অবহেলা

অবহেলা কি কেউ লিখে বুঝাতে পারে? পারেনা ।
অথচ অবহেলা অনেক ক্ষতি করে। যেকোন রকমের অবহেলাই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীরের প্রতি অবহেলা করলে শরীর খারাপ হয়। সম্পর্কের প্রতি অবহেলা করলে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট হয়। অবহেলা না করাটা খুব গুরুত্বপূর্ন অথচ আমরা অবহেলা করতেই বেশী পছন্দ করি।

কোন বস্তু বা ব্যক্তির দরকার যখন ফুরিয়ে যায় তখন আমরা সেটাকে বা তাকে অবহেলা করি। না ভেবেই যে এই বস্তুটি বা ব্যক্তিটিকে যত্ন করলে হয়তো আমাকেও অন্য কেউ যত্ন করবে। বস্তু অবিনাশী । রুপ বদল করে। ঠিক তেমনি অবহেলা করলে বস্তু বা ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্য একটি উপযোগীতা সৃষ্টি হতে পারেনা। আমরা বলি
recycle
remodel
reuse

একটি শহরে প্রবেশ করলেই বুঝা যায় সেই শহরটি অবহেলিত কিনা। শহরের মানুষেরা সড়কের চারিপাশে কাগজ, গার্বেজ, নোংরা ছড়িয়ে রাখে।  দেখলে বোঝা যায় এই শহরের মানুষেরা তাদের সড়কের প্রতি অবহেলা করে। যত্ন করেনা। অথচ সেই শহরের মানুষগুলোই সেই সড়ক দিয়ে হাটে, সেই সড়ক ব্যবহার করে। যেহেতু এই সড়কের উপরে ওরা ঘুমায় না সেজন্য হাতের কাগজটা ঘুচিমুচি করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করেনা। এভাবে অনেক মানুষের অবহেলা জমা হয় পথে পথে আর অবহেলিত সড়ক একাকী কাঁদে। সেই মানুষগুলো যারা পথে পথে নোংরা ফ্যালে তারা তাদের বাসাতে কিন্তু নোংরা ফ্যালেনা। নিজেদের ঘরটা পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে। কেনো ? কারণ সেখানে নিজেরা বাস করে। সেখানে নিজেরা ঘুমায়। সড়কে নোংরা ফ্যালে ভাবে এই নোঙরা ফেলার দায়িত্ব আমার কিন্তু পরিস্কারের দায়িত্ব আমার নয়।

তারপর সেইসব নোংরা মাটির তলার ড্রেনে জমে যায় আর বৃষ্টি হলে পানি আটকে যেয়ে পথে পথে বন্যার সৃষ্টি হয়। প্রকৃতির প্রতি অবিচার করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। আর সেই প্রতিশোধের কস্ট ভোগ করে তারা যারা নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে অক্ষম। অবহেলা হয়তো লিখে প্রকাশ করা যায়না তবে চোখে পড়া যায়। মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠে।

কাকে আমরা সব চাইতে বেশী অবহেলা করি? যে আমাদের সব চাইতে বেশী ভালবাসে। কেনো ? কারণ ভালবাসাকে আমরা দুর্বলতা মনে করি। ভালবাসাকে আমরা উপায়হীনতা মনে করি। আমাকে ভাল না বেসে তার আর কোন উপায় নাই সেজন্য ভালবাসে।

আমি যদি কারুকে ভালবাসি আর ভালবেসে তার বন্ধু হতে চাই তাহলে সে মনে করে আমার এই ভালবাসার পেছনে স্বার্থ আছে। সে মনে করে আমি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি সেজন্য একটি লাঠি খুঁজছি। তখন সে আমাকে লাঠি হবার আশ্বাস দেয় এবং  আমাকে একটি বস্তুর মত ব্যবহার করে। কোন এক বন্দরে বসে থাকে সে একটি  স্যুটকেসের মত আমাকে পাশে রেখে । সে খেয়াল করেনা স্যুটকেসের চোখ আছে, মন আছে, মগজ আছে, এক বৃদ্ধ স্যুটকেস যা ফেলে দিয়ে যেকোন সময় নতুন স্যুটকেস কেনা যায়। ফেলে দেবার সময় হয়ে গেছে তাই সে আর খেয়াল করেনা। সে দ্রুত টাইপ করতে থাকে তার ট্যাবে। কাকে যেন অনেক কথা লেখার ছিল। তখন না লিখলে হয়তো আর কোন দিন লেখা হবেনা। কার সময় যেন অনেক মূল্যবান । সেই মূল্যবান দেওয়ালকে অবহেলা করা যাবেনা।

সেই মূল্যবান ব্যক্তির জন্য অনেক অনেক অনেক লেখাতে ভরে যাছে ট্যাব। । স্যুটকেস অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। স্যুটকেস প্রশ্ন করলে সে এক বা দুই লাইনে জবাব দেয়। সময় নেই। স্যুটকেসের সাথে কে কথা বলে?? স্যুটকেস তো বোঝা বহন করার জন্য, কথা বলার জন্য নয়। স্যুটকেস ব্যবহৃত হয় ভার বহন করার জন্য।  যাতনা বহন করার জন্য ।  অবহেলা সহ্য করার জন্য। বন্দরের বেল্টে ছুঁড়ে মারা হয় স্যুটকেস তখন বেল্ট ঘোরে বন বন করে আর স্যুটকেস ঘুরতে থাকে। সবাইকে বলে – আমাকে উঠিয়ে নাও। আমাকে একটু ধরে রাখো সমতল ভূমিতে।  আমি কখনো কারু উপরে নির্ভরশীল হতে চাইনা  বা কোন লাঠি খুজছিনা । আমি যখন কবরে যাবো তখন হেটে হেটে কবরে যেয়ে শুয়ে পড়বো – সেটাই আমি কামনা করি। যারা ভালবাসে তারা নিঃশর্তভাবেই ভালবাসে তবে যারা ভালবাসে যেহেতু তাদের হৃদয় আছে তাই ভালবাসতে পারে আর হৃদয় আছে বলেই অবহেলা বুঝতে পারে।

অবহেলার একাল আর অবহেলার সেকাল। সেকালে অবহেলা করা হতো অন্য এক কারণে । তা হলো আত্মনির্ভরশীলতা । অনেকই আত্মনির্ভশীল নারী পছন্দ করেনা। অনেকেই মনে করে একজন নারীর আত্মনির্ভরশীলতা অর্থ হলো পুরুষকে  অবমাননা করা। একজন পুরুষ যখন বড় হয় সংসারের দায়িত্ব নেয় তখন সে মনে করে সে তার মায়ের চাইতে বেশী বুঝে। মা যত  শিক্ষিত হোক বা গ্রাম থেকে আসা পঞ্চম শ্রেনী পাস হোক। পুরুষেরা মনে করে তার মা কিছু জানেনা। ভুলে যায় যে তার মা তাকে জন্ম দিয়েছে, লালন পালন করেছে তার এই জন্ম দেওয়া ও লালন পালন করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এমন জ্ঞান অর্জন করেছে  যে জ্ঞান পুরুষেরা কখনও অর্জন করবেনা। যেহেতু পুরুষেরা সন্তান ধারণ করতে অক্ষম।

সম্পর্কে অবহেলা করলে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবহেলা করার পরেও অনেক সংসার টিকে থাকে। কারণ হলো যে সংসারে যাকে অবহেলা করা হচ্ছে আর যে অবহেলা করছে অবহেলিত তার উপরে আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে নির্ভরশীল। সুতারাং যত অবহেলাই করুক সে কোথাও চলে যেতে পারেনা। যখন একজন বেশী বয়সি কুৎসিত চেহারার পুরুষ কম বয়সি সুন্দর চেহারার মেয়ে বিয়ে করে তখন সে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে এই বউ হারাবার। ফলে সে তাকে মাথায় তুলে রাখে।  এই পন্যের বাজার দর ভাল । যেকেউ কিনে নিতে পারে তাই এই পন্যকে ধরে রাখার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা, মেরামত ও ব্যবস্থাপনা সঠিক সময়ে করা হয়ে থাকে।

একবার কানাডার এক পত্রিকাতে দেখেছিলাম একটা কুকুরের ছবি। কুকুরের উপরে কুকুরের মনিব এত অত্যাচার করেছে যে তার চোখের নীচে লোম ছিলে গেছে, তার ল্যাজে লোম নেই, তার শরীরে সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তবু কিন্তু কুকুর সেই অত্যাচারী মনিবকে ছেড়ে যায়নি। কুকুরের কি যাবার কোন জাগা নেই? হয়তো নেই। আমাদের মায়েরা অনেকেই লেখাপড়া জানেন না, অনেকে গৃহবধু, স্বামী ভাল না বাসলেও যেহেতু সামাজিক, আর্থিক, মানসিকভাবে  নির্ভর করার মত তার কেউ নেই বা তার আর কোথাও যাবার কোন উপায় নেই সেজন্য সে ভালবাসাহীন সংসারে একটি নির্জীব স্যুটকেসের মত পড়ে থাকে। লাথি ঝেটা খায় চুপচাপ। সে কি অবহেলা বুঝেনা? বুঝে। অবহেলা বুঝেও সে যারা অবহেলা করে তাদেরকে ভালবাসে নির্জীব স্যুটকেসের মত ভার বহন করে।  সেই সংসারে সে থেকেই যায়। তারপর সে বুড়িয়ে যায়। পঞ্চাশ বছর বয়সে তাকে আশি বছরের মত দেখতে লাগে। সে নিজের যত্ন নেয়না। যত্ন নেবার ইচ্ছা হয়না। অবহেলাগুলো জমে জমে বুকের ভেতর এক বিসুভিয়াস হয়ে থাকে। সেই বুক থেকে সুপ্ত লাভা মাঝে মাঝে উদ্গিরিত হয়।

সবার হৃদয় থাকেনা।
তাই তারা অবহেলা করে। যতক্ষণ স্বার্থ থাকে ততক্ষণ গুরুত্ব দেয়। যখন স্বার্থ উদ্ধার হয়ে যায় তখন সুরু হয় অবহেলা। যে মায়ের অনেক টাকা আছে সেই মায়ের সন্তানেরা সেই মাকে খুব আদোর করে আর যে মা সন্তানের উপরে নির্ভরশীল সেই মা হয়ে যায় একটি নির্জীব স্যুটকেস।

দুই বন্ধুর মধ্য একজন বন্ধু যদি অন্য বন্ধুকে ভালবাসে আর বিনিময়ে বন্ধুর কাছ থেকে অবহেলা পায় তখন  বন্ধুত্ব  এক তরফা হয়ে যায়। আমার বন্ধুর আরো অনেক বন্ধু আছে। সেইসব বন্ধুদের সাথে তার স্বার্থের লেনদেন আছে।  সেজন্য সেইসব  বন্ধুরা অনেক গুরুত্বপূর্ন সুতারাং আমার বন্ধুটি ভুল করেও তাদের অবহেলা করবেনা। আমাকে সে অবহেলা করবে এই ভেবে যে আমার চলে যাবার কোন জাগা নেই। আমি বৃদ্ধ । লাঠি খুঁজছি। অবলম্বন খুঁজছি। সুতারাং আমার প্রতি গুরুত্ব না দিলেও আমি থেকেই যাবো। আমার তো যাবার জাগা নেই।

অর্থনীতির চাহিদা ও যোগান তত্বের মত বন্ধুর যোগান যদি বেশী হয় তাহলে বন্ধুত্বের চাহিদা কমে যায়। সেজন্য ফেসবুকে পাচ হাজারের বেশী বন্ধু করা যায়না। অন্যদিকে যারা নানা রকমের ব্যবসা করে তারা বেশী বন্ধু চায় ফলে নামে বেনামে অনেকগুলা একাউন্ট করে।

যোগান ও চাহিদার ভেতর ভারসাম্য রাখার জন্য যোগানে কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করা হয়। একই পন্য ভিন্ন মোড়কে মূল্য বৃদ্ধি করে বিক্রি করা হয়। তখন সবাই সেই পন্য কিনতে সুরু করে দেয়। সেই পন্যের যেহেতু মূল্য বেশী তাই সবাই কিনতে পারেনা ফলে বাজারে সেই পন্যের চাহিদা বেশী থাকে। যোগান নিয়ন্ত্রন করা হয়।

যে বন্ধুটি অবহেলিত সে যদি বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখে তাহলে সে অবহেলিত থেকেই  যাবে। তার বন্ধুত্বের কোন চাহিদা নাই।  যেসব বন্ধুরা লাঠি না খুঁজে লাথি মেরে দেয় তারা এটা করে যোগানে কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে বন্ধুত্বে গুরুত্ব  বৃদ্ধি করার জন্য। তখন দেখা যায় এই বন্ধুকে পাইবার জন্য রোদ, বৃষ্টি, বন্যা, ঘাম, ধুলাবালি, ক্রসফায়ার উপেক্ষা করে অন্য বন্ধুটি ছুটছে তাকে পেতে কারণ না ছুটলে বাজারে অন্য কেউ এই বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ট হয়ে যাবে এবং অন্য বন্ধুটি ঠিক একইভাবে অবহেলিত হবে যেভাবে সে অন্যকে অবহেলা করে।

যেসব দেশে আইন নেই সেসব দেশে প্রতারক, মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ, দুর্নীতিবাজে ভরে যায়। আর যারা এগুলা করে তারাই সব চাইতে ভাল থাকে। সমাজের উচ্চ স্থানে থাকে। আর ওদের বন্ধু হবার জন্য সবাই ছুটে। বন্ধুত্বে মানবতা বা ভালবাসা খুজলে ভুল হবে। স্বার্থ খুজতে হবে। দুই বন্ধুর যদি দুই বন্ধুর কাছে সমান সমান স্বার্থ না থাকে তাহলে বন্ধুত্ব অবহেলিত হবে।

নারী পুরুষ কখনো বন্ধু হতে পারেনা।
যোয়ান বৃদ্ধ কখনো বন্ধু হতে পারেনা
খাদ্য ও খাদক কখনো বন্ধু হতে পারেনা
প্রভু ও ভৃত্য কখনো বন্ধু হতে পারেনা
যেখানে বিন্দুমাত্র শোষন আছে সেখানে শোষক ও শোষিত কখনো বন্ধু হতে পারেনা।

যদি ভালবাসা না থাকে , শুধু যদি স্বার্থের জন্য সবাই ঘুম থেকে উঠে ছুটে, শুধু যদি জৈবিক আর পেটের ক্ষুধার জন্য মানুষ মানুষের সাথে সম্পর্ক করে তাহলে বন্ধু শব্দটির বিলুপ্তি ঘটে। যা আমরা প্রায় সংসারে দেখি – স্বামী স্ত্রী অনেকটা প্রভু-ভৃত্যের মত অথচ বন্ধু হবার কথা ছিল। সুখে দুখে রোগে শোকে আনন্দে সমান ভাগীদার হবার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়না। একজন সব সময়ই চায় অন্যজন তার নির্দেশ পালন করুক অফিসের কর্মচারীর মত।

বন্ধুত্ব শব্দটি মানুষ শব্দের মতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বন্ধুত্ব শব্দটি ভালবাসা শব্দের মত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এখন আছে শুধু লেনদেন । বেচাকেনা। ক্ষুধা মিটানো আর ঘুমিয়ে পড়া। কৃত্রিম হাসি হাসা আর আবেগ প্রতারণা ভিত্তিক কবিতা লেখা। যেকোন সম্পর্কই ব্যবসা। দুনিয়াটা একটি সুপারস্টোর । মাংসের দোকান। সুযোগ পেলেই কুরবানীর গরুর মতো শুইয়ে দিয়ে গলাতে চালিয়ে দেবে ধারালো চাকু । তারপর সুনিপুনভাবে চামড়া ছিলে মশলা মাখিয়ে আগুনে পুড়িয়ে বা তরকারী রান্না করে খাবে।

তার দেহের অদরকারী রক্ত গড়িয়ে পথের চারিপাশে ছড়ানো থাকবে অবহেলিত । সেখানে মাছি ভন ভন করবে।

আয়শা মেহের
সম্পাদিকা
প্রবাসনিউজ২৪
টরেন্টো, কানাডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.