১৭তম পর্ব
২য় কিস্তি
বাসায় পৌঁছে দেখি আব্বাসহ সবাই আমার প্রতীক্ষায় সময় গুণছেন। সবারই এক প্রশ্ন, নিম্মিকে কেন সাথে নিয়ে এলাম না। সংক্ষেপে জবাবে বললাম, অবস্থা বিবেচনা করে তাকে লন্ডনে খালাম্মাদের কাছে রেখে এসেছি। কিছুক্ষণ পর মাহবুব এক ফাঁকে আমাকে বললো
স্যার, শিশুভাই-এর সাথে আলাপ করে আপনার আগমন বার্তাটা জানিয়ে দিন। মাহবুব নিজেই ডায়েল করে আমাকে রিসিভার দিয়ে বললো
শিশুভাই on the line.
আসসালামালাইকুম শিশুভাই, ডালিম বলছি।
ওয়াসসালাম। Nice to hear you, how was the flight?
Not bad but interesting!
ভালো। শোনো, সন্ধ্যায় বাসায় এসো। রাতের খাবার একসাথেই খাবো। টনি, লাজু, কাজু সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে নিম্মির অপেক্ষায়।
নিম্মিকে তো সঙ্গে আনিনি, তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি।
কেনও, সঙ্গে করে দেশে নিয়ে আসলেও তো পারতে?
তা পারতাম, তবে ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না what is on the card. তাই রিস্ক না নিয়ে লন্ডনেই রেখে এলাম।
I see, anyway, তুমি আসবে সন্ধ্যায়। আর একটি কথা, মাহবুব being one of your closest has been placed at your disposal. He would be at your beak and call. যখন যা প্রয়োজন ডেকে পাঠালে সেই সেটা করবে। তাকে তোমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবেও গ্রহণ করতে পারো। Rest over dinner.
As you desire, শিশুভাই। Thanks a lot.
ফোন রেখে দিলাম।
এর পর মাহবুব বললো
স্যার আমি এখন তবে আসি। বলেই একটা কাগজে দুইটা টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললো
সন্ধ্যায় আমিই আপনাকে শিশুভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেবো, just give me a call whenever you are set to go.
Okay fine, Thanks for everything.
বুকের সাথে বুক মিলিয়ে বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাহবুব চলে গেল। মাহবুব বাসার সবার সাথেই বিশেষভাবে পরিচিত। আব্বা বললেন, মাহবুব সার্বক্ষণিকভাবে তোর সাথে থাকবে এটা শুনে আমি অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। দেশের যা অবস্থা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে স্থিতিশীলতা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। ইতিমধ্যে একদিন শিশুর মাধ্যমে জিয়া আমাকে ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ জানালেন, তাকে রাজনৈতিক ভাবে সাহায্য করতে। তিনি তার ১৯ দফার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দল দাঁড় করাতে চাইছেন। তার আবেদনে বেশ আন্তরিকতা অনুভব করে আমি, শামছুল হুদা, শাহ আজিজ, যাদু মিয়া, ভোলা মিয়াঁ, আরও পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কাজ করছি। তিনি বললেন, বাকশাল আর ভারত বিরোধী নীতিই হবে তার রাজনীতির মূল আদর্শ। তাই যদি সত্যি হয়, তবে তো তাকে সাহায্য করাই উচিৎ। তাছাড়া জিয়া তো তোদেরই একজন। মোশতাকও টানাটানি করছিল তার দলে যোগ দেবার জন্য। তবে আমরা মনে করি জনসমর্থনের দিক দিয়ে জিয়াই এগিয়ে। তাই নির্বাচনে জিয়াই জিতবে। তবে মোশতাক একটি শক্তিশালী দলের নেতা হিসাবে বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারবে। আগামী নির্বাচনের আগেই পার্টি হিসাবে আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যাবে। নেতৃত্বের কোন্দলে তাদের পার্টির কনভেনশন করা সম্ভব হচ্ছে না। তুই কি বলিস?
আব্বা, দেশত্যাগের পর এইতো এলাম, তাই কোন কিছু না জেনে না বুঝে মন্তব্য করতে চাই না। তবে জিয়া একজন চতুর খেলোয়াড়। আমার মনে হয়, তিনি ভারতের সাথে সমঝোতা করেই রাজনীতি করবেন। তাই আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যাবে এই ধারণাটা সঠিক নাও হতে পারে। আপনারা সবাই পুরনো রাজনীতিবিদ। তাই সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতা আপনাদের আছে। সেখানে আমার মতামতের উপর আপনাদের নির্ভরশীল হতে হবে, সিদ্ধান্তের বিষয়ে তেমনটি আমি মনে করি না। আপনারা যা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। তবে একটি কথা জেনে রাখুন, মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। জিয়ার ব্যাপারেও সেটা প্রযোজ্য। অবাক হবেন না যদি কোনোদিন দেখেন জিয়া নিজেই হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগকে দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করছেন।
তা কি করে সম্ভব!
শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিতে সব কিছুই সম্ভব। তাছাড়া প্রচলিত রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই।
তোদের কেনও ডেকে পাঠিয়েছেন জিয়া?
তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে চান।
আলোচনার আবার কি আছে?
সেটাতো জানিনা, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাই এসেছি।
ইতিমধ্যে আব্বা একটা ফোন পেয়ে বললেন, আমাকে একটু বেরুতে হচ্ছে, তুই বিশ্রাম কর। কাল থেকে তো তোর টিকিটির নাগালও পাওয়া যাবে না। সাবধানে থাকিস।
উঠে চলে গেলেন আব্বা। আব্বার কথায় সবাই হেসে উঠল। কেয়া বলল-
জানো ভাইয়া, তোমাদের যাওয়ার পর অফিসার আর সৈনিক ভাইরা কিন্তু প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিতো আর বলতো, আপনারা স্যারদের ফিরে আসতে বলুন, জিয়ার অনুমতির জন্য তারা কেন অপেক্ষা করছেন!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
এরপর দুপুরের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি মহুয়াকে বললাম
এবার আমাকে উঠতে দে। জিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। মহুয়া ফোনটা আমার ঘরে লাগিয়ে দিয়ে আয়।
মহুয়া নীরব কর্মী ও তীক্ষ্নবুদ্ধির অধিকারিণী। নিম্মির মতই স্বল্পভাষী, তাই হয়তো তারা দুইজনই হরিহর আত্মা!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে জানালো- সব কিছু ঠিকঠাক করে দেয়া হয়েছে। আমি উঠতেই মহুয়া বলল-
ভাইয়া, তোমার ডিউটি করার জন্য আরও একটা গাড়ি আর ড্রাইভার ২৪ ঘণ্টা থাকবে বাসায়।
এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তবুও ওটা থাকবে যতদিন তুমি দেশে থাকবে।
বলছিস যখন ঠিক আছে, থাকুক।
নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুরু হলো ফোনালাপ। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বেঁচে থাকা সেনা পরিষদের সদস্য অফিসার-সৈনিক, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সাংবাদিক মহল, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী মহল, ছাত্র ও যুব সমাজের বিশেষ আস্থাভাজন রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত বন্ধু-বান্ধব, সমমনা পুরনো নিকটজনদের আমার আগমন বার্তা জানিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং জিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত জেনে নিলাম। জিয়া সম্পর্কে দেশের সাধারণ জনগণের মনোভাবও জেনে নিলাম।
সবক্ষেত্র থেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলো। একটা বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন সবাই প্রায় একই অভিব্যক্তি জানালো। জিয়া গতানুগতিক সমঝোতা ভিত্তিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরনো ধাঁচের পাতানো খেলার রাজনীতিই করবেন। কোনো বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো আমূল পরিবর্তনের দিকে জিয়া যাবেন না। Status quo-তে বিশ্বাসী জিয়া, প্রতিবেশী ভারতসহ বহির্বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর বলয়ে থেকেই জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোকে খুশি রেখেই চলবেন। তাই তার রাজনীতি তেমন একটা গণমুখী হবে না জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। এতে দেশ বা জনগণের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবেই বলা চলে, জিয়া পরিবার, তার দলীয় নেতৃত্বের ভাগ্য উন্নয়নের দ্বার অবারিত হবে। তিনি সুচতু্র ভাবে নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রেখে নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি পরায়ণ করে নিজের হাতের মুঠোয় রাখবেন ‘ইয়েস ম্যান’ হিসাবে। এ ভাবেই সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশ চালাবেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। প্রতিবাদী কণ্ঠ কিংবা দ্বিমত বলে কিছুই থাকবে না তার দলে। গণতন্ত্রের লেবাসে জিয়া হয়ে উঠবেন এক ভয়ানক স্বৈরচারী রাষ্ট্রনায়ক।
ক্ষমতালোভী কানকথায় বিশ্বাসী জিয়া যে কত নিষ্ঠুর হতে পারেন তার নজির ইতিমধ্যেই তিনি স্থাপন করেছেন প্রায় ৩০০০থ বিপ্লবী সেনাসদস্য ও নেতাকর্মী নৃশংসভাবে হত্যা করে সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে। সেনাসদস্যদের বুট এবং উর্দিসহ গণকবরে পুঁতে দেয়া হয় রাতের অন্ধকারে কড়া নিরাপত্তায় বিভিন্ন স্থানে। বন্ধুদের বেশিরভাগের ধারণা ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি, কোদাল কাঁধে খালকাটার গণসংযোগের চাতুর্যে বর্তমানে কিছুটা বিমোহিত জনগণের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময়ে লাগবে না। অনেকেই জানাল, ডঃ কামাল হোসেনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে সমঝোতা করে তিনি হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করবেন দেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালু হলেই। এর পরিণাম দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়ংকর। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে এই ধরণের আত্মঘাতী পদক্ষেপ যদি নেয়া হয় তবে ‘৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে ইতিহাস মূল্যায়ন করবে এক সুবিধাবাদী, জাতীয় বেঈমান, রক্তপিপাসু এবং ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হিসেবে। সম্ভবত তার নিজের পরিণতিও হবে অতি করুণ!
সবকিছুই বেনগাজীতে জানালাম এবং আমার এবং সেনা পরিষদের করণীয় সম্পর্কে তাদের অভিমত জানতে চাইলাম। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল সহযোদ্ধা বিপ্লবী সাথীরা। তারা বলল, বর্তমানের অবস্থা ২-৩ নভেম্বরের চেয়ে জটিল এবং নাজুক। এই পরিস্থিতিতে, সেনা পরিষদকে জিয়া বিরোধী কোন দ্বন্দ্বে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে কৌশলগত কারণেই। শুধু তাই নয়, ভায়রাদ্বয় যদি প্রতিক্রিয়াশীল কোনও হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তাদের পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে, তাদের সাথে সেনা পরিষদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না এবং তাদের সেই ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করা হবে। এতে জিয়া উপকৃত হবেন। তবে আমাদের নীতি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই অটল থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিকে যে ভাবে জিয়া এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার মোকাবেলা রাজনৈতিক ভাবে করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
অপ্রিয় সত্য হল, কর্নেল তাহের এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সামরিক বাহিনীতে হঠকারী শ্রেণিসংগ্রামের পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে গণহারে অফিসার এবং সদস্যদের বিনাবিচারে হত্যা করাটা সামরিক বাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর সেই সুযোগে পরিকল্পিত ভাবে জিয়া সেনা পরিষদকে তার প্রতিপক্ষ ভেবে ১৮-১৯ টা সাজানো ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ধুয়া তুলে প্রায় ৩০০০ সেনা পরিষদের সদস্য, সাধারণ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সমমনা নেতা-কর্মীদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। কারাবন্দী এবং চাকুরীচুত করেছেন অনেককেই। এভাবেই তার পথের কাঁটা দূর করেছেন জেনারেল জিয়া চাতুর্যের সাথে ক্ষমতার স্বার্থে।
এই সত্যটা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবহিত নন, এই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে জিয়া এখনো দেশবাসীর কাছে তিনি আমাদেরই একজন- সেই ভাবমূর্তিটাও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার সাথে কোনোপ্রকারের সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেটা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হবে না এবং এখনো সেনা পরিষদের যতটুকুই অবশিষ্ট আছে সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের ভাবমূর্তি এবং শক্তি দুটোই ক্ষুন্ন হবে। এই বিষয়ে শিশুভাইয়ের উপদেশটাই আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাদের জোরালো যুক্তি সাপেক্ষে ঢাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল, এই মুহূর্তে জিয়া বিরোধী কোনো কার্যক্রমে জড়িত হবে না সেনা পরিষদ, বরং এর বিপক্ষেই অবস্থান নেবে।
সন্ধ্যার পর মাহবুব আমাকে পৌঁছে দিল মইনুল রোডে শিশুভাইয়ের বাসায়। শিশুভাই তখনো বাড়ি ফেরেননি। টনি ভাবী, লাজু কাজুরা নিম্মিকে কেন সাথে করে আনিনি সে বিষয়ে অভিযোগ করল। কারণটি তাদের সাদামাটা ভাবে বোঝালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহবুবের কাছ থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে বাসায় চলে এলেন শিশুভাই। সাধারণত তিনি মধ্যরাত্রির আগে বাসায় ফেরেন না জানিয়েছিলেন টনি ভাবী। সারাদিন জাগোদলের অফিসে বাকবিতন্ডা, সমঝোতার ম্যারাথন মিটিং, দরকষাকষির ঝকমারিতে বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন শিশুভাই।
শিশুভাই, আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!
আর বলো না, জাগোদলের অফিসকে একটি মাছের বাজারের সাথেই তুলনা করা চলে। সব সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, দলছুট বাস্তুঘুঘু নেতাকর্মীরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য মাছির মত ভনভন করছে। কে কার পিঠে ছোরা মেরে বা ঘাড়ের উপর দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই Rat Race এ সবাই একইভাবে আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত। জঘন্য এদের বেশিরভাগের চরিত্র। স্বার্থের জন্য মানুষ নিজেকে কতটা ছোট করতে পারে এই দায়িত্ব না নিলে জানতে পারতাম না। আমার জন্য বর্তমানের দায়িত্বটা মানুষ চেনার একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ।
তুমি একটু সময় দাও, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।
অবশ্যই।
শিশুভাই অল্পক্ষণেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন।
কেমন আছ তুমি এবং বেনগাজীর বাকিরা?
আমরা বদলে যাইনি শিশুভাই, আমরা আগের মতোই আছি।
নিম্মিকে সাথে নিয়ে আসলেও তো পারতে?
পারতাম। তবে তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি খালাম্মাদের কাছে। মনে হচ্ছে, ভালোমন্দেই সময় কাটছে দেশের ‘রাজপুতিনের’?
বিশ্বাস করো ডালিম, আমি: ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছি। এই সমস্ত প্যাঁচালো অসৎ চরিত্রের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে দেশ কিংবা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করা কি করে সম্ভব?
কিন্তু বর্তমানের স্ট্রং ম্যান জেনারেল জিয়া তো আমাদের তুলনায় এদেরকেই বেশি আস্থাভাজন মনে করে তাদের সাথে নিয়েই রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিশুভাই বললেন-
বাইরের জেনারেল ইসলামের খোলসটা দেখে লোকজন যাই মনে করুক না কেনও, তোমাদের কাছে আমার বাইরের এবং ভিতরের সত্তার কিছুই গোপন নাই, বিশেষ করে তোমার কাছে। তাই নিঃসংকোচে বলছি, I am totally frustrated with the current state of affairs, you guys had created an tremendous opportunity to build a self respecting and self reliant progressive nation but that opportunity had been lost. জিয়া যে ধরনের রাজনীতির সূচনা করতে যাচ্ছেন তাতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কোনোটাই সুরক্ষিত হবে না। জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ধরনের আমূল মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন সেটাও তার পক্ষে আনা সম্ভব হবে না, যদিও জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র।
কারণটি হবে জিয়ার ভুল রাজনীতি। তার রাজনীতির চরিত্র হবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মতোই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে স্বৈরতন্ত্র কিংবা ভুয়া গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র অথবা পরিবারতন্ত্রই হউক সেটা নিয়ন্ত্রিত হবে জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের দ্বারা। ফলে সব আশা-প্রত্যাশা পরিণত হবে সোনার হরিণে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, জিয়াকে তার ভুলের মাশুল দিতে হবে চরমভাবে। দেশ ও জাতির সাথে তার নিজস্ব পরিণতিটাও হবে দুঃখজনক। এই বাস্তবতাটা যদি যুদ্ধকালে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম তবে আমার যে সমস্ত চারিত্রিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও হয়তো বা তোমাদেরই একজন হয়ে যেতাম। এই ব্যর্থতা আমাকে আজ কুরে কুরে খাচ্ছে। আত্মগ্লানিতে নিজেকে খুবই ছোট মনে হচ্ছে। একজন অতি বিশ্বস্ত আপনজনের কাছে সুযোগ পেয়ে নিজেকে একটু হালকা করে নিচ্ছি। বাধা দিও না। ধরা গলায় বললেন শিশুভাই।
তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম
শিশুভাই, এতো মন খারাপ করছেন কেন? জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে, ঝুঁকি নিয়ে আজ আমরা জিয়ার হাতে ব্যবহৃত পণ্যে পরিণত হয়েছি, আপনিও তাই হতেন।
ফুঁসে উঠলেন শিশুভাই
না, আমি যদি তোমাদের একজন হতাম যুক্তিসঙ্গতভাবে জিয়ার চরিত্র তোমাদের কাছে তুলে ধরতাম, তাহলে তোমরা তাকে কিছুতেই rallying figure হিসাবে গ্রহণ করতে না, আর সেইক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার শিকারেও পরিণত হতে হতো না এতদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা। সেদিন সেই আন্তরিক সন্ধ্যায় শিশুভাই মনের দুয়ার খুলে অনেকটাই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তার চোখে পানি জমে উঠেছিল। কোনদিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই, একনাগাড়ে বলে চলেছেন তিনি মন উজাড় করে আর আমি নীরবে একাগ্র মনে শুনছি তার কথা।
