জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা শরিফুল হক ডালিম

১২তম পর্ব

নিজেদের আলোচনা

আলোচনার শুরুতেই রশিদ আর ফারুক টিপ্পনি কেটে বললো
তোমাদের জিয়া এমন গাদ্দারি করতে পারে ভেবেছিলে কখনো?
কর্নেল তাহেরের সাথে তোমাদের ঘনিষ্ঠতার ফলাফলও তো সুখকর হলো না।
তাহেরের সাথে আমাদের সম্পর্কের কথা ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’-তে বিস্তারিত লিখেছি।
সেনা পরিষদের সাংগঠনিক তৎপরতা, জিয়ার সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক এবং দেশব্যাপী রাজনৈতিক দল গ্রুপ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে সেনা পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না দুই ভায়রার।
এমনকি তারা ১৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত এটাও জানতো না যে, খোন্দকার মোশতাক আব্বার ছাত্রকালের বন্ধু।
যুদ্ধের শেষ লগ্নে রশিদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে দেশে আসার পর বর্ডার পেরিয়ে এবং ফারুক কুয়েতে ডেপুটেশনে থাকা অবস্থায় চাকুরিস্থল থেকে পালিয়ে এসে নভেম্বর-ডিসেম্বরে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। সেই কারণেই যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের সাথে আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি। তবে তারা দু’জনই ছিল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতার পর তাঁদের প্রস্তাবেই সেনা পরিষদ একটি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৫ই আগস্টের সফল অভ্যুত্থানের জন্যই একত্রে কাজ করতে রাজি হয়েছিলো। সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পর্কে তাদের কন ধারণাই ছিল না।
তাদের সাথে ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের আগে এক মিটিং-এ আমরা পরিষ্কার করে বলেছিলাম,
অভ্যুত্থান সফল হলে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে সেনা প্রধান হবেন জেনারেল জিয়া, নৌ বাহিনী প্রধান থাকবেন ভাইস এডমিরাল এম এইচ খান আর এয়ার চীফ হবেন এয়ার কমোডোর বাশার।
এয়ার চীফের পদে রশিদ দাবি করে এয়ার কমোডোর তোয়াবকে নিয়োগ দিতে হবে। তাদের প্রস্তাবটা চিন্তাভাবনার পর মেনে নেয়া হয়েছিলো।

কর্নেল তাহেরের সাথে আমি, মতি ও নূর কোয়েটা থেকে একসাথে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। এই ব্যাপারে বিস্তারিত আমার আগের বইতে লিখেছি। নিপীড়িত জনগণের হকের জন্য ন্যায়ভিত্তিক সুষম, প্রগতিশীল রাষ্ট্র এবং সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কোনও দ্বীমত ছিল না।
সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা সমুন্নত রেখে আত্মনির্ভর একটি সুখী,সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলবো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সব বাধা পেরিয়ে, এটাই ছিল সেনা পরিষদের প্রত্যয়।
মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-প্রত্যাশার ব্যাপারেও আমাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল রাজনৈতিক দর্শন এবং পথের। কিন্তু এই পার্থক্য আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ফাটল ধরাতে পারেনি শেষ দিন পর্যন্ত। কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল হঠাৎ করেই আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে।’ সেনা পরিষদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই প্রেক্ষিতে কর্নেল তাহের যখন প্রস্তাব রাখেন দেশ ও জাতীয় স্বার্থে তিনি এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ভারতীয় চাণক্যদের হাতে ক্রীড়নক খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে সেনা পরিষদের সাথে যেকোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত, তাঁর সেই অঙ্গিকারের ভিত্তিতেই বঙ্গভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের রূপ-নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছিল।
পরিকল্পনার অংশ হিসাবে কৌশলগত কারণেই সেনা পরিষদের প্রকাশিত শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দেশত্যাগ করে ব্যাংককে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত হয়েছিলো যুগান্তকারী ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার সফল অভ্যুত্থান।
মত ও পথের ভুল আর কিছু হঠকারি পদক্ষেপের মাশুল হিসেবে কর্নেল তাহেরকে যেভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো সেটা একটি বিতর্কিত বিষয়।

অবশই কর্নেল তাহের ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধা, এক সাহসী দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং নিপীড়িত বঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে একজন আপোষহীন সাচ্চা বিপ্লবী।
হেডকোয়ার্টারের কাগুজে বাঘরা এবং ইতিহাস তাঁকে যে ভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেনও, মানুষ হিসাবে আমরা কেউই দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নই। এই সত্যকে মেনে নিয়েই অতিচেনা ক্র্যাচের কর্নেল তাহের, সিরাজ সিকদার, মেজর জলিল, কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। তাদের সবাই হলেন দেশের অমূল্য রতন, নিখাদ জনদরদী দেশপ্রেমিক।

আগেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, রশিদ-ফারুকের সাথে বৈঠকে আমাকেই হতে হবে সেনা পরিষদের মুখ্য ভাষ্যকার। আমাদের আজকের এজেন্ডাতে তিনটি বিষয়-
১। জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের সাথে তার সম্পর্ককে অস্বীকার করার পর বিপ্লবীদের আহ্ববানে সাড়া দিয়ে জিয়ার বিনা অনুমতিতে আমাদের দেশে ফেরা উচিৎ কি উচিৎ নয়।
২। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর সম্পর্কে জিয়ার সাথে আমাদের যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে সেটা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এখনই প্রকাশ করা যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা।
৩। জেনারেল জিয়ার ব্যবস্থাপনায় লিবিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে, না তার ব্যবস্থা নাকচ করে দিয়ে তৃতীয় কনও দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করাটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে?
প্রথম বিষয়ে রশিদ এবং ফারুকের বক্তব্য ছিল, এখনো জিয়া সামরিক বাহিনীতে তার ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়নি। তাই আমরা একত্রে ফিরে গিয়ে অতি সহজেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবো। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তার স্থলে এমন একজনকে যিনি আমাদের নীতি-আদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন তেমন কাউকে চীফ বানালে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে সহজেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তি হিসাবে বলা হয়-
আজকের জিয়া আর ১৫ই আগস্টপূর্ব জিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। বর্তমানে জিয়া শুধু সামরিক বাহিনীর মধ্যেই জনপ্রিয় তাই নয়, তার মেকি চমকপ্রদ জনপ্রিয়তা আজ দেশব্যাপী। কোন শক্তি কোন প্রক্রিয়ায় তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে সে সম্পর্কে দেশবাসীর বেশিরভাগ এবং সামরিক বাহিনীর অনেকেই অবগত নন।
জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি ক্রমান্বয়ে নিজেকে সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবীদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক খেলায় নেমেছেন। এটাও এখনঅব্দি কারো জানা নেই।
এই অবস্থায় ভারতীয় আগ্রাসনের সম্ভাবনা থাকুক বা না থাকুক, এই বাস্তব পরিস্থিতিতে আমরা যদি তার প্রতিপক্ষ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হই তবে সামরিক বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। কারণ, এখনো তারা মনে করছেন জিয়া আমাদেরই একজন। এই ধারণা সত্য হলেও জেনারেল জিয়া আজ নিজেই সেটাকে মিথ্যায় পরিণত করতে চাচ্ছেন। তাদের কথায় ওজন আছে। এখনও আমরা শক্তির দিক দিয়ে জেনারেল জিয়াকে অনায়াসেই পরাস্ত করতে সক্ষম। কিন্তু ভারত যদি ’৭১ এর মত প্রবাসে বাকশালী সরকার বসিয়ে ২৫ বছরের স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় সেই সরকারের ডাকে বাংলাদেশে ঢুকেই পড়ে সেই আগ্রাসনের মোকাবেলা করা কি সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে বিভক্ত সামরিক বাহিনী আর জাতিকে নিয়ে? তারপরও কথা থাকে। যদি সেই প্রক্রিয়ায় দেশ ভারতের করদ কিংবা অঙ্গরাজ্য এবং জনগণ দাসে পরিণত হয় তবে তার সব দায়দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আমরা চিহ্নিত হবো দেশদ্রোহী এবং জাতীয় বেঈমান হিসাবে। খালেদ আর তাহেরের চেয়েও ঘৃণ্য হবো আমরা। এটাই কি আমাদের প্রত্যাশা যে দেশবাসী আমাদের জানুক ক্ষমতালিপ্সু একদল উচ্চাভিলাষী বিকৃত মস্তিষ্কের নরকের কীট হিসাবে? তাছাড়া যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে আমরা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর অন্য কাউকে বিশ্বাস করে জিয়ার স্থলাভিষিক্ত করলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে স্বেচ্ছায় আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী একজন হয়ে এই পর্যন্ত আসার পর জিয়াই যদি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে নতুন করে যাকে জিয়ার স্থলাভিষিক্ত করা হবে সেও ক্ষমতায় আসীন হবার পর সময় সুযোগ পেলে তেমনটি করবে না তার নিশ্চয়তা কি? এর বিকল্প হিসেবে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আমাদের চেয়ে সিনিয়র সব অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠিয়ে লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফির মতো ২৮ বছর বয়স্ক আমাদের মধ্য থেকেই কাউকে চীফের পদে উপবিষ্ট করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে নিজেদের। এমন পদক্ষেপ বর্তমানের বাংলাদেশে নেয়া কি সম্ভব? এমনটি লিবিয়াতে সম্ভব হয়েছিলো পার্শ্ববর্তী দেশ মিসরের শক্তিধর রাষ্ট্রপতি জামাল নাসেরের প্রত্যক্ষ সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতায়।
আমাদের জন্য তেমন একজন জামাল নাসের আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই যেকোনো সশস্ত্র সংঘাত হবে আত্মঘাতী। তারপরও কথা থাকে, জিয়া তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য কোরআন শপথ নিয়েও কেনো আমাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন? জবাবটা পরিষ্কার, তিনি কখনোই মন থেকে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি আমাদের শুধুমাত্র সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য। জিয়াকে জাতীয় পরিসরে জনপ্রিয়তার সাগরে আমরা ভাসালেও তিনি আইয়ুবি স্টাইলের রাজনীতিই করবেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ভারতের সাথে সমঝোতা করেই, আমাদের উপর নির্ভর করে নয়।
এই অবস্থায় আমাদের একটি বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। সেটা হল, ভাগ্যচক্রে বর্তমানে সশস্ত্রভাবে জিয়ার মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, রাজনৈতিকভাবেও ঠিক এই সময় জিয়া আমাদের কিংবা মোশতাককে সহ্য করবেন না ভারতের স্বার্থের অনুকূলেই।
তবে সময়েতে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, সৃষ্টি হয় নতুন সুযোগ। আল্লাহ্র উপর ভরসা রেখে আমাদের সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে ধৈর্যের সাথে।
এর পর দ্বিতীয় বিষয়, আমাদের পক্ষ থেকেই আলোচনা শুরু করা হল।
উপস্থাপনায় বলা হল
বর্তমানে আমদের পক্ষে নিশ্চুপ থেকে দূর থেকেই সব ঘটনা প্রবাহের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে সেনা পরিষদ এবং সামরিক বাহিনীতে আমাদের সমর্থকদের বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করা। আজ অব্দি অর্জিত সুনাম ও সমর্থনকে মসিলিপ্ত করা চলবে না কোনো হঠকারি পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে। আমাদের সম্পর্কে জনগণের কৌতূহল, ভালোবাসা, দোয়া এবং প্রত্যাশা বজায় রাখতে হবে নিজেদের মেধা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে। অসময়ে সব কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটিয়ে ইতিহাস হয়ে যাওয়াটা সমীচীন হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আমাদের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি বা সাক্ষাতকার মিডিয়াকে দেয়া হবে না। এতে কোনো উপকার তো হবেই না, বরং দেশে-বিদেশে আমাদের প্রতি আকর্ষণ কিংবা ঔৎসুক্য যতটুকুই আছে সেটাও খুইয়ে বসবো। অতএব, সর্ব বিবেচনায় বর্তমানে নিজেদের লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়ে চুপচাপ থাকাটাই হবে যুক্তিসঙ্গত। উপস্থিত সবাই এই প্রস্তাবনা সমর্থন করে কিন্তু। রশিদ আর ফারুক রহস্যজনক ভাবে নিশ্চুপ থাকে। এরপর তৃতীয় বিষয়ে আলোচনা
সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে আমিই আবার শুরু করলাম।
এখনঅব্দি আমাদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সরকার এবং ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল সেনাসদর। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি আমাদের নেই। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সমস্ত খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এখন অব্দি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের শিকড় সন্ধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। তাই আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। তা নাহলে যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় ভবিষ্যত চিন্তা করে আমাদের আসল পরিচয় এবং ভিতরের কথা গায়ে পড়ে তাদের জানিয়ে দিলে সেটা হবে মস্ত বোকামি। নিজেদের উলঙ্গ করলে ভবিষ্যতে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা মোতাবেক কোনো কিছুই করা সম্ভব হবে না। তাদের সুতোর টানে পুতুলনাচ নাচতে হবে। সেটা কাম্য হতে পারে না। নিজস্ব বলে ক্ষমতা গ্রহণের পর বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্বের জোরে ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিদেশী কোনো শক্তি নিজ স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেয় না তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আজকের নিও-ঔপনিবেশিকতাবাদের যুগে অনুন্নত দেশগুলোকে যে আর্থিক সাহায্য করা হয়, সেটা দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষে নয়, তাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলার জন্যই। এই কাজটি করার জন্য স্থানীয় তল্পিবাহকদের গরুখোঁজা করে মসনদে বসিয়ে দেয়া হয়। সেইসব স্বার্থপর গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয় অতি অল্পমূল্যে। পুতুল খোঁজার সাথে সাথে তারা সম্ভাব্য প্রতিবাদীদেরও চিহ্নিত করে তাঁদের নির্মূল করে দেয় অঙ্কুরেই। অতএব কোনো বিদেশী শক্তির আশ্রিত হয়ে নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে জিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়ে সময় কাটানোর সাথে সাথে সাধ্যমতো দেশ ও জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা রাখার চেষ্টায় ব্রতী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এই যুক্তিও সবাই মেনে নেয়। কিন্তু নিরব থাকে ভায়রাদ্বয়।
তাদের নীরবতা কিসের লক্ষণ সেটা বোঝা গেলো না। আমাদের প্রথম বিষয়ের সিদ্ধান্তটিও তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়েছিলো কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ থেকে গেলো।
বৈঠকের পর কথামতো আমরা শিশুভাইকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। জেনারেল জিয়ার প্রস্তাবে লিবিয়াতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে যেতে আমরা রাজি। জবাবে শিশুভাই জানালেন, অতিসত্বর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশে সেনা পরিষদের নেতাদেরও জেনারেল জিয়ার প্রস্তাব এবং আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বুঝিয়ে বলায় তারা আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলো।
এরপরই আচমকা দুই ভায়রা ঘটিয়ে বসলো অপ্রত্যাশিত বিভ্রাট!
কাউকে কিছু না বলে দুই ভায়রা বৈঠকের পর অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাংককে আমেরিকান দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে অর্বাচীনের মতো রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বসলো। যুক্তিসঙ্গত কারণেই তাদের সেই আবেদন নাকচ করে দেয় দূতাবাস। খবরটা তারা আমাদের কাছে চেপে গেলেও আমরা সেটা জানতে পারি। যদিও এই ধরনের কীর্তিতে আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম তবুও এ নিয়ে তিক্ততা না বাড়িয়ে আমরা চুপ থাকি।
পরে একই ভাবে লিবিয়াতে অবস্থান কালে কারো সাথে কনও পরামর্শ ছাড়াই লন্ডনের একটি লাইভ টিভি শো-তে দুই ভায়রা রশিদ আর ফারুকের এক সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করেন এক পাকিস্তানী নাগরিক ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস।
সেই সাক্ষাতকারে দু’জনই দম্ভের সাথে বোকার মতো জানান দেয়,
১৫ই আগস্ট সেনা অভ্যুত্থানের মূল নেতা ছিল তারাই। তাদের নেতৃত্বেই পতন ঘটে স্বৈরাচারী মুজিবের বাকশাল সরকারের ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাদের এই ধরনের গোপন তৎপরতার ব্যাপারেও আমরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের সাথে বাকবিতণ্ডা করা থেকে এবারও বিরত রইলাম।

চলবে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *