জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা শরিফুল হক ডালিম

১৭তম পর্ব

৩য় কিস্তি

উর্দি পরা জেনারেল জিয়া বিশাল টিক উডের গ্লাসটপ টেবিল এর বিপরীত দিকে বসে অপেক্ষায় ছিলেন। Bottle Green Ray Ban চশমাটা টেবিলের উপর রাখা। তাঁর এই চশমা নিয়ে অনেক মুখরোচক গুজব বাজারে চালু আছে, কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি হলো বেশিরভাগ সময় তিনি ওটা পরে থাকতেন কারণ তিনি ছিলেন সামান্য লক্ষীট্যারা। তবে কাছ থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখলে বিষয়টি বোঝা ছিল কষ্টকর।
আমাকে ঢুকতে দেখে তিনি চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের এপাশে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন
অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। How are you and others keeping? বলেই তিনি আমাকে একটি চেয়ারে বসার ইশারা করে নিজে তার Revolving Chair-এ গিয়ে বসলেন।
বসে হালকা ভাবে জবাব দিলাম
যেমন রেখেছেন ঠিক তেমনই আছি স্যার।
জবাব শুনে একটু চিন্তা করে বললেন-
কি খাবে চা না কফি?
কফির কথাটা শুনে মনে পড়ে গেলো যখনই তাঁর বাসায় যেতাম তখন লনে কিংবা ড্রইংরুমে তিনি নিজেই কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। Inter Com-এ ADC কে নির্দেশ দিলেন জিয়া কফি পাঠিয়ে দেবার জন্য।
বলো, বেনগাজীতে তোমাদের কেমন কাটছে? How do you find Gaddafi?
রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে বিলাসবহুল পরিবেশে ভালোই সময় কাটছে আমাদের। গাদ্দাফি নিজেকে একজন ইসলামিক বিপ্লবী হিসেবে মনে করেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন তিনি সারাবিশ্বে তার ‘গ্রীন বুকের’ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একই সাথে তিনি একজন কট্টর পুঁজিবাদ ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বিরোধী হিসাবে বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সমস্ত সংগ্রাম চলছে তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছেন মোয়াম্মর মানে প্রিয় নেতা গাদ্দাফি।
মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ নেতারা তো রাজপ্রাসাদে শুয়ে মুসলিম উম্মাহর মুক্তির আর ইসলামের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এই তরুণ নেতা রাজপ্রাসাদে থেকেই কিন্তু বিপ্লবের স্বার্থে তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা মতো কাজ করে চলেছেন। প্রথমে নাসেরের ‘Pan Arabism’ তাকে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল, পরে তিনি ‘Pan Islamism’ এর দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন বিশ্বের মুসলমানরা নিজেদের ঈমানি শক্তি ফিরে পেয়ে বৈপ্লবিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী এবং ইহুদিবাদী আগ্রাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে লড়ে তাদের পতন ঘটাবে। বিশ্বজোড়া নিপীড়িত জনগোষ্ঠী এবং মুসলমানদের পুনর্জাগরণের বিষয়ে, বিশেষ করে বিশ্বপুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মোড়ল আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে গাদ্দাফি বদ্ধপরিকর। তার জন্য আয়ারল্যেন্ডের সিনফিন মুভমেন্ট, বৈরুতে হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের ফেদাইন, ইরিত্রিয়া, মিন্দানাও-এর মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, ক্রোশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব কয়টি দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য করে চলেছেন গাদ্দাফি পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেই।
মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ-আমীরদের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ। তার মতে, এদের সবাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাসীন হয়ে শুধু নিজের দেশবাসীরই নয়- পুরো উম্মাহর সর্বনাশ করে চলেছেন। তল্পিবাহক ওইসব কায়েমী স্বার্থবাদী বাদশাূ-আমীররা তাদের বিদেশী প্রভুদের ইশারায় মুসলিম উম্মাহকে শত ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে টাকার জোরে। তারাই বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফ্যাকড়াবাজি আর ফ্যাসাদের জন্ম দিয়ে বিভক্তির মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন তাদের দরিদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করে। গাদ্দাফির এই ধরনের চিন্তা ভাবনাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তেল গ্যাস সমৃ্দ্ধ ধনী বাদশাহ আর আমীররা তাকে উগ্রপন্থী এবং চরমপন্থী হিসাবে একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন, তাতে মোটেও বিচলিত নন গাদ্দাফি। তার চিন্তা-চেতনা আর কার্যক্রমের সমর্থনেই বোধকরি কবি লিখেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’, যদিও তার আদর্শের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দ্বিমত থাকার অবকাশ রয়েছে তারপরও বলতে হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তার মতো প্রগতিশীল নেতা সারা মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সংগ্রামী নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে, দেখেছি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই গাদ্দাফি একজন শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বস্ত আপনজন। অবশ্য এদের মধ্যে অনেককেই মনে হয়েছে সুবিধাবাদী, ধড়িবাজ শৃগাল। বলেই জেনারেল জিয়ার চোখে চোখ রাখলাম।
তিনি কিছুটা বিব্রত হয়েছেন বলেই মনে হল। চোখ সরিয়ে দরজার দিকে চাইলেন জিয়া।
দেখলাম ADC এর তত্ত্বাবধানে বেয়ারা খাবারের ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করছে। সাজানো ট্রে রেখে তারা ফিরে গেল জেনারেল জিয়ার ইশারায়। তিনি নিজেই দুটো কাপে কফি তৈরি করে একটা আমাকে দিয়ে অন্যটি নিজে নিয়ে বললেন
Let’s start and feel free.
Of course Sir, একটা প্লেটে কিছু পছন্দমতো খাবার তুলে নিলাম।
জানতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল গাদ্দাফি?
স্যার, গাদ্দাফি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী এবং তিনি বাংলাদেশের সাথে ভাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুবই ইচ্ছুক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। তিনি আমাদের নিঃসংকোচে বলেছেন তার দৃঢ় বিশ্বাস, বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের অধীনে বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে দ্রুততর গতিতে প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অসম্প্রদায়িক দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা রক্তের আহুতি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তারা অবশ্যই স্ব-নির্ভরতার ভিত্তিতেই নিজেদের একটি আত্মমর্যাদাশীল সুখী সমৃদ্ধশালী জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। আমাদের সাথে বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর তার এই প্রত্যয় নাকি আরো জোরদার হয়েছে। বাঁকা চোখে জিয়াকে পরখ করে দেখলাম তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠেছেন।
আমার সম্পর্কে তার কি ধারণা?
আপনি তো আমাদেরই একজন সেটাই গাদ্দাফি জানেন। তাই আপনার বিষয়ে আলাদাভাবে কোন আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। অবশ্য প্রয়োজন হলে সেটাও করার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া আপনার সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে, আপনার অনুরোধে তিনি আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে লালন করে আসছেন কেন? সুযোগ পেয়ে একটা খোঁচা দিয়ে দিলাম। ফলে, তার কালো মুখটা আর একটু কালো হয়ে উঠল। মন্দ লাগছিল না বর্ণচোরা জিয়ার অস্বস্তি দেখতে।
হঠাৎ Red Telephone বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিলেন CMLA জেনারেল জিয়া। অপরপ্রান্ত থেকে কে কি বলছিল শুনতে পারছিলাম না। এ তরফের জিয়া গভীর মনোযোগের সাথে ফোনের কথা শুনছিলেন আর গম্ভীর মুখে আমার দিকে চোখ তুলে বার বার চাইছিলেন। আমি নির্বিঘ্নে খাবার সাবাড় করছিলাম আর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। বেশ কয়েক মিনিট পর তিনি ‘Okay, I am looking into the matter’ বলে রিসিভার ক্রেডলে রেখে দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে কিছু ভাবছিলেন। ঘন ঘন Red Telephone বাজতে থাকায় জিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ছিল। ‘হুঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে অতি সংক্ষেপে আলাপ সারছিলেন জিয়া। তেমনই একটা কল শেষ হওয়ার পর জেনারেল জিয়া হঠাৎ Red Telephone এর রিসিভারটা ক্রেডল থেকে টেবিলে নামিয়ে ফোনটাকে engaged করে রাখলেন। একই সাথে ADC কে বললেন, তিনি না বলা পর্যন্ত যেন কোনো incoming call তাকে transfer করা না হয়। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে।
Dalim, something totally unexpected had happened! কর্নেল ফারুক এখন বগুড়ায়। Brigade Commander has been kept under house arrest and he has taken over the Brigade. সিঙ্গাপুর থেকে যোগাযোগের পর ফারুক থাই-এর একটি ফ্লাইট-এ ঢাকায় পৌঁছানোর পর একদল সৈনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাকে বিমান থেকেই তুলে নিয়ে প্রথমে সাভারে বেঙ্গল ল্যান্সার-এর যেই স্কোয়াড্রনটা রয়েছে সেখানে নিয়ে যায়। স্বল্পক্ষণ সেখানে থাকার পর সোজা বগুড়াতে, সেখানেই ল্যান্সারের মূল ইউনিটটা রয়েছে। এই ঘটনা আর তোমার এবং রশিদের দেশে আগমনের বার্তাটি যেভাবেই হউক দেশের সব ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সবখানেই চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। রশিদকে ইতিমধ্যেই সৈনিকরা ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে গেছে। সব GOC-রা আমাকে চাপ দিচ্ছে যতশীঘ্র সম্ভব তোমাদের সাথে একটা সমঝোতা করার জন্য। তাদের অভিমত, তা না হলে ঢাকাসহ সব ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে যা আমার কিংবা তাদের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সীমান্তের ওপারেও Indian troops movement এর খবর আসছে। ফারুক ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। সাভার থেকে বেশকিছু অফিসার এবং সৈনিক ইতিমধ্যেই চলে গেছে আরিচা আর নগরবাড়ি ফেরি ঘাট secure করার জন্য to facilitate Faruk’s advance to Dhaka. বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-সাভার মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছে ফারুককে স্বাগত জানাতে। জয়দেবপুর থেকেই গেছে তারা। কুমিল্লা ও চিটাগং থেকেও সৈনিকরা দাউদকান্দি এবং শোভাপুর ব্রিজের কাছে জমায়েত হয়েছে। সব ক্যান্টনমেন্টের GOC এবং উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যেহেতু তাদের নির্দেশ সৈনিকরা মানছে না, তুমি কি এসবের কিছুই জানো না?
আপনার এই প্রশ্নটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত আর বিস্ময়কর মনে হচ্ছে! ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, জবাব দেবো কি দেবো না। কারণ, জবাবটা শুধু আমাকেই বিব্রত করবেনা, আপনাকেও বিব্রত করবে। সন্দেহপ্রবণ মন নিয়ে প্রশ্নটা যখন করেই ফেললেন, তখন জবাবটা আমি দেবো সেটা যত কঠিনই হোক না কেনো। বিনা কারণে কাউকে অবিশ্বাস করাটা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়। আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে এতদিনের ঘনিষ্ঠতার পর সেটা আপনার না বোঝার কথা নয়। সেনা পরিষদ আর আমাদের সাথে আপনার আর রশিদ, ফারুকের কি সম্পর্ক সেটা আশা করি আপনি ভুলে যাননি। সেইক্ষেত্রে, এমন একটা প্রশ্ন আমাকে কি করে করতে পারলেন আপনি? কর্নেল ফারুকের এই পরিকল্পনাতে যদি আমি বা আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছি তারা জড়িতই থাকবো তবে আমি এই মুহূর্তে আপনার সামনে বসা কেন? অন্যরা কেন ফারুকের সাথে দেশে উপস্থিত না হয়ে বেনগাজীতে অবস্থান করছে? এর বেশি আর কিছুই আমি বলতে চাই না। যতটুকু জানি, আপনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই বিষয়ে আলোচনা আপনি এখন করতে পারবেন না। তাই যদি অনুমতি দেন তবে আমি চলি, বর্তমানের সংকট সমাধান করে পরে ডেকে পাঠালে আবার আসব। বলে উঠতে যাচ্ছিলাম, শক্তিধর জিয়া ত্বরিত টেবিলের অন্য পাশ থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বসার অনুরোধ জানিয়ে একটি চেয়ারে প্রায় জোর করেই বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে আর একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
ডালিম, ফারুক যদি তার ট্যাঙ্কবহর নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে পড়ে তাহলে Chain of Command ভেঙ্গে পড়বে, সারা দেশজুড়ে এক অরাজকতা সৃষ্টি হবে আর সেই সুযোগে Indian armed forces might move in to reinstall Awami- Bakshalites again in power by force….
Please Sir, for heaven’s sake stop telling me all these. I am not here to take lessons from you in this regard. What I know is that you and your cronies wouldn’t be able to resist Faruk and he shall be ousting you all from power. This is your only concern at this moment. জ্ঞান দেবার চেষ্টা না করে আপনি আমার কয়েকটা কথা শুনুন।
চুপসে গিয়ে জেনারেল জিয়া বললেন
বলো।
অনেক দিনের ব্যবধানে আজ আপনার সাথে আমি মুখোমুখি কথা বলছি একান্তে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তাইনা?
হ্যাঁ।
এই অল্প সময়তেই একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে যেই জিয়াকে বিশ্বাস করে আমরা সযত্নে লালন করে এসেছিলাম আপনি সেই জিয়া নন। নিজেকে এইভাবে বদলে ফেলার পরিণামটা ভাল হবে না খারাপ হবে সেটা সময়ই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। ইতিহাস কিন্তু কাউকে ছাড় দেয় না।
যেকোনো কারণেই হউক, আপনি ইতিমধ্যেই অনেক সত্যকে অস্বীকার করে ফেলেছেন এবং ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছেন। আমার এই বক্তব্য সঠিকভাবে বোঝার জন্য আপনার স্মৃতিকে একটু স্বচ্ছ করে দিচ্ছি।
‘৭১ সাল থেকে আজ অব্দি জাতীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যা কিছুই প্রকাশ্যে ঘটেছে সেটা সম্পর্কে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী অবগত। কিন্তু পর্দার অন্তরালে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যে সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতো দেশের বেশিরভাগ বিজ্ঞজনই অবগত নন। কেউ কেউ হয়তো বা কিছুটা আঁচ করতে পারেন আংশিকভাবে, এর বেশি নয়। ঐসব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বিধায় আমরা কিন্তু অজ্ঞ নই।

১৯৭১ সালে, আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর আপনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকদের উদ্যোগেই বিদ্রোহ করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার কৃতিত্বটার দাবিদার শুধু আপনি একা নন, সেই সময় আপনার সহযোদ্ধাদের সবাই সেই কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু আপনি আজ অব্দি সেই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছেন। আপনার সেই ঘোষণার জন্য মুজিবনগর বাংলাদেশী প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের কাছে মেজর জিয়া মানে, আপনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন উচ্চাভিলাষী অফিসার হিসাবে তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার ফলে যুদ্ধের শুরুতেই আপনাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়াটার্স এ ডাম্প করা হয়। আপনার বাসস্থান নির্ধারিত হয় কল্যানীতে। প্রবাসী ও ভারত সরকারের মনোভাব বুঝে তখন আপনার সাথে কম লোকজনই যোগাযোগ করতো। সেই সময় স্বেচ্ছায় আমিই পূর্বপরিচিত জন হিসেবে গোপনে আপনার সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের দাসখত, ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং আগামীদিনের স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সুদূর প্রসারী নীলনকশা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরাও নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি প্রণয়ন করে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে, সেই বিষয়ও আমি আপনাকে অবগত করে বলেছিলাম আমাদের এই কার্যক্রম আপনাকে কেন্দ্র করেই আমরা এগিয়ে নিতে চাই, যদি এতে আপনি সম্মত হন।
অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করেই, আমাদের একজন হয়ে কাজ করার জন্য আপনি কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন। আপনার তরফ থেকে শর্ত ছিল একটাই, উপযুক্ত সময়ের আগপর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা গোপন রাখতে হবে। জবাবে আপনাকে আশ্বস্ত করে কথা দিয়েছিলাম, আল্লাহ্র রহমতে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে আপনাকে উপবিষ্ট করার আগ পর্যন্ত কেউই আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানতে পারবে না ইনশা আল্লাহ। আপনার সাথে আমাদের যোগাযোগও থাকবে ন্যূনতম পর্যায়ে।
এরপর যুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার যখন ‘S’ এবং ‘K’ ফোর্স নামে দুইটি রেগুলার ব্রিগেড গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কাদের চাপে ‘Z’ ফোর্স নামের ব্রিগেডটি কিভাবে গঠন করতে প্রবাসী সরকার বাধ্য হয়েছিলো সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।

স্বাধীনতার পর আমরা একসাথেই কুমিল্লাতে ছিলাম, আপনি ছিলেন প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মুজিব সরকার আপনাকে অ্যাক্টিভ কমান্ড থেকে সরিয়ে সেনাসদরে নিয়ে আসার পর আপনাকে কর্নেল হিসাবেই সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দেবার চক্রান্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মিলিটারি এটাচি করে বার্মায় পাঠনোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরে আপনাকে সুপারসিড করে শফিউল্লাহকে জেনারেল বানিয়ে আর্মি চীফ পদে অধিষ্ঠিত করা হয় যাতে আপনি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন সুপারসিডেড অফিসার হিসেবে। কিন্তু সরকারের সেই চক্রান্তকেও অকার্যকর করে কোন শক্তি আপনাকে যাতে শফিউল্লার অধীনস্থ PSO হয়ে থাকতে না হয়ে তার জন্য DCOAS এর একটি পদ সৃষ্টি করে সেখানে শফিউল্লার সমপদমর্যাদায় আপনাকে নিয়োগ দিতে সরকারকে বাধ্য করেছিল সেটাও আপনার অজানা নয়।
এরপর PO-9 এর প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের চাকুরি থেকে অসময় অবসরে পাঠানোর পর আপনি ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়লে বলেছিলাম, চিন্তার কোনো কারণ নেই, সময়মত সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরপর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর আমাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি শফিউল্লাহকে সরিয়ে আপনাকে আর্মি চীফ পদে নিয়োগ দান করেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। সেটাও আপনি ভালভাবেই জানেন। সেই সময় খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও সরকারের পেছনে মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ, আর আপনি তাদেরই মনোনীত আর্মি চীফ হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। লক্ষ্য একটাই- ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমাদের স্বপ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় পরিসরে বাস্তবায়িত করা।
এরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে ২-৩ নভেম্বের ’৭৫ এর প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াত এর প্ররোচনায়। এর জন্য আপনি কতটুকু দায়ী সেটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। সেই সংকটেরও মোকাবেলা করেছিলাম আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেই। খালেদ-চক্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সম্মুখ সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে পরোক্ষভাবে খালেদ-চক্রকে উৎখাত করার পরিকল্পনা শেষে আলোচনার মাধ্যমে কৌশলগত কারণেই খালেদভাবী এবং হুদাভাবীকে সঙ্গে করে ব্যাংকক চলে যাই। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় ৭ই নভেম্বর-এর সিপাহী জনতার বিপ্লব, সেটা আপনি মুক্ত হয়ে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরমুহূর্তেই বুঝতে পারেন।
কর্নেল তাহেরই যদি ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের মুখ্যশক্তি হতো তাহলে তো আপনাকে তার হাতের পুতুল হতে হতো তাই না স্যার? কিন্তু তেমনটি তো হয়নি। আপনাকে তাহেরের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সেই একই শক্তি, যখন কর্নেল তাহের আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নেবার জন্য জবরদস্তি করছিলেন তখন কর্নেল তাহেরকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দিয়ে তাকে সরাসরি বলা হয়েছিল তিনি যেন আর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন, তাই না স্যার? সেই শক্তিটি যে সেনা পরিষদ সেটা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হয়েছিল কি?
আমাদের সাথে আলাপের পরই আপনি আমাদের কথামতো খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। যুক্তি হিসাবে আপনাকে ও জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, এতে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেবে। তবে একই ভাষণে তিনি অবশ্য জাতিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ৩রা অক্টোবর ১৯৭৫, জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন ১৫ই আগস্ট ১৯৭৬ থেকে দেশে বহুদলীয় রাজনীতি শুরু করা হবে এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে জনগণ যদি তার উপর আস্থাজ্ঞাপন করেন তবে ভোটে জিতেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, তাই না স্যার?
হ্যাঁ।
কিন্তু সাংবিধানিক জটিলতাটাই কিন্তু আসল কারণ ছিল না আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার পেছনে।
মানে?
আলাপের মাধ্যমে তিনি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কালবিলম্ব না করে আমাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে পুনর্নিয়োগ প্রদান করতে। জবাবে সরাসরি আপনার পক্ষে তখন তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না। তাই আপনি বলেছিলেন, এই বিষয়ে আপনার আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কি স্যার, ঠিক বলছিতো?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছো।
ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক আপনার জবাব থেকে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন আর আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি আপনার নিয়তের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সে জন্যই তিনি পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আপনার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্তে জেনারেল ওসমানী হতবাক হয়ে খন্দকার মোশতাককে ফোন করেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি সবকিছু তাকেও খুলে বলেছিলেন। সব শোনার পর তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে জনাব মোশতাককে বলেছিলেন, পৃথিবীতে মানুষ চেনা দায়! কি জানেন স্যার, জনাব মোশতাকের কথা শুনেও কিন্তু আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যাক সে কথা। খন্দকার মোশতাকের সিদ্ধান্তের পর দেশের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পথে আর কোনো বাধা না থাকায় অতি অল্পসময়ে আপনার পক্ষে শিখণ্ডি রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেই CMLA হয়ে রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে ওঠা আপনার পক্ষে সহজ হয়ে যায়। আপনি এখনো সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বহাল তবিয়তে দেশ শাসন করে চলেছেন। ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বরের পর সামরিক বাহিনীতে যা কিছুই ঘটেছে সে সম্পর্কে দেশবাসী তেমন কিছুই জানে না। কিন্তু আপনি এবং আমরা কি তাদের মতোই অজ্ঞ? আপনার একচ্ছত্র আধিপত্যকালে যাই হয়েছে বা হচ্ছে তার সব দায়-দায়িত্বের হিসাব কিন্তু দিতে হবে শুধুমাত্র আপনাকেই। তখন কিন্তু আপনার আজকের বিশ্বস্ত আস্থাভাজন পরামর্শদাতাদের কাউকেই ধারে কাছে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই একই কথা আমি শেখ মুজিবকেও বলেছিলাম তার সাথে শেষ সাক্ষাতকালে যখন তিনি আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসভবনে।
আপনি ঠিক বলেছেন, এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় আগ্রাসন দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়াবহ। কিন্তু আওয়ামী- বাকশালীদের হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সমঝোতা আপনি তো ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে তাদের অনুকম্পা ও সহমর্মিতা পাবার আশায় করে ফেলেছেন ‘বসন্তের কোকিল’ ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আর তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে যখন পার্টিটি টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে পড়ছিল। এ ধরনের কাজ তো ‘খাল কেটে কুমীর ডেকে আনার’ মতই আত্মঘাতী। খবরটা সত্যি না মিথ্যা স্যার?
কোনও জবাব নেই। জেনারেল জিয়া মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বসেছিলেন।
স্যার, জানিনা আপনি কাদের পরামর্শে ভারতের সাথে সমঝোতা করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করতে চলেছেন। এতো চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও আপনি কি করে বুঝতে অক্ষম হলেন আপনি যতই ছাড় দিন না কেন ভারতের কাছে আপনি কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না, শুধুমাত্র তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবেন। স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর আপনার প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যাবে তখন আপনার পরিণতিটা কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন কি? তাছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিপরীতমুখী স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান সেটা চিরস্থায়ী, সেক্ষেত্রে ভারতের সাথে সমঝোতা করে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করা কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ যদি আত্মনির্ভর, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে ওঠে তবে দীর্ঘদিন যাবত ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তা যারা ভারতীয় কেন্দ্রীয় শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও বীরবিক্রমে সাহসিকতার সাথে লড়ে চলেছে তাদের মনোবল বেড়ে যাবে। তারা ভাববে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আর সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তবে তারা পারবে না কেন? ফলে স্বল্পসময়েই অযৌক্তিক ভাবে সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং এই অঞ্চল ফিরে যাবে হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহী আকৃতিতে। আজ যারা আপনার বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা তাদের রাজনীতির মৌলিক সংজ্ঞা এবং ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে সে প্রশ্ন না করে শুধু এতটুকুই বলব, তাদের কেউই এখানকার রাজনীতি তো দূরের কথা, এ অঞ্চলের মাটি-মানুষের সাথেও তেমনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না কখনোই। তারা দেখেছেন আইয়ুব খানের রাজনীতি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো ঠগবাজদের রাজনীতি আর দেখেছেন কূটকৌশলী ক্ষমতালিপ্সু জেনারেলদের আর আমলাদের।
কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের জনগণের মানসিকতা শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী থেকে ছিল সবদিক থেকেই আলাদা। এরপরও আত্মরম্ভি আইয়ুব খান কিংবা মাদারি ভুট্টো কিন্তু তাদের স্বরূপটি বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেননি পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে। আপনিও পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য আপনার নিজস্ব অবদান কতটুকু সে বিষয়ে কিছু বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। তবে আপনাকে মধ্যমণি করে যারা তিলে তিলে অনেক আত্মত্যাগ এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা পরিষদ গড়ে তুলেছিল সেই প্রক্রিয়ায় আমিই ছিলাম তাদের আর আপনার মধ্যে মূল যোগসূত্র। তাই সবার তরফ থেকে আমি আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের কিংবা দেশ ও জাতির প্রতি আপনি যাই করে থাকুন তার জন্য আপনার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষোভ কিংবা অনুযোগ নেই। কারণ, আমরা সবাই বিশ্বাস করি মানুষ মাত্রই তার নিজ কর্মফলের জন্য দায়ী। একই ভাবে ইহকালে এবং পরকালে। দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সবকিছুই সহ্য করার তৌফিক আল্লাহ্ পাক আমাদের দিয়েছেন। তাছাড়া সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ! এটা আপনার চেয়ে অন্য কারো বেশী বোঝার কথা নয়। যাবার আগে আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, আজকে যেই সংকটের মোকাবেলা আপনাকে করতে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন সংকটের মোকাবেলা আপনাকে ভবিষ্যতে করতে হবে আপনার এই ধরনের সমঝোতার রাজনীতির পথে।
শুনে রাখুন, পাশা, নূর, শাহরিয়ার, হুদা, ডলিমদের বাইরের এবং ভেতরের সত্তায় কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ নিজেকে দিয়েই অন্যকে বোঝার এবং জানার চেষ্টা করে। আমরা মনেপ্রাণে আপনাকে আমাদেরই মতো একজন বিশ্বাস করেই গ্রহণ করেছিলাম। আপনি আমাদের বুঝতে ভুল করেছেন। এখন হয়তো আপনি আমাদেরই আপনার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন। কিন্তু স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি আমরা হয়েও থাকি ব্যক্তিগতভাবে আপনার কোনো ক্ষতি আমরা করবো না। কারণ, আমাদের বিশ্বাস, একদিন আপনি বুঝতে পারবেন আপনাকে ভুল পথের অন্ধকূপের অতলে নিক্ষিপ্ত করেছিল সেনা পরিষদের নেতারা নয়, তার জন্য দায়ী সুযোগ সন্ধানী ষড়যন্ত্রকারী আপনার ঘরের শত্রু বিভীষণরা। আপনি এটাও বুঝবেন আমাদের মধ্যে মানবিকতা, নৈতিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা কিছুটা হলেও রয়েছে যার প্রমাণ আপনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। কথাগুলো কিছুটা তিক্ত হলেও বলে গেলাম। পরে একটু খতিয়ে দেখলে তাতে আপনার কিছুটা লাভ হলেও হতে পারে। যদিও পানি ইতিমধ্যে গড়িয়েছে অনেকদূর। এখন আমি বিদায় নেবো। বলে উঠে দাঁড়াতেই বিচলিত ক্ষমতাধর জেনারেল জিয়া বলে উঠলেন
এখন কি আমরা আর এক নই?
অদ্ভুত প্রশ্ন!
স্যার, এতক্ষণ আমি কি তবে ‘অরণ্যে রোদন’ করলাম! এত কথার পর এই ধরনের প্রশ্ন পরিহাস তুল্য। আসি স্যার, বলতেই তিনি আবার আমার ডান হাতটা দুই হাতে ধরে কাতরভাবে বললেন-
ফারুককে বোঝাতেই হবে তোমাকে।
ফারুক তো আমাকে জিজ্ঞেস করে আসেনি। সে তার নিজের ইচ্ছায় এসেছে।
কিছুক্ষণ ভেবে জিয়া বললেন-
এক কাজ করলে কেমন হয়?
কি?
চলো, তোমাকে নিয়ে আমি সব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দরবারে বলি, আমরা এখনো একই সাথে আছি এবং ১৫ই আগস্টে এবং ৭ই নভেম্বর-এর চেতনা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এটাও তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবে যে, বিপ্লবের স্বার্থেই তোমরা কিছুদিনের জন্য বিদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এটা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে সব ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রতিনিধি আনিয়ে সেনাকুঞ্জে দরবারের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
তা হয়তো করা যেতে পারে, কিন্তু সেখানেও এই ধরনের বক্তব্য আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় আপনার পাশে দাঁড়িয়ে। কারণ, সেই রাস্তাটা আপনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কি করে, সেটা আপনার নিজেরই জানা আছে।
আমার জবাবে চুপসে গেলেন জিয়া।
আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা, তবে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে যদি কিছু করা সম্ভব হয় সেটা করার চেষ্টা নিশ্চয় করবো।
এরপর বেরিয়ে এসেছিলাম।
ADC- এর রুমে বসেই মাহবুব ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু জেনে গেছে। গাড়িতে বসেই বললাম
ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় চলো। পথিমধ্যে লোকজনদের মধ্যে স্বাভাবিকতাই লক্ষ্য করলাম যেমনটি লক্ষ্য করেছিলাম ২-৩রা নভেম্বর রাতে। সে রাতেও তারা ছিল বেখবর আজকেও ঠিক তারা তেমনিভাবে বেখবর!
ব্রিগেড মেস-এ পৌঁছালাম
ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় পৌঁছে প্রথমেই যোগাযোগ করলাম বেনগাজীতে। সবকিছুই বিস্তারিত জানালাম সহবিপ্লবীদের।
খবর পাওয়া গেছে রশিদ ইতিমধ্যেই ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে ঘুরে এসেছে। জিয়ার দরবারের প্রস্তাব আমি নাকচ করে দিয়েছি। জিয়ার কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ এবং উষ্মা থাকলেও এই মুহূর্তে জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাকে হয়তো ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে, কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে নিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। বর্তমান অবস্থা মারাত্মকভাবে ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। সেই বিবেচনায় একমাত্র পথ রশিদ আর ফারুককে বুঝিয়ে নিরস্ত্র করা। এ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। এখন তোমাদের মতামত জানাও, আমি কি করব।
পাশাই সবার তরফ থেকে বললো
স্যার, আপনি ঘটনাস্থলে রয়েছেন, সব কূল রক্ষা করে অবস্থা সামাল দেবার জন্য যাই ভাল বুঝবেন সেটাই করুন। আপনার বুদ্ধিমত্তার উপর আমাদের সবারই আস্থা আছে। কথা শেষ হল। মাহবুবও সংক্ষেপে সবার সাথে সালাম দোয়া এবং কুশল বিনিময় করলো।
রশিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম সে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই ফারুককে ফোন করলাম।
আমি ফোন করেছি জেনে ফোন ধরলো ফারুক।
তুই এ ভাবে কাউকে কিছুই না জানিয়ে এসে কি করতে চলেছিস? জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা ঠিক, কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেবার পর আমি যা জানতে পেরেছি তাতে কোনই সন্দেহ নেই আজকের পরিস্থিতি ২-৩রা নভেম্বর এর চেয়ে অনেক জটিল। যদি তুই শুনতে চাস তবে বলতে পারি একটু বিস্তারিতভাবে।
বল, আমি শুনব কি বলার আছে তোর।
যাদের সাথেই আমার আলাপ হয়েছে দেশের বর্তমান অবস্থা এবং জিয়া সম্পর্কে তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম। জিয়া আগস্ট বিপ্লবের নীতি-আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে সমঝোতার ভিত্তিতে ক্ষমতার রাজনীতি করতে চলেছেন। ভারতের সাথেও তিনি সমঝোতা করে নিয়েছেন তার রাজনীতির স্বার্থেই। একই লক্ষে তিনি ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙ্গা স্যুটকেস আর কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খালকাটা আর রাস্তা বানানোর কর্মসূচির মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে নিজেকে একজন জনদরদী নেতা হিসাবে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছেন। অপর দিকে প্রায় হাজার তিনেক সেনা সদস্য এবং বেসামরিক বিপ্লবীদের সাজানো অভ্যুত্থানের নাটকের মাধ্যমে নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। জেলবন্দীও করেছেন অনেককেই সামরিক বাহিনী এবং দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অজুহাতে। এতে সামরিক বাহিনী ক্ষোভ এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু সেই সুযোগে ভারতীয় সরকার আওয়ামী-বাকশালীদের নিয়ে আর একটি প্রবাসী সরকার বানিয়ে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি দেশে আগ্রাসন চালিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মোকাবেলা করা কি সম্ভব হবে? ভারতকে এই বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন জানাবে সোভিয়েত বলয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সমর্থন দেবার মতো কাউকে কি পাওয়া যাবে? খবর হল, জিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন। আমাদের তো সেই রকম কোনো সুযোগই হয়নি এখন পর্যন্ত।
এই বাস্তবতায় বলা চলে, ভারতের পক্ষে অতি সহজেই সম্ভব হবে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। ফলে দেশটা পরিণত হবে একটি করদ রাজ্যে আর জাতি পরিণত হবে দাসে। এইবার আওয়ামী-বাকশালী সরকারের নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে সুদৃঢ় ঘাঁটি গেড়ে বসবে এবং ক্রমান্বয়ে দেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর-এর বিলুপ্তি ঘটিয়ে সেগুলোকে পুনর্গঠিত করা হবে ভারতের সাহায্যে দলীয় ক্যাডারদের সমন্বয়ে নতুন আঙ্গিকে। এভাবেই ভারতীয় সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়িত হবে। আমরা তো দেশ আর জাতীয় স্বার্থেই সেই সুযোগটা না দেবার জন্যই ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে দেশত্যাগ করেছিলাম এবং খালেদ-চক্রকে ব্যাংকক থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্তমানে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনো ভাবেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে। জিয়ার মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক ভাবেই। আর একটি কথা, ধরা যাক আমরা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলাম, সেই ক্ষেত্রে আমরা বাধ্য হব আমাদের উপরের সব সিনিয়র অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দিতে। এ ধরনের পদক্ষেপে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে সেই সুযোগটা কি ছাড়বে ভারত? অবশ্যই না। তাহলে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে লাভটা কি হবে সেটাও তোকে ভেবে দেখতে হবে।
ফারুক নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো আমার বক্তব্য। আমার বক্তব্য শেষে ফারুক বলল-
All right then, আমি তোর বক্তব্য গুরুত্বের সাথেই শুনেছি, আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিবো।
Thanks, বলে ফোন রেখে দিলো ফারুক।
এরপর আমি জেনারেল জিয়াকে ফোন করে জানালাম, ফারুকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। অবিলম্বে ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বগুড়ায় পাঠাবার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলাম। জেনারেল জিয়া আমার কথামতো ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে অনুরোধ করেন বগুড়ায় গিয়ে ফারুককে বোঝানোর জন্য। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তিনি রাজি হন এবং আর্মির একটি হেলিকপ্টারে করে ফারুকের ছোটবোন ইয়াসমিনকে সাথে নিয়ে ফারুককে বুঝিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। সন্ধির শর্ত হিসাবে ফারুক দাবি করেছিলো, বহুদলীয় রাজনীতিতে তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ জিয়াকে দিতে হবে। তখন অবস্থার চাপে জিয়া তার সেই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
এরপর রশিদ আর ফারুক দুইজনই ঢাকা ত্যাগ করেছিলো।
সংকট কেটে যাবার পর একদিন আবার আমার ডাক পড়ল CMLA ’s Office এ।
সময় মতো গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে ঢুকতেই আগের মতই জিয়া চেয়ার থেকে উঠে এসে স্বাগত জানালেন। আলোচনার বিষয় আমাদের ভবিষ্যৎ।
তোমাকে কি করে ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না।
আমি তেমন কিছুই করিনি, ফারুকই তার বুদ্ধি-বিবেচনায় তার সিদ্ধান্ত পাল্টেছিল।
আমি সবই জানতে পেরেছি।
আমি তার কথার কোন জবাব না দিয়ে কফিতে মনোযোগ দিলাম। জিয়াও খাবারের প্লেটে কাঁটা চামচ নাড়াচাড়া করছিলেন আর ভাবছিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলা শুরু করলেন-
ডালিম, তোমরা সবাই আমার কাছে প্রশংসার পাত্র, বিশেষ করে তোমাকে আমি স্নেহ এবং শ্রদ্ধা করি। অন্যদের সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তোমার সাথে আমার পরিচয় সেই কাকুলের দিনগুলো থেকেই। You all are undoubtedly selfless patriots and progressive minded revolutionaries. আমি অকপটে স্বীকার করছি বয়সের তুলনায় তোমরা সবাই রাজনৈতিকভাবে বেশি সচেতন। (বাংলা ভাষায় তেমন দক্ষতা না থাকায় জিয়া বাংলা ইংরেজি মিলিয়েই কথা বলতেন। এতে তাকে দোষ দেয়া চলে না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার গাবতলীতে পৈতৃকভিটা হলেও বাল্যকাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় তার কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানেই)। ৭ই নভেম্বরের পর এক চরম অস্থিতিশীল অবস্থায় আমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। কৌশলে ১৫ই আগস্টের কথাটা উচ্চারণ করলেন না জিয়া, এটাও বললেন না যে ১৫ই আগস্টের সাথে একটি যোগসূত্র রয়েছে ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের।
তার জন্য আমি মনে করি কিছু সময়ের জন্য তোমাদের বাইরে রাখলে আমার সুবিধে হবে।
সেই সময়টা লিবিয়ায় নিষ্কর্ম হয়ে বসে না থেকে দেশ ও জনস্বার্থে আমার প্রতিনিধি হয়ে যাতে তোমরা কাজ করে যেতে পারো তার জন্য আমি ঠিক করেছি তোমাদের সবাইকে বিদেশের ঐসব রাষ্ট্রে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবো যাদের সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের হুমকির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। সে ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোনও পেশাদার আমলাদের দ্বারা গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব না, কিন্তু সেটা তোমাদের দ্বারা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক আশা নিয়ে আমি এই প্রস্তাবটা করলাম। আমার এই প্রস্তাব তোমরা গ্রহণ করবে কিনা সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমার অনুরোধ, বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবেচিন্তে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ো। আমাকে নিরাশ করো না। তার বক্তব্য শেষে তিনি আমার দিকে একটি জবাবের প্রত্যাশায় উদগ্রীব হয়ে চাইলেন।
তার বক্তব্য শুনে মনে করেছিলাম কোন জবাব দেবো না, কারণ সেটা হবে ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’র মতোই। পরে ভাবলাম এই সুযোগে তাকে কতগুলো সত্য জানিয়ে যাই, এতে কোন লাভ না হলেও ঐতিহাসিকদের বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকবে আমার বক্তব্য।
: স্যার, আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি হবে না সেটা আমি ফিরে যাবার পর সহযোদ্ধাদের সাথে আলাপের পরই আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে। এই বিষয় আর দীর্ঘ ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই। যদি অনুমতি দেন তবে একজন পুরনো সাথী এবং সহযোদ্ধা হিসাবে কিছু কথা বলে যেতে চাই।
বল, কি বলতে চাও?
৭ই নভেম্বর বিপ্লবের পর আপনাকে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনরায় চীফের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল আগস্ট বিপ্লবীরাই। সেনা পরিষদই ছিল ওই বিপ্লবের অগ্রণী এবং মূলশক্তি। কর্নেল তাহের ও তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ভূমিকা ছিল সহায়ক শক্তি হিসাবে গৌণ। এ সত্যটা আপনি ভালো করেই জানেন। সবকিছু জেনেই আপনি ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হবার পরই সিদ্ধান্ত নেন, আগস্ট বিপ্লবের চেতনা আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করে ভিন্ন পথে অগ্রসর হওয়ার। আপনি জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের সাথে আপনার কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিল না, বর্তমানেও নেই। এ ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে হয়তো সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সত্য একদিন সত্য হিসাবেই ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পাবে। এটাই সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষা। ‘বিপ্লব’ শব্দটার অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করার ইতিহাস সুপ্রাচীন। যদিও এই শব্দটির সহজ মানেটা হল আপোষহীন দ্রুত পরিবর্তন।
মানব সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু এই অগ্রগতির ফসল পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঝুলিতে পড়েনি। মুষ্টিমেয় কিছু লোক এবং পরিবার এর ফল ভোগ করে চলেছে জোরজুলুমের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ কিংবা নিও-উপনিবেশবাদের কালে তাদের সেই শোষণ প্রক্রিয়াকেই টিকিয়ে রাখার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন আদালত, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী সামরিক বাহিনী এবং এক অদ্ভুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। ছল-চাতুরীর মাধ্যমে পেশীশক্তি এবং অর্থশক্তির বলে বলিয়ান আগ্রাসী শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছে তাদের তল্পিবাহক একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণি।
এই সমস্ত পোষা স্বার্থবাদী বাস্তুঘুঘুরা প্রয়োজন মতো কখনো গায়ে জড়াচ্ছে গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্রের লেবাস শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই। এতে সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিজেদের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থের সাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় স্বার্থের।
তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবদেশেই ক্ষমতাসীন আর বিরোধীদলগুলোর মধ্যে চরিত্রগত ভাবে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, তাদের সবার শিকড় প্রোথিত ঐ কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর মধ্যেই। তারা বাহ্যিক ভাবে একে অপরের সাথে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বটে, তবে সেটা হয়ে থাকে সমঝোতার ভিত্তিতে। জনস্বার্থের বিরুদ্ধে তারা এক হয়ে যায়। বর্তমান কালে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে এই শুভঙ্করের ফাঁকিটা পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তের বঞ্চিত, শোষিত এবং নিপীড়িত জনগণ আজ কম-বেশি ধরতে সক্ষম হচ্ছেন তাতে তাদের সচেনতা বেড়ে চলেছে। এর ফলে, বর্তমানে বিশ্বজোড়া আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তাদের ন্যায়সঙ্গত এই প্রতিবাদী প্রতিরোধ সংগ্রামকে বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ‘মৌলবাদ’ ইত্যাদি এবং প্রতিবাদী এবং প্রতিরোধকারীদের বলা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী মৌলবাদী। কিন্তু এইসব অপপ্রচারের পরেও আজ অস্থিতিশীল হয়ে ধস নেমেছে বর্তমানের অসম শোষণমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায়।
বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ’৭১ এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিসংগ্রামে এক নতুন ন্যায়ভিত্তিক প্রকৃত স্বাধীনতার প্রত্যাশায়। সেই চেতনা আর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং চাণক্যদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার মাধ্যমে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করার জন্যই যুদ্ধকালে আমরা গড়ে তুলেছিলাম একটি গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন যার একজন সদস্য হয়েছিলেন আপনি শপথ নিয়ে স্বেচ্ছায়। আপনি হয়তো অনেক কিছুর মতোই এটাও ভুলে গেছেন, যখন আপনি ছিলেন পরিত্যাজ্য তখন আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে আপনার কল্যাণীর নিবাসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়েছি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে কি করে আমরা গোপন সংগঠন গড়ে তুলব, কি করে ধাপে ধাপে আপনাকে সবার অজান্তে বৈপ্লবিক পন্থায় শীর্ষ জাতীয় নেতার স্থানে অভিষিক্ত করে ’৭১-এর চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত করব। আমাদের নীতিআদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেই আপনি ওয়াদা করেছিলেন আমাদের একজন হয়ে লড়ে যাবেন আজীবন।
কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পর্বতসম জগদ্দল পাথর সরিয়ে আমরা যখন বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করতে সমর্থ হলাম তখনই সেই সোপান দিয়েই উল্টো পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি। দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করে জনগণের অধিকার অর্জন করা সম্ভব অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। সময় মত এই সত্য আপনি বুঝতে পারবেন।
স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আপনি আমাদের বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করছেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ সমূহ কিন্তু ৭ই নভেম্বরের পর আপনার নিজস্ব কর্মকাণ্ডগুলোই। বাস্তব সত্যটা আপনার কাছে এই মুহূর্তে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তবে অস্থিতিশীলতার যে অঙ্গার আপনি জ্বালিয়েছেন সেটা নিভে যাবার নয়। এর পরিণাম সম্পর্কে আপনার ধারণা কি সেটা আমার জানা নেই। তবে পরিণতিটা আপনার জন্য খুব একটা শুভ হবে বলে মনে হয় না। আপনি যাদের নিয়ে রাজনীতি করতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতালোলুপ। তাই সুধী সাবধান! সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানীরা নিজস্ব স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারে। প্রয়োজনে পা চাটতে পারে আবার ঘাড়ও মটকাতে পারে। ছাত্রকাল থেকেই রাজনীতি করে এসেছি, তাই অভিজ্ঞতার আলোকেই কথাগুলো বলছি, কেতাবি কথা নয়।
স্যার, ক্ষমতার শীর্ষে বসে মানুষের চরিত্র যাচাই করা সম্ভব নয়। চরিত্র যাচাইয়ের কষ্টি পাথর হচ্ছে দুঃসময় এবং সংগ্রামকাল। আপনি পরীক্ষিত সহযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ভেবে নতুন করে যে সমস্ত আস্থাভাজন কিনে একত্রিত করছেন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে সেটা নীতির রাজা সর্বোৎকৃষ্ট গণমুখী রাজনীতির জন্য নয়। আপনার এই সমঝোতার রাজনীতিতে রয়েছে সমূহ বিপদের আশংকা। আমি আমার বক্তব্য শেষ করব আপনাকে আশ্বস্ত করে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেনো দেশ ও জাতির স্বার্থেই কাজ করে যাবো, কোন ব্যক্তিস্বার্থে নয়। সময় নিয়ে ধৈর্যের সাথে আমার বক্তব্য শুনলেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশ ছেড়ে ফিরে যাবো বেনগাজীতে লন্ডন হয়ে। শিশু ভাইয়ের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকবে। তাই আমার গতিবিধি সম্পর্কে আপনি সবই জানতে পারবেন। চলি স্যার, আল্লাহ হাফেজ।
বেরিয়ে এলাম তার অফিস থেকে।

ফারুকের দেশে আগমনের পর থেকে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত সময়ের বেশির ভাগই কেটেছে ক্যান্টনমেন্টে। মালিবাগ পৌঁছে দেখি নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার জন্য একরাশ উৎকন্ঠায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। কারণ, ওই সময় বাসা থেকে কাপড়-চোপড় ড্রাইভার দিয়ে আনিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে মহুয়াকে বলতাম- আমি নিরাপদেই আছি চিন্তার কারণ নেই। তারা সবাই জানতে চায় কর্নেল ফারুকের আসার পর পর্দার অন্তরালে কি ঘটেছে! আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে! জটলার মধ্যে মহুয়াই বলল-
ভাইয়াকে একটু ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে দাও, তারপর সব শোনা যাবে। ভাইয়া, তুমি এক্ষুনি লন্ডনে নিম্মির সাথে কথা বল। বেচারি ভীষণ চিন্তিত অবস্থায় আছে।
হ্যাঁ, সেটাই করা উচিৎ। তুই ফোন মিলিয়ে আমাকে দে।
মহুয়া ফোনে নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিসিভার দিল।
ফোনে নিম্মি প্রথম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলল-
তুমি কোথায় কি অবস্থায় আছ জানার জন্য যখনই ফোন করেছি, মহুয়া আর কেয়া বলেছে তুমি ক্যান্টনমেন্টে খুবই ব্যস্ত, তবে নিরাপদেই আছ।
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম-
নিঃস্বার্থভাবে বৃহত্তর কোনও দায়িত্ব পালন করতে গেলে আল্লাহ্ই সহায় হন। এর প্রমাণ তো ২-৩রা নভেম্বর রাতেই তুমি পেয়েছ। রাত ১টায় বঙ্গভবনে তোমাকে বলেছিলাম, তুমি কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও, আমি নূরকে সাথে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি খালেদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। আর তা না হলে আল্লাহ হাফেজ। তুমি দোয়া পড়ে আমাকে বলেছিলে, “তোমাকে আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করলাম তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।’’ তোমার দোয়ায় আল্লাহ্র রহমতে ৩রা নভেম্বর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশকে এক মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছিলাম। লন্ডনে পৌঁছেই আমি কিন্তু আঁচ করতে পেরেছিলাম এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তাই জোর করা সত্ত্বেও তোমাকে ঢাকায় নিয়ে আসিনি। এসব এসে বলব। জান, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে তুমি পাশে না থাকলেও আমি জানতাম তোমার দোয়া রয়েছে। তাইতো ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে জটিল অবস্থার মোকাবেলা করতে পেরেছি। দু’চার দিনের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি ইন শাহ আল্লাহ। অতএব চিন্তার কোন কারণ নেই। অন্য সবার সাথে এরপর সালাম এবং কুশল বিনিময় করে ফোন রেখে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম গোসল করার জন্য। যেতে যেতে মাহবুবকে বললাম, দু’একদিনের মধ্যে আমার জন্য একটা সিট কনফার্ম করার জন্য। ইতিমধ্যে মহুয়া আর কেয়া দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে খাবার পাট চুকালাম। মহুয়ার তত্ত্বাবধানে আমার প্রিয় ব্যঞ্জনে ভরা ছিল টেবিল। মহুয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, কম কথার মানুষ। কিন্তু সব ব্যাপারে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে সবকিছু তদারকি করে। কেয়া কিছুটা চঞ্চল আর মুখরা। খাওয়ার পর যাবার আগে মাহবুব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
তোমরা স্যারকে একটু রেস্ট নেয়ার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা কর। He has gone through extremely strenuous time all these days.
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল মাহবুব।

চলবে

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *