আর তিন মাস পরে দুই হাজার সতেরো শেষ হয়ে যাবে। প্রতি বছরের মত এ বছরও দৌড়ের উপরে গেল। এ বছরে টরেন্টোতে শীত আসছে দেরী করে। আগস্টের শুরুতে বেশ শীত ছিল তারপর অবাক কান্ড ঘটলো । আবহাওয়া উল্টোদিকে বদলে গরম সুরু হয়ে গেল। শীত আর গরমের মাঝখানে শরীর ঠিক রাখা কঠিন। বিশেষ করে যারা নোংরা ফ্যাক্টরীর পরিবেশে কাজ করে। আমার অফিস ফ্যাক্টরির সাথেই। ফ্যাক্টরিতে রাবারের গুড়ো বাতাসে মিশে আমার অফিসেও আসে। আমি শ্বাস নিই সেই বাতাসে। আমার শ্বাস কষ্টের সাথে এই নতুন কেমিক্যাল রাবারের গুড়ো মিশ্রিত বাতাস আমাকে অসুস্থ করে তুলছে। তবে ইচ্ছা করলেই আমি কাজ ছেড়ে দিতে পারিনা। সেই সামর্থ আমার নেই।
তবে যেকোন সময় আমি কাজ ছেড়ে দিতে পারি। কোন কারণে মন খারাপ হলে আমি কাজ ছেড়ে দেবো। তারপর আবার দৌড়ের উপরে থাকতে হবে। কাজ খোঁজা, কাজ পাওয়া, আবার কাজ ছেড়ে দেওয়া, বেশ রোমান্টিক ব্যাপার। কিছুদিন পর পর পুরুষ বদলের মত। প্রতিটি কর্পোরেশন তার নিজের ব্যবসার সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করে। এমন একটি নীতি যা নাকি সেই কোম্পানীর জন্য মুনাফা বৃদ্ধি করবে, উন্নতি করবে আর উন্নতির সাথে টিকে থাকতে সাহায্য করবে।
জুলাই থেকে জুলাই, টানা এক বছর আমি যে কোম্পানীতে কাজ করছিলাম সেটা একটি সাহায্য সংস্থা। সংস্থাটি ডোনেশনে চলে। নাম মাসকিউলার ডিস্ট্রোফি কানাডা (Muscular Dystrophy Canada) ।
আজ আমি এই সংস্থার কাজ সম্পর্কে লিখবো। এই সংস্থার হিসাব বিভাগে আমি কাজ করেছি এক বছর।
Certain genes are involved in making proteins that protect muscle fibers from damage. Muscular dystrophy occurs when one of these genes is defective. Each form of muscular dystrophy is caused by a genetic mutation particular to that type of the disease. Many of these mutations are inherited.)
মাংসপেশীকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ একটি জিন পুষ্টি সৃষ্টি করে আর সেই জীন যদি ডিফেক্টিভ বা অকেজো বা পুষ্টি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় তাহলে মাংসপেশীকে সুরক্ষা ও সুসংগঠিত করতে পারেনা ফলে মাংসপেশী দুর্বল থাকে আর পঙ্গুত্ব দেখা দেয়। ম্যাসকিউলার ডিস্ট্রফী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
শিশুর জন্ম হয় মা এবং বাবা থেকে ২৩টি করে মোট ৪৬টি ক্রমোজমস নিয়ে
X = 23 Chromosomes ( মা) , XY = 22 + 1 XX = girl
Y= 23 Chromosomes (বাবা), XY= 22 + 1 XY = Boy
XY (মাবাবা) = 46 ক্রমোজমস দিয়ে শিশু তৈরি করে। ছেলে শিশু যদি তার এক কপি এক্স ক্রমোজম ডিফেক্টিভ যা সে তার বাবার থেকে পেয়েছে তাহলে সে সোজা হয়ে বসতে পারেনা বা হাটতে পারেনা। মাংস্পেশি পরিপূর্নভাবে গঠিত না হলে শিরদাঁড়া ভাঙ্গা থাকে ফলে তাকে হুইল চেয়ারে চলাচল করতে হয়। যে শিশু অসম্পুর্ন মাংসপেশি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার মা বা বাবা তাকে অন্য কারু কাছে রেখে কাজে যেতে পারেনা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই ধরনের শিশু জন্মের পরে সংসার ভেঙ্গে যায়। স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। তখন শিশুর দেখাশোনার দায়িত্ব যেয়ে বর্তায় হয় বাবা অথবা মা অথবা পালা ক্রমে মাবাবা দুইজনের উপরে।
যেকোন শিশুর দেখাশোনার জন্য একজন মানুষকে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। আর এই শিশু যদি পংগু হয় তাহলে তার জন্য বিশেষ দেখাশোনার ব্যবস্থা থাকতে হয়। ম্যাসকিউলার ডিসট্রোফি কানাডা সংস্থাটি প্রতিষ্টিত করা হয়েছে সাড়া কানাডা থেকে ডোনেশন সংগ্রহ করে এইসব পরিবারগুলোকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করার জন্য। কানাডাতে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন দাঁত, চোখের চিকিৎসা বিনা মূল্যে হয়না। এছাড়া রয়েছে বিশেষ ধরনের জুতা, যা নাকি প্রতিটি পায়ের জন্য আলাদা আলাদা করে তৈরি করতে হয় সেই পায়ের মাপ অনুসারে আর সেজন্য প্রচুর খরচ হয়। এই সংস্থাটি এই ধরনের রোগীদের সাহায্য করে থাকে। হুইল চেয়ারের জন্য অর্থায়ন করে থাকে।আরো অর্থায়ন দিয়ে থাকে বিশেষ ধরনের কমোড, গোসলের ব্যবস্থা, দোতালা বা তিনতলাতে উঠার জন্য অটোমেটিক ঝুলন্ত সিঁড়ি । ঝুলন্ত সিঁড়ি বেয়ে বাথরুমে ঢোকা বা বিছানায় ঘুমানো বা খাওয়া । হুইল চেয়ার দিয়ে ঘরের ভেতরে উঠার জন্য পথ তৈরি । এছাড়া রয়েছে পাবলিক বাসের ব্যবস্থা যা শুধুমাত্র পঙ্গুদের পরিবহণ করে থাকে।
এই সংস্থাতে আবেদন করার নিয়ম হলো – কারু যদি পঙ্গু শিশু থাকে যারা মাংসপেশিগত অসুস্থতাতে ভুগছে বা এই ধরনের অসুস্থতা নিয়ে জন্মেছে তারা তাদের ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি নেবে। ডাক্তার লিখিতভাবে জানাবে রোগীর কি কি দরকার, যেমন হুইল চেয়ার, অথবা ঝুলন্ত সিঁড়ি, অথবা কমোড অথবা গোসলের ব্যবস্থা অথবা বিল্ডিং মেরামত যাতে সে সহজেই ঘরের ভেতর আসাযাওয়া করতে পারে। অথবা গাড়ী রিমডেলিং যাতে তার হুইল চেয়ার সহজেই গাড়ীর ভেতর যেতে পারে বা গাড়ি থেকে বের হতে পারে।
নীচে কিছু ছবি দিচ্ছি। যা নাকি এই ধরনের রোগীদের জন্য দরকার। ১৯৫৪ সালে ডঃ ডেভিড গ্রীন এবং আর্থার মিনডেন সাথে আরো কিছু রোগীদের অভিভাবক নিয়ে কানাডাতে মাসকিউলার ডিস্ট্রপি কানাডা সংস্থাটি প্রতিষ্টিত করেন।
রোগের ধরনের উপরে রোগীর আয়ু নির্ভর করে। জন্মগ্রহন থেকে সুরু করে বিভিন্ন বয়সে মাংসপেশিতে জড়তা দেখা দিতে পারে। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে জন্ম থেকেই এই রোগ ধরা পরে যেহেতু এই ধরণের অসুস্থতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
এই সংস্থার হিসাব বিভাগে কাজ করে আমি বিভিন্ন রোগির সাথে নিয়মিত কথা বলেছি। বিভিন্ন সাপ্লাইয়ার যারা এইসব রোগীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের পন্য উৎপাদন করে বা মেরামত করে এবং সরবরাহ করে তাদের সাথে কথা বলেছি। তারা এইসব পন্যের খরচ এই সংস্থা থেকেই সরাসরি পেয়ে থাকে। যেমন হুইল চেয়ার সরবরাহ করার পরে এই সংস্থা থেকে পেমেন্ট পেয়ে যায়।
আমরা যারা সম্পুর্ন সুস্থ মানুষ তারা বসে বসে সিগারেট টানি, ইয়াবা নিই, নানা রকমের অসুখ বাধাবার জন্য ব্যাকুল হই। আমাদের কত সমস্যা , কত অভাব, কত অভিযোগ অথচ আমাদের হাত আছে, আমাদের পা আছে, আমাদের মগজ আছে, চোখ, কান, সব ভাল তবু আমাদের অলসতার সীমা নাই , অভিযোগের অন্ত নাই আমরা চাই আকাশ থেকে এসে খাবার, প্রেম, সুখ, সমৃদ্ধি সব ঝপ ঝপ করে পড়ুক আর আমরা খপ খপ করে খাবো।
মাংসপেশি জড়তা নিয়ে কানাডাতে জন্মেছে মোট ৬৪ মিলিয়ন রোগীকে ম্যাসকিউলার ডিস্ট্রোফি কানাডা আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করেছে যাতে যে কদিন ওরা বাঁচে সেকদিন কারু উপরে নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরাই চলেফিরে বেঁচে থাকতে পারে। যেটূকু সম্ভব স্বাধিনভাবে জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
এইসব রোগীদের ভেতর বাঁচার এক অদ্ভত ইচ্ছা দেখেছি। পঙ্গুত্ব নিয়েও কেউ বসে নেই কেউ হতাশ নয় সবার ভেতর আশা আছে, উদ্দীপনা আছে আর আছে অফুরন্ত প্রান উচ্ছাস। জীবন সুন্দর আর সেই জীবনকে উৎযাপন করছে প্রতিদিন।
প্রতিদিন দেখছি বাঁচার আকুতি নিয়ে নাফ নদী বেয়ে আসছে লাখ লাখ মানুষ। বৃদ্ধকে কোলে নিয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে, নারী, পুরুষ, শিশু আসছে আর আসছে। সবাই বাঁচতে চায়। যেভাবেই হোক একটু বাঁচতে চায়। শিশুরা শিশুদের পিঠে করে বয়ে নিয়ে আসছে। যারা বাঁচতে পারছেনা তারা বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে আর যারা বেঁচে আছে তারা নানা রকমের অপকর্মের মাধ্যমে মরে যাবার জন্য বা অসুস্থ হবার জন্য নিজেরা নিজেদের ধবংসের কাজে মহা আনন্দে লেগে আছে। শুধু দরকার চোখ খোলার শুধু দরকার জেগে উঠার শুধু দরকার ভেবে দেখার — হাত পা চোখ মগজ কোন কিছুই আমরা নিজেরা নিজেদের জন্য সৃষ্টি করিনি – সব ফ্রি পেয়েছি আর যেহেতু এইসব কিছু আমরা ফ্রি পেয়েছি তাই এইসব কিছু ধংস করার কোন অধিকার আমাদের নেই । যারা পঙ্গু হয়ে জন্ম নেয় আর যারা পঙ্গু হয়ে জন্ম নেয়না তাদের ভেতর পার্থক্য হলো এই যে পঙ্গু হয়ে জন্মায় তার ভেতরে আশা বেশী থাকে আর যে পঙ্গু নয় তার ভেতর হতাশা থাকে । যে পংগু সে সামান্য প্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞ আর যে পঙ্গু নয় তার হাতে আকাশ এনে দিলেও সে হতাশ থেকেই যায়। পঙ্গুর আশার শেষ নাই। একজন সম্পুর্ন মানুষের হতাশার অন্ত নাই।
https://www.youtube.com/watch?v=xQWfXKL1qBI
আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা