূপ
২৩তম পর্ব – জিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে
২৪তম পর্ব – রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়ার গণচীনে দ্বিতীয় সফর
২৫তম পর্ব – আব্বার উপস্থিতিতে প্রথম রাতে জেনারেল জিয়ার সাথে আমার বৈঠক
২৭তম পর্ব – জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চীন সফর
২৮তম পর্ব – চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিক্রিয়া
২৯তম পর্ব – চীন থেকে লন্ডনে নির্বাসন কালে
৩০তম পর্ব – জেনারেল মঞ্জুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল
৩১তম পর্ব – নিউইয়র্কের পথে জেনারেল এরশাদের সাথে লন্ডনে সাক্ষাৎ
৩২তম পর্ব – খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ার পার্সন
৩৩তম পর্ব – জেনারেল এরশাদের প্ররোচনায় রশিদ-ফারুক বানালো ফ্রিডম পার্টি
৩৪তম পর্ব – ১ম কিস্তি – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ-শেষ কিস্তি
৩৫তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান – ১ম কিস্তি
৩৬তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান – শেষ কিস্তি পেশাওয়ারের পথে
৩৭তম পর্ব – ফিরে এলাম নাইরোবিতে
৩৮তম পর্ব – নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে যাত্রা
৪০তম পর্ব – ১ম কিস্তি – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ
৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ – ২য় কিস্তি
৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ- শেষ কিস্তি
৪১তম পর্ব – রুহানী জগতের আর এক সূফি সাধকের সান্নিধ্যে
৪২তম পর্ব – আমাকে আবার খালেদা জিয়ার জরুরী তলব
৪৩তম পর্ব – ব্যাংকক ট্রানজিট লাউঞ্জে
৪৪তম পর্ব – হংকং হয়ে বেইজিং – ১ম কিস্তি
৪৪তম পর্ব – হংকং হয়ে বেইজিং – শেষ কিস্তি
৪৫তম পর্ব – হংকং হয়ে ফিরলাম ঢাকায়
৪৮তম পর্ব – নাইরোবিতে প্রত্যাবর্তন
৫১তম পর্ব – ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ
৫২তম পর্ব – দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়াতের
প্রতিক্রিয়া
৫২তম পর্ব -দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়েতের
প্রতিক্রিয়া – শেষ কিস্তি
৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – ১ম কিস্তি
৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – শেষ কিস্তি