দুর্বল চরিত্রের মানুষ হয়েও আজ কিছু কথা বলব, মনে রেখো তোমাদের শিশুভাইয়ের কথাগুলো। সময়ই প্রমাণ করবে আমার হৃদয় নিংড়ানো বক্তব্যের সত্যতা। তোমাদের নজিরবিহীন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নৈতিক এবং মানবিক চরিত্র, আত্মত্যাগের সুমহান আদর্শ, রাজনৈতিক বিপ্লবী নীতি -আদর্শ এবং নিপীড়িত এবং বঞ্চিত জনগণের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে আপোষহীন সংগ্রামের প্রত্যয় দ্বারাই সম্ভব সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ’৭১-এর চেতনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন; একটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
সাময়িকভাবে, অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী, বিক্রিত বুদ্ধিজীবী এবং সমাজপতি, বর্তমানে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর প্রতিভূ সরকারের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভে লালায়িত হয়ে তাদের অঙ্গুলি হেলনে তোমাদের সম্পর্কে যে মূল্যায়নই সরবে প্রচার করুক না কেনো একদিন এই দেশেরই জনগণ সব সত্যই উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হবে। তখন তাদের কষ্টিপাথরের পাল্লায় একদিকে মুজিব আর জিয়া এবং অন্যদিকে তোমাদের দাঁড় করালে তোমাদেরকেই বিবেচনা করা হবে জাতীয় বীর আর মুজিব এবং জিয়া দুই জনকেই আখ্যায়িত করা হবে জাতীয় বেঈমান হিসাবে।
আমি নীরবে বসেছিলাম। শিশুভাই যাকে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে আমরা সম্বোধন করতাম ‘নাবালক ভাই’ হিসাবে, যার ভীরুতা নিয়েও কাছের জনরা তিরস্কার করতাম অহরহ সেই শিশুভাই আজ ঘটনাচক্রে জেনারেল জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ‘রাজপুতিন’ নামে খ্যাত সেই শিশুভাই আজ কোন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের স্বগতোক্তি করছেন! আমাদের সাথে শিশুভাই-এর কোন লেনদেনের সম্পর্ক নেই, ছিলও না কখনোই। ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বন্ধন। তাই বোধকরি এতদিনের সুপ্ত বিবেক আজ জেগে উঠেছে প্রবহমান ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। তার সচেতনতা মেনে নিতে পারছে না জিয়া ও তার দোসরদের কর্মকাণ্ড। তার আন্তরিকতায় কোন খাদ ধরতে পারিনি। তাই তার প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা বেড়ে গেল নিজের অজান্তেই। আল্লাহ চাইলে যে কোনো মানুষের মন-মানসিকতা বদলে দিতে পারেন মুহূর্তে তারই জ্বলন্ত একটি নিদর্শন আজকের শিশুভাই সেটা আমাকে মেনে নিতেই হল। টনি ভাবী এসে জানালেন খাবার দেয়া হয়েছে। শিশুভাই, উঠে আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। টনি ভাবী ইতিমধ্যেই মাহবুবকে ডেকে নিয়ে এসেছেন। খাবার টেবিলে বসে দেখলাম ভাবী আমার পছন্দের ছোট মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জন, ভর্তা আর চাটনিতে টেবিল ভরে ফেলেছেন। খাবারের বহর দেখে চক্ষু চড়কগাছ। বললাম
ভাবী একি করেছেন!
জবাবে ভাবী বললেন
কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না, সেটা আমার জানা আছে, তাই এই ব্যবস্থা।
হেসে শিশুভাই মশকরা করে বললেন
ভোজন রসিক ডালিম ইতিমধ্যেই খাবারের ব্যাপারেও নিজেকে De-class করে ফেলেছে সেটা জানা ছিল না।
থামো তুমি, খাওয়া শুরু করো সব জুড়িয়ে যাচ্ছে- বলে সস্নেহে নিজ হাতে আমার প্লেটে পছন্দের ব্যঞ্জনগুলো তুলে দিচ্ছিলেন টনি ভাবী। খাওয়ার পর্ব শেষে আমরা আবার গিয়ে বসলাম বসার ঘরে। আসার সময় নিম্মি কিছু গিফট কিনে দিয়েছিল। আমার ডাকে ভাবী, লাজু, কাজু এল বসার ঘরে। আমি সেগুলো সবার হাতে তুলে দিলাম। আসার পথে স্কাইশপ থেকে শিশুভাই-এর জন্য আনা যা কিছু সেটা তাকে দিলাম। সবারই গিফটগুলো পছন্দ হল। প্রিয় টনি ভাবী বললেন, দেখো নিম্মির কাণ্ড, এসবের কি দরকার ছিল!
বললাম, প্রীতি উপহার।
ও মা! তুমিতো দেখছি নিম্মির চেয়েও এক কাঠি সরেস। তবে বলতেই হচ্ছে, নিম্মির টেস্ট আছে।
সাধে কি আর তোমাকে বুদ্ধির ঢেঁকি বলি! পুরো ঢাকায় এটা স্বীকৃত, আর তুমি ডালিমকে সেটাই জানাচ্ছ। যাও, এবার তোমরা। আমরা কিছু কাজের কথা বলি। তার কথায় সবাই বিদায় নিল। লাজু কাজু আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে দৌড়ে তাদের ঘরে চলে গেল।
শুনলাম, তুমি আর এয়ার চীফ তোয়াব লন্ডন থেকে একই ফ্লাইটে এসেছো?
হ্যাঁ, তিনি নিজেই তো সদ্য লিজে নেয়া বিমানটি চালিয়ে নিয়ে এলেন। ককপিটে আমরা দুইজন পুরো সময়টা বসে আলাপ করতে করতে এলাম।
কি আলাপ করলে?
সব কিছু সংক্ষেপে বয়ান করে বললাম
শিশুভাই, দুই ভায়রা যদি কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেই তখন আমরা কি করব বলে আপনি আশা করেন?
রশিদ তো জিয়ার অফার নাকচ করে দিয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ওয়াদা মাফিক সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না আনলে তারা মানে রশিদ আর ফারুক অন্য কোনো চাকুরি গ্রহণ করবে না।
জিয়া সামরিক বাহিনীতে যা কিছু করেছে এরপর তোমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা তার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব না। একই সাথে পৃথিবীর যে কোনো জায়গাতে তোমরা একত্রে থাকো সেটাও জিয়ার মাথাব্যথার কারণ। রাজনৈতিকভাবে আগস্ট বিপ্লবের সাথে একাত্মতার শপথ নিলেও এখন তার পক্ষে তোমাদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। বিশেষ করে ভারতের আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশায় আওয়ামী-বাকশালীদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করার ভারতীয় শর্ত মেনে নেবার পর।
জিয়া এখন সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে এবং মুজিবের মৃত্যুর সাথে তার কোনো সম্পর্ক কখনোই ছিল না যদিও জিয়া স্বয়ং মুক্ত হওয়ার পর ভালভাবেই বুঝতে পারেন, ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব আর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মূলে কাজ করেছিল একই শক্তি সেনা পরিষদ। ৭ই নভেম্বর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সেনা পরিষদের সহায়ক শক্তি মাত্র। তিনি এটাও জানেন, এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা একই সূত্রে বাঁধা।
ভারতীয় চাণক্যরা জিয়াকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে জিয়া চারিত্রিকভাবে বিপ্লবী নন। জিয়ার রাজনীতি হবে ক্ষমতার স্বার্থে সমঝোতার রাজনীতি। তাই ভারতের সাথে নিজের স্বার্থেই তিনি আপোষ করতে বাধ্য হবেন। একই সাথে নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জিয়া সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বেছে বেছে ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট হবেন।
তাদের মূল্যায়নই সঠিক প্রমাণিত হল!
খন্দকার মোশতাক যখন পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার জেনারেল জিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তখন জিয়া অতি সহজেই জাস্টিস সায়েমকেই ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাষ্ট্রপতি রেখে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে এক সময় তাকে বঙ্গভবন থেকে বিদায় করে দেন। এরপর শুরু করেন রক্তের হোলিখেলা। ব্যর্থ সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে প্রায় হাজার তিনেক সেনাসদস্যকে বেছে বেছে বিনাবিচারে হত্যা করা হয় অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে অগুণতি প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীকে মেরে ফেলা হয় কিংবা জেলে ঢুকানো হয়। এভাবেই জিয়া মনে করছেন, সামরিক বাহিনীতে তার ক্ষমতা তিনি নিরংকুশ করতে পেরেছেন বিশেষ করে সেনা পরিষদের শক্তি দুর্বল করে দিয়ে।
শিশুভাইয়ের বক্তব্য আমদের অজানা ছিল না, তিনি আমাদের জানা সব কিছুর সত্যতাই প্রমাণ করছিলেন।
জেনারেল জিয়া মনে করছেন তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। তিনি বোকার রাজ্যেই বাস করছেন। তার জানা নেই, বিপ্লবীদের মারা যায় কিন্তু বিপ্লবী চেতনার মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হয় না। তার বর্বর নৃশংসতায় সামরিক বাহিনীতে আক্রোশ আর ঘৃণা যেভাবে ধূমায়িত হচ্ছে তাতে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেই জ্বলন্ত লাভায় জিয়ার কি পরিণতি হবে সেটা ভাববার বিষয় নয়। আমাদের চিন্তার বিষয় হলো যদি ভারতের প্ররোচনায় কিংবা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাহায্যে জিয়া এইসব করে থাকেন তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে!
শিশুভাই, আপনি দেখছি একজন দক্ষ রাজনীতি বিশারদ এবং দার্শনিক হয়ে উঠেছেন।
আমি তেমন কিছুই নই। শুধুমাত্র চলমান ঘটনা প্রবাহের সত্যকেই যতটা বুঝি তোমার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এখানে লাভ-লোকসানের কোনো হিসেব নেই। শ্রদ্ধা করি তোমাদের সাহস, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও আপোষহীন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। অন্তর থেকে ভালোবাসি তোমাদের এবং শ্রদ্ধা করি তোমাদের নীতি-আদর্শকে। আমি শুনছিলাম সব কিছু আর মৃদু মৃদু হাসছিলাম। আমার মৃদু হাসি লক্ষ করে শিশুভাই বললেন-
ঠাট্টা করছ? তা অবশ্য করতেই পারো।
না, আপনাকে নতুন ভাবে বোঝার চেষ্টা করছি শিশুভাই। কিন্তু কই, জবাব দিলেন নাতো আমাদের কি করা উচিৎ?
আগেও বলেছি আবারও বলছি, তোমরা প্রত্যেকেই এক একটি অমূল্য রতন। ৮-১০ কোটি দেশবাসীর মধ্যে তোমাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ জনদরদী খুঁজলেও খুব একটা পাওয়া যাবে না এই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই আমার হয়েছে। অপশক্তিগুলোর চোখ রয়েছে তোমাদের উপর। তাই বর্তমানে কোনো ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের শেষ করে দিও না।
অনেক রাত হলো, সকালেই তো আবার আপনাকে অফিসে উপস্থিত হতে হবে। তাই আজকের মত আসি- বলে উঠে দাঁড়ালাম। গাড়ি পর্যন্ত আমাকে আর মাহবুবকে পৌঁছে দিলেন শিশুভাই। হাঁটতে হাঁটতে বললাম
আপনি আমাদের যেভাবে আসমানে তুলে দিলেন ভয় হচ্ছে ধপাস করে ধরণীতলে পড়ে না যাই!
সাবধানে থাকবে।
Wilco. দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যদি সুযোগ আর তৌফিক দেন তবে আমাদের সবার কাছে Happy go lucky type শিশুভাইয়ের আজকের এই অসাধারণ রূপটা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা নিশ্চয় করব।
শিশুভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ালেন। আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম, মাহবুবও উঠে বসল পাশে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করতেই শিশুভাই গাড়ির জানালার কাছে এসে বললেন-
কালই হয়তো তোমাকে ডেকে পাঠাবেন জেনারেল জিয়া, তার CMLA’s Office এ।
Not for Court Martial I suppose!
কার বিচার কে করবে বা কেমন হবে সেটা আল্লাহ্ই জানেন, বললেন শিশুভাই।
তিনজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম।
মালিবাগে পৌঁছে দিয়ে মাহবুব জিজ্ঞেস করল-
আমি কি থেকে যাবো স্যার?
পাগল নাকি! তুমি ফিরে যাও। এত ভয় করলে কি চলে? তাছাড়া এলাকাটা আমাদের নিজস্ব। খানসেনারাই এই বাড়ি রেইড করে স্বপনকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল এই কথাটা ভুলে যাচ্ছ কেন?
ঠিক আছে স্যার, তবে সিভিল ড্রেসে কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈনিক থাকবে বাসার পাহারায়। এই বিষয়ে আপনার কোন আপত্তি আমি শুনবো না। মিনতি ভরা চোখ মাহবুবের। তাই হেসে বললাম-
ক্রসফায়ারে মারা না পড়ি।
জবাব শুনে মুচকি হেসে মাহবুব বলল-
চীফ ডাকলে, সময় মতো ডেকে পাঠাবেন স্যার। ফোন করে দিলেই আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো।
ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।
আল্লাহ হাফেজ, চলে গেল মাহবুব।
কেয়ার ঘরে গিয়ে দেখি পানের বাটা ঘিরে স্বপন, মহুয়া, মুন্নি আর কেয়া আমার অপেক্ষায় নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে মুখর। আমি পৌঁছতেই কেয়া আমার মুখে একটা পান গুঁজে দিয়ে বলে উঠল-
ভাইয়া, তোমার সাথে আমাদের কিছু serious কথা আছে। চলো উপরে স্বপন ভাইয়ার ঘরে। কারণ, আমরা চাইনা আব্বা আমাদের কথাবার্তা শুনুক।
ঠিক আছে। কিন্তু মহুয়া তুই বাসায় ফিরবি না? অনেক রাত হয়ে গেছে।
তুমি যতদিন আছো ততদিন আমি মালিবাগেই থাকবো। লিটু আর শাশুড়িকে সেটা জানিয়ে দিয়ে এসেছি। বিশালকে সাথে নিয়ে এসেছি as he remains much happier at Malibag, so no problem. তোমার দেখাশুনা করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আন্টির পক্ষে একা সবকিছু সামলানো সম্ভব নয়।
কেনও? বাসায় তো একগাদা পুরনো লোকজন রয়েছে, সবাই যার যার কাজে fully trained. Anyway চল উপরে যাই।
দোতলায় স্বপনের বেডরুমের কার্পেটে কুশন নিয়ে সবাই জাঁকিয়ে বসলাম।
মহুয়াই শুরু করলো
জানো ভাইয়া, তোমরা দেশ ছাড়ার পর তোমাদের ভক্ত সৈনিক আর অফিসার ভাইরা প্রায়ই খোঁজ খবর নিতে আসতো। তাদের একটাই কথা, আমরা যাতে তোমাদের কালবিলম্ব না করে ফিরে আসতে অনুরোধ করি। কারণ, তারা জিয়া সম্পর্কে দিন দিন সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। তাদের ধারণা, জিয়া তোমাদের ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন না। ঘটনা প্রবাহে তাদের ধারণাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
পরাজিত বিপ্লবীকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিস তাইনা?
কি বললে? পরাজিত বিপ্লবী! বিপ্লবতো শেষ হয়ে যায়নি। চলছে, চলবেও। তাই জয়-পরাজয়ের প্রশ্নটা অবান্তর।
জিয়া নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে, ফোঁড়ন কাটল কেয়া।
ঠিকই বলেছে কেয়া। মোনাফেকির মাশুল জিয়াকে দিতেই হবে। তবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। জিয়ার মৃত্যুর সাথে বিপ্লবের মৃত্যু হবে না। বিপ্লব একটি সনাতন আবহমান প্রক্রিয়া।
ওরে বাবা, কোটিপতির বউ হয়ে তোর মুখে বিপ্লবের বাণী! আমিতো রীতিমতো ভিরমি খাচ্ছি!
কেনও? তুমি যদি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বিপ্লবী হতে পারো তবে তোমার বোন বিপ্লবী হলে দোষ কোথায়?
আজ যারা ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে নব্যবিত্তশালী বনে সমাজটাকে কিনে নিয়েছে তাদের ওই বিত্তবৈভব সবই তো দেশ থেকেই অর্জিত বৈধ-অবৈধ ভাবে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই কৃতঘ্ন। নৈতিকতা বিবর্জিত কলুষিত মন তাদের। আমি কোটিপতির বউ হতে পারি, তবে আমার একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা আছে। আমি আমার সত্তাকে কারো কাছে বন্ধক দেইনি, আমি শিক্ষিতা। আজ আমি যাই হই না কেনো, তার জন্য দেশের কাছে আমি ঋণী এতটুকু বোঝার যোগ্যতাও আমার আছে। তাই দেশ ও জনগণ নিয়ে আমাকেও ভাবতে হবে। সেটাই স্বাভাবিক, এটা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কি কোনো অবদানই ছিল না? আমরা কি নির্যাতিত হইনি? প্রাণের ঝুঁকি কি আমরা নেইনি?
সেটাতো সর্বজন স্বীকৃত।
ভাইয়া, তুমি জ্ঞানী, বিস্তর তোমার পড়াশুনা। তারপরও তোমারই বোন হিসাবে আমি তোমাকে শুধু বলতে চাই, বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াতে উত্থান-পতন থাকবেই। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সব কিছু মেনে নিয়েই যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। রণেভঙ্গ দেয়া চলবে না। তোমাদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। সেটা আমরা বাইরে থেকে যতটুকু বুঝি ততখানি তোমরা নাও বুঝতে পারো। হোঁচট যদি খেয়েই থাকো তার মোকাবেলা করতে হবে বাস্তব ভিত্তিক বিচক্ষণতার সাথে, আবেগের সাথে নয়।
দৃঢ়চেতা সাহসী কিন্তু ধীরস্থির শান্ত প্রকৃতির মহুয়ার মধ্য যে এই ধরনের স্ফুলিঙ্গ থাকতে পারে সেটা বাহ্যিক ভাবে বোঝা মুশকিল। এমনি হয়তো না জানা লক্ষকোটি প্রাণে সুপ্ত হয়ে ধিক ধিক করে জ্বলছে অঙ্গার, এই অঙ্গারকে প্রজ্বলিত করে দাবানল সৃষ্টি করার মধ্যেই রয়েছে বিপ্লবের সফলতার চাবিকাঠি। কথার মোড় অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলাম। আধশোয়া অবস্থায় স্বপনকে জিজ্ঞেস করলাম-
কিরে তোর ব্যবসা কেমন চলছে?
ভালোই চলছে, ১৫ই আগস্টের পর তোর আর নূর ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী SANS INTERNATIONAL বন্ধ করে দিয়ে নিজের কোম্পানির নামে Import Export- এর ব্যবসার পাশাপাশি নৌযান ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। কাঁটাতার, নাটবলটু, স্ক্রু, চাবি তৈরি করার ডিজাইনটা মোটা দামে মেহের ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিল। ওই টাকায় দুটো Double Decker Launch বানানো হচ্ছে আমার Design অনুযায়ী। প্রতিটি লঞ্চ ৫০০ যাত্রী বহনের ক্ষমতা রাখবে। সদরঘাট থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশাল এই রুটেই চালানো হবে লঞ্চদুটো। আমার বিশ্বাস ১ বছরেই ক্যাপিটাল ফিরে আসবে। এমনটি হলে আরও দুটো লঞ্চ বানাবো। ৩-৪ বছরের পর সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে Under bonded House System, joint venture এ ready made garments factory install করার ইচ্ছে আছে with Taiwan or Korea. This is a labor intensive field and most of the workers would be female. This would be 100% export oriented business. So, earnings would be n foreign currencies.
হংকং এবং সিঙ্গাপুর এ অনেক Korean and Taiwanese companies office খুলে বসে আছে, ওদের থেকেই shall chose some reputed one for the joint venture. নুরুল কাদের ভাইও তাই ভাবছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে স্বপনের দূরদর্শিতা ও জ্ঞান অসাধারণ তীক্ষ্ন সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই ও যাই করুক না কেনো সেটা বুঝেশুনেই করবে সেই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ১৯৭৪ সালে PO-9 এর আওতায় মুজিব সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেছে বেছে মোট ৬২ জন সরকার বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। সর্ব প্রথম যেই ১২ জন আর্মি অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিল তার মধ্যে আমি আর নূর ছিলাম তালিকার শীর্ষে। সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিয়ে মুজিব নিজেই আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছুই তিনি আমাদের জন্য করতে প্রস্তুত। ব্যবসা করতে চাইলে শেখ নাসেরের পার্টনার হয়ে ব্যবসা করতে পারি, যদি বিদেশে যেতে চাই তবে কূটনীতিক হিসেবে যেখানে ইচ্ছে সেখানেই তিনি আমাদের পাঠাতে রাজি আছেন। আমরা তার সেই প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ভাবছিলাম সংসার চালানোর জন্য কি করা যায়!
তখন স্বপনই সহায় হয়ে প্রস্তাব দিল তার সাথে ব্যবসাতে যোগ দিতে। আমাদের আর একজন বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল আকবর হোসেন (জিয়ার আমলে মন্ত্রী) চাকুরিচ্যুত হওয়ার আগেই চাকুরি ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিল। কুমিল্লার সাজেদ মোক্তারের ছেলে আকবর হোসেনের সাথে ছাত্রকাল থেকেই বন্ধুত্ব। ৪ জনের নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে মতিঝিলের টয়েনবি সারকুলার রোডে স্বপনের অফিসেই জন্ম নিল SANS INTERNATIONAL LTD নামের কোম্পানি। অল্প সময়েই অনেক সজ্জন এবং সহানুভূতিশীল পদস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য এবং সহযোগিতায় আমাদের ব্যবসা ভালোই জমে উঠল। এতে রুটি-রুজির সমস্যা রইল না। সেই সময়, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর এবং কর্নেল আকবর মিলে প্রতিষ্ঠিত করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল United People’s Party, সংক্ষেপে (UPP)। আমাদের তারা আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের পার্টিতে যোগদান করার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলাম-
আমরা নীতি-আদর্শের দিক দিয়ে সমমনা, আপনারা আপনাদের পথে এগিয়ে চলুন। আমরা আমাদের পথে এগিয়ে যাবো। জাতীয় স্বার্থে উপযুক্ত সময়ে আমরা অতি সহজেই একত্রিত হতে পারব।
ইতিমধ্যে মেজর শাহরিয়ারও চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে স্বপনের পরামর্শে এয়ারপোর্ট রোডে electric and electronic items repairing shop SHERRY ENTERPRISE খুলে বসেছে। তার কারবারও ভালোই জমে উঠল অল্প সময়েই।
ডালিম শোন, আমি তোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।
জিয়া তোকে কেন ডেকে পাঠিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, জিয়া তোদের শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে। তোদের মধ্যে বোঝাপড়া যাই হয়ে থাকুক সেটার কোনো মূল্য নেই আজকের জিয়ার কাছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি তোদেরকেই তার ক্ষমতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন। ১৫ই আগস্টের সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না সেই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে তার ইশারায়। মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করতে দ্বিধা বোধ করছেন না জিয়া। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, জিয়া ভারতের সাথে আঁতাত করেই রাজনীতি করবেন। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগকে হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো ছাড় দিতেও প্রস্তুত জিয়া। সং সেজে গ্রামে-গঞ্জে মাদারির মতো কোদাল কাঁধে ঘুরে বেড়িয়ে জিয়া আমজনতার কাছে সাময়িক ভাবে হলেও নিজের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটোই হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। Long term নিয়ে জিয়া এখন কিছুই ভাবছেন না। তবে গণচীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা তিনি করলেও করতে পারেন, কিন্তু যত ছাড়ই জিয়া দিক না কেনো ভারত তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না।
কে জানে, হয়তো ভারতই তাকে কবরে পাঠানোর ক্ষেত্র তৈরি করে হায়েনার হাসি হাসছে সময়ের অপেক্ষায়। চাণক্যদের কূটচালের মোকাবেলায় জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আপোষ করে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। জিয়ার উচিৎ ছিল যেই শক্তি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাতে সক্ষম হয়েছিল তাদের সাথেই এগিয়ে চলা, সেটাই ছিল তার জন্য সর্বোত্তম পন্থা।
কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে সেইপথ থেকে সরে এসে চক্রান্তের যে মাকড়সার জাল জিয়া নিজেই তৈরি করেছেন, তাতে আজ নিজেই আটকা পড়ে গেছেন। বাঁচার কোনও রাস্তাই নেই জিয়ার। জিয়ার কোদাল কাঁধের আর ভাঙ্গা স্যুটকেসের চমকের ধোঁকাবাজি অতি অল্প সময়তেই ধরা পড়ে যাবে জনগণের কাছে। প্রকাশিত হয়ে পড়বে তার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ইতিকথা। কিন্তু আমার মনে হয়, তার আগেই তার অপমৃত্যু হবে। সেইক্ষেত্রে কিছু সময় তার দল নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে প্রয়াত জিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে, কিন্তু পরিশেষে দলটিরও অপমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু বেঁচে থাকবে আওয়ামী লীগ আর শেষ হাসি হাসবে ভারতের চাণক্যরা। শিশুভাই সবকিছু বুঝে চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার। Immigration papers হাতে পেলেই তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমাবেন সপরিবারে।
আর একটি কথা। ঠিক এই মুহূর্তে জিয়াবিরোধী যে কোনো পদক্ষেপে লাভ হবে জাতীয় শত্রুদের আর তাদের বিদেশী মোড়ল ভারতের। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি করদরাজ্যে। আর ১০ কোটি দেশবাসী বন্দী হবে দাসত্বের জিঞ্জিরে দীর্ঘকালের জন্য। আমার বিশ্লেষণের সাথে তোরা একমত নাও হতে পারিস। তবে অনুরোধ এই বিষয়ে খবরাখবর নিয়ে একটু ভেবেচিন্তেই যা করার করিস।
এবারের প্রসঙ্গটা পারিবারিক। জিয়া যে ভাবেই হউক আব্বা, শাহ আজিজ, শামসুল হুদা চাচা, জাদু মিয়াকে তার দলে টেনে নিতে পেরেছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘গোড়া কেটে উপর দিয়ে পানি ঢালার মতো’। এতে জিয়া মুখে কিছু না বলেও জনগণকে বোঝাতে পারবে তার সব কার্যক্রমে তোদের সম্মতি রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে তোদের সমর্থক যারাই বেঁচে আছে তারা বিষয়টি খুব একটা ভালো নজরে দেখছে কি?
না, তা হয়তো দেখছে না তবে তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন।
তারা জিয়ার আসল চরিত্র ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারবেন না জিয়া। ভবিষ্যতে আমরা যাই করি সেটা আমরা করব দেশ ও জাতির স্বার্থে, জিয়ার ব্যক্তিস্বার্থে নয় এ বিষয়ে তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। আব্বাদের এখন জিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। জিয়া কানকথায় বিশ্বাসী এক প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্যক্তি। তাই তাদেরকে জিয়াকে বুঝতে হবে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকেই। এর কোনও বিকল্প নেই স্বপন। আমরা সর্বদাই বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। অস্বীকার করব না, আজ অব্দি একটাই মারাত্মক ভুল আমাদের হয়েছে। সেটা হল জিয়াকে চিনতে আমরা ভুল করেছিলাম; ভুলই বা বলি কি করে! কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আমাদের একজন হয়েছিল জিয়া যুদ্ধকালে। সেই জিয়ার মোনাফেকিতে আজ আমরা জিতেও পরাজিত। এর মাশুল শুধু আমাদেরই নয়, দেশবাসীকেও দিতে হবে ভবিষ্যতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-স্বপ্ন বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিল সেনা পরিষদের সাথে গাদ্দারি করে। সব সম্ভাবনার অবারিত দ্বার বন্ধ করে দিল শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার জন্য ভারতের সাথে আপোষ করে। এতদিনের নিরলস পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা সবকিছুই পণ্ড হয়ে গেল একটি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভাই! শুধু কি তাই, ঐ সমস্ত ত্যাগী সাথীরা, যারা বুক দিয়ে জিয়াকে বাঁচিয়ে রেখে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাল তাদের রক্তেই তিনি তার হাত রঞ্জিত করলেন অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। এর বিচার কি আল্লাহ্ করবেন না? নিশ্চয়ই বিচার করবেন তিনি।
হ্যাঁ, তার জঘন্য নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিচার হবেই ইহকালে এবং পরকালে। আর একটি কথা। জানিস, কেন শিশুভাই মাহবুবকে তোর সাথে ছায়ার মতো থাকতে বলেছেন?
কিছুটা আঁচ করতে পারি হয়তো আমার নিরাপত্তার জন্য কিন্তু আমার নিরাপত্তার হুমকিটা ঠিক কোথা থেকে সেটা বুঝতে পারছি না!
আমি তোর Threat perception টা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। শিশুভাই তোর ব্যাপারে জিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বলেই মাহবুবকে তিনি নিজস্ব উদ্যোগেই তোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তোদের সবাইকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন এবং আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন, বিশেষ করে তোকে। যা ঘুমোতে যা, অনেক রাত হল। কালকের কথাবার্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কর গিয়ে।
সবাই উঠে নিজ নিজ কামরায় চলে এলাম। কাপড় বদলে শুয়ে পড়লাম। শিশুভাই আর স্বপনের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ১০ টায় দরজায় টোকা দিয়ে মহুয়া আমাকে জাগিয়ে তুলে বললো
CMLA এর অফিস থেকে জেনারেল জিয়ার ADC ফোন করেছে।
উঠে গিয়ে ফোন ধরতেই ADC বললেন, চীফ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন বিকেল ৫টায় CMLA এর অফিসে পুরনো সংসদ ভবনে। সেখানেই সাক্ষাত হবে।
ঠিক আছে। বলে লাইন কেটে দিয়ে মাহবুবকে খবরটা জানিয়ে দিলাম। মাহবুব বলল, যথাসময়ে ও এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এরপর শিশুভাইকে ফোন করলাম-
শিশুভাই, চীফ আমকে বিকেল ৫টায় CMLA ’s office এ ডেকে পাঠিয়েছেন। মাহবুব এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
That’s fine. একটা বিষয়ে খেয়াল রেখো, কথা বলবে কম শুনবে বেশি।
Okay Sir, shall do as you said. রাখি এখন, সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি।
Be polite and listen what he says. But be firm in whatever you say. Prepare well and take care. পরে সাক্ষাতে শোনা যাবে কি কথা হল।
শিশুভাই, কালকের জন্য আরো একবার আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। We all love you a lot with respect from the core of our hearts.
We too, bye ফোন রেখে দিলেন শিশুভাই।
যথাসময় মাহবুব এলো। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম CMLA ’s Office এ। গেটের গার্ডরুম থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে ADC ক্যাপ্টেন জিল্লুর গাড়ি বারান্দা থেকেই অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো। মাহবুব ADC- এর ঘরে অপেক্ষায় থাকলো। আমি সংলগ্ন দরজা দিয়ে গিয়ে ঢুকলাম Chief Martial Law Administrator এর বিশাল Office এ।
চলবে