জিয়া থেকে খালেদা তারপর – বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শরিফুল হক ডালিম

১০ম পর্ব

খন্দকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে এলেন সাদ্রে ইস্পাহানী

পরদিন জনাব মোশতাকের দূত হয়ে ব্যাংকক এলেন জনাব সাদ্রে ইস্পাহানী। দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি তিনি। পুরো এক দিন এক রাত কাটালেন আমাদের সাথে। আব্বা, জনাব মোশতাক এবং সাদ্রে ইস্পাহানী একে অপরের বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেখ মুজিবের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আমাদের জানালেন,
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের জিয়ার অনুরোধ জনাব মোশতাক উপেক্ষা করেছিলেন সাংবিধানিক যুক্তি দেখিয়ে। সেটাই তিনি তার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণেও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু, আসল কারণটা ছিল ভিন্ন। ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের পর জিয়া যখন তোমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে ফোন করে তখন মোশতাক জিয়াকে জোর তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন,
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথা ভাবার আগে তাকে কালবিলম্ব না করে ব্যাংকক থেকে সব অফিসারদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে, তা না হলে ক্যান্টনমেন্টে শৃঙ্খলা আর শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজটি দুরূহ হয়ে পড়বে।
জিয়া উত্তরে বলেছিলেন, চিন্তাভাবনা করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

তার এই জবাবে বিচক্ষণ মোশতাকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি নিশ্চিত হন, জিয়া তোমাদের ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক নন।
এই জবাবের পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তোমাদের অবর্তমানে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করবেন না। এতে তিনি জিয়ার হাতে জিম্মি হয়ে পড়বেন। দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান, অভিজ্ঞ ঝানু রাজনীতিবিদ বুঝে নিয়েছিলেন জিয়া নিজেই সব ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বুঝতে পারেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কৌশলে বিপ্লবীদের শক্তি খর্ব করে তাদের অস্তিত্বহীন করে ফেলার চেষ্টা করবেন জেনারেল জিয়া।
তাই তিনি ঠিক করেছেন রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করার জন্য দল গঠন করবেন। সেই দলে তোমরাও ইচ্ছে করলে তার সাথে যোগ দিতে পারো। তবে তিনি এটাও মনে করছেন, তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকেই সহজে দাঁড়াতে দেবেন না জিয়া। তার মতে, আওয়ামীলীগকে তিনি তার প্রতিপক্ষ না ভেবে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের রাস্তা করে দেবেন স্বয়ং জিয়া। ইতিমধ্যেই এই ধরনের সমঝোতা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন জিয়া ভারতের সাথে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমানে জিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হচ্ছেন মোশতাক এবং সামরিক প্রতিপক্ষ হচ্ছে আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লবের নেতারা।

নিজের অভিমত প্রকাশ করে অবশ্য জনাব ইস্পাহানী জানিয়েছিলেন, যদি জিয়া নিজের দল গঠন করেন তবে জিয়া বিপ্লবীদের সাথে তার কোনও প্রকার পূর্বসম্পর্ক অস্বীকার করবেন। বিদেশী শক্তিগুলো বিশেষ করে ভারতের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার জন্য তাকে প্রচার করতে হবে মুজিবের মৃত্যুর সাথে তার কনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না, বর্তমানেও নেই। পেশাগত যোগ্যতা এবং সেনাবাহিনীতে তার নিজস্ব জনপ্রিয়তার কারণেই ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে সেনাপ্রধান বানানো হয়েছিলো। তিনি একজন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সৈনিক বিপ্লবী নন।
তিনি আন্তরিকভাবে আরও বলেছিলেন,
ভবিষ্যতের কথা বলতে পারবো না, তবে বর্তমানে তোমরা জিয়ার কূটচালে পরাস্ত। এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই তোমাদের ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আমরা নির্বাক হয়ে তার বক্তব্য শুনে নিশ্চুপ বসে ছিলাম। কথা শেষে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
বিজ্ঞজনেরা বলেছেন,
মানুষ চেনা দায়! কালো চশমাধারী অতি চালাক জিয়া সেটাই প্রমাণ করলেন। এর পরিণতি কি হবে সেটা আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো পক্ষেই কিছু বলা সম্ভব না। তবে আরও একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে,
‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *