মিথ্যা বলা একটি দুরারোগ্য ব্যাধি।
ক্যানসার ভাল হয়ে যায় কিন্তু মিথ্যুক কখনো সুস্থ হয়না।
অনেক কারণে মানুষ মিথ্যা বলে। হরেক রকমের মিথ্যা বলতে বলতে একসময় আর কোন কিছু সত্য থাকেনা। সব মিথ্যা হয়ে যায়। একটা মিথ্যাকে ঢাকতে যেয়ে দশটা মিথ্যা বলা তারপর শুধু মিথ্যাই বলে যাওয়া । অনেক মিথ্যুক আছে যারা শুধু মিথ্যা বলেই জীবিকানির্বাহ করে, প্রেম, পরিবার চালায়। মিথ্যা বলে মানুষের থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়না। ফেরত চাইলে আরো অনেক মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলে। এক মিথ্যা থেকে অন্য মিথ্যা, এইভাবে হাজারো মিথ্যা আর মিথ্যার কাফেলা চলতেই থাকে। মিথ্যুকের মিথ্যা বলাতে কোন ক্লান্তি নেই শ্রান্তি নেই। যা বলে শুধু মিথ্যাই বলে।
একদিন আমি এক মিথ্যুককে প্রশ্ন করেছিলাম – তুমি মিথ্যা বলো কেনো?
মিথ্যুক উত্তর দিয়েছিলো – মিথ্যা না বল্লে প্রেমিকারা থাকেনা। কেউ বিশ্বাস করেনা। হাই সোসাইটির নিঃসঙ্গ মহিলাদের আদোর, স্নেহ পাবার জন্য মিথ্যা বলা দরকার। সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলেই তো তাদের বিশ্বাস অর্জন করে একদিন সুযোগ বুঝে তাকে শিকার বানিয়ে ফেলা যাবে । সেজন্য প্রেমিকাকে বলে না দশ মাসের বাসা ভাড়া বাকী আছে। বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। প্রেমিকাকে বলে এই তো আমার টিমের সাথে সেদিন ইন্দোনেশিয়া থেকে ঘুরে এলাম। আমার ছেলেরা বিভিন্ন অফিসে আইটিতে চাকুরী করে।
আমার ছেলেরা মানে?
ওরা কি তোমার কর্মচারী?
আমি ওদের চাকুরী দিয়েছি।
তুমি নিজে চাকুরী পাওনা অন্যদের কেম্নে চাকুরী দাও?
না, মানে, হ্যাঁ বলতে পারো, আমার বদলে ওদের পাঠিয়ে দেই ওরাই কাজ করে আসে। আমার তো সময় নাই। ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এদিকে ইনটেরিওর ডিজাইনের কাজ করছি। ঢাকা চট্রগ্রাম আসা যাওয়ার ভেতর আছি। ওরাই রিটার্ণ টিকেট দেয়। এইতো কানাডার ব্যাংকে আমার নামে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করেছে। সেলিব্রিটি তো সেজন্য। আইটির কাজগুলো করি সাথে একটি সাহায্য সংস্থাতেও কাজ করি। দরিদ্র মানুষের সেবা আর কি।
তুমি নিজে হাওলাত করে খাও আর তুমি টিম নিয়া ইন্দোনেশিয়া যাও
মিথ্যার অনেক শাখাপ্রশাখা
মিথ্যুকেরা মিথ্যা বলে কারু ক্ষতি করে ফলে যার ক্ষতি হয় সে কষ্ট ভোগ করে
আর শিকারকে কষ্ট পেতে দেখে মিথ্যুকেরা সেটা বেশ উপভোগ করে। এটাই মিথ্যুকের অন্যতম বিনোদন।
সে একা একা হাসে । প্রতিটি শিকার ধরে । তাকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিয়ে সে নিজেকে খুব চতুর মনে করে। তৃপ্তিসহকারে হাসে। এক স্বপ্ন থেকে অন্য স্বপ্নে ঢোকে নতুন নতুন ফাঁদ পাতে।
সেই ভোগান্তির নামকরন করে সে। মজা করে।
অন্য একটা মিথ্যা বলে। বলে – কিসের টাকা? তুমি বলেছিলে টাকা ফেরত দিতে হবেনা। এখন আবার কেঁদে কেঁদে বলছো টাকা ফেরত দিতে। আমরা দুইজনে কত বেড়াতে যাবো, ফটো এক্সিবিশন করবো, গানের এলবাম বের হবে, কবিতার বই বের হবে, কত দেশ বিদেশে যাবো, বেড়াবো, কি সারাদিন্ন ঋন ঋন করো!! আমার ঋন ফেরত দেবার সামর্থ নেই।
কিন্তু আমি আমার টিম নিয়ে মুভিতে ডূব দেই। সাম্পানে বসে কফি পান করি। সিকিমের মোটেলে গানের জলসা করি। দার্জিলিঙ্গের লাভার্স পয়েন্টে যেয়ে নেশা ভাং করি। কিসের ঋন ? কিসের কি ? এভাবে কথা বললে ঋন পরিশোধ তো দূর আমাকে দিয়ে কোন কাজ হয়না। তখন ফটো এক্সিবিশন করতে ইচ্ছা করে। ফটো এক্সিবিশন মানেই স্পনসরদের থেকে টাকা নিয়ে তা দিয়ে এক্সিবিশনের খরচা বাচিয়েও বেশ টাকা হাতে আসে তা দিয়ে কিছুদিন শুয়ে বসে ফুর্তি মেরে আর একজন শিকার ধরা যায়। প্রতিটি এক্সিবিশনের বিজ্ঞাপন দিয়েই ফেসবুকে বসেই ম্যালা শিকার হাতে এসে যায়। যাদের থেকে মিথ্যা বলে বাকি দিনগুলো চালাবার প্রস্তুতি বেশ জমে উঠে। একজন কসাই যখন পশুর গলাই চাকু চালায় তখন হয়তো কিছুটা ব্যাথা অনুভব করে কিন্তু একজন মিথ্যুক যখন মিথ্যা বলে অন্যের ক্ষতি করে তখন বিন্দুমাত্র খারাপ বোধ করেনা। বরং সে মনে করে মিথ্যা বলেছি, তুমি বিশ্বাস করেছো, দোষ তোমার। একজন মিথ্যুক মিথ্যা দিয়েই তার মিথ্যার সমর্থনে যুক্তি দেখায়।
মিথ্যা বলতে বলতে মিথ্যুক একদিন অনেক মানুষের থেকে অনেক অনেক অনেক টাকা নিয়ে গাড়ী, বাড়ী, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স করে ফেলবে তখনও সে মিথ্যা বলবে। বলবে এইসব টাকা এইসব ব্যবসা সব কিছুই তার দাদা রেখে গেছিল । মরার সময় সবাইকে দিয়ে গেছে।
আজ মিথ্যুক বললো যে তার প্রেমিকা জানে তার বারো মাসে দশ মাসের বাসা ভাড়া বাকী থাকে কিন্তু তার কারণ হলো মিথ্যুক একজন জমিদার সেজন্য বাড়িওয়ালার সাথে দুষ্টুমি করে ভাড়া দেয়না। এটা কোন বিষয় না। তার প্রেমিকা জানে যে মুদি দোকানে বাকীর খাতাটি কোনদিন শূন্য হয়না সেটাও সে দুষ্টুমি করেই বাকী রাখে। তার প্রেমিকা জানে মিথ্যুক একজন সৎ ও চরিত্রবান ছেলে। তবে সবাইকে মিথ্যা বলে। মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই বলেনা। ফলে মিথ্যাই নিয়ম হয়ে গেছে। এটা তেমন কোন গুরুতর সমস্যা না। মিথ্যুকের বাসাতে সবাই মিথ্যা বলে। সবাই শুয়ে বসে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় জীবন। কারু কোন কাজ নেই কিন্তু সংসার চলে যাচ্ছে দিব্যি। মিথ্যার অনেক বরকত।
বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ অনাহারে ও অর্ধাহারে কাটিয়ে দেয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধবগতি, বেকার সমস্যা, যেদেশে শিক্ষিত ছেলেরা কাজ পায়না সেখানে যারা অশিক্ষিত অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নেই তাদের অনেকেই দিব্যি বেঁচে থাকার জন্য মিথ্যাকে পূঁজি করে ভেঙ্গে খাচ্ছে। পরিবারের কেউ কোন কাজ না করে শুধুমাত্র মিথ্যার উপর নির্ভর করে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে, ব্যবসা করছে, টিম নিয়ে ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছে, দার্জিলিং যাচ্ছে, ফটো এক্সিবিশন করছে, ঢাবাতে বসে আড্ডা দিচ্ছে, গ্যাঞ্জা, ইয়াবা, মুভি দেখা চলছে – সব কিছুই মিথ্যা নির্ভর। এখানে কোন শ্রম নেই। এখানে কোন সত্য নেই। যা আছে তা হলো অন্য কারু রক্ত আর ঘাম। তার রক্ত আর ঘাম যে তার মিথ্যা বিশ্বাস করেছে। যে ধোঁকা খেয়েছে।
কেউ কেউ তো মিথ্যা বিশ্বাস করে বলেই মিথ্যা পেশা হতে পেরেছে। কেউ কেউ ধোঁকা খায় বলেই তো তাদের রক্ত আর ঘাম মিথ্যুকের হাসিতে, কাপড়ে, উদরে, ক্যামেরার লেন্সে দোলা খেতে পেরেছে। কারু কারু বিশ্বাস হত্যা করেই তো মিথ্যুক ৩২-৩৫ বছর ধরে বেশ চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যার বেসাতী। হাসছে, গাইছে, কবিতা লিখছে, বিভিন্ন মানূষের সাথে উঠছে বসছে , প্রেম করছে আটসাট, আর পাওনাদারেরা ঘুরে যাচ্ছে, অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে অসুস্থ আখ্যায়িত করে মিথ্যুক হাসছে। মজা নিচ্ছে। সমাজের সবাই জানে সে একজন মিথ্যুক । সবাই তার মিথ্যা শুনেছে, বুঝেছে, দেখেছে মিথ্যা ঝুলছে তার ক্যামেরাতে, ট্রাইপডে, আইফোনে, ম্যাকবুকে, মিথ্যা ঝুলছে তার নখে, ঠোটে, চুলে, চোখে, আর হাসিতে। মিথ্যুক কখনো তার শিকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনা।
সত্যর চোখে মিথ্যা কখনো চোখ রাখতে পারেনা।
মিথ্যুকের চোখে এক পিশাচ বাস করে। রক্তচোষা পিশাচ।
যারা অলস, কর্মবিমুখ, অপদার্থ, জন্ম অপরাধি তারাই মিথ্যাকে জিবিকানির্বাহের জন্য পেশা হিসাবে বেছে নেয়। এবং হেসে খেলে মিথ্যা বলে প্রেম করে বেড়াই আটসাট। প্রেমিকা জানে সে মিথ্যা বলে।
মিথ্যুক তার মায়ের সাথে মিথ্যা বলে। তার ভাইয়ের সাথে মিথ্যা বলে। বোনের সাথে মিথ্যা বলে। প্রেমিকার সাথেই শুধু সব সত্য কথা বলে।
মিথ্যাকে যে জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছে সে অসুস্থ। একজন অপরাধী। তার ভেতর ভালবাসা নেই বলেই সে মিথ্যা বলে অন্যের ক্ষতি করে নিজের পেট ভরে। যার ভেতর ভালবাসা নেই তার কাছে তার প্রেমিকার জন্য কি আছে? কিছু নেই। সমাজ ও সংসারে একজন মিথ্যুক এক ধরণের ভাইরাস। বিষাক্ত ভাইরাস। সে ক্ষতি ছাড়া কিছুই করেনা।
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা।