হিংসা / Jealousy – যেকোন সম্পর্কের জন্য খুবই ক্ষতিকারক উপাদান। দুঃখজনক হলেও সত্য হিংসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । যেকোন সম্পর্কেই হিংসা বিদ্যমান থাকতে পারে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে হিংসা। প্রেমিকপ্রেমিকার মাঝে হিংসা। বাবামায়ের মধ্য হিংসা। ভাইবোনের মধ্য হিংসা। অফিসে সহকর্মীদের মাঝে হিংসা। স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের ভেতর হিংসা। ফেসবুকের বন্ধুদের মাঝে হিংসা।
বিশেষ করে যেসব বাংলাদেশীরা প্রবাসে অবস্থান করছে তাদেরকে হিংসা করে যারা বাংলাদেশে আছেন তারা। অথচ সাড়া বিশ্বের সব মানুষকেই যার যার জীবনে কিছু সাধারণ চ্যলেঞ্জের সন্মুখীন হতে হয় – ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সেই চ্যালেঞ্জগুলো সহজ বা কঠিন হয়না। জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কষ্ট বা আনন্দ সেই বুঝে যে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে – অন্যরা যার যার নিজেদের জীবনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে যেয়ে যদি প্রবাসীদের হিংসা করে তাহলে কারু কষ্টই লাঘব হবার কথা নয়।
মূল সমস্যা হলো জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই বা সংগ্রাম। সবাই শর্টকাট পথ খুঁজে অথবা অন্য কারু ক্ষতি করে টিকে থাকতে চায় অথবা অন্য কারু টিকে থাকার সংগ্রামে বাধাঁ দিয়ে বা ক্ষতিগ্রস্থ করে নিজে টিকে থাকতে চায়। অথচ সমাজ গঠিত হবার মূল কারনই হলো একে অন্যের টিকে থাকার লড়াইয়ে শক্তি যোগানো । সন্মিলিত প্রচেষ্টাতে সবাই মিলে টিকে থাকার জন্যই পরিবার গঠন হয় ।
পরিবার গঠিত হয় মূলত – জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে, সন্তানের জন্ম দিয়ে পরিবার গঠন করে যাতে সবাই মিলে একে অন্যকে রক্ষা করতে পারে – এখন যদি একজন অন্যজনকে কোন কারণে হিংসা করে তাহলে এই টিকে থাকার সংগ্রাম বা লড়াই বা পরিবার গঠনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যেহেতু রক্তের নয় ব্যবসায়িক বা স্বার্থনির্ভর সেজন্য এই সম্পর্কে হিংসার অস্তিত্ব সব সময়ই থাকে এবং তা চেতনে অবচেতনে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে থাকে। স্বামী চায় স্ত্রী তার উপর নির্ভরশীল হোক, অবনত হোক, তার নির্দেশ মেনে চলুক সে নির্দেশ ক্ষতিকারক হোক বা লাভজনক হোক যেহেতু স্বামী মনে করে এই প্রক্রিয়াটি আত্মতৃপ্তি দেয় সেজন্য সে লাভ ক্ষতির কথা না ভেবে এটা ভাবে যে তার আত্মতৃপ্তিই তাকে সফল করবে। অতীতে বেশীরভাগ লেখকেরাই পুরুষ ছিল সেজন্য নানা রকমের উক্তি করে গেছেন এই সম্পর্কে – নারীকে ব্যবহার করা, সংসারে নারীর অবদানকে অবমূল্যায়ন করা, নারীর প্রতিভা, অবদান, কাজ, শ্রম, কথা, মেধা সব কিছুকেই অস্বীকার করে তাকে শুধু একটি পা উঠিয়ে যৌন কর্ম করার গর্ত বা গর্তে বীর্য ভরে সন্তান উৎপাদন করার মেশিন বা রান্নাঘরে রান্না করার যন্ত্র বা কাপড় কাচার মেশিন হিসাবে যদি ব্যবহার করা যায় তাহলে বলা হয়
সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে
সংসার সুখের হয় হিংসা কম এবং বিবেচনা বেশী থাকলে।
বিবেচক মানুষের অভাবের কারনেই সংসার সুখের হয়না।
একজনের সুখের জন্য যদি পরিবারের সকল সদস্য ব্যস্ত থাকে তাহলে সেবা করতে করতে একদিন অন্যসব সদস্যরা ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে যায়।
গরু খেতে পাচ্ছে, দুধ দিচ্ছে, বাছুর প্রসব করছে একদিন মাংস হয়ে টুকরো হয়ে মানুষের পেটে যাচ্ছে, পেট থেকে পায়ুপথ দিয়ে ভূগর্ভে চলে যাচ্ছে।
মেয়ে যখন কিশোরী থাকে তখন অনেক মাবাবা এই মেয়ের বিয়ে দিতে চায় কারণ বাজারে কিশোরী মেয়ের চাহিদা বেশী। পুরুষের উপার্জনক্ষম হতে লাগে ৩০ থেকে ৩৫ বছর। অনেক পুরুষই চায় উপার্জনক্ষম স্ত্রী। একজন কিশোরী বড় জোর ম্যাট্রিক পাশ হতে পারে, উপার্জনক্ষম হতে পারেনা। ফলে ১৯ বছরের বদলে যখন ৩০-৩২ বছরের মেয়ে বিয়ে করতে হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ আশা করে যে যেহেতু সে বয়স্ক তাই তাকে বাইরে কাজ করার সাথে সাথে ঘরের বাবুর্চীর কাজ, বাসন মাজার কাজ, সন্তান উৎপাদন, লালন পালন সব কাজই করতে হবে। স্বামী শুধু ঘরে এসে হুকুম করবে এবং ক্রিকেট খেলা দেখবে
মেয়ে সন্তান হলে বিরক্তবোধ করবে । ছেলে সন্তান হলে গর্বোধ করবে। পান থেকে চুন খসলে স্ত্রীর সমালোচনা করবে। খিচুরিতে হলুদ কম হলে বলবে বাসি ভাত পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভাজার মত চেহারা হয়েছে অথবা এই খাবারের একটি নাম ফলক দরকার কারণ তরকারী চেনা যায়না বা মাংসগুলা কোন প্রানীর তা বুঝা যাচ্ছেনা। প্রতিটি পাতিলে একটি নাম ফলক দরকার। এই পাতিলে কি রান্না হয়েছে বিষয়ক নাম ফলক।
সারাদিন কাজ করার পরে এসব সমালোচনাকে ভালবাসা হিসাবে নিতে পারলেই সংসার সুখের হবে রমনীর গুনে। বিরক্ত হলেই সমস্যা। প্রতিবাদী হলেই – হারামজাদী কথা শুনেনা। এত কুৎসিত চেহারার মেয়ে বিয়ে করছি সেটাই তো তোর ভাগ্য। আমি বিয়া না করলে তো তোর গতি ছিলনা। ব্যাস একজন চুপ অন্যজন বলে যাবে। দুইজনেই যদি বলে তাহলে আগুন জ্বলবে। তারপর একদিন তালাক এসে সে আগুন নিভিয়ে দেবে। তখন আবার একাকীত্ব আবার নতুন সাথী খোঁজার পালা আবার নতুন সমালোচনার মুখোমুখি তখন বাজারে কোন চাহিদা নেই। সেকেন্ডহ্যান্ড প্রোডাক্ট বা ব্যবহৃত পণ্যের বাজারদর নেই বল্লেই চলে। পুরুষের যৌনাঙ্গ কখনো পুরানা বা ব্যবহৃত হয়না। পুরুষের যৌনাঙ্গ যতবার ব্যবহৃত হয় ততবারই সেটা নতুন হয় । নতুন বাজার দর তৈরি হয় সেক্ষেত্রে।
ফিরে আসি হিংসা প্রসঙ্গে। নারীর কর্মক্ষমতা, শিক্ষা, মেধা, তার পুরুষ সংগীকে সঙ্কিত করে। তার পুরুষ সংগীটি হীনমন্যতাই ভোগে এই ভেবে যে তার পরিকল্পিত ছকে, স্বাভাবিক মাঠে হয়তো এই গাভীটিকে চড়ানো যাবেনা। এক ভীতি থেকে সে ডিফেন্স মেকানিজম প্রয়োগ করে সংসার বা সম্পর্কের মাঝে একটি চাপ সৃষ্টি করে রাখে। সমালোচনা তীব্রতর হয় পান থেকে চুন খসলে। বেশিরভাগ নারী পুরুষের সম্পর্কেই ভালবাসার অস্তিত্ব থাকেনা। শুধু মুখেই ভালবাসা ভালবাসা লোকের কানে কানে আকাশবাতাস মুখরিত। ভালবাসা থাকলে বিবেচনা থাকবে আর বিবেচনা থাকলে সমালোচনা করার দরকার হবেনা। আত্মসমালোচনা করা দরকার। আমার কি অধিকার আছে সমালোচনা করার? এই সংসারে আমার যদি ৩৫% অবদান থাকে, এই সম্পর্কের মূল ভিত্তিতে আমার যদি ০% অবদান থাকে , এই সম্পর্কের মূল ভিত্তিই যদি একজনের প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে সমালোচনা করে সংসারের অপর অংশীদারের মন বিষিয়ে দেবার বা বেদনার্ত করার কোন অধিকার আমার নেই।
সংসার যেহেতু একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্টান ঠিক সেকারণেই সমালোচনা করার অধিকার সমানভাবে দুইজন অংশীদারেরই থাকা উচিৎ । যে সমালোচনাতে সম্পর্কের ক্ষতি হয় সে সমালোচনা একজন পুরুষ তখনই করে যখন সেই পুরুষ সেই নারীকে আঘাত দিতে চায়। বা তাকে ছেড়ে দিতে চায়। নিজে থেকে সে চলে যাক বা মুক্তি দিক এই অভিপ্রায়েই আঘাত করা হয়। তার মনের অবচেতনে পুষে রাখা হিংসা থেকে সে এইসব আক্রমণতাত্বক কথা বলে এবং নারীকে আঘাত করে। আঘাত দুইভাবে করা যায়। মানসিকভাবে ও শারিরিকভাবে। অনেক পুরুষ দুইটাই করে থাকে। সমালোচনা এবং হাতের মুঠিকে শক্ত করে নারীর দেহে আঘাত।
একজন নারীকে মানসিক ও শারীরিক আঘাত করেও কি একজন পুরুষের ১০০% আত্নতৃপ্তি ঘটে? ঘটে না। বিবাহের মত বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্ত্রীকে মানসিক ও শারিরিকভাবে আঘাত করার পরে পুরুষটি তাকে চরিত্রহীন আখ্যা দেয়। এবং নিজে বাইরে অবাধে অন্য নারীদের সাথে মেলামেশা করে। অন্য নারীকে সুন্দর সুন্দর কথাভরা চিঠি লেখে বা কবিতা লেখে। সেই একই পুরুষ যে তার ঘরের ভেতর রাখা নারীকে কুৎসিতভাবে সমালোচনা করছে সেই একই পুরুষ বাইরের অন্য একটি মেয়েকে আদোর সোহাগভরা চিঠি লিখছে বা পার্কে বসে তার হাত ধরে গান শোনাচ্ছে। বৈবাহিক বাণিজ্যে নারী পুরুষের মাঝে যদি একজনের জন্য অন্যজনের স্বাভাবিক বিবেক বিবেচনা মানবিকতা না থাকে তাহলে সেই সম্পর্কচ্ছেদ করা উচিৎ না হলে যে নিপীড়িত হচ্ছে যে অংশীদার সেই অংশীদারটি মানসিক ও শারীরিকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে একটি জীবন্ত লাশে পরিনত হচ্ছে।
হিংসা আরো অনেক ক্ষতি করে। প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে। অমুকের অনেক সুখ আমার অনেক দুঃখ। অমুকেরা অনেক আরামে থাকে আমার তেমন আরাম নেই। অমুকে যদি আমার আরামের ব্যবস্থাও করে আমি তখন সর্বপ্রথমে অমুকেরে আঘাত করব যেহেতু প্রতিনিয়ত আমি অমুকেরে হিংসা করি। অমুকে যদি মানসিকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয় তাহলে কি আমার দুঃখ কিছুটা লাঘব হবে? না হলেও মনে মনে তৃপ্তি হবে। হিংসা এভাবেই যেকোন সম্পর্কে অবিরত ক্ষতি করে।
একজন মানুষ সুখে আছে কি দুঃখে আছে সেটা আমি জানবো কিভাবে? মানুষেরা সব মুখোশ পড়ে থাকে। মুখ দেখে বা একজন মানুষের ভৌগলিক অবস্থান থেকে তার সুখ নির্নয় করা সম্ভব নয়। তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে তার প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ দেখিয়ে তাকে আঘাত করে হয়তো আত্মতৃপ্তি পাওয়া সম্ভব । প্রবাসী একজন বাংলাদেশীকে হীংসা করে তাকে মানসিকভাবে আঘাত করে বাংলাদেশের যেকোন অঞ্চলের বৃষ্টি থামানো সম্ভব। ঝড় থামানো সম্ভব। লোডশেডিং, গরম, বেকারত্ব, সবই দূর করা সম্ভব। চেষ্টা করতে তো কোন সমস্যা নেই।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা