নাসিমুল গনি খানঃ সাদেক হোসেন খোকা ১৯৫২ সালের ১২ মে তারিখ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ২ নাম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সাহসী গেরিলা অপারেশনে এবং বোমা মেরে পাকিস্তান বাহিনীর বসবাসকৃত বিল্ডিং উড়িয়ে দিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭১ -এর ১৬ ডিসেম্বর তিনি ও তার সহযোদ্ধারা মিলে টেলিভিশন ও রেডিওর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেছিলেন।ছিনিয়ে এনেছিলেন বাংলাদেশের জয়।
স্বাধীনতার পর শহীদ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বিএনপির সৃষ্টির পর জড়িয়ে যান বিএনপির রাজনীতিতে। ‘৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব সংগ্রামী নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে দেওয়া হয়েছিল। সেসময় ঢাকার মানুষ রাজপথে নেমে সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে নয়াবাজার (ঢাকা মহানগর বিএনপি অফিস) থেকে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনের সফলতার ফলে স্বৈরাচার এরশাদের পতন এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে।
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে হেভীওয়েট প্রার্থী শেখ হাসিনাকে ২৭,২৩৯ ভোটের ব্যবধানে ঢাকার বুকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জনগণের নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তার এ মহাবিজয়ে দলের ভাব মূর্তি উজ্জ্বল করেছিলেন । ’৯১ এ বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।
এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র সাদেক হোসেন খোকা নির্বাচিত হন। পরে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি হয়ে ঢাকায় বিএনপির দুর্গ গড়ে তুলে দলকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার নেতৃত্বে প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডে দলের কমিটি গঠন করা হয়। সেই সময় প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বারবার হাসিনার মসনদ কাপিয়ে তোলেন ।। শেখ হাসিনা সরকার পতন করে আবার ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
২০০১ সালেও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল সরাসরি নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে ঢাকার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশেল ইতিহাসে সাদেক হোসেন খোকাই একমাত্র নেতা যিনি আন্দোলনের মাঠে বারবার রক্ত ঝরিয়েছেন । ১৯৯৯ সালের ৮ই নভেম্বর সায়দাবাদ ব্রীজের উপর আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। ০৪ ডিসেম্বর ২০১১; হরতাল চলাকালে ঢাকার কোট কাচারি তে তাকে সরাসরি ছুরিকাঘাত করে গ্রেফতার করে আওয়ামী লীগ সরকার।
রাষ্ট্রদোহ মামলাসহ বর্তমানে তার বিরুদ্ধে অনেক হুলিয়া জারি আছে। বিভিন্ন সময় সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছে নিম্ন আদালত।
দেশনেত্রীর মার্চ ফর ডেমোক্রেসী ঘোষনার পর পরই ২০১৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর তাঁকে আটক করে সরকার। সেই সময়ই তার অসুস্থতা বেড়ে যায় বিধায় ২০১৪ সালের ১৯’শে ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পেয়েই বাংলাদেশের ইতিবাচক রাজনীতির অভিযাত্রা শুরু করে, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। মির্জা আব্বাস, আ স ম হান্নান শাহ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু এই ৩ জনের একজনকে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। দলের প্রতি কতটা অনুগত্য থাকলে একজন নেতা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ! দীর্ঘ সতেরো বছর তিনি ঢাকা মহানগরীর দায়িত্ব সফলতার সঙ্গে পালন করেন। এখনো রাজধানী ঢাকার বিএনপির রাজনীতিতে খোকার বিকল্প নাই।
২০১২ সালে ক্যানসার অপারেশন করার পর তিনি কিছুদিন মোটামুটি সুস্থ ছিলেন। এরপর ২০১৪ এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরে শারীরিক চেকাপ করাতে এসে আবার ক্যানসার ধরা পরে। এরপর ক্যানসারের সুচিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের ২৪শে মে মাসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ট্রিটমেন্টের জন্য গমন করেন। ২০১৭ সালের ১৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে শরীরে অপারেশন করা হয়। সেই সাথে কেমো থ্রেরাপী তো আছেই প্রতি মাসে ।
সাদেক হোসেন খোকার চিকিৎসা নেয়ার অনুপস্থিতির সুযোগ নেয় সরকার। তারা ঢাকার বাঘকে তার বন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা নেয়। ’৯১ সালে শেখ হাসিনাকে হারিয়ে দেয়ার যাতনা ভুলতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ধারাবাহিক ভাবে মামলাগুলো চাঙ্গা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে থাকে। জনগণের সামনে হেয় করার জন্য সকল চেষ্টা চালিয়ে গেছে এ সরকার। কিন্তু এ গ্রেফতার হুলিয়া মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে কি দেশ, মাটি থেকে বিরত রাখতে পারবে? যিনি এ মাটির স্বাধীনতার জন্য বারবার জীবন বাজি রেখেছেন। আজো তিনি দেশে ফিরতে ডাক্তারের ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছেন। খোঁজ নিচ্ছেন কখন তিনি দেশে ফিরতে পারবেন। জেল হুলিয়ার ঠুনকো কারণ সাদেক হোসেন খোকাকে ঢাকাবাসী থেকে কখনো দূরে রাখতে পারবেনা।
সাদেক হোসেন খোকা ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থান করলেও জনগনের এ নেতার মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের আন্দোলনের মাঠে। সাদেক হোসেন খোকা তৃণমূল থেকে উঠে আসা বর্তমানের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার অনুপস্থিতি ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিতে বিরাজ করছে বিশাল শূন্যতা। একই সঙ্গে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে পুরান ঢাকায় বিএনপির রাজনীতিও। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন খোকা ভাইয়ের অভাব অনুভব করছেন পুরান ঢাকার তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীরা।
আমার মনে হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার শত্রুাও বলবে না যে তার কাছে কোন বিষয় নিয়ে গিয়ে খালি হাতে ফেরত এসেছে । এই বীরের ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে কর্মীদের জন্য …… কর্মী ও তার নির্বাচনী এলাকার লোকদের যেকোনো বিবাহ কিংবা যেকোনো অনুষ্ঠান, সবোর্পরি যেকোনো বিপদ-আপদে সব সময় তিনি ভাইয়ের মতো পাশে ছিলেন। আসলে সাদেক হোসেন খোকাকে পুরাতন ঢাকাবাসী সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাশে পেতেন। যখনই ডাক পড়েছে, তখনই তিনি ছুটে গেছেন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে। আওয়ামি লীগের অনেক পুরাতন আসন ঢাকা-৬ কে সম্পুর্ন একক প্রচেষ্টায় বিএনপির দুর্গ তৈরি করে রেখেছেন তিনি । এখনো চিকিৎসার প্রয়োজনে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করলেও নেতা কর্মীদের যেকোন প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধান করে চলছেন ।
সেই বীরযোদ্ধা আজ ক্যানসারকে জয় করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে এখনো টিকে আছেন । ঢাকার রাজপথের একসময়ের অদম্য সাহসী সিংহ পুরুষ খোকা ভাই। ঢাকার রাজনীতির দারুণ প্রভাবশালী এক নেতা। রণাঙ্গনের একজন সাহসী যোদ্ধা।সংস্কৃতিমনা ক্রীড়ানুরাগী আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি মামলা আর সাজা মাথায় নিয়ে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রিয় মাতৃভুমিতে আসার জন্য অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে অপেক্ষায় আছেন কিন্তু এই সরকার তাকে ভয় পায়। তাই তাঁকে দেশের আসার কোন সুযোগই দিতে চায় না। দেশে ফিরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগও দিতে চায় না সরকার ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশ শত শত বীর প্রসবিনী … সেই হিসাবে সাদেক হোসেন খোকা এই দেশের সেরা সন্তানদের একজন … দেশের শ্রেষ্ঠতম ফসল। যার হাত ধরে এই দেশের স্বাধীনতার পতাকা তাকেই মা মাটি ও মানুষের কাছ থেকে বিতারিত করা হচ্ছে । তা না হলে দূর প্রবাসেই সাদেক হোসেন খোকা হয়ত পৃথিবী থেকে বিদায় নিবেন! দেশে ফেরার পর হয়তো সরকারের কিছু অপবিত্র পায়ের ‘বুট’ ও জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য জনগণের টাকায় কেনা বুলেটের শব্দে তাকে ‘জাতীয় সন্মান’ দিয়ে বিদায় জানানো হবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জননেতা সাদেক হোসেন খোকাকে নির্যাতন ও হয়রনি বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কর্মকান্ডের সাক্ষাত প্রমাণ।
জীবনের বাকী সময়টা প্রিয় মাতৃভুমিতে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে খুব শিগ্রই দেশে ফিরে আসছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা । আর এই দিকে বীর এই যোদ্ধার অপেক্ষায় ঢাকাবাসী ।