জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম

২৭তম পর্ব

জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চীন সফর

সফরকালে তিনি একান্তে আমাকে জানালেন
জিয়ার ভ্রান্ত রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে দেশে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনও সময়ে জিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ হতে পারে। তাই তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত। তিনি এ ব্যাপারে জিয়াকে অবগত করার চেষ্টা করে বিফল হচ্ছেন। এই অবস্থায় তেমন কিছু ঘটলে সেনাপ্রধান হিসাবে তার কি করা উচিৎ সে বিষয়ে তিনি অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার মতামত জানতে চাইলেন। জবাবে আমি জেনারেল এরশাদকে বললাম
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের যে কোনও দেশেই সামরিক বাহিনীর একজন সৈনিকের পক্ষে যেখানে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অবকাশ রয়েছে সেখানে সেনাপ্রধান এর পদভারে আপনি তো অতি সহজেই জিয়ার গদিটা দখল করে নিতে পারবেন। এই বাস্তবতাটা আপনি ভালোভাবেই বোঝেন এবং তার জন্য আপনি প্রস্তুতিও নিচ্ছেন সেটা মনে করার যুক্তি রয়েছে তাই নয় কি, স্যার?
আমার উত্তরটা শুনে জেনারেল এরশাদ সরাসরি একটা অনুরোধ জানালেন
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান হিসাবে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থেই আমার উপর অর্পিত দায়ভার তো আমাকে নিতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তোমাকে বিশ্বাস করেই একটা অনুরোধ করতে চাই। আমি চৈনিক শীর্ষস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দেশের বর্তমান আসল অবস্থাটা জানাতে চাই। যদি সেই রকমের কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেই সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তারা যাতে আমাকে তাদের বন্ধু হিসাবেই সমর্থন জানায় সে চেষ্টা তুমি করবে। তুমি নিশ্চয় আমার সাথে একমত হবে এই ধরণের স্পর্শকাতর বিষয় প্রতিনিধি দলের সাথে যে সমস্ত আনুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে সেখানে আলাপ-আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃত্বের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য তোমাকে একটি গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমি জানি সেই যোগ্যতা তোমার আছে।

ধূর্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ চৈনিক নেতৃবৃন্দের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। তার মানে ড্রপসিন পড়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে! পালাবদলের সন্ধিক্ষণে আগামীদিনের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিকে সরাসরি মানা করে দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই বললাম
ঠিক আছে স্যার, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
চেষ্টা নয়, এই বৈঠকের ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে। মরিয়া হয়ে আবারও অনুরোধ জানালেন জেনারেল এরশাদ। তাছাড়া
বাংলাদেশ-গণচীনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বৈঠকটি হওয়া অতি প্রয়োজন বোধ কোরেই বৈঠকের ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছিলো। বৈঠকের আয়োজন হল।
গোপন সেই বৈঠকে আমাকে উপস্থিত থাকতে অনেক পীড়াপীড়ি করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। কারণ, আমি জানতাম বৈঠকের পর চৈনিক নেতারা আমাকে তাদের কথাবার্তার সবকিছু জানিয়ে এরশাদের বক্তব্যের উপর আমার মন্তব্য জানতে চাইবেন। হয়েছিল ঠিক তাই।
চীনা নেতৃবৃন্দ বিশেষভাবে জানতে চেয়েছিলেন জেনারেল এরশাদের চরিত্র এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে।
জেনারেল এরশাদ চীনা নেতাদের বলেছিলেন, তিনি আন্তরিক ভাবেই বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। তবে ভারত সম্পর্কে তার মনোভাব জানতে চাইলে জেনারেল এরশাদ চীনাদের জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। উপরন্তু ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ সম্ভব। তার এমন বক্তব্যের উপর আমার অভিমত জানতে চাওয়ায় আমি চৈনিক বন্ধুদের বলেছিলাম
জেনারেল এরশাদ পরিবারের মূল প্রোথিত রয়েছে ভারতের কুচবিহারের দিনহাটায়। সুতরাং কৃতজ্ঞতা জানানো আর সেবাদাস হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিয়ে দেশটাকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার নীলনকশা বাস্তবায়নে ক্রিয়ানক হওয়ার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে প্রবাসী সরকার গঠনের শর্ত হিসাবে যেই ৭দফা চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলো ভারত সরকার সেই চুক্তিকে পরিবর্ধন করে ২৫ বছর মেয়াদী অসম মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে একটি দাসখতই মনে করে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একমাত্র আওয়ামী লীগ এবং বাকশালীরা ছাড়া। ভারত তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশেষ করে শরণার্থীদের যেই পরিমাণ সাহায্য দিয়েছিলো তার হাজার গুণ তারা সুদে আসলে বাংলাদেশ থেকে লুটে নিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বিদেশ থেকে প্রেরিত সাহায্য সামগ্রীর সিংহভাগই আত্মসাৎ করে নেয় দুর্নীতিপরায়ণ প্রবাসী সরকারের সহযোগিতায়। তবে তাদের মূল দুটো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে

প্রথমটিঃ পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দেশটিকে দুর্বল করে তোলা।

দ্বিতীয়টিঃ বাংলাদেশ নামের একটি করদ রাজ্য কায়েম করে ভারতে চলমান বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামীদের পয়গাম দেয়া যে, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র কখনোই তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না ভারত-নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া। অতএব তাদের নিজস্ব স্বার্থেই উচিত হবে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পথ ত্যাগ করে বিশাল ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এর জন্য ভারতীয় চাণক্যরা প্রণয়ন করেছিল এক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা। তাদের এই হীন নীলনকশা সম্পর্কে আমরা ছাড়াও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই জানতে পারে এবং তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে নিজেদের গোপনে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ভারতের নীলনকশার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার লক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে।

জেনারেল জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে একান্তভাবে তার নিজস্ব উদ্যোগে নয়। সেই ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন বাঙ্গালী জুনিয়র অফিসার আর সৈনিকদের চাপে অনেকটা জীবন বাঁচানোর তাগিদেই। তবুও তার সেই ঘোষণার ফলে তিনি প্রবাসী এবং ভারতীয় সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার হিসেবে। ফলে যুদ্ধের শুরুতেই তাকে সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে এনে কোলকাতার হেড কোয়ার্টারে ডাম্প করা হয়। জিয়া রাজনীতি সম্পর্কে তেমন সচেতন ছিলেন না জেনারেল এরশাদের মতোই। তাদের অল্পবিস্তর যে জ্ঞান সেটা সীমাবদ্ধ ছিল জেনারেল আইয়ুব খান থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রাজনীতি পর্যন্ত। গণমুখী রাজনীতি সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না। যাই হউক, আমাদের সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে নেবার জন্য বহুল পরিচিত সৎ জাতীয়তাবাদী একজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রয়োজন দেখা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে। বেছে নিয়েছিলাম মন্দের ভালো জিয়াকেই তারই ইচ্ছায়।
’৭১-এর স্বাধীনতার যুদ্ধটাকে আমরা দেখেছিলাম জাতীয়মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ধাপ হিসেবেই যাতে পরবর্তীকালে সম্ভব হয় সার্বিক মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া জিয়াকে কেন্দ্র করে।
যেমনটি আপনারা এ্যাংলো-স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলদারিত্ব থেকে সান ইয়েত সেনের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করেছিলেন দেশকে। তারপরেই আপনাদের গণমুক্তির সংগ্রামের পথ সুগম হয়ে ওঠে এবং চরম বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়। সব বিচারে জিয়ার সমতুল্য তখন আর কেউই ছিল না তাই সর্বসম্মতিক্রমে আমিই তার সাথে গোপনে যোগাযোগ করে ভারতীয় নীলনকশা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলি। সব শুনে, তিনি আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে সম্মত হন এক শর্তে। ক্ষমতার কেন্দ্রে তাকে উপবিষ্ট করার আগ পর্যন্ত তার সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হবে। আমাদের তরফ থেকে তার সেই শর্ত মেনে নেয়া হয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন তিনি বিপ্লবীদের সাথে ওয়াদার বরখেলাপ করে ভারতের সাথে সমঝোতা করে ক্ষমতার রাজনীতির পথ বেছে নেন।
তার এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত জবাব দেয়ার মতো সামরিক বাহিনীতে আমাদের সাংগঠনিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও তখন আমরা তার বিরুদ্ধে কোনও সংঘর্ষে না যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ, তাতে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে সহজেই, কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না দ্বিধাবিভক্ত সামরিক বাহিনী ও জাতিকে নিয়ে।
এরপর আমাদের শক্তি খর্ব করার জন্য তিনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না নিয়ে বিদেশে নির্বাসনে রাখার ব্যাবস্থা করলেন এবং আমাদের গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন সেনা পরিষদের তিন হাজারেরও বেশি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী সেনা সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ এ বর্ণিত দর্শন অনুযায়ী হত্যা করেন নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার জন্য।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার এ সমস্ত ভুল পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে সেনাবাহিনীতে জিয়া আজ নিষ্ঠুর এক ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে অতি দ্রুত। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এবারের সফরে তিনি আমার পিতাকে ডেপুটি হেড অফ ডেলিগেশন এবং আমার নিকট পরিবারের সদস্যদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যস্থতায় তিনি দুই রাতে আমার সাথে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর একান্তে আলোচনা করেন। প্রথম রাতের আলোচনায় আমার পিতাও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা কালে তিনি বলেছিলেন, তিনি অনেক ভুল করে ফেলেছেন। একই সাথে তিনি আমাদের সাহায্য চাইছিলেন তাকে বাঁচাতে। কিন্তু তিনি নিজে যে গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন তা থেকে এখন আমাদের পক্ষেও তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তার ভুলের মাশুল তাকেই গুণতে হবে।
জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে বন্ধুরা জানতে চেয়েছিলেন। তাই আমি বলেছিলাম
ব্যক্তি হিসাবে জেনারেল এরশাদ একজন চরিত্রহীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বল চরিত্রের মানুষ। তিনি মিথ্যেবাদী এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এরশাদ যখন ভারতে NDC Course করছিলেন তখনি তিনি ভারতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে এসেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতীয় খেলায় জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে সেনাপ্রধান হিসাবে জেনারেল এরশাদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। RAW-এর পরামর্শ মোতাবেক এগুচ্ছেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন হিসাবে একদিকে জিয়াকে উস্কে দিচ্ছেন জেনারেল মঞ্জুর এবং বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, অপরদিকে পুরনো সহকর্মী জেনারেল মঞ্জুরকে আশ্বাস দিচ্ছেন জিয়ার বিরুদ্ধে যদি জেনারেল মঞ্জুর কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তবে তিনি তাকে পূর্ণ সমর্থন জানাবেন বলে। এভাবেই RAW-এর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি এক ঢিলে দুই পাখি বধ করার ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। একই সাথে এরশাদ চেষ্টা করছেন সামরিক বাহিনী থেকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী অফিসার ও সৈনিকদের একই জালে আটকে নির্মূল করতে। ভারতের সুতার টানে এরশাদকে যথাসময় রাজনৈতিক সমর্থন দেবে হাসিনার আওয়ামীলীগ। এ ছাড়া প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে জেনারেল এরশাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আমার বক্তব্যের সত্যতা সময়েই যাচিত হবে।
চীনা বন্ধুরা জানতে চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সফরের পর আমি বেশ কিছুদিন চীনের বাইরে ছিলাম এবং পরে ঢাকাতেও গিয়েছিলাম। এর কারণটা কি?
জবাবে বলেছিলাম
এগুলোও জেনারেল জিয়ার ইচ্ছাতেই বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিলো। দীর্ঘসময় আলাপের পরও যখন আমার পক্ষে অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে তার সাথে একত্রে রাজনীতি করার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হলো না, তখন জিয়া অনুরোধ জানালেন আমি যাতে বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য সহযোদ্ধা এবং সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যারা বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সাথে আলোচনা করে দেশে গিয়ে সরেজমিনে সব দেখেশুনে সার্বিক অবস্থা বুঝে তাকে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা জানিয়ে আসি। আমার পিতার জবরদস্তির ফলে তার সেই প্রস্তাবটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল। আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা জিয়ার মনঃপুত হবে না। পরিণতিতে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া যাই করবেন তার জন্য আমরা সবাই তৈরি হয়েই আছি।
সেই বৈঠকে সব শুনে বিশ্বস্ত চীনা অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান নেতারা আন্তরিকভাবেই বলেছিলেন
বন্ধু হিসাবে আপনি আন্তরিকভাবে আমাদের যেসব মূল্যবান তথ্য জানালেন তার জন্য ধন্যবাদ জানালে আপনাকে ছোট করা হবে। আপনি একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় বীরই নন, পরম বন্ধুও বটে। আমাদের এই বন্ধুত্ব বংশানুক্রমে বজায় থাকবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আপনার এবং আপনার অন্যান্য বীরসহযোদ্ধা সাথীদের কর্মস্থল হওয়া উচিত বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা অবগত হলাম যে বর্তমানে আপনাদের দেশে ফেরার পথে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। তবে সময় বদলায়, আর তার সাথে সৃষ্টি হয় নতুন সুযোগ। সেই সুযোগের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে থাকুন, নিশ্চয় উপযুক্ত সময় আপনারা দেশে ফিরে আপনাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন। বিপ্লবের পথ বন্ধুর ও কন্টকাকীর্ণ একটি চলমান ধারা। এতে রয়েছে উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাই, এরপরই আসে বিজয়। কথাগুলো পরিণত গোধূলি বেলায়ও কানে বাজে।

এই দুষ্কর কাজটি সাধন করার জন্য চাই দাগহীন চরিত্র, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ কিছু সাহসী মানুষ যারা ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব আকর্ষণ ত্যাগ করে এসে শামিল হতে পারে নিপীড়িত শোষিত মানুষের কাতারে। তাদের ব্যক্তিগত উদাহরণে উজ্জীবিত হয়ে তাদের নেতৃত্বে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ত্বরিত গতিতে আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে লাখো-কোটি জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের পরিণত করবে এক অপরাজেয় শক্তিতে। এটাই হচ্ছে বিপ্লব।
এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির পক্ষেই সম্ভব সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশকে রূপান্তরিত করতে একটি দুর্জয় ঘাঁটিতে। এ ধরণের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর লৌহ-কঠিন জাতীয় ঐক্যকে পরাজিত করতে পারে না কোনও বিদেশী অপশক্তি। এটাই ইতিহাসের লিখন।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক দেশেই এ ধরনের বিপ্লবকে সফল করে তুলেছেন কিছু নিবেদিতপ্রাণ সাহসী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশেও সেই সুযোগ এসেছিল ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধকালে। তারপর আবার সেই সুযোগের স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা ও জনগনণর সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
কিন্তু সেই সুযোগ মরীচিকায় পরিণত হয় কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির অন্ধগলিতে ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা এবং অদূরদর্শিতায়।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *