আমাদের কানাডাতে প্রায় আটমাস শীত থাকে ফলে কমপক্ষে তিন থেকে চারটি কাপড় দিয়ে দেহকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করা হয়। অতিরিক্ত কাপড় দিয়ে দেহ ঢাকার সাথে “স্বাধীনতার” কি সম্পর্ক?
পোষাকের সাথে নারী পুরুষের স্বাধীনতার সম্পর্ক হলো “আমি যে পোষাক পরিধান করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো সেটাই পরিধান করবো আর আমার পছন্দের সেই পোষাক পরিধান করতে পারার অধিকারই আমার স্বাধীনতা ।
আমি স্বাধীন তাই হাতে পায়ে মোজা পড়ি, বোরখাঁ পরিধান করে হাটি
আমি স্বাধীন সেজন্য প্যান্টশার্ট জিন্স পড়ি, বুকের কাছে দুইটা বোতাম খুলে রেখে আমার স্তনের অগ্রভাগ সবাইকে দেখাই। এটা আমার স্বাধীনতা। যার দেখতে ভাল না লাগে সে চোখ বন্ধ করুক । সেটাও তার স্বাধীনতা । যার দেখতে ভাল লাগে সে চেয়ে চেয়ে দেখুক। সেটাও তার স্বাধীনতা ।
বোরখা পরিধান করে আমি চোখ খোলা রাখি যাতে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারি। এটাও আমার স্বাধীনতা । আমি হিজাব পরিধান করে আইস্যাডো, মাসকারা লাগিয়ে চোখে, গাড় রঙ্গের লিপস্টিক দিয়া ফেসবুকে ছবি পোস্ট করি – এটাও আমার স্বাধীনতা। হিজাব পরিধান করে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে পানির উপরে বসে ফেসবুকে ছবি পোস্টাই – এটাও আমার স্বাধীনতা । স্বাধীনতা অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয়।
আমি একজন গৃহবধু। তার অর্থ হলো আমি একজন অংশীদার – আমি আর আমার স্বামী দুইজন এই সংসারের অংশীদার। আমি এবং আমার স্বামী একজন অন্যজনের উপরে বিভিন্নভাবে নির্ভশীল । আমরা কেউই ১০০% স্বাধীন নই। যেকোন বৈবাহিক সম্পর্কই আইনের সম্পর্ক । ধর্ম ও আইন দুইভাবেই এই সম্পর্ক অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। এখানে দুইজন দুইজনের কাছে সব ব্যাপারেই কৈফিয়ত দেবার জন্য দায়বদ্ধ সেজন্য দুইজনের কেউই স্বাধীন নয়।
আমি বিবাহিতা ও চাকুরীজীবি। সংসারে রান্না, বাচ্চাকে দেখাশোনা, আবার চাকুরী করে বাইরে থেকে উপার্জন করে সংসারে সাহায্য করি – সব কিছু করার পরেও আমি যেহেতু বিবাহিতা সেহেতু আমি একজন অংশীদার। স্বাধীন নই। বিবাহ একটি পরাধীনতা । অথবা একে অন্যের উপরে নির্ভরশীলতা । টাকার জন্য, দেহের জন্য, পেটের জন্য, ভালবাসার জন্য, সঙ্গের জন্য, সন্তানের জন্য, এই সব নানা কারণে বিবাহিত নারীপুরুষেরা কেউ স্বাধীন নয়।
আমি একটি অফিসে চাকুরি করি। সেই প্রতিষ্টানের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে চলি। যদি আমি আমার খেয়াল খুশীমত চলি তাহলে আমার চাকুরী থাকবেনা। আমার সাথে আমার অফিসের সম্পর্ক আমি এখানে আমার শ্রম বিক্রি করি বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক পাই তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। ব্যাস আর কোন সম্পর্ক নাই। যেহেতু এই অফিসের মালিক আমি নই সেহেতু আমি এই অফিসে স্বাধীন নই। এখানে আমার ব্যক্তি স্বাধিনতা নাই।
আমি যে পথ দিয়ে হেটে অফিসে বা বাজারে বা পিকনিকে যাই সে পথটিও আমার সম্পত্তি নয়। সে পথটি সাধারণের যাবার জন্য রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সুতারাং এই পথকে নোংরা করার স্বাধীনতা আমার নাই। একজন নাগরিক হিসাবে আমি যেহেতু এই পথ দিয়ে হাটার সুযোগ পেয়েছি সেহেতু এই পথকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমি দায়বদ্ধ।
আমি যখন একটি দোকানে ঢুকি তখন সেই দোকানের সেলফ থেকে আমার পছন্দের চকোলেট নিয়ে আমি খাওয়া সুরু করে দিতে পারিনা। এখানেও আমার কোন স্বাধীনতা নাই। কারণ এই চকোলেট অন্য কারু পূঁজি বিনিয়োগ করে ক্রয় করে সেলফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রি করার জন্য। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি এই চকোলেটের জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ না করছি ততক্ষণ পর্যন্ত এই চকোলেটের প্যাকেজ খোলার অধিকার আমার নেই। যদি তা করি তাহলে আমি হয়ে যাবো স্বেছাচারী। আমি নিয়ম ভাংছি – সমাজের ও আইনের চোখে এই ধরনের নিয়ম ভাঙ্গা অপরাধ হিসাবে গন্য হয়। এটা স্বাভাবিক ও সাধারন জ্ঞান।
সমাজে চলতে গেল, বলতে গেলে, উঠতে গেলে, আমাকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় সেখানেও আমি স্বাধীন নই। আমি আমার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা অন্যের উপরে চাপিয়ে দিতে পারিনা ।
একজন নারী হিসাবে বা পুরুষ হিসাবে আমি যদি একটি সমাজে বসবাস করি তাহলে দেখা যায় আমি বিভিন্ন শৃংখলে আবদ্ধ। আমি স্বাধীন নই।
সেজন্য আসুন আমরা জংগলে যেয়ে বসবাস করি। কিন্তু তার উপায় নাই। কারণ বিল্ডার্সরা জঙ্গল সাফ করে বাড়িঘর বানিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনভাবে সুন্দরবনে যেয়েও বাস করা যাবেনা কারণ সেখানে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সম্ভবত উৎপাদন সুরু হয়ে গেছে বা যাবে তখন কার্বন মনোওক্সাইড আমার শ্বাস নেবার স্বাধীনতা কেড়ে নেবে।
পূর্ব বাংলা নামের বদ্বীপটি কবে স্বাধীন ছিল আমার জানা নেই।
একটি দেশ স্বাধীন হয় তখন যখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়, সেই দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করে, দেশের অধিকাংশ মানুষের কর্ম সংস্থান করে, আপামর জনগনের ভাত, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করে। জনগনের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সরকার গঠন করে। দুর্নীতি, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষন ইত্যাদি আইনের শাসন প্রতিষ্টিত করে রোধ করে বা হ্রাস করে। একজন চা বিক্রেতার কাছে যখন কেউ চান্দা না পেয়ে তার দেহে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েও পুলিশের চাকুরীতে বহাল থাকে তখন সে দেশকে স্বাধীন দেশ বলা যায়না। কারণ চা বিক্রেতা একজন নাগরিক। তাকে অগ্নীদগ্ধ করে মেরে ফেলার অধিকার দেশে অন্য একজন নাগরিকের নেই। যদি থাকে তাহলে সেই সমাজে কেউ স্বাধীন নয়। যে দেশের পথের উপরে খোলা আকাশের নীচে হাজারো মানুষের সামনে নারীকে বিবস্ত্র করা হয় সে দেশের নারীরা স্বাধীন কেমনে হয়? ঘরের আগল ভেঙ্গে যে দেশে নারী ধর্ষন চলে সে দেশের তো নিজের ঘরের ভেতর শান্তিতে ঘুমাবার নিরাপত্তা নাই। পাবলিক বাসের ভেতর সারারাত নারী যাত্রীকে ধর্ষন করে, হত্যা করে ছুঁড়ে ফেলা হয় পথের পাশে সে দেশের কতিপয় নারী স্বাধিনতা খুঁজে হিজাবে, হাত মোজাতে ?
দেশ যেখানে স্বাধীন নয় সেখানে দেশের মানুষেরা কিছু মহিলার হাত মোজা, হিজাব, বোরখা, পা মোজা ইত্যাদি পোষাকের টুকরোতে স্বাধীনতা তালাশ করে মরে।
বিনোদিত হইলাম।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা ।