১৩তম পর্ব
২য় কিস্তি
রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
বেনগাজী বিমানবন্দরটি বেশ বড়, আধুনিক এবং পরিষ্কার পরিছন্ন। ট্যাক্সিং এর সময় যায়গায় যায়গায় বেশ কয়েটি জঙ্গিবিমান দেখলাম কংক্রিটের হ্যাঙ্গারে রাখা রয়েছে। সবই প্রায় রাশিয়ার মিগ গোত্রের। বেশ কয়েকটা হেলিকপটার গানশিপও দেখলাম ক্যামোফ্লেজড অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উড়ো জাহাজ থেকেই দেখতে পেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথিদের উষ্ণ সম্বর্ধনা দেবার জন্য লাল গালিচা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর্মি ব্যান্ড, গার্ড অফ অনার দেবার জন্য চৌকস একটি সেনা Contingent সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে টারম্যাকে। অতিথিদের মোয়াম্মর গাদ্দাফির তরফ থেকে স্বাগত জানাবার জন্য স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন মেজর সুলাইমান। তিনি বেনগাজি এলাকার প্রজাতন্ত্রের Revolutionary Command Council এর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। সালেম জানালেন, ‘মোয়াম্মর’ মানে ‘প্রিয় নেতা।’ জাতির প্রিয় নেতার সামরিক পদবি কর্নেল, ফলে লিবিয়া প্রজাতন্ত্রে অন্য সবার সর্বোচ্চ পদবি মেজর অব্দি। সালেম আরও জানালেন, ক্ষমতার শীর্ষে মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরেই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন মেজর সুলাইমান। Revolutionary Command Council এ কর্নেল মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরই তার স্থান। তিনি বেনগাজীর গভর্নর এবং সামরিক বাহিনী প্রধান। ত্রিপলি দেশের রাজধানী হলেও বেনগাজী শহর শুধু বৃহত্তমই নয়, সব বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীতে প্রচুর বিদেশীদের অবস্থান, তাছাড়া সব দূতাবাসও সেই শহরে অবস্থিত বিধায় নিরাপত্তার জন্যই বেনগাজীতেই আমাদের রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আমাদের প্লেনটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে দাঁড়ালো। প্লেনের দরজা খোলার পর প্লেনের দরজা থেকে টারম্যাক-এ বিছানো লালগালিচা পর্যন্ত আর একটা লাল কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হলো। নিচে চৌকস সেনা Contingent, সামনে মেজর সুলাইমানের পাশে পদবী অনুযায়ী আরও ৮-১০ জন সেনাসদস্য ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তারা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। মেজর সুলাইমানের ইশারায় ক্ষুদে ছেলেমেয়েদের একটি দল হাতে ফুলের স্তবক নিয়ে এসে দাঁড়াল সিঁড়ির কাছে সুশৃঙ্খল ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে। এরই মধ্যে সালেম সিভিল ড্রেস পাল্টে আর্মি ইউনিফর্ম পরে নিয়েছেন। তিনিই প্রথমে নেমে মেজর সুলাইমানকে স্যালুট করে কচি-কাঁচাদের দলের পুরোভাগে অবস্থান নিলেন। এরপর তার ইশারায় আমরা একে একে অবতরণ করলাম। প্রতেকের হাতে একটি করে ফুলের তোড়া দিয়ে সালাম জানিয়ে স্বাগত জানাল লিবিয়ার ভবিষ্যতের ক্ষুদে নাগরিকরা।
সালেম, মেজর সুলাইমান এবং তার সাথীদের সাথে আমাদের প্রত্যেককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই আরবি কায়দায় আমাদের বুকে বুক মিলিয়ে অভিবাদন জানালেন। এরপর আমরা সবাই যার যার জায়গাতে অবস্থান নেবার পর Contingent Commander এর নির্দেশে গার্ড অফ অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমাদের স্বাগত জানানো হলো। ব্যান্ডে বেজে উঠল বাংলাদেশের এবং লিবিয়ার জাতীয় সঙ্গীত। আমরা প্রথামতো অভিবাদন গ্রহণ করলাম। যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল ব্যান্ডে, এক অপূর্ব মূর্ছনায় পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমাদের মন। মার্চপাস্ট করে চলে গেল Contingent এবং ব্যান্ডপার্টি। সঙ্গেসঙ্গেই একটি গাড়ির বহর এসে উপস্থিত হলো আউট রাইডারসহ। সব কয়টাই মারসেডিজ বেঞ্জ। সামনে পেছনে BMW মোটর সাইকেল এর আউট রাইডারস এবং এস্করট। নিখুঁত ব্যবস্থা। গাড়ীর বহর ধীরগতিতে এগিয়ে চলল এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ওমর খৈয়ামের উদ্দেশ্যে। সেটাই ছিল তখন বেনগাজীর একমাত্র পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল।
সেখানেই প্রাথমিকভাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, জানিয়েছিলেন সালেম। হোটেলকে আরবি ভাষায় বলা হয় ‘ফন্দুক।’ ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেঁষে অতি মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী হোটেল ওমর খৈয়াম। সর্বোচ্চ দু‘টি তলা আমাদের জন্য সুরক্ষিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক অন্যসবও নিখুঁত ভাবেই করা হয়েছে আর্মির তত্ত্বাবধানে।
মেজর সুলাইমানের আগমনে হোটেল কর্তৃপক্ষ তটস্থ হয়ে পড়ল। সুলাইমান ম্যানেজারের সাথে ঘুরে সব ব্যবস্থা পরিদর্শন করে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন চা-নাস্তার বিশেষ আয়োজনে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের অবস্থান সফল এবং আনন্দদায়ক হউক। অতি বিনীতভাবে বললেন, আমরা যেন লিবিয়াকে নিজের দেশ বলেই আপন করে নেই। অতি স্বল্পভাষী এত বড় মাপের নেতার বিনয় এবং আন্তরিক উষ্ণতা আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। পরে গণচীনেও অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যিনি যত বড় মাপের নেতা ততই তিনি বিনয়ী। চা পর্ব শেষে ফিরে যাবার সময় তিনি বললেন, সালেম এখন থেকে আমাদের দেখাশোনার জন্য ২৪ ঘন্টাই আমাদের সাথেই থাকবেন। তিনি আরও জানালেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের উপযুক্ত বাসস্থানে স্থানান্তরিত করা হবে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মেজর সুলাইমান।
এরপর ম্যানেজার ও তার স্টাফরা আমাদের পূর্বনির্ধারিত স্যুইটগুলোতে নিয়ে গেলেন। সালেমের জন্যও একটি স্যুইট বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পর আমাদের তিনি শপিং-এ নিয়ে যাবেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য। এখন আমাদের দীর্ঘ সফরের পর বিশ্রাম প্রয়োজন।
বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দু‘টি মুসলিম অধ্যুষিত বৃহত্তম দেশ সুদান এবং লিবিয়া। তেল, গ্যাস ছাড়াও মূল্যবান খনিজ ও ধাতব সম্পদের ভাণ্ডার দেশ দু’টি। তাই পশ্চিমা শক্তিগুলোর শ্যেনদৃষ্টি দেশ দু’টির উপর বিশেষ করে লিবিয়ার উপর। কারণ, বিপ্লবী নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফি পাশবিক শক্তির দম্ভে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজোড়া নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে সোচ্চার। একই ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশী অপশক্তিগুলোর তল্পিবাহক বাদশাহী এবং আমিরাতির কঠোর সমালোচক বিধায় পশ্চিমা জগতের চক্ষুশূল। তাছাড়া এই বিপ্লবী নেতা পৃথিবীর যেকোনো জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামে তাদের পাশে নির্ভীক ভাবে দাঁড়ান সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।
এটাও আগ্রাসী লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর গাত্রজ্বালা। তাই তার বিরুদ্ধে করা হয় ঐক্যবদ্ধ অপপ্রচার এবং প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র। কিন্তু সাহসী এই বিপ্লবী বীর সবকিছুর মোকাবেলা করেই তার নীতি-আদর্শে অটল থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সুদান, কেনিয়া, চাদ, নাইজেরিয়া, মরক্কো, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, ক্যামেরুন, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো, লেবানন, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, উগান্ডা, বসনিয়া, চেচনিয়া, সোমালিয়া, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, মিন্দানাও, মোজাম্বিক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে গাদ্দাফির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে। এই সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী অনেক নেতার সাথেই ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল লেখকের।
মুসলিম জাহানের দুর্নীতি পরায়ণ আমীর-বাদশাহদের কাছেও তার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ছিল ভীতির কারণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সক্রিয় সাহায্যে ফিকরাবাজির সৃষ্টি করে মুসলিম বিশ্বের বিভক্তিকরণের ষড়যন্ত্রের ঘোর বিরোধী গাদ্দাফি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার। সেই উদ্যোগও গ্রহণযোগ্য ছিল না পশ্চিমা শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল স্বৈরশাসক আমীর-বাদশাহদের কাছে। পাকিস্তান কোনোদিনই পারমাণবিক শক্তি হতে পারত না যদি মোয়াম্মর গাদ্দাফি মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য না করতেন।
মরু অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রচণ্ড তাপদাহে দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে, বাজারে এমনকি অফিস আদালতেও তেমন একটা লোক সমাগম হয় না। শহর জীবন্ত হয়ে ওঠে আসরের পর। ঝিমিয়ে থাকা শহর পড়ন্ত বিকেল থেকেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সব কিছুই খোলা থাকে রাত ১০-১২টা পর্যন্ত।
আমাদের প্রতিটি স্যুইট থেকেই দেখা যায় Outer anchorage এ নোঙ্গর করা বিভিন্ন আকারের সামুদ্রিক জাহাজগুলো। এত বড় অভাবনীয় সম্পদের অধিকারী দেশ লিবিয়ার লোকসংখ্যা তখন ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। তাই প্রতিটি নাগরিকের চাহিদা অতি সহজেই মিটিয়ে চলেছিল বিপ্লবী সরকার। জনগণ ছিল খুশি এবং সন্তুষ্ট। কাছেই শহরের সবচেয়ে বড় Shopping Mall. আরবী ভাষায় ‘সুখ’। যথাসময় সালেম এসে গেলো। আমরাও তৈরি হয়েই ছিলাম। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি বিশ্রাম নেয়ায় কেটে গেছে, সবাই ফ্রেশ। গাড়ির বহরে গিয়ে বসলাম সবাই। সাথে এস্করট। পথ দেখিয়ে চলেছে আউট রাইডারস।
প্রশস্ত আধুনিক হাইওয়ে, স্কাই স্ক্র্যাপারস, দোকানপাট, অফিস আদালত, বাড়িঘর সবি প্ল্যানড। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে পুরো শহর। Shopping Mall গুলোর সব দোকানেই রয়েছে বিশ্বের নামিদামি বুটিক। কার পার্কিং-এ দেখলাম সব নামিদামি গাড়ির সারি। তবে লক্ষ করলাম স্থানীয় পুরুষ বাসিন্দাদের বেশিরভাগের পরনে ‘তুপ।’ বাংলায় যাকে বলা চলে আলখাল্লাহ। এই লেবাস সমস্ত আরবদেশের অধিবাসীদের মধ্যেই পরার চল রয়েছে। মেয়েরা ফ্যাশনেবল বোরকা পরিহিত। কেউ আবার নামিদামি বুটিকের শালীন ড্রেসের সাথে মাথায় ম্যাচিং স্কার্ফ পরে চলাফেরা করছে। অশ্লীল কাপড় পরা কোন মেয়ে কিংবা মহিলা চোখে পড়ল না।
সালেম বললেন, প্রয়োজন আর পছন্দমত কাপড়-চোপড় এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিন সবাই।
কেনাকাটার খোলা ছুট দেয়া হলেও আমরা সংযতভাবেই সবাই ন্যূনতম যা কিছু প্রয়োজন তাই পছন্দ করে কিনলাম। কেনাকাটা শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। ফেরার পর সালেমের অনুরোধে সবাই এক বৈঠকে বসলাম। প্রথমেই সালেম আমাদের প্রত্যেককে একটি কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লিবিয়ার ইতিহাস তুলে ধরলেন আমাদের অবগতির জন্য।
প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, লিবিয়া সুদীর্কাল বিভিন্ন শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৫৫১ সাল থেকে দেশটি অটোম্যান শাসনাধীনে ছিল। তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে ১৯১১ সালে ইতালি লিবিয়ার এক অংশ দখল করে। ঔপনিবেশিক দখলদারির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লিবিয়ার এক নেতা ওমর মোখতার বিদ্রোহ করেন। তিনি ছিলেন কুরআন শিক্ষক, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। ২০ বছর ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। কয়েকটি যুদ্ধে ইতালীয়রা তাঁর কাছে পরাজিত হয়। এক যুদ্ধে তিনি আহত হওয়ার পর ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইতালীয়রা তাঁকে আটক করতে সক্ষম হয়। তড়িঘড়ি করে আয়োজিত প্রহসনের বিচারের পর ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে তারা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পর লিবিয়া ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ক্ষমতায় আসেন বাদশাহ ইদ্রিস। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাদশাহ ইদ্রিস লিবিয়াতে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেন। এর অনেক বছর পর লিবীয় সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণ অফিসার ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, মোয়াম্মর গাদ্দাফির নেতৃত্বে এক সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী লিবিয়া কায়েম করে। এরপর থেকে দেশ পরিচালিত হচ্ছে Revolutionary Command Council এর নেতৃত্বে। ওমর মোখতারকে লিবিয়ার ‘জাতীয় বীর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার নামে মুদ্রা ও ডাকটিকেট ছাপা হয়। আজ অব্দি লিবিয়াবাসী শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করে থাকে। দেখি, আমাদেরকে দেয়া কাগজের মোড়কে মোয়াম্মর গাদ্দাফির লেখা সারাবিশ্বে বহুল ভাবে পরিচিত এবং পঠিত ‘গ্রীনবুক’ এর দুটি খণ্ড রয়েছে। এতে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে বিপ্লবের পটভূমি, নীতি-আদর্শ, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বীরগাথা, লক্ষ্য, কি করে লিবিয়াকে একটি স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল দেশ ও জাতি হিসাবে প্রগতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া সম্ভব তার কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত কিন্তু অতি সরলভাবে লিখেছেন। মোটকথা, এই গ্রীনবুকের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আদর্শিক সমন্বয়, রাষ্ট্র এবং দেশবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দায়িত্বের বিষয়ের সবকিছুর সারবস্তু। গ্রীনবুক এর খন্ড দুটো পড়ার পর আমরা এই বইয়ের বিষয়বস্তু এবং বাংলাদেশ এবং আপনাদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মতবিনিময় করতে ইচ্ছুক যদি আপনারা সম্মত থাকেন। অতি উত্তম প্রস্তাব, আমরাও দ্বিপাক্ষিক অভিজ্ঞতা নিয়ে মত বিনিময় করতে একই ভাবে উদগ্রীব। বৈঠক শেষে তিনি বিদায় নেবার আগে আশা প্রকাশ করে জানালেন, এক সপ্তাহের আগেই সম্ভবত আমরা সুরক্ষিত এলাকাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফ্ল্যাটে চলে যেতে পারবো। সালেম চলে যাবার পর প্যাকেট খুলে দেখলাম গণচীনের বিপ্লবের পর ছাপা চেয়ারম্যান মাও সে তুং- এর লেখা চীন বিপ্লবের নির্যাস হিসাবে প্রকাশিত ‘রেডবুক’ এর মতো প্রায় একই সাইজে ছাপানো হয়েছে গাদ্দাফির দুই খণ্ডের গ্রীনবুক। সাথে একটি চিরকুট আর কিছু দিনার। চিরকুটে লেখা রয়েছে, প্রতিজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য মাসিক ২০০ আর বাচ্চাদের জন্য ১০০ দিনার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে হাত খরচার জন্য, গ্রহণ করে বাধিত করবেন। সেই সময়, ১ লিবিয়ান দিনারের মূল্য ৪ ব্রিটিশ পাউন্ডেরও উপর। মানে, দিনারের উপর মুদ্রিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর মোখতারের ছবির দাম ছিল ব্রিটিশ পাউন্ডে অংকিত রানীমাতার ছবির চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। যেখানে সব কিছুই ফ্রি সেখানে এই পরিমাণ হাত খরচা যথেষ্ট।
হোটেলের অবসর জীবন, হাতে প্রচুর সময়। তাই মেয়েরাসহ যুগপৎ সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রীনবুকের খণ্ড দু’টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে নিতে হবে, সাথে নোটও নিতে হবে আলোচনার সুবিধার্থে। আলোচনাকালেই গাদ্দাফির মন-মানসিকতা, রাজনৈতিক দর্শন, মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন, নিয়ন্ত্রণ, শোষণ থেকে তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম এবং মুক্তি বিশেষ করে মুসলিম জাহানের পশ্চাদপদ রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে কিনা এ সমস্ত বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করে নেয়া সম্ভব হবে। সেই কালে কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা এবং আলজেরিয়ার বেন বেল্লাকে হত্যা করার পর এই তরুণ নেতার মধ্যেই বৈপ্লবিক ধ্যান ধারণার উপসর্গ পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের তুলনায় মোয়াম্মর গাদ্দাফি ছিলেন Comparatively more radical. তার উপর মিসরের জামাল নাসেরের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাকিরা ছিল দ্বিমেরু কেন্দ্রিক কোনো না কোনো বলয়ের তল্পিবাহক। পুঁজিবাদী বলয়ের মোড়ল আমেরিকা, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মোড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
গাদ্দাফির রাজনৈতিক দর্শন মূলত ছিল ‘ইসলামিক রাষ্ট্র এবং বৈপ্লবিক সমাজ ব্যবস্থা।’ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ্ই সর্বশক্তিমান এবং সার্বভৌম। সৃষ্টিকর্তার নির্দিষ্ট জীবন বিধানই সর্বোত্তম দর্শন ইহকাল এবং পরকালের পরিপ্রেক্ষিতে। তার মতে, মানুষের পক্ষে সৃষ্টির জ্ঞান এবং চিন্তাশক্তি কখনই স্রষ্টার সমতুল্য হতে পারে না যুক্তিসঙ্গত ভাবেই। তার মতে, ধনতন্ত্র এবং মার্ক্সসীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই। কারণ, এই দুইটি দর্শনই প্রতিক্রিয়াশীল এবং বস্তুবাদ ভিত্তিক। সমাজতন্ত্রীরা নাস্তিক আর ধনতন্ত্রীরা পথভ্রষ্ট আস্তিক। তাদের সব চিন্তা-চেতনা খুবই সীমিত। ইহজাগতিক জীবনের রিপু ভিত্তিক চাহিদাই তাদের দর্শনের ভিত্তি। আত্মিক বিষয়ে তার এই দৃঢ়বিশ্বাস ছাড়া চেয়ারম্যান মাও-এর রেডবুক এবং গাদ্দাফির গ্রীনবুকের বর্ণিত আর্থ-সামাজিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইন বিভাগ, প্রশাসন, গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতার নীতি ভিত্তিক তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, বিপ্লবী দল এবং কর্মীবাহিনী গঠন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে একটি আধুনিক সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশব্যাপী সমর্থ তরুণ-তরুণীদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের বিষয়ে তেমন কোন বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সাম্যবাদের দর্শনে প্রতিটি নর ও নারীর যোগ্যতা এবং কর্মক্ষমতার বিচারে সমান পরিগণিত করা এবং ধনতান্ত্রিক দর্শনে বিশাল ব্যবধানের ব্যাখ্যা কিছুটা অস্বচ্ছ ভাবেই বর্ণিত হয়েছে গ্রীন বুকে। ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে প্রগতির নামে আর সাম্যবাদের বুলির আড়ালে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে যন্ত্রে। এই ধরনের আদর্শিক কলুষতার সমালোচনা করা হয়েছে প্রচণ্ড ভাবে গ্রীনবুকে।
প্রথম মহাযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সাইকস-পিকোট চুক্তির মাধ্যমে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তারপর নিজেদের স্বার্থে তারা পাল্টে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। সৃষ্টি করে ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য মূলত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো একদিকে সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে, অন্যদিকে কয়েকটি আশ্রিত ছোট ও মাঝারি রাজ্যকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্র কায়েম করে তাদের তল্পিবাহক কিছু বেদুঈন গোত্রকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ মজবুত করে তোলে।
শুধু তাই নয়, সেই সমস্ত দেশগুলোতে ফিকরাবাজি উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখে। এরপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত করার জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করে ইসরাইল নামে একটি ধর্মভিত্তিক ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম করে। পশ্চিমা শক্তির উপর নির্ভরশীল আঞ্চলিক রাষ্ট্রপতিরা এর বিরোধিতা না করে নীরবে ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়। এই বিষফোঁড়া সৃষ্টির একটি মাত্র কারণ ছিল গোপনে ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমাদের স্বার্থের অনুকূলে পদানত করে রাখা। আমেরিকাই ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিল। ফিলিস্তিনি জনগণ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবেই স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। গত শতকে ’৪০, ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে ইসরাইলের সাথে আরবদের তিনটি যুদ্ধ হয়। এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যতদিন ইসরাইল নামক বিষফোঁড়াকে উৎপাটন করা সম্ভব না হবে ততদিন এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে না এবং এই অঞ্চলের বিশাল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পশ্চিমাদের কব্জা থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব হবে না। পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকারী তখন মাত্র ৪ টি দেশ। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। পারমাণবিক প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশকেই দিতে অসম্মতি জানায় ৪ টি দেশই।
গণচীনের নেতা চেয়ারম্যান মাও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি চেয়ে ব্যর্থ হবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং গণচীন ‘কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বেরিয়ে আসার ফলে বিশ্বজোড়া কম্যুনিস্ট আন্দোলনও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
পরে ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়।
এদিকে ’৭০ দশকের গোড়ায় পাকিস্তানের জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, ইরানের রেজা শাহ পেহলভি এবং লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে প্রস্তাব দেন যে প্রয়োজনীয় আর্থিক যোগান পেলে পাকিস্তান সারাবিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে মুসলিম জাহানের স্বার্থে পারমাণবিক প্রযুক্তি হাসিল করে ‘ইসলামিক বম্ব’ বানাতে সক্ষম। তার ঐ প্রস্তাবে তিনজনই আকৃষ্ট হন। তবে গাদ্দাফিই সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণের পরই পাকিস্তান গোপনে আণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক আত্মত্যাগের পর পরিশেষে যখন চিরশত্রু ভারত পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সদম্ভে জানান দেয় যে ভারত একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ তখন জবাবে পাকিস্তানও সমস্ত পৃথিবীকে চমকে দিয়ে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। একই সাথে পাকিস্তান ঘোষণা করে, পাকিস্তান শুধু পারমাণবিক শক্তির অধিকারীই নয়, বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রেরও অধিকারী। জনাব ভুট্টোর জাতীয় রাজনীতির সাফল্য এবং ব্যর্থতার বিষয়টি বিতর্কিত হলেও একটি সত্য মানতেই হবে- সেটা হলো ‘ইসলামিক বম্ব’-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। তবে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসের বিষয় হচ্ছে যে সমস্ত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় তারা পরবর্তীকালে বিভিন্ন কাকতালীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
ভুট্টোকে ঝুলতে হয় ফাঁসিকাষ্ঠে, বাদশাহ ফয়সল নিজের দরবারে তার ভাতুষ্পুত্রের গুলিতে নিহত হন, শাহ পেহলভিকে করুণ ভাবে দেশান্তরিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। সর্বশেষে, লিবিয়ার বিক্ষুব্ধ জনতা নৃশংসভাবে হত্যা করে মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে। বিশ্ব মোড়লরা কখনই এই ধরনের ধৃষ্টতা মাফ করে না পোষ্য পদলেহিদেরও।
বিশ্বের আবিষ্কৃত এবং অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত অনুন্নত দেশগুলোর মাটির নিচে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক মোড়লরা শংকিত হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাকিস্তান নামক দেশটিকে ধ্বংস করার এক সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। এই বাস্তবতার মোকাবেলা পাকিস্তান কি করে করবে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে।
এক সময় সালেম জানিয়ে গেলেন দু’ একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের চার্জ দ্য এফেয়ারস জমির, বাংলাদেশ সরকারের হুকুমে সস্ত্রীক ত্রিপলি থেকে আসছেন আমাদের সাথে দেখা করে খোঁজ-খবর নিতে। জমির এবং তার স্ত্রী আমার ও নিম্মির পূর্বপরিচিত হলেও তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সালেম আরও জানালেন, আমাদের শিফটিং এর পরই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে লিবিয়ার বিপ্লব, গাদ্দাফির নীতি-আদর্শের আলোকে কি করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে Revolutionary Command Council-এর নেতৃত্বে এই সব বিষয়ে মত বিনিময় হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তারা বিস্তারিত জানতে চান। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব উম্মাহর সম্পর্ক বিশেষ করে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ লিবিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে কি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত ভাবে গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়টি আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিপ্লবী ভাইরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন, সেই ব্যাপারেও লিবীয় নেতৃত্বের আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। সালেমের বক্তব্যে যথেষ্ট আন্তরিক উষ্ণতা উপলব্ধি করলাম। গাদ্দাফি ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বেই নয়, সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন, একই সাথে রাজতন্ত্র এবং আমিরাত- তন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিপ্লবী হিসাবে পৃথিবীর প্রতি প্রান্তেই এক আলোচ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার এই বৈপ্লবিক চরিত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের এবং তাদের পদলেহী বাদশাহ, আমীর এবং রাষ্ট্রনায়কদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। জামাল নাসেরের ধ্যান-ধারণার চেয়ে গাদ্দাফির বৈপ্লবিক চেতনা শুধু মুসলিম জগতকেই যে প্রভাবিত করেছিল তাই নয়, তৃতীয় বিশ্বের চলমান জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতার সংগ্রামগুলোও তার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্বার হয়ে উঠতে থাকে। এই কারণেই তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচার মাধ্যম তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে অপপ্রচারণা চালাতে থাকে। বিশ্বমোড়ল এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সুতার টানে পরিচালিত বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর কাছে গাদ্দাফি হয়ে ওঠেন এক বিপদজনক চরমপন্থী সন্ত্রাসী, বিপরীতে বৈষম্যমূলক বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিশ্ব-বিপ্লবের একজন নির্ভীক প্রতীক।
চলবে