৪০তম পর্ব
প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ
শেষ কিস্তি
বাংলাদেশ সামরিকবাহিনী আর 7th Fleet-এর মেরিনসদের যৌথ অভিযান ‘Operation Sea Angels’ শুরু হয়ে গেছে। হতবাক হয়ে দেখলো দেশবাসী অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে কি নিপুণভাবে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে অকুতোভয় আমেরিকান মেরিনস এবং জাতীয় সেনা সদস্যরা ফেরেশতা হয়ে বাঁচিয়ে দিলো হাজারো জলবন্দী মানুষের জীবন!
উদ্ধার কাজের পাশাপাশি ত্রাণএবং পুনর্বাসনের কাজও শুরু হয়ে গেলো দ্রুতগতিতে।
সারা দুনিয়া থেকে এলো প্রচুর ত্রাণসামগ্রী।
জনগণ প্রচার মাধ্যমে দেখলো প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত, পীড়িত জনগণের মাঝে। খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা প্রায় আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো।
যুদ্ধের জন্য তৈরি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এক বিশাল এবং অপরিমেয় শক্তিশালি নৌবহরকেও যে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা সম্ভব তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হলোSea Borne ‘Operation Sea Angels’. কৃতজ্ঞতার সাথে দুঃস্থ জনগণ আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া জানালেন জানবাজ নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী দু’দেশের সেনা সদস্যদের কল্যাণ কামনায়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই চরম বিপর্যয়ের সফল মোকাবেলার সবটুকু কৃতিত্ব, প্রশংসা ও রাজনৈতিক ফায়দা পেলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার।
কাদের প্রচেষ্টায় ‘Operation Sea Angels’ এর সব কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারলেন খালেদা জিয়া এবং তার সরকার সেটা অজানা রয়ে গেলো শুধু দেশবাসীর কাছেই নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও।
এরপর থেকে দিনগুলো কাটছিলো আনন্দে। প্রতিদিন রাতেই কনও না কনও বন্ধুর বাসায় ঘরোয়া পার্টি দেয়া হচ্ছে নিম্মি ও আমাকে আপ্যায়ণ করার জন্য। সব কমন বন্ধুরা সস্ত্রীক সেই সব পার্টিতে উপস্থিত থাকছে। সাথে গানের জলসারও বন্দোবস্ত থাকছে। গান আমরা দুই জনই ভালবাসি। আমরা বিশেষ ভাবে কাউকে নিমন্ত্রণ করতে চাই কিনা সেটাও জেনে নেয়া হচ্ছে
একরাতে স্বপনের বাসায় চলছে জমজমাট পার্টি। হঠাৎআজিজ মোহাম্মাদ ভাই এসে বসলো আমার আর নিম্মির পাশে।
ডালিম, আমার একটা অভিযোগ আছে তোমাদের দু’জনের বিরুদ্ধে।
কি রকম?
আমারবাড়ীতে যেকোনো পার্টিতে কূটনৈতিকপাড়াথেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবংসমাজের ক্ষমতাশালী রুই কাতলা যাদেরই নিমন্ত্রণ করি তারা সবাই সাগ্রহে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু আমার একটা দুঃখ, বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তোমরা আজ অব্দি আমার কনও নিমন্ত্রণই গ্রহণ করনি। এর কারণ কি?
আমাদের অনুপস্থিতিতে তোমার পার্টির আমেজে কনও ভাটা পরেছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
না, তা হয়তো পরেনি, তবে ব্যাক্তিগতভাবে আমি পীড়িত হয়েছি।
তা কেন?তোমার সাথে তো অন্যান্য জায়গাতে দেখা সাক্ষাৎহচ্ছেই। নেশায় রং ধরলে মনের কথা বেরিয়ে আসে। তাকে হাল্কা করার জন্য বললাম
দেখো আজিজ, তোমার পার্টিগুলো ঠিক ঘরোয়া প্রকৃতির নয়- বরং সেগুলোকেবলাচলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন মানসিকতার লোকজনদের মিলনকেন্দ্র। সেখানে আমরা দু’জনই নিজেদের কিছুটা বেমানান মনে করি।
আমরা কেবল সেই সমস্ত পার্টিতেই আনন্দ পাই যেখানে থাকবে অতি ঘনিষ্ঠরা, যাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, হাসি তামাশা করা যায়, অতীতেরস্মৃতি রোমন্থন করে হাসি-কান্না শেয়ার করা চলে।সেই ধরনের পরিবেশ তোমার পার্টিগুলোতে থাকে না। এটাই আমাদের অনুপস্থিতির প্রধান কারণ। অন্য কনও কারণ নেই। আজকের এই পার্টি এবং তোমার পার্টিগুলোর মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
নিশ্চুপ বসেছিল আজিজ কিছুটা বিষণ্ণ চিত্তে। শাহনাজ তখন মেহেদি হাসানের একটা প্রিয় গজল গাইছিল সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছিলো বাচ্চু। চলো, গান শুনি গিয়ে বলে অন্য সবার সাথে গিয়ে যোগ দিলাম।
বুফে ডিনার পরিবেশনার পর রোজি এসে পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। টেবিলে গরম কেসারলের উপর পরিবেশিত হয়েছে হরেক রকমের খাবার। সবাই পছন্দসই খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে ছোট ছোট জটলায় বিভক্তহয়ে খাবারে মন দিলো।
এক সময় কামাল সিদ্দিকি আমাকে আর নিম্মিকে বললো
চল, একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসি।
বুঝতে পারলাম একান্তে আলাপের জন্যই কামাল প্রস্তাবটা দিচ্ছে। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে উপরে একটা সিটিং রুমে আমরা বসলাম তিনজন।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তোদের সাথে আলাপ করতে চাই। আমি সব কিছু না জানলেও অনেকের চেয়ে কিছুটা বেশি জানি কি করে কোন শক্তির বলে জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হতে পেরেছিলো। কিন্তু ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পরমুহূর্ত থেকেই তোদের একজন হয়েও জিয়া তোদেরকেই তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করে সেনা পরিষদ এবং সেই সংগঠনের নেতাদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে।
জিয়া যে ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকারই করেছিলো শুধু তাই নয়, তোদের শক্তিকে সমূলে নির্মূল করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে হাজারো বিপ্লবীকে হত্যা করেছিলো এবং অনেককেই বিনাবিচারে জেলে পুরেছিলো।
এক সময় এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তোকে এবং অন্যান্যদের জড়িত করে চরম শাস্তি দেবার উদ্যোগও নিয়েছিলো। বন্দীদের অনেকেই এখন পর্যন্ত কারাগারে অমানবিক পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো আমি নিজেও যখন বন্দী ছিলাম।
তাদের এবং তোদের নিখাদ ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎচিন্তা করে তোরা সবকিছুই নীরবে মেনে নিয়েছিস যদিও আমি জানি, যদি ইচ্ছে করতিস তবে যে কনও মুহূর্তে জিয়াকে গদিচ্যুত করার মতো শক্তি তোদের ছিল। কিন্তু আগ্রাসী ভারতের অনুপ্রবেশের কথা চিন্তা করেই সেটা তোরা করিসনি। আত্মত্যাগের এক অভাবনীয় নিদর্শন তোরা প্রত্যেকেই!
আমি এটাও জানি, তুইসহ তোদের সবাই চাকুরি ছেড়ে সমাজে স্বাধীনভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে আগ্রহী। এই পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কাল থেকে নির্বাচন পর্যন্ত এবং নির্বাচনের পর আজঅব্দি তোদের পক্ষ থেকে তুই পর্দার অন্তরালে যে অসাধারণ অবদান দেশ ও জাতীয় স্বার্থে করে এসেছিস সেসব কিছুর সবচেয়ে বড় Beneficiary হচ্ছে খালেদা জিয়া। এই বাস্তবতায় কারাবন্দী সহযোদ্ধাদের মুক্তি এবং তোদের স্বীকৃতি প্রদান করে যথাযথ মর্যাদায় সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি খালেদার কাছে উত্থাপন করাটা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত।
তুই হয়তো ঠিকই বলছিস তবে তোকে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যাই করেছি সেটা করেছি বৃহত্তর দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে, কোনও ব্যক্তি স্বার্থে নয়। আমাদের নিঃস্বার্থ অবদানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি উপকৃত হয়ে থাকে সেটা তার ভাগ্য। এর জন্য প্রতিদানে কিছু চেয়ে নেয়াটা আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।
তুই শুধু বিশ্বস্ত বন্ধুই নস, ভাইও বটে। নিম্মিরা তোকে বদ্দা বলে সম্বোধন করে, খালাম্মা আর চাচা তোকে বাপ্পির চেয়ে কম ভালবাসেন না তাই তোকে জানাচ্ছি,
নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া নিজে থেকেই কথা দিয়েছেন নির্বাচনে জয়ী হলে আমাদের প্রতি জিয়ার সময় থেকে যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করবেন।এর অনেক সাক্ষী রয়েছে দশে বিদেশে।
যদি সেটাই তিনি করেন তাহলে আমরা বুঝবো, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সফল অভ্যুত্থান যে একই সূত্রে গাঁথা, এই দুইটি সফল বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলো সেনা পরিষদ সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। সেই সত্যকেই স্বীকৃতি দিয়েই ভারতের রক্ত চক্ষুকে উপেখ্যা করেই তিনি আমাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে রাজনীতির মূলধারায় কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। তেমনটি হলে আমরাও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাববো, ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে কি করে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার প্রক্রিয়ায় বিএনপির সাথে কি ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
কূয়োর ব্যাঙের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না।আমাদের রয়েছে সুদূরপ্রসারী সুচিন্তিত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেনা পরিষদের রয়েছে নীতি-আদর্শ ভিত্তিক একটি কর্মসূচি। এ সমস্ত বিষয়ে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই তুই অনেক কিছুই জানিস।
এখন শোন, তুই অনুমতি দিলে আমি এই দুইটি বিষয়ে ম্যাডামকে অতিসত্বর পদক্ষেপ নেবার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করতে পারি।
এই বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই, তুই তোর ইচ্ছে অনুযায়ী যা করতে চাস করতে পারিস।
স্বল্পভাষী নিম্মি সব শুনে বললো
বদ্দা, আপনার কোনও প্রচেষ্টাই কার্যকর হবে না, কারণ খালেদা জিয়া জেনারেল জিয়ার পথেই হাঁটবেন। বরং আমার মনে হয়, খালেদা জিয়া যতটুকু সম্ভব তার স্বার্থ হাসিল করে নেবার পর অতি সহজেই তার দেয়া কথাটা ভুলে যাবেন। ডালিমদের রাজনীতিতে আলাদাভাবে কিছুতেই দাঁড়াতে দেয়া আপনাদের ম্যাডামের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এর অনেক যুক্তি রয়েছে। Sooner or later তিনিও জিয়ার মতোই বিশ্বাসঘাতকতার নজিরবিহীন আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। চলুন নিচে যাওয়া যাক।
নামতে নামতে কামাল বললো
চেষ্টা করতে দোষ কি বইন?
নিম্মি কনও জবাব দিলো না। তিনজনই নিচে নেমে অন্যদের সাথে যোগ দিলাম।খাওয়ার পর চা, কফির সাথে পানের সরঞ্জাম পরিবেশিত হল। গানের আসরও জমে উঠেছে।
এক কোণে নিম্মি, কামাল আর আমি একটা জায়গা বেছে নিলাম। আরামদায়ক কুশনে ঠেস দিয়ে গান শুনছিলাম আর নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আলাপ করছিলাম।কামাল নিম্মিকে লক্ষ্য করে বললো
তুমি খালেদা সম্পর্কে এতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছো কেন বইন?
আঁতে ঘা লাগছে মনে হয়! তাহলে একটু বুঝাইয়া কই শুনেন, যদিও এর অনেক কিছুই হয়তো আপনার জানা থাকলেও থাকতে পারে। ডালিমদের সাথে তথাকথিত ষড়যন্ত্রের দায়ে জড়িয়ে নবি ভাইয়েরও কোর্টমার্শাল শুরু করেছিলেন জেনারেল জিয়া।
কর্নেল নুরুন্নবি খান বীরবিক্রম তখন ঢাকার ইএমই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। শুধু তাই নয়, জিয়ার সাথেই নবিভাই শুরু থেকে সহযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছিলেন।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ঝুনুর(কর্নেল নবির স্ত্রী)মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়! ঝুনুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার সরকারি বাসভবন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঝুনু বাস্তুহারা হয়ে অসহায় হয়ে পরে।এম এ পাশ ঝুনুর পক্ষে একটা চাকুরিও যোগাড় করা সম্ভব হয়নি যোগ্যতা থাকলেও। কারণ, জিয়ার রোষানলে পরার ভয়ে সবাই তখন বহুলভাবে পরিচিত একজন বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে এড়িয়ে গেছে।
তখন নিরুপায় ঝুনু এলিফেন্ট রোডের বস্তিসংলগ্ন একটা গলিতে দুই রুমের বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয়। একটা অখ্যাত স্কুলে সামান্য বেতনের একটা চাকরিও ভাগ্যক্রমে জুটে যায় আল্লাহ্র অসীম করুণায়।
সংসারের ন্যূনতম খরচা যোগাতে ঝুনু বিপর্যস্ত হয়ে পরে।
দেশের বড় বড় বুলি কপচানো মহারথীদের কেউই এতটুকু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়নি তখন।
জনগণ আর দেশের কথা বলতে বলতে আপনারা সব সময় মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, জীবনের ঝুঁকিও নিয়ে ফেলেন আগপিছ কিছু না ভেবেই যার দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের।
এই বিষয়টা কখনও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বলে আপনারা মনে করেন না। আমরাও আপনাদের সততায় সব কিছু মুখ বুঁজে মেনে নেইগর্বের সাথেই।
আমরা তখন নির্বাসনে। আমি লন্ডনে একটি দোকানে কাজ করি। কারণ আমাদের স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পত্তি সবই বাজেয়াপ্ত করে লুটপাট করে নেয়া হয়েছিল তাই টাকা থেকে ঝুনুকে মাসিক কিছু টাকা পাঠাতাম আমার চাকুরির বেতন থেকে।
একবার ঢাকায় এলে ঝুনু আমার সাথে দেখা করতে আসে। তখন জোর গুজব নবি ভাইকে ফাঁসি দেয়া হবে। ওর অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বুকটা ফেটে গিয়েছিলো। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, নবি ভাইকে না জানিয়ে তুমি একবার খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তার সাহায্য চাও।
আমার কথাতেই ঝুনু একদিন অতি কষ্টে খালেদার সাথে দেখা করতে সমর্থ হয়। অশ্রুর বন্যায় ভেসে ঝুনু তার দুর্বিষহ জীবনের কথা তাকে শোনায় এবংনবিভাইয়ের জীবন ভিক্ষা চায়। সব শুনে একজন অসহায় দুঃস্থ মহিলাকে কিজবাব দিয়েছিলেন আপনার ম্যাডাম গর্বের সাথে, জানেন? বলেছিলেন
এসমস্ত কান্নাকাটি বন্ধকরুন।আমার স্বামী কতজনকে ফাঁসিতে লটকিয়েছেন, কতজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরেছেন সেটা আপনি জানেন? তবুওতো ভালোআপনার স্বামী এখনও জীবিতই আছেন। তার যা হবার সেটা আইনি ভাবেই হবে।
এরপর তাকে বিদায় করে দেন খালেদা জিয়া।
যার মধ্যে সভ্যতা, সহমর্মিতা, মায়া-মমতা এবং সহানুভূতি দেখাবার মতো ন্যূনতম জ্ঞানটুকু নেই সেই মহিলাকে কি বলা উচিৎ? মানুষ নাকি অমানুষ?
এভাবে অপমানিত হয়ে ঝুনু ফিরে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। সেই দিন ঝুনুকে বুকে ধারণ করে নিজেকে খুবই দোষী মনে হচ্ছিলো। নবি ভাইয়ের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েও সরকারের এজেন্সিরা কনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়নি। পরে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় নবি ভাই মুক্তি পান। কিন্তু তার মুক্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্বিষহ অবস্থার সাথে লড়াই করতে করতে ঝুনু অকালে মারা যায়।
নিম্মির কথা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট করে একদম চুপ হয়ে গেলো কামাল।
ঝুনুর মুখটা মনে ভেসে ওঠায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো আমার মন। অতি নিষ্পাপ সরল হাসি হেসে সর্বদাই আপ্যায়ন করত ঝুনু যখনই গেছি তাদের বাসায়। এরপর আর পার্টিতে থাকতে মন চাইছিলো না। তাই বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম কোনও মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থায়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। স্বপন জানিয়েছিল
সে নিজে গিয়ে নবিকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিল কিন্তু সে রাতে তার সাইট এ যেতে হওয়ায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল নবি। বলেছিল, আমার আর নিম্মির সাথে পরে দেখা করবে।
পরদিনই নবি ফোন করলো। আমি তাকে মিনু ফুপ্পুর বাড়ীতে আসতে বললাম। জবাবে নবি বললো
বন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে শপথ নিয়েছি ক্যান্টনমেন্টের গেটপেরিয়ে বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত কোনোক্রমেই ভেতরে প্রবেশ কোরব না। তাই দয়া করে তুই ভাবীকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আয়। অফিস থেকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবো।
এলিফেন্ট রোডে নবির বিরাট অফিস! নবির তখন রমরমা ব্যবসা। জেল থেকে বের হয়ে নবি একটি কনস্ট্রাকশন ফার্ম খুলে বসে। সে এখন শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীই নয়, দেশের বিত্তবানদের শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে নিজের মেধা ও পরিশ্রমের বদৌলতে।ওর চেম্বারে নিয়ে গিয়ে তার বিরাট গ্লাসটপ টেবিলের সামনে আমাদের দু‘জনকে বসিয়ে নিজে গিয়ে অপর প্রান্তে তার রিভলভিং চেয়ারে বসলো নবি। অসাধারণ সাফল্যের পরও নবির মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে নবি!
অফিসে আসতে বলেছি কেনও জানিস?
কেনও? একটা জিনিস দেখাতে। বলেই তার সামনে টেবিলের গ্লাসের নিচে একটা ১০০ টাকার নোটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো
এটা দেখাতে।
এটা তো ১০০ টাকার একটা নোট নবি ভাই!কিছুটা বিস্মিত হয়ে নবির দিকে তাকালো নিম্মি।
না ভাবী, এটা শুধুমাত্র একটা নোট নয়। এটাই আমার উন্নতির চাবিকাঠি, আর এটা আপনার দান। জেল থেকে বেরুবার পর ঝুনুর কাছ থেকে আমি আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত সব কিছুই জানতে পারি। যখন ঝুনু ছিল সবার কাছেই বর্জনীয় তখন একমাত্র আপনিই তাকে বড়বোনের মতো বুকে টেনে নিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করে গেছেন গোপনে। আপনিই হয়ে উঠেছিলেন ঝুনুর সংগ্রামী জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা। যখন কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই তখন আপনার পাঠানো টাকা থেকেই ঝুনু কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, দেবীতুল্য ভাবীর টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো।এতে আল্লাহ্পাক বরকত দেবেন। সেই টাকা থেকে এই নোটটা বাঁচিয়ে টেবিলের কাঁচের নিচে চোখের সামনে রেখে এগুচ্ছি। প্রতিটি সাফল্যের পর এই নোটটার মধ্যে আমি ঝুনুকে দেখতে পাই। শুনতে পাই ঝুনু বলছে
বলেছিলাম না, পুত-পবিত্র ভাবীর টাকায় ব্যবসা শুরু করলে আল্লাহ্পাক তোমার উপর তার রহমত উজাড় করে দেবেন।
কথাগুলো বলতে বলতে নবির দুই চোখে প্লাবন বইছিলো। আমাদের চোখ ও ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো। কারণ, নবির স্বচ্ছলতা ঝুনু বেশিদিন উপভোগ করতে পারেনি। হঠাৎকরেই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঝুনু সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা করে।
নবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো
চল, বাসায় বাচ্চারা তোদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
সেকেন্ড ক্যাপিটালে চারতলা বিশাল একটা বাড়ি বানিয়েছে নবি। তিন বাচ্চার জন্য তিনতলা আর নিজের জন্য নিচের তলা। বাসার গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই তার দুই মেয়ে আর ছেলে দৌড়ে এসে সালাম জানিয়ে নিম্মিকে জড়িয়ে ধরলো।
নিম্মি ওদের জন্য কিছু উপহার আর চকলেট নিয়ে এসেছিলো। সেগুলো হাতে তুলে দিলো।
রুচিশীল ছিমছাম ভাবে সাজানো বিশাল অট্টালিকায় কোনও কিছুরই অভাব নেই, শুধু ঝুনুর সদাহাস্য মুখের সাদর স্বাগতম ছাড়া! বাচ্চারা নিম্মিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে গেলাম আমি আর নবি।
বিশ্বাস কর নবি, আমি কিন্তু এ সবের কিছুই জানতাম না!
সেটাই স্বাভাবিক। ভাবী যা কিছুই করেছেন সেটা তিনি তার কর্তব্য মনে করে করেছেন সবার অগোচরে। এখানেই তিনি অনন্যা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় মেয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলো খাবার ঘরে। পরিবেশিত হয়েছে আমার প্রিয় ছোট মাছের ব্যঞ্জন, শাক আর ডাল। অবাক হলাম, এ যেনো ঝুনুর হাতেরই রান্না!
