গতি

লড়াই করতে করতে একদিন চুপচাপ পেছনে ফিরে দেখি – দেখি আমি ছুটছি আর ছুটছি – বুদ্ধি হওয়া অবধি ছুটছি। এক্সপ্রেস ট্রেনের মত দ্রুত গতিতে জীবন কেটে গেল । দ্রুত বড় হয়ে গেলাম। দ্রুত ভালবেসে ফেললাম। দ্রুত মা হয়ে গেলাম। দ্রুত জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে গেলাম। দ্রুত কাজ পেয়ে গেলাম। দ্রুত কাজ ছেড়ে দিলাম। দ্রুত বিশ্বাস করে ফেললাম। দ্রুত প্রতারিত হলাম। সব কিছুই আমি খুব দ্রুত করি। দ্রুত আঘাত পেলাম। দ্রুত প্রতিঘাত করার জন্য ব্যাকুল হলাম। দ্রুতই কষ্ট পেলাম। দ্রুত গতিতে কেটে যাচ্ছে অন্যের প্রয়োজনে জীবন। নিজের জন্য কিছুই করা হয়নি আমার। এই মুহুর্তে দ্রুত গতিতে এই লেখা লিখে  দ্রুত তৈরি হয়ে দ্রুত গতিতে বাসস্টপে যেয়ে একটা ধীরে ধীরে আসা বাস নিয়ে অন্য একটা অফিসে যেয়ে দ্রুত তাদের হিসাব নিকাশ করে দ্রুত ফিরে আসতে হবে ঘরে।

তারপর আগামীকালের সব কাজ খুব দ্রুত সেরে অপেক্ষা করতে হবে ভোরের । দ্রুত উঠে দ্রুত গতিতে আবার অন্য এক কাজ। এভাবেই কেটে গেছে দ্রুততার সাথে সময়গুলো। তখন যখন আমি বাসে দুই ঘন্টা বসে দূর পাল্লার অফিসে কাজে যেতাম সেইসব দিনের মত এখনো আমি দুরের একটা অফিসে কাজ করি। সেখানে যেতে সেই আগের মত দেড় দুই ঘন্টা লেগে যায়। তখন স্মার্ট মোবাইল টেপাটিপি। তখন মনে হয় এই বুঝি আমার নিজেকে নিয়ে নিজের ইচ্ছাগুলো বলার ইচ্ছাগুলো শোনার ইচ্ছাগুলোকে খুলে খুলে দেখার অবসর এসেছে। এই বুঝি আমার হাজার বছরের একাকীত্বের ওপারে কোন মানবের সাড়া পাওয়া গেছে। এই বুঝি কোন পরিচিত প্রিয় গানের সুর শোনা গেল। এই বুঝি আমার দ্রুত জীবনের গতির নীচে পিষ্ট দিবাস্বপ্ন দেখার মুহুর্ত এলো।

আমি কেমন করে অন্যের জীবনের রুপরেখা টানতে পারি?
তাতো পারিনা। অন্য কেউ কখনো বলবে না কেন তারা কিছুক্ষণের জন্য আমার জীবনে এসেছে। কেউ সত্য বলেনা।
সেদিন যখন আমি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেদিন আমি জানিনি এই গতি আমাকে একদিন উধাও করে দেবে আমারই মাঝে। অন্যের দরকারে  অন্যের স্বপ্ন পুরণে আমি দ্রুত গতিতে একটি যন্ত্র হয়ে যাবো আর সেই যন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলেই দ্রুত গতিতে আমি লাশ হয়ে যাবো। তখন আর কোন দ্রুততা সঞ্চারিত হবেনা আমার দেহে, মনে, হাতে, পায়ে বা মগজে।

একজন মানুষ যখন সন্তান লালন পালনের জন্য মা ও বাবা এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করে, তখন তাকে একটি  যন্ত্র হয়ে যেতে হয়। এখানে নিজের বলতে কিছুই থাকেনা।  যখন সে মায়ের ভূমিকা পালন করে তখন সন্তানের জন্য সৃষ্টি করে সুন্দর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ যাতে তার সন্তান সুস্থ থেকে লেখাপড়া শিখে আনন্দে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে  থাকে আর যখন সে বাবার ভূমিকা পালন করে তখন সে নিজেকে শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ক্রমাগত দক্ষ রাখার জন্য সচেষ্ট থাকে, নিজের দক্ষতা, কৌশল , অভিজ্ঞতা, পড়ালেখা সব কিছুই সময়ের সাথে আপডেট  করতে থাকে যাতে সে পিছিয়ে না যায় যাতে শ্রম বাজারে চাহিদা অনুযায়ি সে তার শ্রম বিক্রি করতে পারে  যে উপার্জনে সে তার জীবিকা নির্বাহ করবে, নিজের আর সন্তানদের ভাত, কাপড়, ছাদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কেনার অর্থ যোগাবে।

দ্রুততার সাথে এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে করতে দ্রুততার সাথে সন্তানেরা বড় হয়ে যায় । সেটাই কাম্য ছিল। সেটাই দেখার জন্য একদিন যন্ত্রের মত কেটে গেছে জীবন।  এই দায়িত্ব শেষে আর কোন চাওয়াপাওয়া নেই। সন্তান জন্ম দেবার দায় মায়ের, লালন পালন করার দায়িত্ব মায়ের। ভালবাসার দায়িত্ব মায়ের। এখানে প্রত্যাশা শুধু একটাই আমার সন্তান যাতে থাকে দুধেভাতে। ভালবাসাই ছিল এই দীর্ঘ ও দ্রুত পথযাত্রার শক্তি।

ভালবাসাই দায়িত্ব পালন করার শক্তি যোগায়। ভালবাসাই সকল জটিল সমস্যা সমাধানের উপায় বলে দেয়। তারপর যখন সবার দরকার মিটে যায় তখন শুধু ভালবাসা থেকে যায়। সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়।  তারপর দূর পাল্লার বাসে বসে আমি যুক্ত  হয়ে যাই পেছনে ফেলে আশা আমার শেকড় – বাংলাদেশের সাথে । দুই দেড় ঘন্টা সময় আসা যাওয়া প্রায় তিন ঘন্টা সময়ে হঠাৎ করেই আমি ভেবে বসি – এই বুঝি আমার নিজের জন্য ভাবার সময় এসেছে।

এই বুঝি আমি আবার বোহেমিয়ান হয়ে ঘাসের উপরে হেঁটে যেতে পারবো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এই বুঝি আমি বেড়িয়ে যাবো পেছনে একটা ব্যাগ নিয়ে, থেমে যাবো ক্ষুধা লাগলে, দেখবো চারিদিকে, খাবার না থাকলে ম্লান মুখে আকাশ দেখবো, বৃষ্টি চাইবো মেঘের কাছে, নয়তো কপোলে নেমে আসা অশ্রু পান করে ঢোক গিলে এগিয়ে যাবো  আগামীকালের কাছে।

চলবে

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.