প্রতারক রক্তচোষা বাদুড় – ২

একজন মা হিসাবে আমি খুব সহজেই দাবী করতে পারি যে ভ্রূণ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত শিশুর মনের উপরে,তার মা, নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেন। ছেলে বা মেয়ে সব শিশুই মাকে অনুকরণ করে। অনুসরণ হয়তো করেনা।  মা যখন শিশুকে শাসন করেনা তখনই শিশুর সব চাইতে বেশী ক্ষতি করে্ন। শিশু বড় হলে বাবার মত মাকে চোখ রাঙ্গাতে থাকে।  মা শিশুর হুকুম পালন করেন।

শিশুর কথাই মা চলে্ন।

আমার মাকে আমি অনেক ভালবাসি।
আমার মা আমাকে অনেক ভালবাসে।

ভালবাসা আসলে কি?
আমার ছেলে যদি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে আর আমি নিয়মিত টিভি সিরিয়াল দেখি, ঘুরে বেড়াই, গল্প গুজব করি, রোগ শোকে কাটিয়ে দেই অবসর তাহলে আর আমি ছেলেকে কেমন ভালবাসলাম?

আমার ছেলের প্যান্টের পকেতে ইয়াবা পেয়ে আমি চুপচাপ ভাবলাম এটা বোধহয় এক ধরণের বিদেশী লজেন্স। কারণ আমি মানিকগঞ্জের গ্রাম থেকে এসেছি। আমার ভাইয়েরা ইয়াবা বিক্রি করেই জীবন কাটিয়ে দিলো আমি সেই ইয়াবাতে করি বাস, ইয়াবাই দিচ্ছে সুখ,শান্তি, সমৃদ্ধি, আমার ভাইদের কারণেই আমার স্বামী নেশাগ্রস্থ হতে হতে পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যায়। মুন্সিগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর প্রথম সংসার ভেঙ্গে দিয়ে আমার ভাইয়েরা আমার সাথে এই ব্যবসায়ীর বিয়ে দেয়  তারপর বোনের স্বামীর সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে বোনাইকে টক্সিকেটেড করে স্ট্রোক করানো, পঙ্গু করে কষ্ট পাওয়া এবং তিল তিল করে অবহেলা দিয়ে তাকে হত্যা করার মাধ্যমেই আমরা সবাই শান্তি পাই। আমি সব জানি, বসে বসে দেখি, খাবার যখন আসছে টেবিলে আর চিন্তা নেই। এই হলো আমার ভালবাসা।

আমার ছেলে মা বলতে অজ্ঞান। আমার ছেলে কি করে? কিছু করেনা। কিন্ত টাকা আসছে। বাজারে দোকানপাট আছে। বাজারে দোকান করার টাকা কে দিয়েছে? সেটা আমি জানতে চাইনা। যে দিক সেটা যে দিয়েছে তার সমস্যা। আমাদের সমস্যা না। আমাদের খাবার আসছে। আমাদের কাপড় আসছে। তাতেই আমরা খুশী। আমার ছেলে নিয়ে আসছে।  সব কিছুই ভালবাসা থেকে আসছে। আকাশ থেকে ঝরছে। ইয়াবা, আড্ডা, দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, ব্যবসা, গান, কবিতা, সব চলছে শুধু কেউ কিছু করেনা। আমি খুশী । ছেলের কথা মত সব কিছু করি। ছেলে যা বলে তাই বুঝে নিই। অনেক ভালবাসে আমাকে আমার ছেলে। আর আমিও তাকে অনেক ভালবাসি।

আমার ছেলে যখন দূর দেশে বেড়াতে যায়। তখন কে এই বেড়ানোর টাকা যোগালো সেটা জানতে চাইনা তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কোন উড়োজাহাজটিতে আমার ছেলে বসে আছে তা নির্ণয় করি। উড়াল দেবার টাকা কে যোগালো সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এইসব ব্যাপারে কথা বলার অধিকার মাকে কেউ দেয় নাই। একজন মা হিসাবে আমার এই  টুকুই কাজ। ছেলের প্রতি বিশ্বাস রাখা। আমার ছেলে কখনো মিথ্যা বলে না। আমিও বলিনা। আমার ভাইয়েরাও বলেনা।

কেউ কিছু করেনা কিন্তু আমাদের সংসারে কোন অভাব নেই। খাবার আসছে। নতুন সোফা আসছে। নতুন আইফোন, ম্যাকবুক, ইন্টারনেট, সব আছে , মুভি চলছে রাতদিন চব্বিশঘন্টা, আমার ছেলের দামী ক্যামেরা আছে, বড় বড় লোকেদের সাথে উঠাবসা, পত্রিকাতে ছবি প্রকাশ পাচ্ছে, ধানমন্ডি, শ্যামলি, উত্তরা, বারিধারা, সব খান থেকে সেলিব্রিটিরা এসে আমার ছেলের হাতে টাকা গুজে দিচ্ছে। আমি সেই সৌভাগ্যবতী মা। যার ছেলে আর ভাইয়েরা কিছু না করেই কত টাকার মালিক।

আমি বুঝিনা অন্যরা রাতদিন বোকার মত এত পরিশ্রম কেনো করে। এত লেখাপড়া করারই বা কি দরকার। অযথা সময় নষ্ট। আমি আমার বাবা আমার ভাই আমার ছেলেমেয়েরা কেউ কোন দিন স্কুলের চৌকাঠে পা রাখেনি তবুও কি সুন্দর আমার সংসার। কোন কিছুর অভাব নেই।

ঘরে নতুন ফ্লাট স্ক্রিণ টিভি, নেটফ্লেক্স, শাড়ী, চুড়ি, গহনা, ব্যাগ, আংটি, মাদুলী, যা চাইবো আলাদীনের চেরাগ ঘসলেই এসে হাজির হয় দৈত্য তাকে হুকুম করলে শো শো করে উড়ে যায় দূরে বসুন্ধরা সিটিতে বা
যেকোন সপিং মলে তারপর স্যুটকেস থেকে বের করে নিয়ে আসে সপিংমল। আমরা পরিবারের চারজন মানুষ কিছু করিনা । খায়, দায়, ভিডিও গেম খেলি, বোনদের সাথে ফোনে কথা বলি, আমার ছেলেরা চান্দের দেশ বেড়াইতে যায় আমি ঘুমায়।

আমার একটা মেয়ে আছে। বাচাল। অহংকারী। ও ভাবে ওর পায়ের নীচে দুনিয়া। আমার একটা ছেলে আছে প্রতিবন্ধি। বাচাল। আর আমার বড় ছেলে সব চাইতে ভাল। মিথ্যা ছাড়া কিছুই বলেনা। ধোঁকা ছাড়া কিছুই দেয়না। জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত সে একটাও সত্য  কথাও বলেনি। মাঝে মাঝে আমি ভাবি, মিথ্যার মত সুন্দর জিনিষ এই জগতে আর কিছু নেই।

সবাই কত বোকা। আমার ছেলেকে কত সহজে বিশ্বাস করে ধোঁকা খায়। আমরা খুব মজা করি ওদের নিয়ে। বোকার মত আমার ছেলের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দেয় আর সেই টাকা দিয়ে আমরা শুয়ে বসে ভিডিও গেম খেলে খায় দায় আর চান্দের দেশে বেড়াইতে যাই।

আমরা একটি সুন্দর সুখী পরিবার। সবাই সবাইকে খুব ভালবাসি।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.