মা, এগুলো কে রান্না করলো?
কেনও, ভালো হয়নি বুঝি? আমিই রেঁধেছি।
অপূর্ব হয়েছে, মনে হচ্ছে ঝুনুর হাতের রান্নাই খাচ্ছি! বেঁচে থাকো মা, তোমার মার রান্নার হাতটাই পেয়েছো তুমি মা শা আল্লাহ্।
বিকেল পর্যন্ত নবিদের সাথে কাটাবার পর বিদায় নেবার প্রাক্কালে নবি বললো
কাল বৃহস্পতিবার, তোদের আর মিনু ফুপ্পুকে নিয়ে যাবো নরসিংদী আমার আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে, তিনি একজন সিদ্ধ কামেল সূফি সাধক।
তুই আবার এই দিকে ঝুঁকলি কবে?
আমিতো ফরজ হজ্জও করে ফেলেছি।
বলিস কিরে! সুইন্ডনের কার্ল মার্কসের প্রতিভূ হজ্জ করে ফেলেছে! এতো অবিশ্বাস্য পরিবর্তন!
তাই হয় বন্ধু, আল্লাহ্র মর্জিতে মুহূর্তে মানুষ বদলে যায়। ঝুনুর অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যাবার পর আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমিও বদলে গেছি। তবে আমাকে কাঠ মোল্লা ভাবিসনে যেনো! বাবার সাথে আলাপ করলে তোদেরও ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের পরিবেশটাও নির্মল। কাল সকাল ১১ টায় তোরা ক্যান্টনমেন্ট এর মেইন গেটের সামনে পৌঁছাবি।ওখানেই আমি তোদের জন্য অপেক্ষা কোরব।
ঠিক আছে। ভালোই হবে শহর থেকে দূরে একটা দিন একজন বুজুর্গের সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসতে পারলে মনটা কিছুটা হলেও আবর্জনামুক্ত হবে।
বাসায় ফিরে মিনু ফুপ্পুকে নবির দাওয়াতের কথাটা জানাতেই তিনি সাদরে সেটা গ্রহণ করলেন। বেনু ফুপ্পুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনিও যাবেন আমাদের সাথে। মোস্তাফিজ কাক্কুর বাবাও একজন খ্যাতিমান সূফিসাধক ছিলেন। এই জ্ঞান তাপসরা এই জগতের বাইরে যে বিশাল সৃষ্টি জগত রয়েছে সেই সম্পর্কে এবং আল্লাহ্তায়ালা কি করে এই বিশ্বভুবনে নিজের নিজাম কায়েম রেখে চলেছেন সেই রহস্য জানার সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য পাবার একাগ্র বাসনায় নিজেদের তরিকায় চিরন্তন নিমগ্ন থাকেন।
মিনু ফুপ্পু, বেনু ফুপ্পু এবং নিম্মি তিনজনই ভীষণভাবে ধার্মিক। মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর দুঃখীজনের কষ্টে যে ভাবে তারা কাতর হয়ে ছুটে যায় সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমবেদনা জানাবার জন্য নিঃস্বার্থভাবে, সেটা সচরাচর আজকের দুনিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয় না। একই ভাবে উদারপ্রাণ পুরুষ মোস্তাফিজ কাক্কু। একই সাথে BJMC এবং BJIC এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব মোস্তাফিজুর রহমানকে একজন দূরদর্শী, সৎ,পাট বিষয়ে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ পরিচালক হিসেবেই জানেন তার সহকর্মী এবং পাট ব্যবসায়ীরা।সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই ব্যক্তির বাইরের আবরণটা কঠিন হলেও তার মনটা ছিল শিশুর মতোই কোমল। তাদের জুটিটা ছিল একটা আদর্শ জুটি।আমাকে দু’জনেই নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
সব বিপদ-আপদে ঢাল হয়ে রক্ষা করেছেন। কিন্তু প্রতিদানে আমি কিছুই করতে পারিনি। পিতৃস্নেহ আর মাতৃমমতার ঋণ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। মায়া-মমতা একতরফা ভাবে নিম্নগামী চিরকাল। এটাও হয়তো একটি প্রাকৃতিক নিয়ম।
চলবে