জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম

৫০তম পর্ব

নিরুদ্দেশে যাত্রা

নির্বাচনের সরকারি ফলাফল প্রকাশের পরই বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেলাম, ক্ষমতায় আসীন হয়েই হাসিনা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য সফল আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করবেন যে ভাবেই হউক না কেন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তাই আমি এবং আরও কয়েকজন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হই পরিবার পরিজনদের দেশে রেখেই অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করে সরকার গঠনের পরপরই শেখ হাসিনা সংসদে একটি সাধারন বিল উত্থাপন করে সাংগঠনিক বিধি লঙ্ঘন করে দুই-তৃতীয়াংশের পরিবর্তে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পঞ্চম সংশোধনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি বাতিল করিয়ে নিলেন বেআইনি ভাবে। বিলটি যখন পাশ করানো হয় তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার জোটের সদস্যরা এর প্রতিবাদে টু শব্দটি না করে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলেন। ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং’ প্রমাণিত হওয়ার পরই হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রয়াত শেখ মুজিবের একজন একান্ত সচিব মোহিতুল ইসলামের দ্বারা ১৫ই আগস্ট সফল সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে ধানমণ্ডি থানায় একটি জিডি দারিজ করিয়েগোলাম রসুলের জজকোর্টে ‘মুজিব হত্যা’ নামে একটা সাধারণ ক্রিমিনাল খুনের মামলা শুরু করে দেয়া হয়।
ঐ মামলায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং জেনারেল জিয়াউর রাহমান ছিলেন যথাক্রমে ১নংএবং ২নং আসামী। নুরুল ইসলাম মনজু সহ অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সব সামরিক অফিসার যারা বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছিলো অথবা দেশে কিংবা বিদেশে এবং সেনা পরিষদের বিপ্লবী কয়েকজন JCO এবং NCO কে আসামী করা হয়। জারি করা হয় সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা।
একই সাথে, লালবাগ থানায় দারিজ করানো একটি জিডির ভিত্তিতে ‘জেল হত্যা’ নামে আর একটি বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
এই মামলাতেও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, প্রয়াত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সহ আগস্ট বিপ্লবের সব শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়।
অতি ক্ষিপ্রতার সাথে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্টও জারি করাতে সক্ষম হয় হাসিনা সরকার।
সব কিছুই ঘটছিলো অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে।
পরবর্তীে সময়ে মৃত বিবেচনায় খোন্দকার মোশতাক আহমদ ওপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আসামীদের এই লিস্ট দুটো থেকে বাদ দেয়া হয়।
ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের প্রহসনের পর শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য নিয়োজিত বিচারক গোপালগঞ্জের গোলাম রসুল দম্ভভরে উদ্ভট রায় দিলো,
‘আসামীদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারতে হবে’ যদিও পিনাল কোডে এমন কোনো বিধান নেই। খালেদা জিয়ার জোট এই ধরনের রায়ের পরও নিশ্চুপ থাকে।

নির্বাচনের দিন বিকালেই বিএনপির ভরাডুবি অনুধাবন করে মেজর হুদা তার নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকা ফেরত আসে এবং দেশত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে ব্যাংকক আগমন করে। আমি হুদার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বলি, ব্যাংকক তার জন্য মোটেও নিরাপদ স্থান নয়, সুতরাং দ্রুত তাকে ব্যাংকক ত্যাগ করতে হবে’। জবাবে হুদা বলেছিলো,ব্যাংককে কিছু কাজ আছে। শেষ হলেই সে ব্যাংকক ছাড়বে। হুদা ব্যাংকক পৌঁছানোর পরপরই বাংলাদেশ দূতাবাসের বিএনপি পন্থী রাষ্ট্রদূত জুলমত আলী খান তার বাসায় হুদাকে নিমন্ত্রণ করেন। অতীতে হুদা জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ছিলো বিধায় অনেকের কাছেই হুদা ছিলো পরিচিত মুখ।
সম্ভবত রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকেই হুদার ব্যাংকক অবস্থানের কথা জানাজানি হয়ে যায়।
কোনও এক অজানা কারণে হুদারও ব্যাংকক ছাড়তে দেরী হয়ে যায়। সবই নিয়তি!
ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আমলারা হুদাকে অনুসরণ করতে থাকে।
এক বৃষ্টির দিনে একটি দোকানের মধ্যে একটি নাটক সাজিয়ে হুদাকে ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করা হয়।
টাকা-পয়সা খরচ করতে পারলে ব্যাংককের মতো জায়গায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। সে দিনটি ছিল শুক্রবার।
শনি-রবি সাপ্তাহিক বন্ধ বিধায় হুদাকে দুইদিন দিটেনশন সেন্টারে কাটাতে হয়।সোমবার তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ব্যাংকক পুলিশ হুদাকে ছেড়ে দেয়।
হুদা হোটেলে এসে জানতে পারে তার পাসপোর্ট দূতাবাসের কর্নেল হানিফ ইকবাল নামেরএক প্রভাবশালী কর্মকর্তা (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসার) বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গেছে।
কর্নেল হানিফ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তৎপর হয়ে হুদাকে তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে হুদাকে বন্দী অবস্থায় ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় ব্যাংকক পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
হুদার ছোটবোন প্রয়াত রাষ্ট্রদূত কর্নেল পাশার স্ত্রী জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে ছিলো সেই সময়।
হুদার কনও খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন বোন রেডক্রসে জরুরী ই-মেল পাঠালে ব্যাংককের রেডক্রস অফিস হুদার বোনের ইমেলটি ব্যাংককে অবস্থিত UNHCR কে প্রদান করে। এ ভাবেই এই কেসের সাথে UNHCR জড়িত হয়ে পড়ায় প্রায় আড়াই বছর হাসিনা সরকার তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও হুদাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। পরে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সরকার থাইল্যান্ড সরকারের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি করে। বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরই হুদাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় থাইল্যান্ড সরকার।

সংবিধান লঙ্ঘন করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি বিল পাশ করিয়ে এই দুইটি ক্রিমিনাল খুনের মামলা দায়ের করা হয়। বিচার দুইটি শুরু করার প্রক্রিয়ায় আইনি বৈধতার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, কোনও সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বিচারের নজির দুনিয়ার কনও দশেই নেই। কনও ব্যর্থ অভ্যুথানেও যেখানে চাকুরিরত অফিসার কিংবা সৈনিক জড়িত থাকে তাদের বিচার করা সম্ভব একমাত্র সামরিক আইনের আওতায় কোর্টমার্শালের মাধ্যমে, বেসামরিক আইনী আদালতের মাধ্যমে নয়।
এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর একটি ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তার ফুফা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে কন্ট্রাক্ট বেসিসে সেনাপ্রধান বানিয়ে তার মাধ্যমে সেনাসদর থেকে একটি সনদ জারি করিয়ে নেন যাতে বলা হয়, বর্তমান সরকার ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামক যে দুইটি বিচার কার্যকর বেসামরিক আদালতে শুরু করেছে তার সাথে চাকুরিতে বহালরত সেনাঅফিসার এবং সৈনিকরা জড়িত থাকলেও সেই বিচার প্রক্রিয়ার পথে কোনও প্রতিবন্ধকতা সেনাসদরের তরফ থেকে নেই।
ইতিমধ্যে মুজিব হত্যা মামলা শুরু করিয়ে দেয়া হয়েছে, আমাদের নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট।
মেজর হুদার এই পরিণতিতে আমরা সবাই ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিলো না।সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যারা তখনও কূটনৈতিক হিসাবে চাকুরিতে বহাল রয়েছে তাদের সবাইকে চাকুরীরত অবস্থাতেই গোপনে যার যার সুবিধা মতো নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে নিতে হবে কালবিলম্ব না করে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরার নির্দেশ আসার আগেই। বাহ্যিকভাবে প্রত্যেকেই দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে চলবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। ফেরত যাবার ডাক এলে মিশনের সবাইকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে দেশেই ফিরে যাচ্ছে সবাই। প্রস্তুতিও নিতে হবে সেইভাবেই প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যাতে করে কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সব নিয়ম মেনেই প্রত্যেককে কর্মস্থল ত্যাগ করে পথিমধ্যে পাড়ি জমাতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে পরিকল্পনার পথে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়।
হুদার দুর্ভাগ্যজনক পরিণামের বিষয়টিও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হলো। হাসিনা সরকার এবং ভারতীয় RAW-এর জালে আটকে পড়ায় হুদার পক্ষে ব্যাংকক থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।

কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিনকে(যে বন্দী জিয়াকে ৭ই নভেম্বর মুক্ত করেছিল) আরও অনেকের সাথে বন্দী করে কারাগারের কন্ডেম সেলে নিক্ষিপ্ত করা হলো বেআইনি ভাবে।

প্রায় আড়াই বছর যাবত আপ্রাণ চেষ্টা ও মিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৯৯৮ সালের ৮ই নভেম্বর প্রহসনের বিচারের প্রহসনের রায় দেয়ার দিন সকালে ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নোংরা কৌশলের মাধ্যমে হুদাকে থাই কর্তৃপক্ষের নিকট হতে নিজেদের হেফাজতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত নিয়ে আসে।
মেজর হুদাকেও দেশে ফিরিয়ে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো কন্ডেম সেলে। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদেরকেই রাখা হয় জেল কোড অনুযায়ী কন্ডেম সেলে।
উচ্চ আদালত তাদের বেইল পিটিশন নাকচ করে দিলেও রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে তাদের ক্লাস দেবার রায় দিয়েছিলেন।
কিন্তু জিঘাংসা পরায়ণ অগ্নিশর্মা হাসিনার রোষ থেকে বাঁচার তাগিদে প্রশাসন এবং জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের সেই রায় বাস্তবায়িত করা থেকে বিরত থাকে শেষদিন পর্যন্ত।
নির্বাহী সরকারের প্রশাসন কর্তৃক আদালতের রায় কার্যকরী না করা স্বাধীন বিচার বিভাগের পরাধীনতারই চরম বহিঃপ্রকাশ!

বৈপ্লবিক জীবনের উত্থান-পতনের এক চরম দৃষ্টান্ত!
দীর্ঘ তিনদশক পার হবার পরও ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সব শীর্ষস্থানীয় নেতারাই হাসিনার সৌজন্যে ‘খুনের আসামী’ হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায়!
কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই! জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বজাধারী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত জোট কনও প্রতিবাদ কিংবা উচ্চবাচ্য না করে নিশ্চুপ হয়ে ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের প্রহসন দেখছিলো।
সত্যিই বিচিত্র এইসব দল, তাদের নীতি-আদর্শ এবং দলীয় নেতৃত্বের চরম মোনাফেকি এবং সুবিধাবাদিতা! রাজনীতি। তাদের জন্য রাজনীতি শুধুই ধর্মপ্রাণ নিরীহ জনগণকে চটকদার কথায় ভুলিয়ে নিজেদের স্বার্থ এবং ভাগ্য উন্নয়নের পন্থা মাত্র।

বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলো, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের যূপকাষ্ঠের নিগড় থেকে নিজেদের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছিলো মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং বাক স্বাধীনতা, যারা যুদ্ধকালীন সময় থেকেই একনিষ্ঠ নিরলস সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলো স্বাধীনতার পর জনগণের মনে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গড়ে তুলতে প্রগতিশীল এবং আত্মসম্মানে বলীয়ান সুখী, সমৃদ্ধশালী এক নতুন বাংলাদেশ এবং ন্যায়ভিত্তিক সুষম সমাজব্যবস্থা যেখানে থাকবে প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের সমঅধিকার। যেখানে থাকবে না শোষকের পৈশাচিক অট্টহাসি আর শোষিতের হাহাকার।
এইসব মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যরা স্বাধীনতার পর সব প্রলোভন পদদলিত করে নিজেদের ব্রতে অটল থেকে ভারতের পুতুল সরকারের বরকন্দাজ না হয়ে প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নির্ভীক ভাবে জনস্বার্থের সাথেই একাত্মতা প্রকাশ করে নিজেদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে এসেছে, সেই ইতিহাস মুছে যাবার নয়। তারপরও তাদেরকেই দেশবাসী দেখলো সাজানো মামলার আসামি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ আদালতের কাঠগড়ায়!

যখন ভারতের পদলেহি এবং নব্য পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী একজোটে ক্ষমতার স্বার্থে সংবিধান লঙ্ঘন করে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চক্রান্ত মূলক বিচারের প্রহসনের স্পর্ধা দেখাচ্ছিলো তখন জনগণের বৃহদংশের ভোটে জেতা বিরোধীদলগুলোর সাংসদরা উটপাখি সেজে নীরব থেকেছিলেন আওয়ামীলীগ ও ভারতকে খুশি রাখার জন্যই, এই বিশ্বাসঘাতকতা যে একদিন তাদের জন্যই কাল হয়ে উঠবে সেটা না বুঝেই।
সম্প্রসারণবাদী ভারত-প্রীতিতে আওয়ামী-বাকশালী সরকারকে পরোক্ষ সমর্থন প্রদান জনগণের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নকেই শুধু বিলীন করেই দিয়েছিলো তাই নয়, এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়বে সেটাই হয়ে উঠলো হতাশা বেঞ্জক বাস্তবতা!
জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠা স্বকীয় ঐতিহ্যকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দেশটাকে রূপান্তরিত করা হবে ভারতের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা অনুযায়ী একটি করদ রাজ্যে কিংবা অঙ্গরাজ্যে
দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেই আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সেটাই আমরা অতিতের মতই ভবিষ্যতেও করবো সব প্রতিকূলতার মকাবেলা করেই সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হলো।

সর্বসম্মতি সাপেক্ষে, আমি বিদেশ থেকেই নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে তাকে বললাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন-এর সাথে দেখা করে আইনি সাহায্য চাইতে। নিম্মি তার সাথে দেখা করেছিলো। ন্যায়নিষ্ঠ প্রখ্যাত এই আইনজীবী নিম্মিকে অকপটে জানিয়েছিলেন
এটা কোনো মামলাই নয়, বিচারের প্রহসন মাত্র। হাসিনার জালে হাসিনাকে জড়িত করে অনায়াসেই তার সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব। এর জন্য তারাও প্রস্তুত। কিন্তু পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। তিনি চাচ্ছেন না, এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে বিএনপির কনও প্রকার সম্পৃক্ততা কিংবা বিরোধী জোটের প্রতি সহানুভূতিশীল আইনজীবীরা এই বিচারে আসামী পক্ষে ওকালতি করুক।
সব শুনে নিম্মি প্রশ্ন তুলেছিলো
মইনুল ভাই, আপনারা তো পেশাদার আইনজীবী। সেই সুবাদে এই কেসটা গ্রহণ করে আসামী পক্ষে আইনি লড়াই লড়তে পারেন না কি?
ভাবী, আপনাকে বলতে বাধা নেই, সংসদে যখন সাংবিধানিক বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে হাসিনার সরকার একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় ইনডেমনিটি এ্যাক্ট বাতিল করে মামলা দায়ের করে, তখনই আমরা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম সরকারের পতন ঘটানোর এই মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। তিনি আমাদের পরামর্শে কর্ণপাত না করে শুধু বললেন,
আপনারা এই মামলা থেকে দূরে থাকবেন। পার্টিপ্রধানের এহেন নির্দেশে হতবাক হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছি আমরা। যদি সম্ভব হয়, আপনি তার তরফ থেকে একটি ইশারার ব্যবস্থা করুন, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, বিনা খরচায় আমি ও সমমনা দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীদের অনেকেই স্বেচ্ছায় আসামীদের পক্ষে এই কেস লড়তে রাজি হবেন।

তার সাথে সাক্ষাতের পর নিম্মি বিশ্বস্তজনদের সাথেও এই প্রসঙ্গে আলাপ করে জানাতে পেরেছিলো খালেদা জিয়া কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাচ্ছেন, তাই সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন কেসটা থেকে দূরে থাকতে। অতএব বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে কোনও রকম সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে না আইনি লড়াই লড়তে। রাজনৈতিক ভাবেও আগস্ট বিপ্লবীদের বিচারের পক্ষে দাঁড়াবে না তারা।
খালেদা জিয়া আরও ভাবছেন,তাদের এই মৌন সমর্থনে হাসিনা সরকার এবং ভারত তাদের পক্ষে নমনীয় থাকবে।
লেনদেনের এক অভাবনীয় সমীকরণ!
ইতিমধ্যে, অন্যান্য সাথী ভাইদের কাছে দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ পৌঁছালো। নির্দেশ পাবার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই গোপনে যার যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো।
জানতে পারলাম, দেশে অবস্থানরত আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বন্দী করার সাথে সাথেই বিদেশ থেকে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত নেতারা দেশে না ফেরায় তাদেরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে তাদের নামেও গ্রেফতারি পরওয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করেছে হাসিনা সরকার।
ডিবি-এর আওয়ামী লীগ অনুগত সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দের নেতৃত্বে তল্লাশির নামে সবার বাড়িঘর তছনচ করে ফেলা হয়েছে। আমার বইগুলোও রেহাই পায়নি। নিম্মি আর সস্তির পাসপোর্ট জব্দ করে তাদের গৃহবন্দী করে রাখা হলো।
নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও চালানো হয় একই তাণ্ডব। বাজেয়াপ্ত করার সমন জারি করা হলো সরকারের তরফ থেকে আমাদের নামে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি এবং ব্যাংক একাউন্ট।

ছোটভাই স্বপনকে বন্দী করে নিক্ষেপ করা হলো কারাগারে এই সন্দেহে, যে স্বপন আমাকে এবং আমার পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে থাকে। রিমান্ডে নিয়ে তার উপর চালানো হয় পাশবিক অত্যাচার। দীর্ঘ দু’ বছর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেইল পেলে, স্বপন সপরিবারে আমেরিকাতে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তার ব্যবসা-বাণিজ্য লুটপাট করে নেয় সরকারী দলের ক্ষমতাশালী লুটেরারা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার সবগুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন শুরু হয়েছে নতুন এক তামাশা।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভাগ-বাটোয়ারার পর আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্র তাদের ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় আঁস্তাকুড়ে।

১৯৯৬-এর নির্বাচনে জামায়াতের সিটের সংখ্যা ১৭ থেকে উদ্দেগজনক ভাবে কোমে আসায় জামায়াত বুঝতে পারে বাংলাদেশে ভারত ঘেঁষা রাজনীতি করে কোনও দলের পক্ষেই জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব নয়।
তাই দল হিসাবে রাজনীতির ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে স্বর্ণলতিকার মতো বাহ্যিক ভাবে ‘ভারত বিরধি’ বিএনপিকেই অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প তাদের নেই।
অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপিও বুঝতে পারে সমঝোতা ও সুবিধাবাদের রাজনীতিতে একগুয়েমি এবং স্বেচ্ছাচারিতা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেলো হিসাব। তাই আবার বিএনপিএবং জামায়াতের গাঁটছড়ার উদয় হলো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের জনগণের সত্তায় মিশে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের চেতনা। প্রাচীনকাল থেকেই এই দু’টি চেতনার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের স্বকীয় পরিচিতি। ১৯৪৭ সালেও ভারত বিভক্ত করে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান নামের রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকেও মেনে নিতে হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সত্তার সাথে সামঞ্জস্যহীন ভারতের সংবিধানের চার নীতির উপর দেশের সংবিধান গড়ে জাতিকে বিভক্ত করার চক্রান্ত করা হলো শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। পরিণতিতে সৃষ্টি হলো রাজনীতির মূলধারায় দুইটি তথাকথিত বিপরীতমুখী রাজনৈতিক ধারা। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে এই দুইটি শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখার পরই দেশবাসী বুঝতে পারলেন কাগুজে ভাবে এদের নীতি-আদর্শে ব্যবধান থাকলেও এদের চরিত্র এক। দুইটি রাজনৈতিক শক্তিই একই গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিভূ। জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। অন্যদিকে তথাকথিত যারা ধর্মের ঠিকাদার, তাদের চেহারাতেও কোনও ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হল না।
তাই আজ হয়তো জনগণ বুঝতে পারছে পরীক্ষিত বিকল্প নেতৃত্ব ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎঅন্ধকার।
কিন্তু জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুরা তৃতীয় বিশ্বের সম্পদশালী সম্ভাবনাময় কনও দেশেই চায় না সেখানে জাতীয় স্বার্থে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হউক দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তাই সে ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে বিনাশ করে দেয়া হয় ছলেবলে কৌশলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সেই ধরণের প্রকৃত অর্থে ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত শক্তি এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র গড়ে তোলা সম্ভব আপোষহীন অন্যায়, অপশাসন ও শোষণ বিরোধী কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমেই। এর জন্য চাই সাহসী এবং সচেতন মানুষ।

যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই সংগ্রামে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে হবে দেশের তরুণ প্রজন্মকেই সব প্রলোভন এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। তারাই হচ্ছে যেকোনো দেশের দুর্বার এবং নির্ভীক চালিকা শক্তি। যেকোনো দেশ এবং জাতির ইতিহাস সৃষ্টির মুখ্য উপাদান এবং মেরুদণ্ড এই টগবগে তারুণ্য। এদের সংঘবদ্ধ জাগরণে হৃৎকম্পনের সৃষ্টি হয় দেশীয় ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী শক্তিধর মুরুব্বীদের। তখনই সুযোগ হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নতুন সমীকরণ সৃষ্টির।

নিম্ন আদালতে গোপালগঞ্জের জজ গোলাম রসুল তার ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের নামে তামাশা করে হাসিনার দয়াও করুণা পাবার জন্য আইনে কনও বিধি না থাকা সত্ত্বেও সদর্পে অপরাধীদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার রায় দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। এই রায় দেবার পরও খালেদা জিয়ার জোট মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ থাকে।
এরপর বিবাদী পক্ষের সব রিট এবং রিভিউ পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে দায়সারা গোছের বিচার প্রকিয়া পরিচালিত হয় সরকারি প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে।
স্মরণ রাখতে হবে, এই মামলা চলাকালে উচ্চ আদালতের ৮ জন বিবেকবান বিচারক বিব্রতবোধ করে বিচার কার্যক্রম থেকে সরে এসেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের তিনজন বিচারপতি বিবেকের তাড়নায় এই বিচারের রিভিউ বেঞ্চে বসতে বিব্রত বোধ করেছিলেন।
এই পুরোটা সময় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সরকারি চাপ, ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে প্রাণনাশসহ বিভিন্ন ধরনের ধমক-ধামকি এবং হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। তৎকালীনস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম এবং মায়ার নেতৃত্বে লাঠি ও চাপাতি মিছিল বের করা হয়েছিলো। সেই মিছিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সদম্ভে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন
বিচারের রায় যদি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয় তবে সেই প্রত্যাশিত রায় কি করে আদায় করতে হয় সেটা আওয়ামীলীগের ভাল করেই জানা আছে।
এরপরও হাসিনা সরকারের পক্ষে সেই টার্মে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।

২০০১ সালের নির্বাচনী নাগরদোলায় স্বজনপ্রীতি, পুকুরচুরি, জাতীয় সম্পদের হরিলুট, মানুষ খুন, অন্যায়-অবিচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দলীয় মাস্তানি, গুমখুন, জবরদখল, চাঁদাবাজির প্রচণ্ডতায় শাসরুদ্ধকর অবস্থা, একই সাথে ভারত তোষণ নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ নিরুপায় হয়ে আবার খালেদা জিয়ার জোটকেই ভোটের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে।
নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করে নিয়ে জনগণের ভোট প্রার্থনা করায় জনগণ তাদের বিশ্বাস করেছিলো অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না এবারের জোট সরকার। আমরাও ভেবেছিলাম এবার হয়তো খালেদা জিয়ার জোট সরকার অন্যায়ভাবে বাতিলকৃত ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি আবার সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে পুনর্বহাল করবে এবং আইনগত ভাবেই আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা‘খুনের মামলা’ দুটো খারিজ হয়ে যাবে, মুক্তি পাবে সবাই মানবেতর বন্দী অবস্থা থেকে। নির্বাসিত নেতারাও স্বাধীনভাবে দেশে ফিরতে পারবে।
কিন্তু জনগণ হতবাক হয়ে দেখলো, নবনির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকার সেই পথে এগুলো না সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও। যদিও সংবিধান লঙ্ঘিত বেআইনি ভাবে ক্যাঙ্গারু কোর্টের প্রহসন মূলক এই বিচারের বিরুদ্ধে তখন বিশ্বজনমত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাজ্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ছাড়া বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা এই বিচার প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করে সরকারকে ইনডেমনিটি এ্যাক্ট পুনর্বহাল করে এই বিচার বন্ধের আবেদনও জানিয়েছিলো।
বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিল কয়েকটি ভাতৃপ্রতিম দেশ, যাদের বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা খালেদা জিয়ার জোটকে ২০০১ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে বিশেষ অবদান রেখেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতোই।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি যথাসময়ে সেই উদ্দগ গ্রহণ করবেন।
কিন্তু তার পাঁচ বছরের শাসনকালের মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে তিনি রহস্যজনকভাবে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, কারাবন্দীদের ‘কন্ডেম সেল’-এর মানবেতর অবস্থা থেকে ক্লাস দেবার উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে খালেদা জিয়ার জোট সরকার।

এভাবেই স্বীয় স্বার্থ এবং ভারতের চাণক্যপুরি এবং তাদের প্রতিভু আওয়ামীলীগকে খুশি করার লক্ষেই আগামিতে আসামীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার পথটি অতি নিষ্ঠুরতার সাথে খোলা রেখে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং তার জোটসরকার।এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জরুরী অবস্থায় ‘উদ্দিনদের’ সরকারের সহযোগিতায় ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যা গরিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসায় ইন্দো-আমেরিকান বলয়।
তাদের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্যই দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতানো হয়েছিলো আওয়ামী লীগ জোটকে।
অতি চতুরতার সাথে বিদেশী দূতিয়ালির মাধ্যমে নির্বাচনী ফাঁদে ফেলা হয়েছিলো খালেদার জোটকে।
দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক ভারতের হাতের পুতুল আশিত্তোর এরশাদ বুড়ো বয়সে জেলের ভাত না গেলার স্বার্থে ভারতের সুতোর টানে হাসিনার পেটিকোটের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
ক্ষমতাসীন হয়েই তড়িঘড়ি করে জ্যেষ্ঠতার রীতি উপেক্ষা করে পছন্দমতো বিচারকদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়োগদান করে ৫ সদস্যের মনপছন্দ একটি বেঞ্চ গঠন করে হাসিনার আওয়ামীলীগ মহাজোট সরকার। বেঞ্চের দুইজনই ছিলেন সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিচারপতি। তাদেরই একজন ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
সেই বেঞ্চ ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দান করে বন্দী পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনদরদী সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে তাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের প্রতিদানে।
সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রদান এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আইনগতভাবে যে সময় দেবার রীতি সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিলো জাতীয় বীরদের। যদিও বীরদের সবাই ক্ষমা প্রার্থনা না করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলেন স্বেচ্ছায় তবুও আইন অনুযায়ী সময় না দেয়াটা ছিল বেআইনি হঠকারিতা।
প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে জেলকর্তৃপক্ষ রায় ঘোষিত হবার পর, তাড়াহুড়ো করে জাতীয় বীরদের নিকট আত্মীয়-স্বজনকে কড়া নিরাপত্তার সাথে কারাগারে এনে তাদের সাথে শেষ সাক্ষাৎকরিয়ে প্রত্যুষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং মেজর হুদার গলায় ছুরি চালিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় নির্ভীক, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক বীরদের।

সূচীপত্র  [প্রতিটি পর্বে্র নীচে ক্লিক করলেই সেই পর্বটি পাঠ করতে পারবেন]

১ম পর্ব   “জিয়া থেকে খালেদা তারপর” – লেখকের কথা

২য় পর্ব  শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানীর সাথে শেষ সাক্ষাত

৩য় পর্ব দ্বিজাতি তত্ত্ব

৪র্থ পর্ব –  কিছু বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের জবাব

৫ম পর্ব – সত্য কহন

৬ষ্ঠ পর্ব – ব্যাংককে আমরা

৭ম পর্ব – বঙ্গভবনে কি হচ্ছিল রাত ১২ টায়!

৮ম পর্ব – বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হলো জেনারেল জিয়াকে

৯বম পর্ব – “সংঘর্ষের পথে জিয়া”

১০ম পর্ব – খন্দকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে এলেন সাদ্রে ইস্পাহানী

১১তম পর্ব – শিশু ভাই এলেন ব্যাংককে

১২তম পর্ব  – নিজেদের আলোচনা

১৩তম পর্ব  ১ম কিস্তি   – রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে

১৩তম পর্ব – ২য় কিস্তি- রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে

১৪তম পর্ব –  বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জমির এলেন সস্ত্রীক

১৫তম পর্ব – এভিএম তোয়াব আসছেন

১৬তম পর্ব  –  শিশুভাইকে বেনগাজীতে আসার অনুরোধ

১৭তম পর্ব  –  ১ম কিস্তি – জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে

১৭তম পর্ব – ২য় কিস্তি

১৭তম পর্ব –  ৩য় কিস্তি

১৭তম পর্ব –  শেষ কিস্তি

১৮তম পর্ব –  বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস

১৯তম পর্ব –  জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক

২০তম পর্ব – লন্ডন হয়ে ফিরলাম বেনগাজীতে

২১তম পর্ব – ঢাকা হোয়ে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা

২২তম পর্ব – বাংলাদেশে নীতি বিবর্জিত কুটুম্বিতার রাজনীতির রূপ

২৩তম পর্ব –  জিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে

২৪তম পর্ব –  রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়ার গণচীনে দ্বিতীয় সফর

২৫তম পর্ব  –  আব্বার উপস্থিতিতে প্রথম রাতে জেনারেল জিয়ার সাথে আমার বৈঠক

২৬তম পর্ব – দ্বিতীয় বৈঠক

২৭তম পর্ব – জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চীন সফর

২৮তম পর্ব – চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিক্রিয়া

২৯তম পর্ব  –  চীন থেকে লন্ডনে নির্বাসন কালে

৩০তম পর্ব  –  জেনারেল মঞ্জুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল

৩১তম পর্ব  – নিউইয়র্কের পথে জেনারেল এরশাদের সাথে লন্ডনে সাক্ষাৎ

৩২তম পর্ব – খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ার পার্সন

৩৩তম পর্ব – জেনারেল এরশাদের প্ররোচনায় রশিদ-ফারুক বানালো ফ্রিডম পার্টি

৩৪তম পর্ব – ১ম কিস্তি – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ

৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ

৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ-শেষ কিস্তি

৩৫তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান – ১ম কিস্তি

৩৬তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান  – শেষ কিস্তি পেশাওয়ারের পথে

৩৭তম পর্ব – ফিরে এলাম নাইরোবিতে

৩৮তম পর্ব – নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে যাত্রা 

৩৯তম পর্ব – ঢাকায় পৌঁছালাম

৪০তম পর্ব –  ১ম কিস্তি – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ

৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ – ২য় কিস্তি

৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ- শেষ কিস্তি

৪১তম পর্ব – রুহানী জগতের আর এক সূফি সাধকের সান্নিধ্যে

৪২তম পর্ব – আমাকে আবার খালেদা জিয়ার জরুরী তলব

৪৩তম পর্ব – ব্যাংকক ট্রানজিট লাউঞ্জে

৪৪তম পর্ব – হংকং হয়ে বেইজিং – ১ম কিস্তি

৪৪তম পর্ব –  হংকং হয়ে বেইজিং – শেষ কিস্তি

৪৫তম পর্ব – হংকং হয়ে ফিরলাম ঢাকায়

৪৬তম পর্ব – গোপনে আমেরিকা সফর

৪৭তম পর্ব – আবার ঢাকায়

৪৮তম পর্ব – নাইরোবিতে প্রত্যাবর্তন

৪৯তম পর্ব – দেশে ফিরলাম

৫০তম পর্ব – নিরুদ্দেশে যাত্রা

৫১তম পর্ব – ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ

৫২তম পর্ব – দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়াতের
প্রতিক্রিয়া

৫২তম পর্ব -দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়েতের
প্রতিক্রিয়া  –  শেষ কিস্তি

৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – ১ম কিস্তি

৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – শেষ কিস্তি

৫৪ তম পর্ব – শেষকথা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *