বিষন্নতা বা Depression

আজকাল সেই আগের মত দিনকাল খুব বিষন্ন যাচ্ছে। হতে পারে দিন ছোট হবার কারণে। টরেন্টোতে শীত এসে গেছে। আজ সকালে তেমন শীত ছিলনা । সেই ভোর সাড়ে পাচটাই বের হয়েছি এখন বাজে ছয়টা আটত্রিশ। দীর্ঘ সময়ে কঠোর পরিশ্রমের মাঝে মাঝে আজ প্রচুর টেক্সট মেসেজ করেছি। কাল ভোর থেকে আজ সারাদিন আমি টেক্সট মেসেজ করেছি।  আগে যখন বিষন্ন হতাম তখন একাকী হেটে হেটে অনেক দূরে চলে যেতাম। এখন সেটা সম্ভব না। কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। ঋনে ডুবে আছি আমি। বিষন্নতার সেটাও একটা কারণ।

একসময়ে আমি অন্যদের অনুপ্রেরণা দিতাম এই বলে যে আমি তোমার পাশে দাঁড়াবো, তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। কলেজের সার্টিফিকেট বাতিল হয়ে গেছে তাতে কি? আবার কলেজে ভর্তি হও। আবার পরীক্ষা দাও। ভাল রেজাল্ট  করে উকিল হও । বারিস্টার হও। স্বপ্ন পূরণ করো। আমি আছি। আমার বাসা বন্ধক রেখে তোমাকে ঋন করে দেবো। কোন সমস্যা নেই। আমি লেগে গেলাম অনুপ্রেরণা দিতে । সত্যি সত্যিই আমি আমার বাসা বন্ধক রেখে ঋন নিয়ে কলেজে ভর্তি হবার জন্য ১৬০০০ ডলার হাসিমুখে অনুপ্রেরণার হাতে তুলে দিলাম। ভাবলাম এই ছেলেটা যদি আমি হতাম তাহলে আমি এমন একজন আমাকে খুঁজতাম যে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। তারপর আমি প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে সেই ঋন পরিশোধ করতে লাগলাম ।  যদি আমার কোন ঋন না থাকতো তাহলে আমি কিছু কিছু টাকা আমার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতাম । কিছুদিন পরে আমি অবসর নেবো। তখন আমি প্রচুর ঋন নিয়ে অবসর  নেবো। ফলে আমি বাড়ী বিক্রি করে দেবো এবং দরিদ্র অবস্থায় অভাবের ভেতর একবেলা খেয়ে কাঁটাবো জীবনের বাকীগুলো দিন।

অথবা আধাপেটা খেয়ে ঋনে ডুবে একদিন মরে যাবো। আমি তখন যেখানে থাকবো সেখানকার জানিটর আমার লাশের পচা গন্ধ পেয়ে সবাইকে খবর দেবে তারপর আমার পচাগলা লাশ বের করবে।  আত্মীয় বলতে আমার তেমন কেউ নেই। যারা আছে তাদের খবর দিলে আমার লাশ দাফন করবে। খুব ইচ্ছা ছিল নিজের দাফনের জন্য অগ্রীম ব্যবস্থা করে রেখে দেবো কিন্তু সেটা সম্ভব হলোনা। হাতে সঞ্চয় নেই। ঋন করে দাফনের ব্যবস্থা করবোনা।

ব্যাপরটা বেশ বিষন্নতাই ভরা। তাতে কি? বাংলাদেশে অনেকেই গুম হয়ে যায়। তাদের প্রেমময়ী স্ত্রী আছে বা প্রেমিকা আছে, মা আছেন, ভাইবোন আছে যারা তাকে ভালবাসে । তবুও গুম হয়ে যায়। কারু প্রেমই তাকে রক্ষা করতে পারেনা। একদিন তার পচাগলা লাশ পাওয়া যায় পথের ধারে বা নদী নালাতে। আমিও তেমন মরে পড়ে থাকবো একাকী। কোন নির্জন ঘরে। এটা বিষন্ন ব্যাপার হলেও স্বাভাবিক ব্যাপার।

আমি তখনো বিষন্ন ছিলাম যখন একাকী হাটতাম। যখন আমার বয়স এগারো ছিল। বারো ছিল। তেরো ছিল। চোদ্দ ছিল। অথচ এই বিষন্নতা আমাকে কখনো আমার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। আমি সন্তানের মা হয়েছি। বিষন্ন মা। বিষন্নতা নিয়েই আমি সন্তানের লালন পালন করেছি । সবাই ভাল আছে। বিষন্নতা নিয়ে আমিও ভাল আছি।

বিষন্নতা মনকে খেয়ে ফ্যালে। আর দায়িত্ববোধ মনকে মেরামত করে। একটু অবসর পেলেই বিষন্নতা মনের ভেতর ছেয়ে যায়। তবু যখন কেউ মিথ্যা করে তার সমস্যার কথা বলে তখন আমি তাকে বিশ্বাস করি। তখন  বিষন্নতা আর থাকেনা, আমি প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সেই সমস্যা পীরিত মানুষকে উদ্ধার করার কাজে লেগে যাই ।  তারপর যখন বুঝতে পারি সে আমার সাথে মিথ্যা বলেছে । সে যা বলেছে তা  আদৌ সত্য ছিলনা। তখন আমি আবার বিষন্ন হয়ে যাই। শত শত লাইন টেক্সট লিখতে থাকি দিনরাত।  শুধু বুঝিনা  এই বিশাল ভূভারতে মিথ্যা বলার জন্য সবাই কেনো আমার মত একজন একাকী বিষন্ন মানুষকে বেছে নেয় ? মিথ্যা বিশ্বাস করার জন্য আমি একজন যোগ্য প্রার্থী। একজন বিষন্ন, একাকী, বন্ধুবিহীন মানুষ। যাকে যেকোন সময় আততায়ী উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে আর মিথ্যা বলে ঋণের দায়ে আকন্ঠ ডুবিয়ে দিতে পারে!

নাকি এটা আমার দোষ? আমি মিথ্যুকদের প্রতি আকৃষ্ট ?  আমি ছুটে যাই এমন কারু কাছে যারা আমাকে মিথ্যা বলে । ধোঁকা দেয়। তারপর ? তারপর আমি অনেক অনেক অনেক কথা বলি, তারপর বিষন্নতা আমার মন খেয়ে ফ্যালে। তবু আমি হারিনা । তবু আমি ছুটে চলি। কোন বিষন্নতা কোন অসুস্থতা কোন মানুষের ধোঁকা, কোন মানুষের মিথ্যাচার আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। আমি ছুটি শুধু ছুটি । কথা বলি, ব্যাথা পাই, বিষন্ন হই তবু ছুটে চলি। রাত দিন পরিশ্রম করি। ফিরে পেতে আমার স্থিতিশীলতা। ফিরে পেতে সেই সময় যখন আমি কোন মিথ্যাচারের মুখোমুখি হইনি। কারু ফাঁদে পা রাখিনি।

আজ পর্যন্ত আমি কোন কিছুর জন্য কারু কাছে হাত পাতিনি। আমার বাড়িটা আমার সম্পত্তি। সেটা না দেখে ব্যাঙ্ক আমাকে ঋন দিতোনা। সুতারাং ঋনটা আমার ঘর। আমি ঋনে ডূবে মরতে চাইনা। সেজন্য অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য পরিশ্রম করি। আমার চাহিদা কম আর সেই যৎসামান্য চাহিদা পূরণ করার জন্য কারু কাছে হাত পাতা লাগেনা। আমি নিজেই তা উপার্জন করতে পারি। এটা আমার গর্ব । এটা আমার অহংকার। আমি জীবনে কোনদিন কারু উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ করিনি। আমার শরীরের রক্ত ঘাম সব কিছুই আমার নিজের উপার্জন। আর সেকারনেই বিষন্নতা আমাকে পরাজিত করতে পারেনা।

এই মুহুর্তে আমি যুদ্ধ করছি তিনটি বিষয়ের সাথেঃ

১- ঋণ
২- অসুস্থতা
৩- বিষন্নতা

কোন সমস্যার সমাধান করতে গেলে প্রথমে সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যা আছে সেটা স্বীকার করতে হবে। তারপর সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।  কিছুদিন আগে আমি যুদ্ধ করছিলাম শুধু অসুস্থতা আর ঋণের সাথে। বিরোধীদল হিসাবে এখন বিষন্নতা এসে যোগ দিয়েছে। ওরা দলে ভারী আর আমি একা।

এখন আমি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা হয়ে এই তিনটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করছি। আমি জানিনা কে জয়ী হবে কে পরাজিত হবে। তবে আমি একজন আজন্ম যোদ্ধা। যুদ্ধ করা ও প্রতিহত করাই আমার কাজ।

যখন আমাকে কেউ অপছন্দ করে তখন আমি জানি কেনো সে আমাকে অপছন্দ করে। আমার প্রতি তার অপছন্দের প্রকাশ করার কারন হলো
– আমাকে দমিয়ে দেওয়া।

আমাকে প্রতিহত করা। কেউ যদি আমাকে অকারণে অপবাদ দেয় তাহলে সে সেই অপবাদ দেয় যাতে আমি দমে যাই। যুদ্ধে হেরে যাই। যারা বলে আমার কারণে তাদের কাজে বিঘ্ন ঘটছে তারা মিথ্যা বলে। তারা তাদের সব কাজ করে যাচ্ছে ঠিক ঠিক শুধু আমাকে মানসিকভাবে পরাভূত করার পাঁয়তারা হিসাবে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলছে “দেখো তোমার কারনেই আমার ক্ষতি হচ্ছে” – আমি যদি এই কথাতে মন খারাপ করি, বিষন্নতার জয় হবে। আমর মনকে খেয়ে ফেলে আমাকে পরাভুত করে দেবে আমার শারীরিক অসুস্থতা ।

বিষন্নতা আর অসুস্থতা মিলেমিশে যদি আমাকে ধরাশায়ী করতে পারে তাহলে আর আমার ক্ষমতা থাকবে না ভোর রাতে উঠে শীতের ভেতর দৌড়ে যেয়ে বাস ধরার আর সারাদিন তিনজন মানুষের কাজ একাকী করার।
তখন ঋন, বিষন্নতা আর অসুস্থতা সবাই বিজয়ের গান গাইবে আমার ভাঙ্গা মনের চারিপাশে। আমার নিথর লাশের চারিপাশে ওরা উল্লাস করবে। আমার মনের শক্তির জন্য যারা আমাকে এতদিন হিংসা করেছে। ভাল আমিকে যারা ধংস করতে চেয়েছে। আমাকে যারা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে ওরা খুশী হবে । ব্যাঙ্গের হাসি হাসবে। উতসব করবে।

সবার জীবনে উৎসব থাকেনা। অনেক বিষন্ন হৃদয় উপরে হাসি রেখে মিথ্যা দিয়ে বিষন্নতা ঢেকে বিষন্নতাকে আজীবন আশ্রয় দিয়ে রাখে মনের ভেতর । এভাবে ধীরে ধীরে বিষন্নতা মনকে খেয়ে ফ্যালে তখন তারা এক মিথ্যা আবরণের উপরে সুখের রং লাগিয়ে সবাইকে ধোঁকা দেয়। আত্মপ্রবঞ্চনা করে।

সবার জীবনেই চ্যালেঞ্জ থাকে।
সবার জীবনেই যুদ্ধ থাকে।
কেউ অংশগ্রহণ করে কেউ করেনা।  কেউ আমার মত যোদ্ধা নিয়োগ করে বিনা পারিশ্রমিকে, নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে গেলে আমাকে ওরা মানসিকভাবে পরাভুত করার চেষ্টা করতে থাকে।
আমি যখন যুদ্ধ করি শুধু নিজের জন্য যুদ্ধ করিনা
আমি তার জন্যও যুদ্ধ করি যে আমাকে পরাভূত করতে চেয়েছে। যে আমাকে ব্যবহার করেছে। যে আমাকে ব্যবহার করে আমার শক্তিকে নিজের শক্তি বলে প্রক্সিতে ধোঁকা দিয়েছে।

রোগ, শোক, বিষন্নতার সাথে যুদ্ধ করছি বহুকাল। এখন ঋন এসে যোগ দিয়েছে ওদের সাথে। লড়াই চলবে আজীবন।  শুধুমাত্র মৃত্যুই এই লড়াইকে স্তব্ধ করতে পারে। মৃত্যু খুব কাছাকাছি এসে গেছে। হতে পারে ওরাই জয়ী হবে এইবারে। একজন প্রকৃত যোদ্ধার কাজ আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *