১৭তম পর্ব – শেষ কিস্তি
সবাই মেঝেতে শুয়ে বসে গেঁজাচ্ছিলাম। হঠাৎ অতি আপনজন বন্ধুবর সাচৌ (বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) এসে উপস্থিত।
কোথায় ডালিম, আওয়াজ দিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই বললো
এক্ষুনি তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। তুই বাসায় ফিরেছিস খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছি।
উসকো খুসকো চুল, চোখে মোটা লেন্সের চশমা, শুকনো মুখ।
বললাম, কোথায়?
কাপড় বদলে নে জলদি।
যাচ্ছি, বলে নিজের ঘরে গেলাম কাপড় বদলাতে।
বোঝাই যাচ্ছে আপনার দুপুরের খাওয়া হয়নি, আসুন একটু খেয়ে নিন।
ঠিক ধরেছিস। চল, বলে মহুয়ার সাথে সাচো খাবারের টেবিলে গিয়ে বসল। ওর খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই আমি রেডি হয়ে ওর কাছে এসে বললাম
তলবটা বেশ জরুরী মনে হচ্ছে?
গাড়ীতেই আলাপ হবে। খাবারের সময় কথা বলা সুন্নতের খেলাপ বলেই গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করে কেয়ার কাছ থেকে একটা পান মুখে পুরে সিগারেট ধরিয়ে সবাইকে বলল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব। আমার গাড়িতেই যেতে হবে।
হুকুম মতো সাচোর গাড়িতে উঠে বসলাম। সাচো গাড়ি চালাচ্ছিল বেশ দ্রুতগতিতে। বুঝতে পারছিলাম কেউ কোথাও অপেক্ষা করছিল।
কিরে, শারলক হোমসের এর মতো কোথায় নিয়ে চলেছিস বলত?
জেনারেল মঞ্জুর তোর জন্য অপেক্ষা করছেন।
আশ্চর্য! কেন?
পাকিস্তান আর্মির চৌকস অফিসার ‘গ্যুডেরিয়ান’ নামে খ্যাত জেনারেল মঞ্জুর তার ভারিক্কি ভাব বজায় রেখে জুনিয়র অফিসারদের সাথে তেমন একটা মিশতেন না। তার স্ত্রীতো তার চেয়েও এককাঠি সরস ছিল এই বিষয়ে। যুদ্ধকালে আমাদের অনেক পরে মেজর জিয়াউদ্দিন আর মেজর তাহেরকে সাথে নিয়ে শিয়ালকোটের ব্রিগেড মেজর সপরিবারে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কোয়েটা থেকে আমরা মেজর তাহেরকে সাথে নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকে এ্যাবোটাবাদ বদলি করে দেয়ায় তিনি আমাদের সাথে পালাতে পারেননি। এ সম্পর্কে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে বিশদভাবে লেখা রয়েছে। পরে যখন কর্নেল আবু ওসমানকে দুর্নীতির জন্য সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে মেজর মঞ্জুরকে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার বানানো হয়েছিল তখন আমিও ঐ সেক্টরের গেরিলা এডভাইজার ছিলাম, কিন্তু তার সাথে তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেনি। তিনি নিজেই যখন সবার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে ভালবাসতেন তখন আমরাও গায়ে পড়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করিনি। তিনি বরাবরই ক্যারিয়ার সম্পর্কে খুবই সচেতন থাকতেন।
স্বাধীনতার পর থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যে যা কিছুই ঘটেছে তার থেকে তিনি সযত্নে নিজেকে সর্বদা সরিয়েই রেখেছেন। আস্থাভাজন হিসাবে স্বাধীনতার পর পরই তাকে ভারতে পাঠায় মুজিব সরকার মিলিটারি এটাচি করে।
এরপরও আমি তাকে ১৫ই আগস্টের পর ভারত থেকে ডাকিয়ে এনে বলেছিলাম
স্যার, এখানে আপনার প্রয়োজন। তাই দিল্লী থেকে আপনাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। তিনি জবাবে তেমন কোন উৎসাহ দেখাননি। তার প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম!
পট পরিবর্তনের পর তোরা সবাইতো ডাকের অপেক্ষা না করে ছুটে এসেছিলি বিপ্লবকে সমর্থন করে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে পুনর্গঠিত করার কাজে এবং বিভিন্ন দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-গ্রুপ এর নেতা-নেত্রীদের সাথে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য যোগাযোগের ব্যাপারে তোর অবদান কম ছিল না। ৭ই নভেম্বরের পর ভারত থেকে ফিরে জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন CGS হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন, কি প্রয়োজনে সেটাই ভাবছি।
সেটা আমারও জানা নেই তাই আমিও ভাবছি, গেলেই বোঝা যাবে।
আমরা বনানীর একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছালাম। কার বাড়ি সেটা আমি জানতাম না।
‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনেকেই অনেক কথা বলার চেষ্টা করে চলেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এদের বেশীর ভাগ দিগগজ এবং বোদ্ধারা কিন্তু নিজেরা তেমনভাবে যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। তাই তাদের শোনা কথা এবং কল্পকথায় স্বচ্ছতার যথেষ্ট বৈপরীত্য ধরা পড়ে। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না বলেই এই সব অপপ্রচারে স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এর জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধারাই। বেশীরভাগ কমান্ডাররা যে কোনো সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যোদ্ধাদের বৃহদাংশের সার্বিক মনোভাব প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে কি ধরনের স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের স্বপ্ন এবং কাম্য এ সম্পর্কে তেমন কোনও দলিল রেখে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। যারাই লিখেছেন তারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ সম্পর্কেই লিখেছেন যেখানে তারা ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধের ঘটনাগুলো লিখে রাখাটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে তার চেয়েও বেশী তাদের লেখা উচিৎ ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আপামর জনগণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ অঙ্গীকার। যাকে বলা চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং Guerrilla Advisor to the Sector Commanders হিসেবে রণাঙ্গনের প্রতিপ্রান্তে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী এবং পেশা থেকে আগত আবাল বৃদ্ধ বণিতা, ইয়ুথ এবং শরণার্থী ক্যাম্পের অভিবাসী এবং সাধারণ জনগণের সাথে মিশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা কি ছিল সেটা পাঠকদের কাছে বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করে একটি রাষ্ট্র, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সবারই প্রত্যাশা ছিল, রক্তের বদলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নতুন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে, সেটা গড়ে তুলতে হবে নতুন আঙ্গিকে। সেখানে থাকবে না মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের আধিপত্য। তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়, প্রশাসন, আইন-আদালত এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি ও স্ব-নির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি সুষম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামের মাধ্যমেই সৃষ্টি হবে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তির। অগ্রণীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন পরীক্ষিত জনদরদী, নির্লোভ, আত্মত্যাগী, সাহসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাদের হতে হবে আপোষহীন। বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছাড়া এই ধরনের বাংলাদেশ গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব হবে না। বিগত কালের ঘুণে ধরা ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিসরে আনতে হবে আমূল মৌলিক পরিবর্তন। তবেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার। এই ধরনের একটি রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠন তখনই সম্ভব হবে যখন দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের সৃজনশীল কর্মশক্তি এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর পূর্ণসুযোগ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রগতির পথে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠনের আর কোন বিকল্প পথ নেই। এটাই ছিল ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্ন। স্বল্পকথায় জাতি চেয়েছিল এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে তারা উপভোগ করবে আর্থ-সামাজিক পরিসরে সম-মর্যাদা, আইনের শাসন, জান ও মালের নিরাপত্তা, আদালত, প্রশাসন, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ থেকে নিরপেক্ষতা। সুখ ও শান্তির দেশ, যেখানে সর্বক্ষেত্রে শিকড় গাড়বে গণতান্ত্রিক এবং স্বকীয় মূল্যবোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় দেশকে প্রগতির পথে সমৃদ্ধশালী করে গড়ার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের অঙ্গীকার।
কিন্তু এই চেতনা ও স্বপ্ন ছিল ভারতের স্বার্থবিরোধী। তাই তারা তাদের প্রসূত প্রবাসী সরকারের যোগসাজসে এই চেতনা এবং স্বপ্নের পরিপন্থী এক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে ভারত নির্ভর একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার লক্ষে। সেই পরিকল্পনার বিরোধিতার প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়েই রাজনৈতিকভাবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের আড়ালেই গড়ে তোলায় ব্রতী হয়েছিলেন একটি গোপন সংগঠন। স্বাধীনতার পর তাদের নিয়েই গড়ে তোলা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সেই গোপন সংগঠনের নামকরণ করা হয় সেনা পরিষদ।
যে কোনো জাতিকে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হতে হলে তাদের অবশ্যই জানতে হবে নিজেদের ঐতিহ্য, সঠিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস, জানতে হবে তাদের সম্পদ, সম্ভাবনা এবং জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে এবং সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে শত্রু-মিত্র কারা। বিশেষ করে, দেশের সামরিক বাহিনীরও থাকতে হবে এই সমস্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা। কারণ, সামরিক বাহিনী হচ্ছে যে কোনো দেশ এবং জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাস বিকৃতির জঘন্য প্রতিযোগিতায় একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু তথ্য তুলে ধরছি পাঠকদের অবগতি জন্য।
চলবে