জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা শরিফুল হক ডালিম

১৭তম পর্ব
১ম কিস্তি

জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে

যাই হউক, জমিরের ব্যবস্থা অনুযায়ী একদিন আমি নিম্মিকে সাথে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম ঢাকার পথে। লন্ডনে পৌঁছে জানতে পারলাম রশিদ জার্মানি হয়ে ঢাকায় পৌঁছে গেছে আর ফারুক সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছে। খবরগুলো আমাদের কাছ থেকে গোপন করে রাখায় সন্দেহ হলো, এর পেছনে কিছু একটা মতলব আছে। খবরগুলো বেনগাজীতে জানিয়ে দিয়ে বললাম সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এলার্ট থাকতে হবে। লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন করেছিল। নির্ধারিত দিনে বিমানের একটা ফ্লাইটে ঢাকায় যাবার জন্য হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। সেই সময় আমার শ্বশুর সাহেব লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কন্স্যুলার মিনিস্টারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। Basically, he was an Ex-PSP Officer, পদবীতে ছিলেন DIG Police. মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিও জনাব হোসেন আলীর সাথে Calcutta Mission থেকে একসাথে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের পক্ষে Defect করেছিলেন। তার কর্মনিষ্ঠা, নীতি-আদর্শ, সততা পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল সর্বজনবিদিত। তার চরিত্র বোঝার জন্য দুই একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
ষাটের দশকের শেষার্ধে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অপরিসীম। তখন আমার হবু শ্বশুর জনাব আর আই চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন আজম খান। জেনারেল আজম অবাঙ্গালী হয়েও ছিলেন এক অসাধারণ মানবিক গুণে গুণান্বিত ব্যাক্তি। বাঙ্গালীদের জন্য তার আন্তরিক ভালোবাসা এবং বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আচরণের বিরোধিতার ইতিকথা আজো বাংলাদেশী জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করে। জনাব চৌধুরী দুঃস্থ জনগণের পুনর্বাসনের জন্য দুর্গত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে ত্রাণ কাজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার কাজে খুশি হয়ে জেনারেল আজম খান পুরস্কার হিসাবে তাকে ঢাকার অভিজাত গুলশান আবাসিক এলাকায় দুই বিঘার একটি প্লট বরাদ্দ করেন। খবরটা জেনে জনাব চৌধুরী গভর্নর সাহেবের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেছিলেন একজন বেতনভুক সরকারি চাকুরে হয়ে সাধ্যমত তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জন্য কোন পুরস্কার গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। জবাবে গভর্নর আজম খান কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘If you don’t take it as a free gift then pay through monthly installments.’
জনাব চৌধুরী বলেছিলেন সংসারের খরচ চালিয়ে সেটাও সম্ভব নয়। তাই কৃতজ্ঞতার সাথে তিনি গভর্নর সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন প্লটটির এলটমেন্ট বাতিল করে দিতে।
’৭১ সালে পাকিস্তানের কোলকাতা মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে কোলকাতা মিশনের সব অফিসার ও স্টাফরা গোপন বৈঠক করছিলেন, তখন জনাব চৌধুরী ছিলেন মিশনের উপপ্রধান হিসাবে Covert Job এ নিয়োজিত। তৃতীয় সচিব ছিলেন আর. করিম জয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তারা সবাই ডিফেক্ট করবেন। তখন মিশনের সবাই কোলকাতায় সপরিবারে বসবাস করছিলেন, কিন্তু তখন চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, একমাত্র ছেলে বাপ্পি এবং কন্যা নিম্মি ঢাকায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। কোলকাতায় তার সাথে থাকতো সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মানু। সে তখন Convent School এর ছাত্রী।
পরিবারের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও তিনি অন্য সবার সাথে ডিফেক্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলেন, ভারতের সাথে যেই ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার গঠন করছে সেই চুক্তির অধীনে রক্ত দিয়েও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা সেই সম্পর্কে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বরং ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ হয়তো বা ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত হবে। তার সেই বক্তব্যের জবাব তখন উপস্থিত কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব হয়নি। তার Defection এর খবর প্রচারিত হবার পর তার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সেই লোমহর্ষক পলায়নের বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে প্রকাশিত বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে এবং ওয়েবসাইট দুটোতে বিস্তারিত লেখা রয়েছে।
Defection এর আগেই অবশ্য ভারত সরকার জনাব হোসেন আলীকে আশ্বস্ত করেছিল তাদের বেতন-ভাতা, থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য কূটনৈতিক সব সুবিধাদি বহাল রাখা হবে। কোন বিষয়েই কোন ঘাটতি হবে না। প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে মিশন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবে ভারত সরকার। Defection এর পর ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যখন জনাব চৌধুরীর কাছে তার Contacts দের ফাইলগুলো চেয়েছিল তখন জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী সেগুলো দিতে অস্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি সব জ্বালিয়ে ফেলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Such a request is beyond professional ethics.’ নৈতিকতার এক বিরল উদাহরণ! তার সেই দিনের দূরদর্শী ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বর্তমানের বাংলাদেশে কতটুকু প্রমাণিত, সেটা যাচাই করার ভার দেশবাসীর উপরই থাকল। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মোশতাক সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারি চাকুরেদের সবাইকে যথাসময় অবসর নিতে হবে। কাউকে Extension দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর একদিন প্রেসিডেন্ট ডেকে জানালেন আমার ছোট শালি মানুর পড়াশোনার সমাপ্তির জন্য জনাব চৌধুরীকে আরও দু’বছর লন্ডনে থাকতে হবে অবসর নেবার পর। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশসহ ফাইল এসেছে তার চাকুরির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে দেবার। তিনি আমার মতামত জানতে চাইলে আমি পরিষ্কার বলেছিলাম, সরকারের সিদ্ধান্ত সবার ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। তাই আমার শ্বশুরের ব্যাপারে ব্যতিক্রম করাটা ঠিক হবে না। প্রেসিডেন্টের পুরনো বন্ধু জনাব চৌধুরী। তাই প্রেসিডেন্ট বললেন, তার সাথে একবার আলাপ করতে। বলেছিলাম, এর প্রয়োজন ছিল না। কারণ, আমার বিশ্বাস তিনি এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হবেন না। তারপরও প্রেসিডেন্ট আমার সামনেই তাকে ফোন করলেন। আলাপ হল দুই পুরনো বন্ধুর মধ্যে।
তিনি জানালেন Extension তিনি নেবেন না। কারণ, তার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন সমাধান কি করে হলো। জবাবে জনাব চৌধুরী জানালেন, তার সমস্যাটা নিয়ে তিনি ব্রিটিশ হোম অফিসের সাথে আলাপ করেছিলেন এবং ২ বছরের জন্য থাকার অনুমতি চেয়েছিলেন, তার সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার তার পুরো পরিবারকে ব্রিটিশ পাসপোর্টই দিয়ে দিয়েছে। এমন ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। ধর্মের কল এভাবেই বোধ করি বাতাসে নড়ে। সততার মূল্য মানুষ দিতে না পারলেও সৃষ্টিকর্তা কার্পণ্য করেন না। তিনি যথাসময়ে সবার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে থাকেন কোনো না কোনো উপায়ে।
অফিস কামাই করে জনাব চৌধুরী এয়ারপোর্টে আসেননি। তিনি ছাড়া অন্য সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। যথাসময়ে প্লেন আকাশে উড়ল। আমি একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে চীফ পারসার সম্ভ্রমের সাথে এসে জানাল, আমাকে ককপিটে ডেকে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানের অনেক সিনিয়র ক্যাপ্টেনই বন্ধু। বন্ধুদের কেউই আজ বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনই কেউ ডেকে পাঠিয়েছে। তাই উঠে পারসারের সাথে ককপিটে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই চোখ আমার চড়ক গাছ! দেখলাম এয়ার চীফ তোয়াব প্লেন চালাচ্ছেন। কিছুটা অবাক হয়ে সালাম জানিয়ে বললাম-
: স্যার, আপনি? আমার আগমনে কো-পাইলটের সিটটা খালি করিয়ে জনাব তোয়াব আমাকে সেইখানে বসতে বললেন।
আমি বসে পড়লাম। মনে পড়ে গেল পুরনো দিনের কথা, যখন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট হিসাবে ককপিটে বসে প্লেন নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়াতাম। উড়োজাহাজ চালানোর হাতেখড়ি ও প্রশিক্ষণ আমাদের দু’জনেরই একই যায়গায়, PAF Base রিসালপুরে। ব্যবধান শুধু অভিজ্ঞতার। সেটা বয়সে বড় হওয়ার কারণে। আধুনিক বিমানগুলোর প্রায় সবগুলোই যান্ত্রিক অনুশাসনেই পরিচালিত হয়। শুধু টেকঅফ আর ল্যান্ডিং এর সময় পাইলটদেরকে হাল ধরতে হয়। বাকিটা পথে অটো পাইলট অন করে দিলেই জাহাজ ফ্লাইট প্ল্যানের কমান্ড অনুযায়ী চলতে থাকে গন্তব্যস্থলের দিকে। শুধু মাঝেমধ্যে দেখতে হয় প্রয়োজনীয় মিটারগুলোর রিডিং ঠিক আছে কিনা আর পথিমধ্যে চেকপয়েন্টগুলো থেকে জেনে নিতে হয়ে যান্ত্রিক বলাকা ঠিক পথে এগুচ্ছে কিনা।
তবে কোন অস্বাভাবিক অবস্থায় ক্যাপ্টেনকেই সামাল দিতে হয় পরিস্থিতির কো-পাইলট, নেভিগেটর আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এর সহায়তায়। যান্ত্রিক কোন গোলযোগ হলে জাহাজ নিজেই জানান দেয়। গোলযোগ সারিয়ে তোলে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। দিক নির্দেশনা উচ্চতার কোন হেরফের কিংবা জ্বালানি সংকটের সমাধান করে নেভিগেটর। সার্বিক তদারকির ভার ক্যাপ্টেনের। আগেপিছে আশেপাশের সবকিছুই ধরা পড়ে রাডারে। যান্ত্রিক বলাকা এগিয়ে চলেছে, আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ককপিট ক্রুরা পাশেই রেস্টিং কেবিনে চলে গেছে। আমি ও এয়ার চীফ তোয়াব আলাপ করছি। তিনি বলছেন-
: বিমান এটি নতুন লিজে নিয়েছে। ফাইনাল সাইনিং সেরিমনি এ্যাটেণ্ড করতে এসেছিলাম। মাঝে জার্মানিতে কয়েকদিনের জন্য ফ্যামিলি দেখতে গিয়েছিলাম এই সুযোগে। You know, since the terrifying incident of 2-3 November, your Bhabi has decided to live in Germany with the children. এরপর থেকে দুইপক্ষই আসা যাওয়া করে থাকি সুযোগ-সুবিধা মতো।
তুমিও ঢাকায় চলেছো ব্যাপার কি?
তার প্রশ্নই বলে দিলো আমি ছাড়া আমাদের অন্য আরও কেউ ঢাকায় যাচ্ছে সেটা উনার জানা। বললাম-
কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, জেনারেল জিয়া ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই যাচ্ছি।
কর্নেল রশিদ, ফারুকও যাচ্ছে নাকি?
না, শুধু আমাকে আর রশিদকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে।
I see!
আমার জবাবে এভিএম তোয়াবকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
কেনও হঠাৎ ডেকে পাঠালেন জিয়া?
প্রশ্নটার জবাবটা জানা থাকলে তো যাবার প্রয়োজন ছিল না। যাক বলুন, আপনার সিরাত মাহফিল কেমন চলছে? দাওয়াহর কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়।
তা ঠিক। তবে আমার এই উদ্যোগটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। উপরন্তু উদ্যোগটাকে রাজনৈতিক রং দেবার চেষ্টাও করা হচ্ছে।
এই ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার মনোভাব কি?
ঠিক পরিষ্কার নয়, কিছুটা রহস্যজনক।
তার জবাব শুনে মুচকি হেসে বললাম-
স্যার, আপনি সব সময় বলে থাকেন আপনার কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। এরপরও রশিদ, ফারুকের সাথে আপনি হরহামেশাই দেখা সাক্ষাত করছেন লন্ডনে কিংবা জার্মানিতে। ত্রিপোলিতেও কয়েকবারই আসা-যাওয়া করেছেন। এই সব জেনে জেনারেল জিয়া যদি কিছুটা সন্দিহান হয়ে ওঠেন তাহলে সেটাকে কি অস্বাভাবিক বলা চলে? আমি তো বলবো সেটাই স্বাভাবিক। সন্দেহ কেন, তিনি যদি আপনাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন তবে সেটাকেও যুক্তিসঙ্গত বলা যেতে পারে।
কিছু বুঝতে পারছিনা। স্বগতোক্তি করলেন এভিএম তোয়াব।
পারবেন স্যার, সময়েতেই পারবেন। জেনারেল জিয়া একজন পাকা খেলোয়াড়।
আমার কথায় চুপ করে গেলেন এভিএম তোয়াব। তিনি কতটা সাহসী তার প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলাম ২-৩ নভেম্বর ’৭৫ রাতেই। তাকে নিয়ে রশিদ, ফারুক গাদ্দাফির টাকায় জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে যে খেলা খেলতে চাইছে সেটা কোনোদিনই সাফল্যের মুখ দেখবে না সে সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। শুধু ধর্মীয় জিকিরের আবরণে জনপ্রিয়তা অর্জন করে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা বাংলাদেশে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মভীরু- কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তাই যদি হতো তবে অনেক আগেই জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যসব ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখা যেত। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে ধর্মহীনতা এবং ধর্মান্ধতা সমানভাবে বর্জিত। এই বাস্তবতাকে না বুঝতে পারায় এই দুই অক্ষের নেতৃত্বের উস্কানি এবং ভ্রান্ত প্ররোচনায় বলির পাঁঠা হতে হয়েছে অগুণতি সাধারণ নিরীহ ধর্মপ্রাণ দেশবাসীকে।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে বিদেশের পেট্রোডলার পকেটস্থ করে যারাই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধারক-বাহক হয়ে লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন তাদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি দেখে তাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ফিকরাবাজির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যে ফাটল আর ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্বল করে রাখাটাই তাদের মূল লক্ষ। পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন, ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশকে কব্জা করে নিয়েছিল মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে। বিশ্বাসঘাতক হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং বেনিয়াদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য ও সহযোগিতায় প্রতিদানে মুসলমান সম্প্রদায়ের সব সম্পদ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এবং বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের যে শুধু বিত্তহীন গোলামেই পরিণত করেছিল তাই নয়, একই সাথে তাদেরকে অশিক্ষিত করে রেখেছিল সমসাময়িক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজের কিছু প্রভাবশালী ওলামাদের কিনে নিয়ে তাদের মাধ্যমে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের জন্য হারাম ফতোয়া জারি করে। তাদের অর্থেই ঐ সব তল্পিবাহক আলেম ওলামাদের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছিল দেওবন্দ, বেরেলভি জাতীয় ফিকরাবাজির বিভিন্ন সূতিকাগার শুধুমাত্র মুসলমানদের বিভক্ত করে রাখার জন্যই।
কুটকৌশলে তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছিল প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হতে আর ঐ সব ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল কোরআন, হাদিস যার অপব্যাখ্যা করে সৃষ্টি করা হয়েছিল হাজারো ফিকরা। সেই বিষফোঁড়ার বিষাক্ত কবলে বর্তমানে উপমহাদেশের সব কয়টি দেশই হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর। আসল অপশক্তির মোকাবেলার পরিবর্তে নানাভাগে বিভক্ত নামেমাত্র মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী সহিংস সংঘাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে নৃশংস দাঙ্গা-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়ে দেশগুলোকে পশ্চাদমুখী করে মধ্যযুগেই ঠেলে দিচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রতা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা সুযোগ বুঝে বিশ্বপরিসরে ভ্রান্ত প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত ইসলামের ভাবমর্যাদাকেই ক্ষুন্ন করছে। যদিও প্রকৃত ইসলাম হলো সার্বজনীন শান্তি এবং মানবতার ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
ফিরে চলি এভিএম তোয়াব এর সাথে আলাপে।
পরিবেশ হালকা করার জন্য প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম-
স্যার, আপনাদের মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেশন কেমন চলছে? জেনারেল জিয়ার গৃহীত রাজনৈতিক উদ্যোগকে আপনি কি ভাবে দেখছেন? নিজের কারিশমা বাড়াবার জন্য গেঞ্জি পরে কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খাল কাটার কর্মসূচির চমকে তো দেশবাসী বিমুগ্ধ। তার প্রণীত ১৯ দফাও জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে বলে জানতে পারলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তার?
এভিএম তোয়াব আমার প্রশ্নগুলোর কোনো জবাব না দিয়ে হেসে বললেন
এই সমস্ত বিষয়ে জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে কোন আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজনই বোধ করেন না। এই সব বিষয়ে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মহব্বতজান, জেনারেল শিশু, জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল শওকতই তার মূল পরামর্শদাতা। বাহ্যিকভাবে আমি এবং জিয়ার আত্মীয় এম এইচ খান ন্যাভাল চীফ ডেপুটি মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর বটে, তবে সব ক্ষমতা তো জিয়ার মুঠোয়। তার অঙ্গুলি হেলনেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। শুনেছি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের পর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছেন জিয়া। সেই প্রক্রিয়াতেও আমাদের কোন ভূমিকা নেই।
তাহলে তো বলতে হয় কাঁধে চাকচিক্য বাড়িয়েও আপনারা হচ্ছেন নিধিরাম সর্দার, কি বলেন স্যার? কিছু মনে করবেন না একটু রসিকতা করলাম পরিবেশটাকে হালকা করতে। বড্ড গুমোট অনুভব করছিলাম।
আমার কথায় জনাব তোয়াব প্রাণ খুলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
ঠিকই ধরেছো তুমি। একটা খোঁচাও দিলেন সাথে-
তোমরা সবাই গত, আর আমরা যাবার পথে, হা হা হা! তবে স্বীকার করতে সংকোচ নেই তোমরা সাহসী বীর। কিছু অর্জন করে গিয়েছো কিন্তু আমরা এলাম আর যাবো। তবে কোনো অর্জন ছাড়াই। যে ধরনের পাঁচমিশালি ককটেল সৃষ্টি করা হচ্ছে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় তার সেই রাজনীতিতে দেশ বা জাতি কতখানি উপকৃত হবে সেটা জানিনা। তবে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতা জিয়া সংরক্ষণ করবে নিজের মুঠিতে তথাকথিত গণতান্ত্রিক লেবাসের আবরণে সেটাই স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কম্প্রোমাইজের নীতিই হবে তার রাজনীতির আদর্শ। এই ধরনের রাজনীতি পাকিস্তানেও চলে এসেছে শুরু থেকেই। তার পরিণাম সম্পর্কে আমার চেয়ে তুমি কম অবগত নও। জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী আর তাদের বিদেশী শক্তিধর মোড়লদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে ব্যক্তি আর গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করা যায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। কিন্তু তার বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থ এবং স্বকীয়তা। তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতোই চলবে বাংলাদেশের রাজনীতি। জিয়া এর বিপরীতে কোনো প্রগতিশীল বৈপ্লবিক রাজনীতির সূচনা করবেন তেমনটি মনে করার কারণ নেই।
ভাগ্যচক্রে ‘৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়া একজন চতুর উচ্চাভিলাষী পাকিস্তানী সামরিক অফিসার হিসাবে ভারত এবং প্রবাসী সরকারের চক্ষুশূল, স্বাধীনতার পর তোমাদের ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনীতে টিকে থাকা, অবশেষে আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লবের বদৌলতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে আবিষ্কার! এটাই তো তার জীবন বৃত্তান্ত। এতে তার নিজের অবদান কতটুকু? বাংলাদেশের মাটি-মানুষের সাথেই বা তার নাড়ির সংযোগ কতটুকু? আমার মতোই ভালো করে বাংলা বলতে বা লিখতেও পারেন না। আমি আর জিয়া রাজনৈতিক ভাবে কতটুকু সচেতন ছিলাম কিংবা আমরা কি কখনোই ছাত্র বা জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম? সঠিক জবাবটা হবে Absolutely not. বরং বলতে হবে We were just careerists and that was our only passion.
তোমাদের কথা আলাদা। জানতে পেরেছি, তোমাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিবার থেকে আগত। ছোটকাল থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। তাছাড়া রাজনীতির উপর বিস্তর পড়াশুনা ও চর্চা তোমাদের অনেককেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে তোলে চাকুরিতে যোগ দেবার আগেই। চাকুরিতে যোগ দেবার পর শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ তোমাদের সচেতনাকে আরও ধারালো করে তোলে। তাই তোমরা সব সময় কঠিন ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বয়সের তুলনায় তোমাদের রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব করে তুলেছে সেটাই আমি বিশ্বাস করি। তোমাদের সাথে জিয়া বা আমার মতো লোকদের কোনো তুলনাই হতে পারে না। এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে আমি মোটেও লজ্জিত নই।
আমি চুপচাপ শুনছিলাম এভিএম তোয়াবের বক্তব্য।
এতোটা সাহসও মানুষের হতে পারে সেটা কখনোই আমি কল্পনা করতে পারতাম না তোমাদের স্বচক্ষে না দেখলে। দেশ ও জাতিকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে বাঁচাতে নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে তুমি ও নূর দুইজনেই ছুটে এসেছিলে খালেদের সাথে আলোচনার জন্য। তোমাদের দেশপ্রেম আর সাহস দেখে সেদিন শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে এসেছিল, মনে মনে সিনিয়র হয়েও আমি তোমাদের স্যালুট করেছিলাম যদিও ভাষায় কিছুই প্রকাশ করার সাহস হয়নি, তবে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল। খুব ছোট আর স্বার্থপর মনে হয়েছিল নিজেকে।
এভিএম তোয়াবের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্যে সততার অভাব ছিল না। খুলে না বললেও তার কথা থেকে জিয়ার সম্পর্কে তার মনোভাব বুঝতেও বেগ পেতে হয়নি আমার। সাহস আল্লাহ্ তায়ালার একটা বিশেষ দান। অতি কঠিন ক্রান্তিলগ্নে খুব কম লোকেই সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। এটাও একটা প্রাকৃতিক বিধান। এই অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে অনেকবার রণাঙ্গনে।
জনাব এভিএম তোয়াব যখন লিবিয়াতে এসেছিলেন তখন রশিদ, ফারুক তাকে যেভাবেই হউক রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল যে গাদ্দাফির গ্রীনবুক এ বর্ণিত অস্বচ্ছ ‘প্রগতিশীল ইসলামিক সমাজতন্ত্র’ দর্শনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ধর্মভীরু জনসাধারণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাবার চেষ্টা তাকে করতে হবে। এর জন্য যত টাকাই লাগুক তার যোগান তাকে দেয়া হবে। এর ভিত্তিতেই তিনি ফিরে গিয়ে শুরু করেছিলেন সিরাত মাহফিল। সেনা পরিষদের আমরা বিশ্বাস করতাম, গাদ্দাফির গ্রীনবুক ভিত্তিক আদর্শ এবং শুধু মাত্র জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে কার্যকরী করা সম্ভব হবে না। তাই, আমরা তাদের উদ্যোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর থেকে তাদের কার্যক্রম অবলোকন করছিলাম।
জনাব তোয়াব যখন দেশে ফিরে গিয়ে সিরাত মাহফিল করা শুরু করেন তখন জিয়া তার ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তাই সাময়িক ভাবে তোয়াব কিছুটা খোলা ছুট পেয়েছিলেন। তবে আমরা জানতাম উপযুক্ত সময়ে এভিএম তোয়াবকে বলির পাঁঠা হতে হবে জিয়ার হাতে। রশিদ, ফারুক থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এয়ার চীফ তোয়াবের কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল জিয়ার সাথে তার সহাবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না।
আমি একটি বিষয় নিয়েই বিশেষভাবে ভাবছিলাম। জার্মানিতে দুই ভায়রার সাথে মিলিত হয়ে তোয়াব দেশে ফিরছেন। রশিদ ঢাকায়, ফারুক সিঙ্গাপুরে! এসব আমার কাছে একটি অশনি সংকেত বলেই মনে হচ্ছিল। ভাবছিলাম, যদি শেষকালে দুই ভায়রা মিলে কোন অঘটন ঘটিয়েই বসে সেইক্ষেত্রে আমার এবং সেনা পরিষদের বেঁচে থাকা অবশিষ্টদের করণীয় কি হবে সে সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত আমাকে জিয়ার সাথে দেখা করার আগেই নিয়ে নিতে হবে।
মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, পৌঁছেই লিবিয়াতে অবস্থিত সহযোদ্ধা এবং দেশের বিভিন্ন সেনাছাউনিগুলোতে সেনা পরিষদের ইউনিটগুলোর নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশ্বস্ত বন্ধু-বান্ধব এবং সমমনা শুভার্থীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এইসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই এক সময় এভিএম তোয়াব নিজেই ল্যান্ড করলেন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। ক্যাপ্টেন তাকে সাহায্য করলেন। ল্যান্ডিংটা একটু হেভি হয়েছিল, তবে খুব একটা বেশি না। আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন
Bloody hell! The landing was a bit heavy isn’t it?
Not much of any concern Sir.
যাত্রীরা কেউই কিছুই টের পেলো না। ল্যান্ডিং এর পর আমরা দুইজনই নিজেদের জায়গাতে ফিরে এসে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ক্যাপটেন ট্যাঁক্সিং করে প্লেন টারম্যাকে দাঁড় করাল।
দরজা খুলতেই দেখলাম VIP Lounge এর চত্বরের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মিনু ফুপ্পু, স্বপন, বাপ্পি, মহুয়া, কেয়া। সাথে মেজর মাহবুব বীর উত্তম। সারগোদীয়ান মাহবুব জেনারেল মঞ্জুরের ভাগ্নে। জেনারেল মঞ্জুর ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন (দালাইলামা) দুইজনই ছিলেন সারগোদীয়ান। বন্ধুবর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ কামাল সিদ্দিকীও (Principal Secretary to President Mushtaq Ahmed & Begum Khaleda Zia) ছিল সারগোদীয়ান। মাহবুবের বোন মাহমুদা ছিল নিম্মির সহপাঠী।
মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সেনা পরিষদ গঠনের যৌক্তিকতা এবং ভবিষ্যৎ গণমুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের নীতি-আদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থার সাথে সেও আমাদেরই একজন হয়ে কাজ করে চলেছিল সাংগঠনিক ক্ষেত্রে।
সেই সূত্রে মাহবুবের সাথে আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পর আমরা সবাই কুমিল্লাতে জিয়ার নেতৃত্বে ৩৩ ব্রিগেড পুনর্গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলাম। অনেক দেন-দরবারের পর মুজিব সরকার ৫টি পদাতিক ব্রিগেড এবং আনুষঙ্গিক ইউনিট, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর Nucleolus গঠনের সম্মতি দিতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে মিত্র ভারত লুট করে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৬০০০ কোটি টাকার যুদ্ধ সম্ভার এবং অস্ত্রশস্ত্র। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তারা ইলেকট্রিকাল এবং সেনেটারি ফিটিংসগুলো খুলে নিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি। সমুদ্র বন্দর এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্তূপীকৃত আমদানিকৃত ও রপ্তানির জন্য আনীত সব মালামাল গণিমত হিসাবে লুটে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। দেশের বড় বড় শহরের সব দোকানপাট থেকে সমস্ত মালামাল, সোনা; মিল-ফ্যাক্টরিগুলো থেকে মেশিন, কাঁচামাল এবং স্পেয়ারপার্টস কিছুই লুটে নেয়া বাদ দেয়নি বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি বাংলাদেশের সরকারের সম্মতিক্রমে। এ ধরনের হরিলুটের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অভাবনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল। একই কারণে মেজর জলিলের মতো একজন বীর সেক্টর কমান্ডারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সরকারি নির্দেশে। কিন্তু পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপে তাকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভারত সরকার চাইছিল মুজিব সরকারের নিরাপত্তার অজুহাতে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তির আওতায় দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান রাখবে বাংলাদেশে। তাই মুজিব সরকারের আদেশে দেশের সব কয়টি ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অধীনে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় হাতিয়ার ভারতীয় বাহিনীর হাতে জমা দিয়ে ৫০ টাকা পথ খরচা নিয়ে আপন আপন ঠিকানায় ফিরে যাবার। নিয়মিত বাহিনি ‘Z’, ‘S’, ‘K’-কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় শহর থেকে দূরে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। আর মুক্তিবাহিনীকে বনে-জংগলে। সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে ঐসব মুক্তিযোদ্ধারা যারা সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় আধিপত্য মেনে না নিয়ে আর একটি ভারত বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে তুলেছিল খানসেনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধের আবরণে। তারাই তখন সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় বাহিনীর সদস্য এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বপ্রান্তে ওদের অবস্থানের উপর চোরাগোপ্তা গেরিলা অপারেশান করে তাদের উৎখাতের মাধ্যমে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। প্রতি রাতে মারা পড়তে থাকে শত শত লুটেরা বাহিনী এবং তাদের মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে তল্পিবাহক মুজিব এবং তার মনিব ভারতীয় সরকার। এই ধরনের লুটতরাজের ফলে দেশবাসীও ভারতের উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি ভারত বাংলাদেশে ঢুকেছে রক্ষক হিসেবে নয়, ভক্ষক হয়ে।
দেশের মুক্তিকামী জনগণ প্রতিবাদী লড়াকু দেশপ্রেমিক মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের প্রতি সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীর মনোবল দ্রুত ভেঙ্গে পড়তে থাকে দেশবাসীর ঘৃণা এবং গেরিলাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনের কথা, সহায়ক প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আমরা শ্রদ্ধা করব, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশকে তাদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতে চায় তবে প্রয়োজনে আরও রক্ত দেবো- কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হতে দেবো না। সবারই এক কথা, ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীর গোলামির জন্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করা হয়নি। রক্তের বদৌলতে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা রক্ষা করবো যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে। এভাবেই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের প্রতি বাংলাদেশীদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা দুটোই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একইসাথে বিদেশী সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও চাইছিল না বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী। কারণ, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে, অঞ্চলটাকে তখনও তারা মনে করছিল ‘Occupied Territory’ of Pakistan হিসাবে। এই উভয় সংকটে পরে মুজিব সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ভারত সরকার বাধ্য হয় তাদের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উঠিয়ে নিতে।
এই বিষয়েও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াসের কমতি নেই। তারা প্রোপাগান্ডা করে থাকে দেশে ফেরার পর মুজিবের হুকুমেই নাকি ইন্দিরা সরকার ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিয়ে গিয়েছিলো! এটা নাকি ছিল মুজিবের একটা বিরাট সাফল্য। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৃতিত্ব নেবার যে জঘন্য প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয় তারা জনগণকে বেকুব মনে করেন। তারা এটাও ভুলে যান যে একদিন এইসব মিথ্যাচার ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই স্থান পাবে।
ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হবার পর মুজিব সরকারের নিরাপত্তার জন্য বিএলএফ, কাদেরিয়া বাহিনী, আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও বিভিন্ন নেতাদের অধীনস্থ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী ভারতের সাহায্যে। কারণ, চাপের মুখে মুজিব সরকার জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করার অনুমতি দিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার এবং সৈনিকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করতে পারেনি মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী as their character was not pro- establishment but pro-people. দেশ ও জাতীয় স্বার্থই ছিল তাদের কাছে প্রধান, ব্যক্তি-গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থ নয়।
বিমান বাহিনীর চীফ তোয়াবকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। ভিআইপি লাউঞ্জে একই সাথে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। অনেক দিনের অনিশ্চয়তা এবং ব্যবধানে আমাকে দেখে সবাই অশ্রুসিক্ত চোখে জড়িয়ে ধরল। আমি একে একে সবাইকে জনাব তোয়াবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। স্বপনের সাথে পরিচয় হবার পর জনাব তোয়াব তাকে বললেন-
: শুনেছি তুমিও তো বীরবিক্রম খেতাব প্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা শহরে খানসেনাদের বিরুদ্ধে যতগুলো লোমহর্ষক গেরিলা অপারেশন করা হয়েছে সেই গেরিলা গ্রুপটির মধ্যে তুমি অন্যতম। জানতে পেরেছি, দেরাদুন থেকে কমিশন নিয়ে দেশে ফেরার পর সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে তুমি আর্মিতে যোগদান না করে ব্যবসা করছ?
জবাবে স্বপন বললো
স্যার, আমাদের দলের সবাই ছিল সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা। আমিও ছিলাম তাদেরই একজন। তাই কৃতিত্বের যদি কিছু থাকে সেটার দাবীদার সবাই, আমি একা নই। তাছাড়া যুদ্ধের আগেই বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে জার্মানি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, আর সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে MBA কোর্সটাও শেষ করছিলাম। সেই সময় যুদ্ধ শুরু হয়, আর তাতে আমরা যোগদান করি দেশকে স্বাধীন করতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই ফিরে এসেছি নিজের ব্যবসাতে। যুদ্ধে হারিয়েছি অনেক প্রিয় সহযোদ্ধাদের। আর্মিতে চাকুরি করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে আমরা কেউই যোগ দেইনি।
স্বপন, শাহাদাত চৌধুরী (সাচো), ফতেহ আলী, বদি, রুমি, কাজি কামাল, বাদল, আলম, চুল্লু, সামাদ, আজাদ, উলফাত, তৈয়ব আলি, মেওয়া, ফাজলে, বাচ্চু, মোক্তার, দস্তগির, মায়া, মূলত এদের নিয়েই ২নং সেক্টরের অধীন গঠিত হয়েছিল এই দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপটি।
এরা ত্রাসের সঞ্চার করেছিল ঢাকায় খানসেনাদের মনে দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়ে। তটস্থ করে তুলেছিল কুর্মিটোলার হেডকোয়াটার্স এর বাঘা বাঘা জেনারেল সমরবিদদের। জনগণ তাদের নামকরণ করেছিল সংক্ষেপে ‘বিচ্ছু’ হিসেবে। খানসেনাদের কাছে তারা পরিচিত ছিল ‘মুক্তি’ নামে। অবস্থা এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এই দামাল জানবাজ গেরিলা গ্রুপটি যে বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও খানসেনারা আতঙ্কে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতো ‘মুক্তি আগিয়া’ ‘মুক্তি আগিয়া’ রব তুলে। স্বপন জার্মানিতে পড়াশুনা করেছে জেনে, এভিএম তোয়াব স্বপনের সঙ্গে কিছুক্ষণ জার্মান ভাষায় কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
:He is very sharp and bright young man, I am impressed.
জবাবে বলেছিলাম-
: Sir, all of his Comrades were the brightest lot in the Dhaka University. All were stars in real sense of the term. Luggage have arrived, so it is time to leave.
মালপত্র এসে গেছে তাই বিদায় নেবার পালা। এভিএম তোয়াব-এর কাছ থেকে বিদায় চাইলে তিনি বললেন
ফিরে যাবার আগে দেখা হবে নিশ্চয়ই? Shapan, do remain in touch.
যদি সুযোগ হয়।
বলে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই মালিবাগে এসে পৌঁছালাম।

চলবে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *