৩৪তম পর্ব
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
শেষ কিস্তি
ভারতের সাথে সমঝোতার ফলে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতেপুনর্বাসিত করার পর ব্যালেন্সিংএ্যাক্ট হিসাবে জেনারেল জিয়া প্রফেসর গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। ফিরে এসে জনাব গোলাম আজম জামায়াত-এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোনিবেশ করেন।সেই প্রক্রিয়ার এক পর্যায় জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাগ্রাসী জেনারেলএরশাদের আনুকূল্য পাবার জন্য এবং আওয়ামী লীগেরকাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পাবার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেওআওয়ামীলীগের লেজুড়বৃত্তি করে অংশগ্রহণ করেছিলো জামায়াতে ইসলামী।
কিন্তু তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েও খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন বর্জনে ছিলেন অনড়।এর মূল কারণ ছিলো, খালেদা জিয়া বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করছিলেন তার স্বামীর অকালমৃত্যুর পেছনে জেনারেল এরশাদ, আওয়ামী লীগ এবং ভারতের হাত ছিল।
তাই, বিক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া জেনারেল এরশাদের অবৈধ ভাবে অস্ত্রের মুখে বিএনপির নির্বাচিতরাষ্ট্রপতি জনাব সাত্তারের অসুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা কব্জা করাকে বৈধতা না দিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।এতে তার আশাতীত লাভ হয়।খালেদার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি জনগণের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আপোষহীন নেত্রীহিসেবে।একই সাথে তার জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক ভাবেএটা ছিল তার একটি অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। ফলে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াই জনগণের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন মূলনেত্রী হিসাবে।
দেশজুড়ে গণআন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ঠিক সেই সময় এরশাদের ভরাডুবি অবধারিত বুঝতে পেরে ভারতীয় চাণক্যদের ইশারায় আওয়ামীলীগ এরশাদের সাথে গাঁটছড়ায় ইতি টেনে আবারগণ-আন্দোলনে এসে শরিক হয়। জামায়াতও অবস্থা বুঝে এরশাদের প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে আন্দোলনে ঢুকে পড়ে আওয়ামীলীগের পদাংক অনুসরণ করে।
১৯৮৬ সালের এরশাদের পাতানো খেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত উভয় দলই বিভিন্নভাবে লাভবান হয়েছিলো।
যাই হউক, এরশাদের কথা থেকে বুঝতে কষ্ট হলো না, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে চাণক্যপুরির সার্বিক সাহায্যে আবার আওয়ামীলীগ এবং এরশাদ জোট সরকার বানাবার ব্যাপারে প্রায় সুনিশ্চিত।জনসমর্থন খালেদার পক্ষে থাকলেও অনুগত কিংবা নির্দলীয় প্রশাসন, অর্থবল, সাংগঠনিক এবং পেশিশক্তির দিক থেকে এরশাদএবং আওয়ামী লীগ তুলনামূলক ভাবে বিএনপি থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী।এই চারটিউপাদানের উপরই বেশিরভাগ নির্ভর করে তৃতীয় বিশ্বের যে কোনও দেশের নির্বাচনী ফলাফল।
দীর্ঘ ৮ বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয় করণের কাজটি ভালোভাবেই করে নিতে সক্ষম হয়েছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং আওয়ামীলীগ। জামায়াতও এইক্ষেত্রে কিছুটা এগুতে সক্ষম হয়েছে জুনিয়র পার্টনার হিসাবে।
এই অশনিসংকেতে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। খালেদা জিয়াকে এরশাদের সিদ্ধান্ত বদল ও তার বক্তব্যের তাৎপর্য এবং বিশ্লেষণ খুলে বলা উচিৎ যাতে করে খালেদা জিয়া সতর্কতার সাথে এই কঠিন বাস্তবতার মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
আমাকে বিশেষভাবে চিন্তিত দেখে ছায়াসঙ্গী রব্বানি বললো
কি ব্যাপার, এতো চিন্তিত কেনো?
আমি তাকে খেলার নতুন অধ্যায় সম্পর্কে সব কিছু খুলে বললাম। সব শুনে রব্বানি বললো
শোনো, এই বিষয়ে আমার একটা বিশ্লেষণ আছে।
আগামী নির্বাচনের পর এরশাদ নয়,আওয়ামীলীগই সরকার গঠন কোরবে, জেনারেল এরশাদ হবে আওয়ামীলীগের সমর্থক শক্তি। আওয়ামীলীগ এবং ভারত জামায়াতকে ব্যবহার করতে চাইবে শুধু খালেদার ভোট কাটতে,তবে ক্ষমতায় জামায়াতকে অংশীদারিত্ব কখনই দেয়া হবে না। এরপরও কথা থাকে।
এরশাদকে আওয়ামী লীগের লেজুড় হয়ে বৈধতা দিতেই হবে। বৈধতা দেবার পরও জামায়াত নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নিবে তাদের বেঁচে থাকাই হয়ে উঠবে মুশকিল।
তাই রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া জামায়াতের আর কোনোও গত্যান্তর থাকবে না। খালেদা জিয়ার নির্বাচনী মোর্চায় ঢোকার সার্বিক প্রচেষ্টা করবে তারা। বিএনপির উচিৎ হবে তাদের গ্রহণ করা। আমি দৃঢ়ভাবেই বলছি, আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ১৯৮৬ সালের মতো হবে না।সেইসময় বিএনপি জোটের আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলার জন্যই জামায়াতকে সরিয়ে আনা হয়েছিলো।একই সাথে আওয়ামীলীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলকে বৈধতা দেবার জন্যই জামায়াতকে গুণতিতে নেয়া হয়েছিলো।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের কোনও প্রয়োজন হবে না জামায়াতের। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে এখনঅব্দি জামায়াত-এর গ্রহণযোগ্যতা আমজনতার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেটা বিগত ১৯৮৬ এর নির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
যেই বিষয়টি আমাকে বেশি ভাবিয়ে তুলছে সেটা হল, আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগ এরশাদকে সাথে নিয়ে ক্ষমতায় যায় তবে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী বিএনপি এবং ইসলামিক মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে ক্রমান্বয়ে। এই দুইটি দলই অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়বে সময়ের সাথে। পরিণামে দেশ পরিচালিত হবে নিও-বাকশালীদের দ্বারা।
তোমার বিশ্লেষণেওজন আছে, সেইক্ষেত্রে এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে।এই দুইদলের নেতৃবৃন্দকে বোঝাতে হবে বর্তমান বাস্তবতা। নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরেই উভয় পক্ষকেই অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হবে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে। এই সমঝোতার জন্য Common Friends দের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে।
হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে।
কি প্রশ্ন, জিজ্ঞেস করলো রব্বানি।
ধরো, এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করা গেলো। তারপরও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল এই জোটের পক্ষে শুধুমাত্র খালেদার জনপ্রিয়তা দিয়ে সার্বিকভাবে বেশি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষকে পরাজিত করা সম্ভব হবে কি? ভায়া, এই জনসমর্থনের বেশীরভাগই হচ্ছে Silent Majority. আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের স্ট্র্যাটেজি হবে তাদের অর্থবল, অনুগত প্রশাসন এবং পেশীশক্তি দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে করে ঐ Silent Majority ভোট কেন্দ্রে যেতেই না পারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।সেক্ষেত্রে এই জনপ্রিয়তা প্রত্যাশা অনুযায়ী কনও চমকপ্রদ ফল দেখাবার সুযোগ পাবে কি?
খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। তাই নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা নির্ভয়ে পোলিং বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারে। এর জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে প্রতিটি পোলিং বুথে। সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই দাবিটা জোরালো করে খালেদাকে অবশ্যই ওঠাতে হবে নির্বাচন কমিশনের কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের দাবির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ উঠবে না দেশে কিংবা বিদেশে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেবে না আওয়ামীলীগ, জেনারেল এরশাদ এবং তাদের প্রভু ভারত।
তবে এর প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। কারণ, এবারের নির্বাচনটা হবে একটি গণআন্দোলনের ফসল হিসেবে। এই বিষয়গুলোর সমস্ত কিছুই বোঝাতে হবে বেগম জিয়াকে।
Absolutely correct! অবশ্যই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সেই রাতেই খালেদা জিয়াকে ফোন করলাম।
হ্যালো, মোহাম্মদ বলছি।
বলুন, অপরপ্রান্তে খালেদা জিয়া।
জেনারেল এরশাদ মত পালটেছেন অদৃশ্য ইঙ্গিতে।দেশান্তরী হবেন না তিনি। জেনারেলএরশাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে থেকেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন।
অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন খালেদা জিয়া।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন তিনি দেশত্যাগ করতে রাজি আছেন। তবে আমি এটাও বলেছিলাম তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন ভারতের মর্জি মোতাবেক।
হ্যাঁ, তখন তিনি যা বলেছিলেন সেটাই আমি আপনাকে বলেছিলাম। এখন তিনি মত পাল্টে নির্বাচনে চাণক্যদের ষড়যন্ত্রের গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হতে বাধ্য হয়েছেন। ষড়যন্ত্রটি সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দিতে চাই, যদি আপনি শুনতে চান।
বলুন।
আমি সার্বিক বিষয়ে আমার আর রব্বানির বিশ্লেষণের সারবস্তু তুলে ধরলাম।
সব শুনে তিনি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন
আপনার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আপনি আমাকে যেই পথে এগুতে বললেন, তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। দেশের ভেতর থেকে বর্তমানে আমার জন্য সেটা যোগাড় করা সম্ভব নয়। বিত্তবানরা ইতিমধ্যেই আওয়ামীলীগ ও এরশাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে।তারা ধরেই নিয়েছে আওয়ামীলীগ আর এরশাদ মিলেই আগামী নির্বাচন জিতবে।
আমাদের সব একাউন্ট এরশাদ ক্ষমতা দখলের পরই বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলো, কি কষ্ট করে যে এতটুকু এসেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। নির্বাচনের জন্য সীমান্তের ওপার থেকে টাকার স্রোত বইছে। সেই স্রোতের বিরুদ্ধে একদম খালি হাতে কি টিকে থেকে মোকাবেলা করা সম্ভব ভাই?
কথাটা ঠিকই বলেছেন। তাছাড়া যাদের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাজনীতির জন্য টাকার ব্যবস্থা করতেন তাদের প্রায় সবাই তো জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পরই এরশাদের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। এখনো তারা এরশাদের সাথেই আছে সেটা আমি জানি।
আমার বক্তব্য শুনে হয়তো কিছুটা বিব্রত বোধ করে থাকবেন খালেদা জিয়া।আবার অল্প সময় নিয়ে বললেন
আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন।
বলুন।
আপনার ছোটভাই স্বপনকে আমি নির্বাচন করার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সে রাজনীতিতে আসতে রাজি নয় বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে আপনি কি আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন না?
সরকারি চাকুরে হিসাবে সেটা সম্ভব নয়। তারচেয়ে বড় কথা হল,
যে কারণে জেনারেল জিয়ার চীন সফর করার সময় তার অনুরোধ রক্ষা করে তার সাথে একত্রে রাজনীতি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেই কারণটি এখনও বর্তমান। তাছাড়া দেশে ফিরে আপনার জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম হবো সেটা করার মতো মানুষ দেশেই যথেষ্ট রয়েছে। তার চেয়ে বিদেশে থেকেই ওই সমস্ত বিষয়ে আমি যদি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি যা দেশে থেকে কারও পক্ষে করা হয়তো সম্ভব নয়, তাহলে সেটাই বেশি লাভজনক এবং শ্রেয় নয় কি? আর্থিক সঙ্গতি এবং জামায়াতের সাথে নির্বাচনী ঐক্য এই দুইটি উপাদানই আপনার জন্য আগামী নির্বাচনে মূল বিষয়। আমি চেষ্টা করে দেখবো এই বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হয় কিনা।
আপনার এই আন্তরিক উদ্দগ, সবকিছুর জন্যই আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো ভাই।
ভাবী, আমরা কিন্তু কারও ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করছিনা।আমাদের সব প্রচেষ্টা হচ্ছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যতদিন বেঁচে থাকি আমরা এই চেতনাকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রোথিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাবো,সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকেই। আমাদের সেই চেষ্টায় কোনও ব্যক্তিবিশেষের যদি লাভ হয় সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনি অনুগ্রহ করে যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যান, আমরাও আমাদের চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখবো না। ফল কি হবে সেটা একান্তভাবে নির্ভর করবে আল্লাহ্ সুবহান ওয়া তায়ালার উপর। রাখি আজকের মতো। পরে প্রয়োজনে আবার যোগাযোগ করবো। আল্লাহ্ হাফেজ। রেখে দিলাম ফোন।
আমাদের কথোপকথনের বিষয়বস্তু রব্বানির মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে কোনও অসুবিধাই যে হয়নি সেটা তার দু’চারটা প্রশ্ন থেকেই বুঝে নিলাম। ঠিক হলো, আগামীকাল আমরা দু’জন বোসব আমাদের পরবর্তী করণীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করতে।
সন্ধ্যার পর রব্বানি এলো নাসরিনকে সাথে নিয়ে। আমিও ক্লাব থেকে ফিরে এসেছি। Annual Inter Club Tennis Tournament চলছে পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবে।
আমি সেখানে এবার অংশ নিচ্ছি নাইরোবি ক্লাবের পক্ষ থেকে। পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবেরও মেম্বার আমি। তাই আমার এই পক্ষপাতিত্বে বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।পরে একটা সমঝোতা হয়, পরের বছর আমি পার্কলেনস্পোর্টস ক্লাবের তরফ থেকে খেলবো।
নাসরিনদের আসার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে। পরিচারিকা বিত্রেস কফি পরিবেশন করে গেলো। কফিউৎপাদনে কেনিয়া পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। চা-ও উৎপন্ন হয় কেনিয়াতে। বেশিরভাগই রপ্তানি করা হয়ে বিদেশে। ছোট ছোট পাহাড় আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এই দুইটি উপাদান কফি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। হঠাৎহাউস কিপার আলতাফ এসে খবর দিলো লন্ডন থেকে ফোন এসেছে। বাবু সাহেব ফোন করেছেন। ফোনটা প্লাগ ইন করে রিসিভারটা আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিলো আলতাফ। অপ্রত্যাশিত নয়, অস্থির হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবু ও নেলি আবার ফোন করেছে।
: হ্যালো, আমি বাবু বলছি। কি খবর ডালিম ভাই?
: খবর বিশেষ ভালো না। গতকাল জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলে হতাশ হয়ে পড়লাম, তিনি মত পালটে জানালেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশ ছাড়বেন না।তিনি নির্বাচন করে নাকি ১৫০টা সিটে জিতে সরকার গঠন করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি আওয়ামীলীগের সাথেও নির্বাচনী জোট বাঁধবেন। তার এই ধরনের ডিগবাজিতে আমি হতবাক হয়ে গেছি বাবু!এই আজগুবি হঠকারি সিদ্ধান্তের ফায়দা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করবে আর জেনারেল এরশাদকে স্থান নিতে হবে শ্রীঘরে।
কি বলছেন ডালিম ভাই, দুলাভাই শেষে আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সাহায্য করে জেলে যাবেন!
আমার তো তেমনটিই মনে হচ্ছে। কারণ, সরকার গঠনের পর মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সিট ভাগাভাগির পর এরশাদ সাহেবের আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না আওয়ামী লীগের কাছে।সেই অবস্থায় জনগণের সাবাশি পাবার জন্য দুর্নীতি ও অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা গ্রহণ এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের চার্জে তাকে জেলে পুরতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হবে না হাসিনা এবং তাদের প্রভু ভারত। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি জেনারেল এরশাদের হবে সেটা হচ্ছে, তার পিঠে ভারতের দালাল হিসাবে একটা চিরস্থায়ী স্ট্যাম্প লেগে যাবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে হাসিনার পেটিকোটের নিচে থেকেই একদা দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদকে থাকতে হবে আওয়ামীলীগের তাঁবেদার হয়ে ভারতের ইঙ্গিতে। ভারতের দালালী আওয়ামীলীগের তাঁবেদারী, কারাবাস এটাই হবে তার নিয়তি। আমি তার মত না পাল্টানোর ঘোর বিরোধিতা করে বলেছিলাম, ৮ বছর তো রাজত্ব করলেন, এখন শেষ বয়সে ভারতের দালালী আর হাসিনার চাকরি না করে কিংবা জেলে না পচে বাইরে চলে আসলে কিছুটা হলেও সম্মানের সাথে আগামী দিনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেই ভালো করতেন। কিন্তু আমার সেই আবেদনে কর্ণপাত করলেন না জেনারেল এরশাদ। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় বাবু, আমি জেনারেল এরশাদের চেয়ে ডেইজি ভাবীর কথাটাই বিশেষভাবে ভাবছি। শারীরিকভাবে তিনি একজন অসুস্থ মহিলা। এতসব ঝামেলা তার পক্ষে কি সহ্য করা সম্ভব হবে!
ডালিম ভাই, আমার একটা অনুরোধআপনি কি দুই-এক দিনের জন্য লন্ডন আসতে পারেন?যদি আসতেন, তাহলে দুইজনে মিলে দুলাভাইকে তার এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টা করতাম। আপাকেও বলতে পারতাম চাপ সৃষ্টি করে বাইরে চলে আসার জন্য।
মনে হচ্ছে তুমি ঠিক আমাকে বিশ্বাস করছো না!
না না, এটা আপনি কি করে ভাবলেন! আপনাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। বিশ্বাস করি বলেই অনুরোধ জানালাম, এলে সবাই মিলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতাম।
ঠিক আছে, আমি গোপনে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো। বাবু, আমার কিছু মেহমান রয়েছে তাই এখন রাখতে হচ্ছে ফোন। কিছু মনে করো না।
ঠিক আছে আমরা আপনার আসার প্রতীক্ষায় থাকবো, আল্লাহ্ হাফেজ।
উপস্থিত সবাইকে সবকিছু খুলে বললাম।
নিম্মি স্বল্পভাষী।হঠাৎসে বলে উঠলো
তোমরা বেগম জিয়াকে বাঁচানোর আর নির্বাচনে জেতানোর চেষ্টা করছো কেনও? তিনি তো তার স্বামীর রাজনীতিকেই আরও শক্তভাবে এগিয়ে নেবেন। এতে দেশ বা জাতির কি লাভ হবে বলতে পারো?
হাসিনার তুলনায় খালেদা তো Lesser Evil. বললো রব্বানি।
চরিত্রগত ভাবে হাসিনা এবং খালেদা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এর প্রমাণ সময়মতো আপনারা ঠিকই পাবেন। জানো নাসরিন, এদের মাথায় খালেদার যে ভূত চেপে বসেছে সেটা দূর হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। Let them learn from their own experience. ডালিম তো বরাবরই মানুষ চিনতে ভুল করে এসেছে।এটা নিজে না মানলেও প্রমাণিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, আমি সেই সমস্ত সবই জানি। জিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধকাল থেকেই যে স্বপ্ন তারা দেখে আসছিলো সেই স্বপ্নও যে নির্ঝরে ভঙ্গ হবে সেটাও আমি ওকে বলেছিলাম। একগুঁয়ে মানুষ তাই, কখনোই তর্কে যাই না। কারণ সেটা হবে অর্থহীন। Time shall prove Khaleda to be if not more but no less fraudulent and mischievous than her late husband General Ziaur Rahman. চলো, আমার ঘরে। সেখানে আরামে বসে গল্প করা যাবে- বলেনাসরিনকে সাথে নিয়ে উঠে চলে গেল নিম্মি। আমি আর রব্বানি কফির পেয়ালা হাতে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। স্তব্ধতা কাটিয়ে রব্বানিই মুখ খুললো
সত্যিই কি নিম্মি যুদ্ধের সময় বলেছিলো যে জিয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়?
হ্যাঁ বলেছিলো
তাহলে তো মেনে নিতেই হবে তার কথায় ওজন রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে জেতানোর চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনোও গত্যন্তরও যে নেই
এবারের নির্বাচনে কোনোভাবে যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে তবে বাংলাদেশের মাটি থেকে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক শক্তিকে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলা হবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্যের নিগড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সত্তা। ভবিষ্যৎহয়ে উঠবে নেপাল, ভুটান কিংবা সিকিমের মতো। তাই সব জেনেও Lesser Evil-কেই সাহায্যের চেষ্টা করতে হবে।যেকোনো কারণেই হউক, বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের কাছে খালেদা জিয়াই হয়ে উঠেছেন ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার ধ্বজাধারী। সেই বিবেচনায়, আমি মনে করি আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সেটা যত সামান্যই হউক না কেন, চালিয়ে যেতে হবে খালেদা জিয়ার জন্য নয়- বাংলাদেশের ভবিষ্যৎএবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থেই।
হ্যাঁ বন্ধু তুমি ঠিকই বলছো। তাহলে, রব্বানি এই যুদ্ধের একটা রোডম্যাপ তুমিই ভাই ঠিক করে ফেল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা এখান থেকে কি ভাবে শুরু আর কোথায় গিয়ে হবে তার শেষ!
রব্বানি জানালো-গত রাতে ফিরে যাবার পর এইসব নিয়েই সারা রাত ভেবে একটা রোড ম্যাপ ও ইতিমধ্যেই ঠিক করে নিয়েছে। আমি যদি সম্মত হই তবে সেই ভাবেই এগোনো যেতে পারে।
ঠিক আছে, বলো শুনি তোমার রোডম্যাপটা কেমন।
রব্বানি বলা শুরু করলো
১। বাবুর মাধ্যমে শেষ চেষ্টা করতে হবে এরশাদকে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে আসার। যাতে তার দল বিএনপির ভোট কাটতে না পারে।
২। খালেদার আর্থিক সঙ্গতির জন্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে যেখানে আমাদের পূর্বপরিচিত প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব রয়েছে তাদের মাধ্যমে ঐ সমস্ত দেশের ক্ষমতাসীনদের বুঝিয়ে খালেদাকে অর্থের যোগান দানের জন্য সম্মত করার চেষ্টা করতে হবে।
৩। অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে অতীতের সব তিক্ততা ও ব্যবধান বাদ দিয়ে জামায়াত এবং বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অন্যান্য সমমনা ভারত বিরোধী ছোট ছোট দলগুলোকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গঠনে বাধ্য করতে হবে।
৪। আমাদের প্রচেষ্টার চারণভূমি হবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, গণচীন এবং পাকিস্তান।আমরা যদি যুক্তি দিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মহলে পেশ করতে পারি তবে পাকিস্তানই হতে পারে এই প্রজেক্টের মূল চালিকাশক্তি।
৫। নির্বাচন কালে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেপ্লয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
গভীর মনোযোগের সাথে রব্বানির উপস্থাপনা শুনে বললাম
অতি উত্তম। তোমার রোডম্যাপ সম্পর্কে কোনও দ্বিমত কিংবা প্রশ্ন নেই আমার। আল্লাহ্র উপর ভরসা করে কালবিলম্ব না করে আমাদের কার্যক্রম শুরু করে দেই, কি বলো?
তাই করা উচিৎ।
তাহলে, কাল পরশুর মধ্যেই আমি লন্ডন হয়ে আসি?
পরশু কেনও কালই চলে যাও বন্ধু। শুভস্য শীঘ্রম।
ঠিক আছে।
তাঞ্জানিয়াতে ট্যুরে যাচ্ছি বলে, দারুস সালাম থেকে লন্ডন এসে পৌঁছালাম। পৌঁছেই বাবুর সাথে যোগাযোগ করলাম। বাসার সবাইকে বললাম বিশেষ কাজে লন্ডন এসেছি, তাই খবরটা গোপন রাখতে হবে। বাবু খবর পেয়েই এসে আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। যোগাযোগ হলো জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে। মোহাম্মদের মাধ্যমে পতিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেলো বাবু এবং নেলি।
বাবু নিজেই জেনারেল এরশাদকে আমার কথাগুলোই আবার বুঝিয়ে বললো
এখনো সময় আছে। আপনি আপাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। ডেইজি ভাবীকে জোর দিয়ে বাবু এবং নেলি দুইজনই বললো, দুলাভাই-এর কোনও কথাতেই যুক্তি নেই। তাই অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে তাদের দেশ থেকে বাইরে আসা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। তাদের দেশ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে অবিলম্বে, তা না হলে সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে সহসাই। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। আমাদের অনুরোধে ডালিম ভাই গোপনে লন্ডন পর্যন্ত এসেছেন যাতে করে দুলাভাইকে সবাই মিলে দেশের বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে রাজি করানো যায় দেশ ছাড়ার জন্য।
বাবু, নেলি এবং ভাবীর জোরের মুখে এরশাদ কিছুটা দোটানায় পরে জানালেন আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। এরপর বাবু আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো।
ফিরে এসে যোগাযোগ করলাম খালেদা জিয়ার সাথে। বললাম
এরশাদকে দেশ থেকে বের করে আনার শেষ চেষ্টা করছি। আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন।
কিন্তু বেগম জিয়া জানালেন
এদিকে হাসিনা সেই রাস্তা বন্ধ করার জন্য প্রেস কনফারেন্স করতে যাচ্ছে জানতে পারলাম। সেখানে হাসিনা হুঁশিয়ার করে দিয়ে দেশবাসীকে বলবেন
তিনি জানতে পেরেছেন কিছু লোক ক্ষমতাচ্যুত দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক যাতে দেশত্যাগ করতে পারে সেই চেষ্টা করছে। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না দেশের জনগণ এবং আওয়ামী লীগ। এরশাদকে অবিলম্বে শ্রীঘরে পাঠানোর দাবিও তুলবেন হাসিনা।এই অবস্থায় তার প্রেস কনফারেন্সের আগেই যদি এরশাদ দেশ না ছাড়েন তাহলে পরে তাকে বিদেশে পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। বললেন খালেদা জিয়া। খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা।
আচ্ছা, আমি দেখছি কতটুকু কি করতে পারি।
অবস্থা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে চলেছে। খালেদা জিয়ার কথায় উদ্বিগ্ন হয়ে তক্ষুনি বাবুকে ফোন করে বললাম আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাবু এসে পৌঁছালো।
কি ব্যাপার ডালিম ভাই, এত জরুরী তলব!
জরুরীই বটে।এইমাত্র খালেদা জিয়ার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম দেশের অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে।
বাবুকে খালেদার আলাপের সার সংক্ষেপ খুলে বললাম। সব শুনে বাবু হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
ভেঙ্গে পড়ার সময় এটা নয় বাবু, রাজনীতির খেলায় এখন সময় খুবই কম। তাই সময় নষ্ট না করে জেনারেল এরশাদকে শেষবারের মতো বোঝাতে চেষ্টা করতেই হবে।সে জন্যই তোমাকে আবার ডেকে পাঠাতে বাধ্য হলাম। আবার গিয়ে উপস্থিত হলাম বাবুদের বাসায়।
ফোন করলাম জেনারেল এরশাদকে।
স্যার, হয়তোবা আপনার সাথে শেষবারের মতো কথা বলছি। আমি আপনার শত্রু নই। আমি আপনাদের দু’জনকেই শ্রদ্ধা করি ব্যক্তিগত ভাবে। তাই অতি বিনয়ের সাথেই বলছি নতুন ফাঁদে পা ফেলে কেনোও বাকি জীবনটা গোলাম হয়ে থাকতে চাইছেন? ভাবীকেও কেনও কষ্টে ফেলছেন?এই বয়সে এই ধরনের কাজ কি শোভা পায়? Enough is enough, Sir.
বাবু খালেদা জিয়া থেকে সদ্যপ্রাপ্ত খবরটা জানিয়ে আকুতি জানাতে লাগল দেশ ছেড়ে আসার জন্য।
এরশাদ সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বললেন
খবরটি কিছুতেই সত্য হতে পারে না। কারণ, নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলেও তিনি আওয়ামীলীগের সাথেই কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন সেটাই ঠিক হয়ে আছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ প্রধান হাসিনা এ ধরনের দাবি কিছুতেই উত্থাপন করতে পারে না তাদের স্বার্থেই।
তিনি দেশে থেকেই রাজনীতি করবেন এবং আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার নেতৃত্বেই সরকার গঠন করবেন তিনি। ক্ষমতার মোহ জেনারেল এরশাদকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ করে তুলেছে। তার একগুঁয়েমিতে এখানে বাবু নেলি আর ঐদিকে ডেইজি ভাবী কাঁদছেন।এমন একটা বিদঘুটে অবস্থায় পড়তে হবে সেটা জানা ছিল না।
শেষবারের মতো রিসিভার হাতে নিয়ে আমি বললাম
স্যার, যখন থেকে আপনি আর আপনার দোসররাগৃহবন্দী হয়েছেন আপনারা তো নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ করতে পারছেন না, তাই না? সেই অবস্থায় আমি কেন আপনার সাথে এবং খালেদা জিয়ার সাথে যেভাবেই হউক নিজ থেকেই যোগাযোগ করলাম?এতে আমার কি স্বার্থ সেটা একটু বুঝিয়ে দিলে কৃতার্থ হতাম।
থমকে গেলেন এরশাদ।
সত্যি, এতে তোমার কি স্বার্থ সেটা তো ভেবে দেখিনি!
তাহলে এখন ভেবে বলুন। কেনই বা বাবু আর নেলির অনুরোধে গোপনে এখানে এসে আপনার সাথে এতো কথা বলছি দয়া করে তার কারণটাও বুঝিয়ে দিন।
হয়তো তুমি আমাদের ভালবাসো। তাই এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ ভেবে পাচ্ছি না। তুমি একজন নির্লোভ, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। নিজের জন্য কখনোই তোমাকে কারো কাছেই কিছু চাইতে দেখিনি আমি।
আপনার জবাবটা আংশিক সত্য। তবে আর একটা কারণ রয়েছে। সেটা হল, এই মুহূর্তে দেশের চলমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কি ঘটছে সেই সম্পর্কে আমি হয়তোআপনার কিংবা খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি না হলেও কিছুটা অবগত।আমি কিন্তু অনুমানভিত্তিক কোনও কিছুই বলছি না।যা বলছি সেটা তথ্যভিত্তিক।এটা খালেদা জিয়া মেনে নিয়েই আমার সাথে কথা বলছেন। আমার অনুরোধেই উনি জিয়া হত্যা সম্পর্কে আপনার ভূমিকার প্রায় সবকিছু জানার পরও আপনাকে সপরিবারে দেশের বাইরে চলে আসার ব্যাপারে সব বন্দোবস্ত করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এই বন্দোবস্ত করাটা খুব সহজ ছিলো না। কিন্তু আপনি দুঃখজনক হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাইছেন না। তাহলে কি বুঝবো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?
তোমাকে আমি অবিশ্বাস কোরবো সেটা তুমি ভাবলে কি করে?
ভাবতে আপনি বাধ্য করলেন, স্যার। এরপরও শেষবারের মতো অনুরোধ জানাচ্ছি, আজকের রাতের মধ্যেই বেরিয়ে আসুন। বাবু যা বলেছে তার সত্যতা কালকের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনি দেশে জেলবন্দী অবস্থা উপভোগ করতে চান নাকি বিদেশে মুক্তঅবস্থায় থাকতে চান- এটাই এখন আপনার বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ। আমার কথা না হয় ছেড়েই দেন, এখানের সবাই যেভাবে আপনাকে মিনতি জানাচ্ছে, তাদের কথা আপনার মেনে নেয়া উচিৎ ছিল। এখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি বলবো মানুষ হিসাবে আপনি অতি স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী। সেনাবাহিনীর আপনার পালিত জেনারেলরা তো আপনাকে মসনদে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হল। ফলে, আপনারা সবাই এখন গৃহবন্দী। আওয়ামীলীগ আর জামায়াত বাতাস বুঝে আপনাকে পরিত্যাগ করলো। চাপে পড়ে আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। আপনার এই দুর্দিনে আপনার বিদেশী প্রভুরা কেউই এগিয়ে এলো না আপনাকে উদ্ধার করতে? তারা সবাই এখন আপনাকে কি করে Toilet Paper হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেটাই ভাবছে। এ সমস্ত খবরাখবর জানার পরও আপনি দিবাস্বপ্নতেই বিভোর, এটা সত্যি বিস্ময়কর! আপনি অবগত নন, বর্তমানে দেশের মানুষ আপনার প্রতি এতোটাই ক্ষুব্ধ যে আপনাকে নাগালের মধ্যে পেলে তারা আপনার সুগঠিত শরীরটাকে বটি বটি করে চিল আর শকুনকে খাওয়াতো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যেই সুযোগটা সৃষ্টি করেছিলাম সেটার কদর যখন আপনি করলেনই না এর পরিণতিটা কি হবে সেটা আপনি অচিরেই দেখতে পাবেন। আমার এই প্রচেষ্টায় আন্তরিকতার কমতি ছিল না। অতএব ঘটনা ঘটার পরও বিকারগ্রস্ত হয়ে আপনি একই কথা বলে চলেছেন, আগামী নির্বাচনে জিতে আপনিই আবার সরকার বানাবেন। সেই কারণে আপনি দেশত্যাগের সুযোগটা গ্রহণ করবেন না!
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
খুবই ভালো। আমিও দেখবো অদূর ভবিষ্যতে পতিত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের শেষটা কেমন হয়। এখন থেকে আমার আর কোনও দায়িত্ব রইলো না। আপনার সাথে মোহাম্মদের আর আলাপ হবে না। নিয়তি থেকেই শিক্ষা নিতে হবে আপনাকে।
ভাবীকে বললাম
আপনি আল্লাহ্র সাথে রুজু রাখবেন, তিনিই ভবিষ্যতে আপনার সহায় হবেন। আমরাও দোয়া করবো। আল্লাহ্ হাফেজ।
বাবু বললো
ডালিম ভাই, আপনার কাছে আমরা চিরঋণী থাকবো। ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট কোরব না। আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করুন।
বাবু আর নেলিকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে এলাম বাসায়।
পরদিনই হাসিনার প্রেস কনফারেন্সের খবর প্রচারিত হল। এরশাদ এবং তার পরিবারকে বন্দী করা হয়েছে। তাদের গুলশানের বাড়িটাকেই ‘সাব জেল’ আখ্যায়িত করে সবাইকে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আওয়ামীলীগ জোর দাবি জানাচ্ছে, স্বৈরশাসক এর স্থান সাব জেল নয়, তাকে পাঠাতে হবে নাজিমুদ্দিন রোডে।
ফিরে এলাম নাইরোবিতে। সব কিছু জানালাম পরম বন্ধু রব্বানিকে। সব শুনে রব্বানি ভবিষ্যদ্বাণী কোরল
জেলে থেকে এরশাদ নির্বাচনে তেমন বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে বিগত রাষ্ট্রপতি হিসাবে কিছু সিট পাবে বিশেষ করে রংপুর আর উত্তর বঙ্গে। সেটাই হয়তো হবে তার রক্ষাকবচ।
সূচীপত্র [প্রতিটি পর্বে্র নীচে ক্লিক করলেই সেই পর্বটি পাঠ করতে পারবেন]
১ম পর্ব “জিয়া থেকে খালেদা তারপর” – লেখকের কথা
২য় পর্ব শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানীর সাথে শেষ সাক্ষাত
৪র্থ পর্ব – কিছু বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের জবাব
৭ম পর্ব – বঙ্গভবনে কি হচ্ছিল রাত ১২ টায়!
৮ম পর্ব – বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হলো জেনারেল জিয়াকে
৯বম পর্ব – “সংঘর্ষের পথে জিয়া”
১০ম পর্ব – খন্দকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে এলেন সাদ্রে ইস্পাহানী
১১তম পর্ব – শিশু ভাই এলেন ব্যাংককে
১৩তম পর্ব ১ম কিস্তি – রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
১৩তম পর্ব – ২য় কিস্তি- রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
১৪তম পর্ব – বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জমির এলেন সস্ত্রীক
১৬তম পর্ব – শিশুভাইকে বেনগাজীতে আসার অনুরোধ
১৭তম পর্ব – ১ম কিস্তি – জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে
১৮তম পর্ব – বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস
১৯তম পর্ব – জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক
২০তম পর্ব – লন্ডন হয়ে ফিরলাম বেনগাজীতে
২১তম পর্ব – ঢাকা হোয়ে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা
২২তম পর্ব – বাংলাদেশে নীতি বিবর্জিত কুটুম্বিতার রাজনীতির রূপ
২৩তম পর্ব – জিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে
২৪তম পর্ব – রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়ার গণচীনে দ্বিতীয় সফর
২৫তম পর্ব – আব্বার উপস্থিতিতে প্রথম রাতে জেনারেল জিয়ার সাথে আমার বৈঠক
২৭তম পর্ব – জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চীন সফর
২৮তম পর্ব – চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিক্রিয়া
২৯তম পর্ব – চীন থেকে লন্ডনে নির্বাসন কালে
৩০তম পর্ব – জেনারেল মঞ্জুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল
৩১তম পর্ব – নিউইয়র্কের পথে জেনারেল এরশাদের সাথে লন্ডনে সাক্ষাৎ
৩২তম পর্ব – খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ার পার্সন
৩৩তম পর্ব – জেনারেল এরশাদের প্ররোচনায় রশিদ-ফারুক বানালো ফ্রিডম পার্টি
৩৪তম পর্ব – ১ম কিস্তি – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
৩৪তম পর্ব – এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ-শেষ কিস্তি
৩৫তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান – ১ম কিস্তি
৩৬তম পর্ব – ১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান – শেষ কিস্তি পেশাওয়ারের পথে
৩৭তম পর্ব – ফিরে এলাম নাইরোবিতে
৩৮তম পর্ব – নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে যাত্রা
৪০তম পর্ব – ১ম কিস্তি – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ
৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ – ২য় কিস্তি
৪০তম পর্ব – প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ- শেষ কিস্তি
৪১তম পর্ব – রুহানী জগতের আর এক সূফি সাধকের সান্নিধ্যে
৪২তম পর্ব – আমাকে আবার খালেদা জিয়ার জরুরী তলব
৪৩তম পর্ব – ব্যাংকক ট্রানজিট লাউঞ্জে
৪৪তম পর্ব – হংকং হয়ে বেইজিং – ১ম কিস্তি
৪৪তম পর্ব – হংকং হয়ে বেইজিং – শেষ কিস্তি
৪৫তম পর্ব – হংকং হয়ে ফিরলাম ঢাকায়
৪৮তম পর্ব – নাইরোবিতে প্রত্যাবর্তন
৫১তম পর্ব – ২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ
৫২তম পর্ব – দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়াতের
প্রতিক্রিয়া
৫২তম পর্ব -দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়েতের
প্রতিক্রিয়া – শেষ কিস্তি
৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – ১ম কিস্তি
৫৩তম পর্ব – বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম – শেষ কিস্তি