৩৩তম পর্ব
জেনারেল এরশাদের প্ররোচনায় রশিদ-ফারুক বানালো ফ্রিডম পার্টি
ভায়রাদ্বয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দল গঠন
করে টাকার থলে হাতে ঝুলিয়ে আর ১৫ইআগস্টকে বেচে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেবে অতি সহজেই আর অর্থের যোগান বন্ধ করে
দিলে প্রগশ-এর হবে অপমৃত্যু। ফলে আমরা তাদের তাঁবেদার হয়ে
রাজনীতি করতে বাধ্য হবো।
এ ভাবেই তারা দলে তাদের নেতৃত্ব নিশ্চিতকোরে রাখবে।এক উদ্ভট
বালখিল্য চিন্তা চেতনা !
যাই হউক, একদিন ভায়রাদ্বয় আমাদের সাথে বৈঠকে এরশাদের প্রস্তাব
আর তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনায় বসলো।
সব কিছু শুনে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, প্রগশের কিহবে? জবাবে তারা বললো
জেনারেল এরশাদ যখন খোলা রাজনীতির সুযোগ দিচ্ছেন তখন
গোপন রাজনীতির প্রয়োজন নেই। তাদের নতুন পার্টি, নাম ফ্রীডমপার্টি (FP)-এর সাথে প্রগশ এর মার্জ হয়ে যাওয়া উচিৎ।
কিন্তু যেখানে প্রগশের সাংগঠনিক কাজ অতিদ্রুত এগিয়ে চলেছে
তখন তোমাদের নেতৃত্বে নতুন আর একটি দল গঠিত হলে সেটা নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এবং একই সঙ্গে অনেক
প্রশ্নেরও জন্ম দেবে। যার সঠিক উত্তর দেয়া কঠিন হতে পারে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে যারা আমাদের সাথে একত্রে রাজনীতি করতে
রাজি হয়েছেন আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ, রাজনৈতিক আদর্শ এবং
ম্যানিফেস্টোতে বিশ্বাসকরে- অন্য কনোও লোভে নয়। এরপরও
কথা থাকে। জেনারেল এরশাদ যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন, তাকে বৈধতা দিতে কর্নেল ফারুকের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার
বিষয়টিও প্রগশের প্রেসিডিয়াম-এর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই হওয়া
উচিৎ। শুধু তোদের দুইজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে
পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দের কাছে। তাছাড়া জেনারেল জিয়াকে
বিশ্বাস কোরে খোলা রাজনীতি করতে গিয়ে বিগত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এবং তার পার্টির করুণ পরিণতি সম্পর্কে আমরা সবাই
বিশেষ ভাবে অবগত। জেনারেল এরশাদকে বিশ্বাস করে আমাদের
এবং ফ্রিডম পার্টিরও যদি তেমন পরিণতি হয় তাহলে আমাদের
অবস্থা কি হবে এই বিষয়ে তোরা ভেবেছিস কি? আমরা মনে করি এরশাদ জিয়ার রাজনীতিতে তেমন কনও পার্থক্য থাকবে না। তিনি যদি আমাদের প্রতি আন্তরিকই হতেন তবে বাকিদের বাদ দিয়ে শুধু তোদের দুই জনকেই রাজনীতি করতে দিচ্ছেন কি উদ্দেশ্যে সেটা সম্পর্কেও তদের ভাবা উচিত ছিল।
রশিদ জবাবে বললো
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা ইতিমধ্যেই জেনারেল এরশাদকে জানিয়ে
দিয়েছি। সেই ক্ষেত্রে যারা আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে আমাদের দলে
যোগদান কোরবে তাদের সাথে নিয়ে চলবো। বাকি যারা দ্বিমত পোষণ
করবে তারা কি কোরবে সেটা তাদেরকেই ভেবে দেখতে হবে।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এতদিন সবাই জেনে এসেছে
আমরা সবাই এক।
কিন্তু এখন সবাইকে তোরা জানিয়ে দিতে চাচ্ছিস আমরা এক নই। এই ধরনের দ্বিধা বিভক্তি ভবিষ্যতে আমাদের সবারজন্যই ক্ষতিকর হবে।
এই দিকটাও তোদের ভেবে দেখা উচিৎ ছিল। জেনারেল এরশাদকে কথা দেবার আগে অন্তত আমাদের সাথে তোদের দুইজনের আলাপ করাটা
উচিৎছিল। প্রগশের কাজ কিন্তু আমরা সর্বসম্মতি ক্রমেই একত্রে শুরু
করেছিলাম। এর কি জবাব দিবি তোরা? কর্নেলফারুক বললো
তখন এই সুযোগটা ছিল না। এখন যখন সুযোগটা এসেছে তখন
এটাকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না বলেই আমরা জেনারেল এরশাদকে কথা দিয়ে এসেছি।
One has to be pragmatic in politics.
অবশ্যই, তবে সেটাও করা উচিৎ পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী।
আমার কথায় চুপ হয়ে গেলো দুইভায়রা ভাই। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে
রশিদ বললো
আমাদের যা বলার বলে গেলাম।
এখন তোরা কি কোরবি সেটা ভেবে জানিয়ে দিস।
তাদের কথাবার্তায় পরিষ্কার বোঝা গেলো তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তাদের এই ধরনের আচরণ আমাদের এক মহা সংকটে ফেললো।
আমরা সবাই বুঝতে পারলাম
এই অবস্থায় প্রগশের কাজ আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না
টাকার অভাবে।
তাই অবিলম্বে প্রগশের কাজ স্থগিত করে দিতে হবে শাহরিয়ার
আর হুদাক।কারণটা নেতা-কর্মীদের বুঝিয়ে বলতে হবে। বলতে হবে
স্বৈরচারী এরশাদ তার বেআইনি ভাবে ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেবার জন্য কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুককে প্রকাশ্য রাজনীতিতে
অংশ গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে এবং দুইজনই সেই সুযোগ
গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্য সবার সাথে কোনও পরামর্শ না কোরেই।
কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের বেশিরভাগ নেতারা তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ
করায় তারা একটি নতুন দল গঠন করছে। এই অবস্থায় প্রগশের
প্রেসিডিয়াম সিদ্ধান্ত নিতে পারে প্রগশ নতুনপার্টিতে মার্জ কোরবে কি কোরবে না। প্রেসিডিয়াম সিদ্ধান্ত নেয়
প্রগশ নিজের অস্তিত্ববজায় রেখে আগের মতোই গোপনে তাদের
তৎপরতা চালিয়ে যাবে।
একই সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়,
স্বৈরাচারীএরশাদের সাথে প্রগশের কনোও সম্পর্ক থাকবে না। অর্থের সংকুলান সম্ভব না হলে প্রগশ নিজের সামর্থ অনুযায়ী অগ্রসর হবে।
তবে ইতিমধ্যে কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুক যাতে
দ্বিমত পোষণকারী আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের ভাবমূর্তি
ক্ষুন্ন করতে না পারে সেই বিষয়ে কৌশলগত একটা পদক্ষেপ
গ্রহণ করতে হবে।
পার্টির প্রেসিডিয়াম-এর এই সিদ্ধান্তটি ছিল বিশেষগুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্তগৃহীতহয়,
প্রথমে মেজর বজলুল হুদা পরে কর্নেল শাহরিয়ার ফ্রিডম পার্টিতে
যোগ দেবে দুইভায়রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেলএরশাদ জিতলেন আওয়ামীলীগ
সমর্থিত প্রার্থী হয়ে।
পীর হাফেজ্জি হুজুর দ্বিতীয় এবং কর্নেল ফারুক তৃতীয় স্থান লাভ করে।
সংসদীয় নির্বাচনে জেনারেলএরশাদের জাতীয়পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফ্রিডমপার্টি ১টি সিট লাভ করে, মেজর বজলুল হুদা (ফ্রিডমপার্টিরসেক্রেটারিজেনারেল)। বিএনপি দুটো নির্বাচনই
বয়কট করে।
আওয়ামীলীগএবংজামায়াতেইসলামী নির্বাচনেঅংশগ্রহণ করে। জামায়াত ১০ টি আসনে জিততে সমর্থ হয়। শেখহাসিনা বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলংকৃত করেন। এভাবেই বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারী ভারতের দালাল জেনারেল এরশাদ আওয়ামীলীগের
সমর্থনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা উপভোগ করতে
সক্ষম হন গায়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরে।
আমাদের অনুমানকে সঠিক প্রমানিত করলেন জেনারেল এরশাদ।
জেনারেল জিয়া প্রণীত রাজনীতি হাইজ্যাক করে একই কায়দায়
রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন জেনারেলএরশাদ।
ফলে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন, শোষণ, নিপীড়ন তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বক্ষেত্রে ক্যান্সারেরমতো ছড়িয়ে পরতে থাকে দ্রুত। দূষিত হয়ে ওঠে দেশের রাজনীতি। এরশাদ আর হাসিনার চাপে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দলের তখন খুবই করুণ হাল। সুযোগ সন্ধানী বাস্তুঘুঘুদের বিবর্জিত শূন্য খাঁচা পাহারা দিচ্ছেন তখন গৃহবধূ খালেদা জিয়া। প্রতিদিন গুটিকতক তরুণনেতা-কর্মীর সাথে পার্টি অফিসে বসে মাছি মেরে সময় কাটাচ্ছেনপার্টির চেয়ারপার্সন।
তার সেই দুঃসময়ে তারপাশে যারা ছিল তাদের মধ্যে বি চৌধুরী, সাইফুর রহমান, মীর্জা গোলাম হাফিয, যাদু মিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, তরিকুল ইসলাম। তরুনদের মধ্যে গয়েশ্বররায়, মীর্জা আব্বাস, খোকা, সাঈদ,বুলু, মাহফুজ, আলাল, রিজভী, খোকার নাম উল্লেখযোগ্য। বদরুদ্দোজাচৌধুরী,কর্নেলওলিএবংঅন্যরা মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে
আসাযাওয়া করতেন। বেগম জিয়া এবং তার দলের নিষ্ক্রিয়তা
দেশের জাগ্রত জনতাকে হতাশ করতেপারেনি। দেশবাসীক্রমশএরশাদেরস্বৈরশাসনেরবিরুদ্ধেসোচ্চারহতেথাকে। দেশব্যাপী এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানাবেঁধে উঠতে থাকে
জনগণেরস্বতঃস্ফূর্তঅংশগ্রহণেরমাধ্যমে।
জেনারেলএরশাদএবংতার দলের জনপ্রিয়তায় দ্রুত ধস নেমে আসতে থাকে।
সেইসময় দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধেবিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদী
আমজনতা বেগম খালেদা জিয়ার দিকেই চেয়েছিলো এরশাদ বিরোধী গণচেতনাকে সংগঠিত করে এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে।
এরফলে নতুনকরে জীবনীশক্তি ফিরে পায় নিষ্ক্রিয় দল বিএনপি
আর এরশাদবিরোধী আন্দোলনেরমাধ্যমে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন
দেশনেত্রী।
১৯৮৬সালে জেনারেলএরশাদযখন নির্বাচনের ব্যবস্থা করছিলেন তখন
দেশের বড় দুইদল আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির মধ্যেএকটা সমঝোতা হয় যে এই দুই বড় দল জেনারেলএরশাদের অধীনে কোনও নির্বাচনেঅংশগ্রহণ করবে না। এই সমঝোতার পর লাল দীঘির ময়দানে এক জন সভায় দর্পভরে হাসিনা এলান করে, “যে এরশাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবে তাকে জাতীয় বেঈমান বলে আখ্যায়িত করা হবে।“
কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তেসেই সমঝোতা ভঙ্গ করে
জেনারেল এরশাদের সাথে শেখ হাসিনা এক রাতে গোপন লংড্রাইভ থেকে
ফিরে দেশবাসীকে হতবাক করে ঘোষণা দিলেন আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশনেবে।নিয়েও ছিল যৌথআন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে।
জামায়াতেইসলামীও নির্বাচনে অংশ নেয়।
বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
তখন থেকে দেশবাসী খালেদাকে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করে। বলা হয়ে থাকে, সেই মোহিনী রাতে লংড্রাইভে জেনারেলএরশাদ হাসিনাকে দিয়েছিলেন ১৭কোটি টাকা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্য।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যতই বেগবান হতে থাকলো ততই খালেদা
জিয়ার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সেই পাতানো খেলার নির্বাচনের ফলেএরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নতুনমাত্রা সংযোজিত হল। আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার চরম অবনতি,লাগামহীন দুর্নীতির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় এবং সংকট, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, রাষ্ট্রীয়সন্ত্রাস, ডাঃমিলনসহ অসংখ্য শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণহানি, হয়রানি, মামলা, জেলজুলুম, অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কিতমানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে।
দেশের ভিতরের এবং বাইরের খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে এরশাদের পতন অনিবার্য। আওয়ামীলীগ এবং তাদের মুরুব্বি ভারতও সেটা বুঝতে পারে।
তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অবিলম্বে এরশাদের সঙ্গ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনে পুনরায় শরিক হবে। পার্টি হিসাবে আওয়ামীলীগের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই ঐ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিলো। জামায়াত ও আওয়ামীলীগের পদাংক অনুসরণ করে। এরশাদকে বোঝানো হল,ভবিষ্যতে খেলা চালু রাখার স্বার্থেইএইসিদ্ধান্ত। তাকে আশ্বস্তও করা হল লাইনে চললে তার কনোও ক্ষতি হবে না। আশ্চর্যের বিষয় হল,
তখনকার চলমান আন্দোলনের বিতর্কহীন একচ্ছত্র নেত্রী হয়েও
খালেদা জিয়া শুভঙ্করের ফাঁকিটা ধরতেপারলেন না! সত্যই বিচিত্র বাংলাদেশের রাজনীতি!
দুর্বার গণ-আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়ায়
জেনারেলএরশাদ সিদ্ধান্ত নিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে তাকে কারাবন্দী করার। কিন্তু ভারতীয় চাণক্যরাএরশাদকে জানান দেয় যে, শুধুমাত্র খালেদাকে জেলে পুরলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সম্পূর্ণভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
তাই হুলিয়া জারি করতেহবে দু’জনের নামেই।
তবে সরেজমিনে স্বৈরশাসকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্যহবে
খালেদা জিয়া এবং তার সহযোগী অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা। এভাবেই
ভারত তাদের বড়ে হাসিনাকে ভবিষ্যতেরজন্য মাঠে
জীবিত রাখতে সক্ষম হয়।
ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষ আনুগত্যের সাথে রাষ্ট্রপতিএরশাদ
দুইনেত্রীর বিরুদ্ধেই হুলিয়া জারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। হুকুম জারি করা হল। হুলিয়া জারি করার পর প্রকাশ্য আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে
খালেদা জিয়া ও তার সহযোগী অন্যান্য নেতারাও আন্ডারগ্রাউন্ড যেতে বাধ্য
হলেন। কিন্তুজেনারেল এরশাদের এই সিদ্ধান্ত তার জন্য বুমেরাংহয়ে উঠলো। গণ-আন্দোলন তীব্রতর হয়ে প্রায় গণবিস্ফোরণের পর্যায়ে পৌঁছালো।
বিএনপির সাথে আলোচনার পর অন্যান্য দলের অতি উৎসাহী নেতৃবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন সারা দেশ থেকে জনসমুদ্র ঢাকায় সমবেত করে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাধ্য করা হবে। ফলে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিও ঘোষিত হল।
সেই ঘোষণার সুযোগ নিয়ে প্রেসিডেন্টএরশাদ নিজের অস্তিত্বও গদি বাঁচানোর জন্য তার হাতের শেষঅস্ত্র দেশেমার্শালল’ জারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাার ঘনিষ্ঠ সহচরদের প্ররোচনায়।
তার এই সর্বনাশা সিদ্ধান্তে যারা বিশেষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে
জেনারেল আতিক, জেনারেল সাদেক,জেনারেল আব্দুর রহমান,
জেনারেল মান্নাফ, জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল মীরশওকত, জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জেনারেল নাসিম, জেনারেল আশরাফ, ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদ,ব্রিগেডিয়ার রফিক,ব্রিগেডিয়ার আমসাআমিন, ব্রিগেডিয়ার হাফিজ, ব্রিগেডিয়ার নাসের, কর্নেল মালেকের নাম উল্লেখযোগ্য।
এরা প্রায় সবাই ছিল পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার।
জেনারেল এরশাদের এইধরনের সিদ্ধান্তে দেশের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতেহবে। শুরু হবে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ! দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরবে দেশের সেনাবাহিনী সহআইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী সব বাহিনী। সেই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রাষ্ট্রপতি অতি সহজেই আহ্বান জানাতে সক্ষম হবেন ভারতীয় সরকারের সাহায্যের জন্য‘২৫বছরেরমুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তির আওতায়। সেই মোক্ষমসুযোগটিলুফেনেবেভারত। শক্তিধরভারতীয় বাহিনী ঢুকে পরবে দেশের ভেতর। তাদের প্রবল আগ্রাসনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন বড়ে জেনারেল এরশাদ এবং তারসহচরদের সাথে গণ-অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ক্ষমতায় বসানো হবে হাসিনার নেতৃত্বে নব্য বাকশালীদের। তার সরকারের সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সামরিক বাহিনী, বিভিন্নআইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবংএজেন্সি, রাজনৈতিকঅঙ্গন, আমলাতন্ত্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী যারাই অবশিষ্ট আছে তাদের সমূলেউৎপাটন করা হবে।
একই সাথে সব বাহিনী এবং এজেন্সিকে দলীয় বরকন্দাজ হিসেবে
গড়ে তোলা হবে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য অতি সতর্কতার সাথে। ফলে বাংলাদেশকে পরিণত করা হবে একটি করদ রাজ্যে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশী মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আবার হিন্দুদের
দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হবে। এভাবেই বাস্তবায়িত হবে ‘৭১-এর ভারতীয় চাণক্যদের প্রণীত সুদূরপ্রসারী নীলনকশা।
যেকোনো প্রকৃত দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে এই পরাজয় মেনে নেয়া কখনোই সম্ভব নয়। এই ধরনের সুযোগ না দেবার জন্যই
ভারতের হাতের ক্রীয়ানক ব্রিগেডিয়ার খালেদএবংকর্নেলশাফায়াত জামিল যখন
২-৩রা নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটিয়েছিল তখন তাদের পরাজিত করার মতো শক্তি থাকা সত্ত্বেও সুচিন্তিত কৌশল গ্রহণ করে
স্বেচ্ছায় সাময়িক ভাবে দেশত্যাগ করেছিলাম তাদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে।
নিজেদের শক্তি বলেই সেনা পরিষদের প্রকাশিত শীর্ষ নেতারা ব্যাংককে অবস্থান নিয়েও সক্ষম হয়েছিলেন ঐতিহাসিক ৭ই
নভেম্বরের সফল সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাতে। এই বিপ্লবে সেনাপরিষদের সাথে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থাও যোগ দিয়েছিল সহযোগী শক্তি হিসেবে।
এসম্পর্কে বিস্তারিত পরিকল্পনা দেশত্যাগের পূর্বেই করা হয়েছিলো বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের সাথে রুদ্ধদ্বার একদ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। এসম্পর্কে আমার পূর্বপ্রকাশিত বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’তে
বিস্তারিত ভাবে লেখা আছে। পাঠকদেরপক্ষেএখন বইটি সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে তারা নিম্নে দেয়া ওয়েব সাইট দুটোর যে কোনোও একটি থেকে পছন্দ মতো বাংলা কিংবা ইংরেজিতে ডাউনলোড করে নিতেপারেন। ওয়েবসাইটএড্রেসঃ
www.majordalimbubangla.com এবংwww.majordalimbu.com
একই সুযোগ না দেবার জন্য জেনারেল জিয়ার অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতার পরও সেনাপরিষদ এবং সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধাচরণ না করে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নির্বাসিত জীবনকেই মেনে নিয়েছিলেন।কারণ তাদের সবাই ছিল সবচাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। তারাকখনোই শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা
লিপ্সু ছিলেন না। তাদের সংগ্রামের একমাত্র লক্ষ্য ছিল জনগণ তাদের নিজেদের ক্ষমতাশালী করে গড়েতুলুকএকটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী,ন্যায়, সাম্য এবং জাতীয় ঐক্যভিত্তিক সুখী বাংলাদেশ। এইস্বপ্ন তাদের মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূক হয়ে থাকবে আমৃত্যুকাল।
চলবে