আমি গিরগিটি দেখিনি কখনো তবে ছেলেবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি গিরগিটি রং বদল করতে পারে। আমার মা ছিলেন আমার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। মায়ের কাছেই আমি শুনেছি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের কথা, আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্টানে আগুন লাগার কথা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা, গান্ধি-নেহরু-এ কে ফজলূল হক আর ইংরেজের কথা। মায়ের কাছেই শুনেছিলাম খ্রীষ্ট ধর্ম, মুসলিম আর হিন্দু ধর্মের কথা। আমি আমার মাকে প্রচুর জ্বালাতাম। আর আমার মা আমার দেওয়া সব জ্বালা যন্ত্রনা হাসিমুখে সহ্য করতেন। পরবর্তীকালে আমি নিজে মা হবার পরে বুঝেছিলাম উনি কেনো হাসিমুখে আমার সব স্বৈরাচার সহ্য করতেন। মা তার সন্তানকে ভালবাসেন সেজন্য। দেশকে আমরা মা বলি। মায়ের দুগ্ধ পান করে শিশু যেমন বিকশিত হয় ঠিক তেমনি সেই শিশু যে ভুখন্ডে জন্ম নেয় সেই ভুখন্ডের সকল সম্পদ সে ভোগ করে জীবন ধারণ করে আর সেকারনেই সেই মাটির প্রতি সে কৃতজ্ঞ থাকে। সেই মাটিকে রক্ষা করতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে । মা যেমন শিশুকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে তেমনি সেই শিশু যে ভুমিতে ভূমিষ্ট হয় যে ভূমি তাকে ধারন করে সেই ভূমিকে রক্ষা করতে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। জন্মের ঋন পরিশোধ করা সম্ভব নয় সেজন্য মা ও মাটিকে জীবন দিয়ে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হয়। এটা শুধু কথার কথা নয় – করে দেখাবার কথা।

আজ  কানাডাতে ৬ই মে, ২০১৮।
এখন বাংলাদেশে ৭ই মে ভোর। ২০১৩ সালের ৭ই মে’র ভোরে ঠিক এই সময়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার শাপলা চত্বর ও তার আশেপাশের এলাকা ধুয়ে মুছে সাফ করা হয়। ধুয়ে ফেলা হয় মানুষের রক্ত। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া সন্তানদের রক্ত। এতিম, আলেমের রক্ত। ২০১৩ সালে এই সময়ে ওদের সবার লাশগুলো নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল। সেরাতে দীগন্ত টিভি যতক্ষ্ণ টিকে ছিল ততক্ষ্ণ আমি জেগে ছিলাম । দেখলাম অনেক মানুষ আসছে। দেখলাম সাজোয়া পুলিশবাহিনী ঘুরছে। চারিদিকে আগুন জ্বলছে। গুলির শব্দ।  ট্রাকে উঠাচ্ছে ছেলেগুলোকে, দেখলাম পুলিশ ভ্যানের চাকার নীচে পিষ্ট মানুষের লাশ। গুলি এসে লেগে শুয়ে পড়লো একজন। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি এভাবে পাখির মত গুলি করে মানুষ হত্যা করার মত মন ও মানসিকতার খুনীরা বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে কাজ করে। খুনীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষা করার দায়িত্ব। ৫-৬ মে, ২০১৩ আবার দেখলাম ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের ভয়াল রাত।
কোথাও কিছু নেই হঠাৎ করেই মহানবীকে ব্যাঙ্গ করে ব্লগ করা হয়েছিল ।  ইন্টারনেটে পোষ্ট করা এই ব্লগ সম্পর্কে মাদ্রাসার ছেলেদের জানার কথা না। সাড়া বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলো থেকে যারা এতিম আলেমদের ঢাকাতে নিয়া আসে মহানবীর ব্লগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাদের সাথে ব্লগারদের সাথে কোন পার্থক্য নেই। ওরা সবাই সেই ব্যক্তি/দেশ/বা প্রতিষ্টানের বেতনভোগী কর্মচারি যে বা যাহারা এইসব অরাজকতা সৃষ্টি করে সেসময়ে সব চাইতে বেশী লাভবান হয়েছিল।

বুলেট খরচা না হলে বুলেট ফুরাবেনা। বুলেট না ফুরালে নতুন বুলেট কেনা হবেনা আর বুলেট ফুরিয়ে গেলে আরো বুলেট কেনা হবে ফলে আগ্নেয়াস্ত্র যারা তৈরি করে তারা মুনাফা করবে। গুলি করে মানুষ হত্যা করলে পুলিশ বোনাস পাবে। মহানবীকে ব্যাঙ্গ করে যারা ব্লগ তৈরি করেছিল তারা বেশ ভাল পারিশ্রমিক পেয়েছিল । বেশ ক’একজন ব্লগারকেও  হত্যা করা হয়েছিল ঠিক তাদেরই মত যারা মহানবীর অপমানে ব্লগারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এসেছিল।

ব্লগারদের সময় নিয়েএকে একে হত্যা করা হয়েছে আর ব্লগের বিরোধিতাকারীদের সবাইকে একসাথে।

সাড়া দেশের মানূষ চুপচাপ থেকেছে। ফলে এই গণহত্যা থেকে হত্যাকারী নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে যে বাংলাদেশের মানূষেরা ভীত এবং মেরুদ্বন্ডহীন। তরল পদার্থের মত এদের যে পাত্রে রাখা যাবে সেই পাত্রের আঁকার ধারণ করবে। রং বদলে ফেলবে গিরগিটির মত। সুতারাং এই দেশের সব সম্পদই বিদেশে পাচার করা সম্ভব। যারা বাঁধা প্রদান করতে পারতো তাদেরকে অনেক আগেই হত্যা করা হয়েছে। আরো কেউ আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যই এই হত্যাকান্ডের আয়োজন করা হয়। দেশের মানূষের সাহস নেই রখে দাঁড়াবার। সাহস নেই দেশের সম্পদ রক্ষা করার । ফলে বাংলাদেশের যেকোন এলাকাতে পারমানবিক বা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদেশীরা মুনাফা করতে পারবে। মানুষসহ বাংলাদেশের সব সম্পদই অরক্ষিত। বাংলাদেশের যেকোন নদী ভরাট করে মালবাহী ট্রাক যাবার পথ সুপ্রসস্থ করা যেতে পারে। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা!!

২০১৩ সালের মে মাসের ৫-৬ তারিখের গণহত্যার আগে ছিল গণজাগরণ মঞ্চের সময় যখন শাহবাগের মোড়ে সারাদেশ থেকে  মানুষ এসে তথাকথিত রাজাকারদের ধইরা ধইরা ফাঁসীর দাবীতে নাচগান সুরু করে ফলে সাতক্ষীরা থেকে সীতাকুন্ড আর তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ যাকে খুশী  তাকে ধরে “হত্যা স্বাভাবিকিকরণে”র অভিষেক হয় । মানুষ হত্যা স্বাভাবিকিকরণে দেশের সর্বস্তরের পেশাজীবি জনগন, ছাত্র ও শিক্ষক, এমনকি শিশুরাও অংশ নেয়। নীচে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হলো ঃ

 

Quote
বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন
যুদ্ধাপরাধের সর্বো্চ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, “কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে শাহবাগে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল একটি প্রজন্মের স্ফূলিঙ্গের পূর্বাভাসের মত। কিন্তু কী দেখা গেল?

“তিন দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এই গণজাগরণ মঞ্চ কৌশলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেল। তাদের সাংস্কৃতিক জোটকে দাঁড় করিয়ে দিল। বিরানির প্যাকেট সরবরাহ করতে শুরু করল। সেখানে ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন করা হল। এভাবে নতুন প্রজন্মের একটি জাগরণকে ক্ষমতাসীনরা শ্রেণির আবর্তে নিয়ন্ত্রণে নিল।”

Unquote  —- তাই ??? আওয়ামীলীগে নিয়া নিলো মঞ্চ ? মঞ্চ তো আওয়ামীলীগেরই জন্য বানাইছিলো। সেটা কি আপনে বুঝেন নাই ? তাইলে আর এত জ্ঞানগর্ভ আলোচনা কার কোন কাজে লাগবে?

একজন বামপন্থী লেখক যিনি একজন ভাল ছাত্র যিনি সবগুলো আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী এবং যিনি এত গবেষনা করেছেন এবং এত লেখালেখি করেছেন আর যার এত পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। যিনি মার্কসবাসে বিশ্বাসী যিনি বিশ্বের সব বিপ্লব সম্পর্কে অবহিত । যিনি জানেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে হত্যা করা হয়, ভারতে ডিটেইন করা হয়, নির্যাতন করা হয়, শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনী দ্বারা হত্যা করা হয় যিনি জানেন আগরতলা মামলা ছিল একটি দালালী চুক্তি যা বাস্তবায়িত হয় ১৬-১২-১৯৭১ সালে। যিনি নক্সালবাড়ি সম্পর্কে অবহিত যিনি জানেন কমরেড সিরাজ সিকদারকে কে হত্যা করেছিল তিনি শুধু জানেন না “গণজাগরণমঞ্চ” তুমি কার?

মুজিবের পদলেহন করে যারা টিকে আছে – বৃদ্ধ বয়সে তারা মুজিবের প্রতি অভিমানভরা উক্তি করে একটু বিটলামী করেন আর কি। সেজন্য তিনি শুধু জানেন না
জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগই “ভুয়া” ছিল
তিনি অভিমান করে বলেছেন মুজিবে শাসক শ্রেনীর বাবা – আমার আপনের কৃষক মজুর শ্রমিক মেহনতী মানুষের বাবা না –

আমাগের বাবা কেমনে হবে কন?
আমাগের বহুবাবাতে জন্ম দেয় নাই। যাদের বহুবাবাতে জন্ম দিছে তাদের অনেক বাবার এক বাবা শেখ মুজিব
পুঁজিপতিদের সাথে দালালী চুক্তি করে, দেশ বিক্রি কর্‌ দেশের সম্পদ বিদেশের হাতে তুলে দিয়ে দেশের অর্থনীতির কবর রচনা করে, সেই দেশের মেহনতী মানূষের বাবা হিসাবে মুজিবকে দেখতে না পেয়ে জনাব বদরুদ্দীন উমর সাহেব অভিমান করতেই পারেন। সমস্যা নাই। বদরুদ্দীন উমরের মত একজন স্কলারের  এগুলা জানার কথা না। সেজন্য তিনি গণজাগরনমঞ্চকে “একটি প্রজন্মের স্ফুলিঙ্গের পূর্বাভাসের মত” মনে করে ভিমরতিতে ঝুলে থাকেন ।

গণজাগরণমঞ্চ যারা তৈরি করেছিল তারাই এই মঞ্চের নটনটিদের বিরিয়ানীর প্যাকেট সরবরাহ করে এবং ভ্রাম্যমান টয়লেট সরবরাহ করে । সারারাতদিন নেচে গেয়ে ফাঁসি চেয়ে বিরিয়ানি খেয়ে গ্যাঞ্জা টেনে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যদি ওরা উমর সাহেবের বাসাতে যেতো তাহলে বড্ড দেরী হয়ে যেতো। যেমনটি হয়েছিল ১৬-১২-১৯৭১ সালে। স্বাধীনতা বেহাত হয়ে গেছিল । জনাম বদরুদ্দীন উমর সাহেব সম্ভবত তখন সোনাগাছীর সেক্টর কমান্ডার হিসাবে রিলিজ করে ক্লান্ত অবসন্ন ছিলেন, টের পাননি কিছু। গণজাগরণমঞ্চ যদি জামাতের হতো তাইলে জিলাপি দিতো। আওয়ামীলীগের বলে বিরিয়ানি দিছে তাও সেই বিরিয়ানীর খরচা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বহন করেছে। যারা খাবার সরবরাহ করেছে তারাই খাবার নির্গত করার জন্য টয়লেট সরবরাহ করেছে শুধু তাই নয় বামপন্থি লেখক জনাব বদরুদ্দীন উমর সাহেব ভুলে গেছেন – সেই স্ফুলিঙ্গের পুর্বাভাস আসলে সাড়া বাংলাদেশে যেখানে সেখানে যাকে খুশী তাকে ধরে হত্যা করার স্বাভাবিকিকরনের পুর্বাভাষ ছিল। বামপন্থী লেখক জনাব বদরুদ্দীন উমর নিশ্চয় টু শব্দ করেননি ৫-৬ মে, ২০১৩ সালে। উনার মনে হয়েছিল স্ফুলিঙ্গেরা এবারে রং সরবরাহ করেছে

ওরা সব রং মেখে শুয়েছিল । পুলিশকে আসতে দেখে দৌড়ে পালাতে গেছিল পুলিশ তাই ওদের ধরে যার যার বাড়িতে পৌছে দিয়ে এসেছে।

ব্যাস খেল খতম – জাতী কুলুপ এঁটে বসে গেল সেই সাথে বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন উমর গর্বভরে ঝিমুতে ঝিমুতে নিদ্রা গেলেন। দাঁড়ি টুপি লাগিয়ে কোরআন পাঠ করা এতিম লাওয়ারিশ হলো পিপড়ার মত — ওদের কে মশামাছির মত টিপে মেরে ফেলা যায়। এটা কোন বিষয় নয়।

মার্কসবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ডে বসবাসকারী সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা আর সেটা করতে যারা বাঁধা দেবে তাদের সাথে লড়াই করা। সাধারণ মানুষের আবেগ ও ভালবাসাকে আঘাত করার কথা মার্কসের কোন পুস্তকে লেখা নাই। সব ভাল ছাত্রেরাই আমার সাথে একমত হবেন যে যেকোন অপরাধীকেই সাক্ষ্যপ্রমানসহ ন্যায় বিচারের মাধ্যমে এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমানের সুযোগ দেবার পরেই দোষী প্রমানিত হলেই সাজা দেওয়া উচিৎ। জনাব বদরুদ্দীন উমরের সাথে একজন যুদ্ধাপরাধীর কোন পার্থক্য থাকেনা তখন যখন তিনি কোন প্রমান ছাড়াই একজন মানুষকে যুদ্ধাপরাধী বলে অভিহিত করেন।

বাংলাদেশের চারিদিকে গুম খুন আর খন্ডিত ধর্ষিত লাশ আর খুনীরা সব উৎসবমুখর। বাংলাদেশের কোন খুনীর কোন শাস্তি হয়না কারণ খুনীদের হাতে আইনশৃঙ্খলারক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সেজন্য জনাব বদরুদ্দীন উমরও দায়ী।

আয়শা মেহের।
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো। কানাডা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *