তুফানরা দুর্বৃত্ত হয়ে জন্মান না, কোনো মায়ের সন্তানই এমন হয় না। প্রশ্নটা এখানেই, তুফান সরকারদের জন্ম ও বৃদ্ধি কোথায় হয়? তাঁদের মতো লোকদের নেতা বানায় যে রাজনীতি, মা ও মেয়ের নির্যাতনে কি তাদের হাত নেই, দায় নেই? পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে এমন দৃশ্যের জন্ম হয়, যখন মা ও মেয়েকে একসঙ্গে নির্যাতিত হতে হয়? কোনো গল্পকারও কি এতটা কল্পনা করতে পারেন?
যে ‘মহানায়ক’ হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের মতো ছয়টি ফৌজদারি মামলার আসামি, সেই ব্যক্তি কীভাবে শ্রমিক লীগের নেতার পদধারী হন? অল্প বয়সে এতই বড় শেঠ তিনি হয়েছেন যে তাঁর ব্যবসার দরজা উদ্বোধন করতে আসেন বগুড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি! যে পুলিশ ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় তাঁর মধ্যে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ আবিষ্কার করছে, আগের ঘটনাগুলোর সময় তাঁরা কোন যুগে বাস করছিলেন? তুফান সরকারদের উত্থানের প্রতিটি সিঁড়িতে রক্ত, পাপ ও বর্বরতার দাগ। যে ধর্ষণের ঘটনা তোলপাড় তুলেছে, তা পাপের সমুদ্রে ডুবোপাহাড়ের চূড়ামাত্র। তলায় আরও অনেক ‘বর্বরতা’ আছে। আছে তার সেসবের হরেক অংশীদার। তাদের পরিচয় আবিষ্কারের সাহস কি পুলিশ বা সরকারের হবে? যে রাজনীতির বিষবৃক্ষের বিষফল তুফান সরকাররা, সেই বৃক্ষকে অটুট রেখে সমাজ নিরাপদ হওয়ার আশা বাতুলতা।
কেউ বলতে চাইবেন, তুফানরা দলের ভেতর ঢুকে পড়া ‘কাউয়া’। এসব কাউয়াকে দলের যেসব বটবৃক্ষ ছায়া দেন, বাসা বাঁধতে দেন, তাঁরা দায়মুক্ত? নেতারা গডফাদার হয়ে না উঠলে তুফানরা দলে ঠাঁই পেতেন না। অপরাধে হাতেখড়ির সময়েই যদি তুফানদের বিচারের মুখোমুখি করা হতো, মা ও মেয়েকে নিয়ে এ রকম মর্মান্তিক দৃশ্যের জন্ম হতো না। যঁাদের ছাড় ও পৃষ্ঠপোষকতায় তুফানরা শহরের সরকার হয়ে ওঠেন, তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলে রাজনীতির তুফান মেইল এভাবেই চলবে।
বগুড়ার ইতিহাসে নৃশংসতমভাবে খুন হন যুবদল নেতা ইমরান শেখ। সেই ঘটনার চার্জশিটভুক্ত আসামি তুফানরা চার ভাই। সবাই স্বনামধন্য। পঞ্চমজন হলেন বড় ভাই, বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ভাইবেরাদর, স্ত্রী-শ্যালিকা নিয়ে যে জাল তিনি পেতে বসেছেন, তা কি কোনো ‘কাউয়ার’ পক্ষে সম্ভব? বগুড়ার অভিশাপ যে জুয়ার আসর ও মাদকের রাজত্ব তার ভাগীদার তো তুফান একা নন। বগুড়ার সব অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন যে লাখো টাকা চাঁদা তুলতেন, তা-ও তিনি একা ভোগ করতেন না।
ঘরে বিদ্যুতের লাইন থাকলে বাতি জ্বলে। তুফানদের দলীয় লাইনে ক্ষমতায়িত করা হয় বলেই তাঁরা ধরাকে সরা ভাবতে পারেন। তুফানদের ক্ষমতার রক্তনালি এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা। যে রাজনীতি অবৈধভাবে টাকা বানানোর উপায়, তার দরকার আধিপত্য। সে জন্য তুফানদের দরকার। তাঁরা দলের হয়ে মাস্তানি করবেন, নেতার হয়ে খুন করবেন, ব্যবসার নামে লুটপাট চালাবেন। দলে যাঁর এত অবদান, দল কি তাঁকে ধনী বানাবে না? বানাবে। দল কি তাঁর ভোগ-ধর্ষণকে ছাড় দেবে না? দেবে, যতক্ষণ না তাঁরা বোঝা হয়ে ওঠেন। লোকে খুব খেপে গেলে তখন একটি-দুটি তুফানকে বলি দিয়ে তুফান বানানোর তুফান মেইলটাকে দুর্দান্ত গতিতে চালিয়ে যাবে।সেই তুফান মেইলের চালকদের ছবি তো কোথাও দেখা গেল না!
তুফানকে ক্যামেরার সামনে ঠেলে দিয়ে, হাতকড়া পরিয়ে গণরোষ শান্ত করা গেলে তুফান মেইল রাজনীতির বরং লাভ। তাদের সত্যিকার ক্ষতি হয়ে যাবে যদি নতুন নতুন তুফানদের তৈরি, প্রতিস্থাপন ও ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। তাই এক তুফান যখন জেলে, তখন কুখ্যাত সন্ত্রাসী জোসেফসহ ৫৩ জন দুর্ধর্ষ তুফানকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সামনে নির্বাচন, সন্ত্রাসীদের তাই বিপুল কদর।
সাধারণ নাগরিকেরা তাহলে কী করবে? শিশু নিজের মুখ ঢেকে ভাবে, কেউ তাকে দেখছে না। আমরা কি হতাশায় মুখ ঢেকে ফেলব? তারপর লুকোচুরি খেলার মতো মাঝেমধ্যে টুকি দিয়ে জানান দেব যে ‘বিবেক বাবাজি জাগ্রত আছেন’। এসব টুকি দেওয়া প্রতিবাদে তুফান মেইল থামে না। এ রকম ক্ষোভের জাগরণ তো আগেও ঘটেছিল। জি, রেইনট্রির ঘটনার সময়। তারও আগে? ও হ্যাঁ, রসু খাঁ নামের সিরিয়াল কিলার কাম রেপিস্ট ধরা পড়ার পর। ভাগ্যিস মাঝেমধ্যে কয়েকটাকে ধরা হয়। তাদের বদৌলতে সমাজের পিত্তথলিতে জমা ঘৃণা কিছুটা খালি হয়।
সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ কিংবা বনানীর ধর্ষকেরা সবাই এই সমাজেরই লোক। অপরাধীকে সমাজের বাইরের কল্পনা করার এই আত্মপ্রবঞ্চনা মাদকের মতো, ছাড়া যায় না। কিন্তু ভিলেন কি আমাদের মধ্যেই নয়? আমরাই দিনরাত যাঁদের প্রশংসা করতে বাধ্য থাকি, যাঁদের কৃপার ওপর আমাদের ভালো-মন্দ চলে, এসব ধর্ষক ও খুনি কি তঁাদের হাতেই পালিত ও ক্ষমতায়িত নয়? কথাটা বলে ফেলেছেন বগুড়া আওয়ামী লীগের এক নেতাও: যাঁরা তুফান সরকারের মতো ব্যক্তিকে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ দেন, এ ঘটনার জন্য তাঁরাও কম দায়ী নন। সত্য যিনিই বলুন, তার ধার তাতে কমে না।
পৃথিবীর আর সব দেশে অপরাধীরা লুকিয়ে কাজ করে, মহাসমারোহে জাহির হয় না। কিন্তু সোনার বাংলাই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যেখানে অপরাধীরা দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারে পোস্টারে সম্পূর্ণ রঙিন চেহারায় তারা হাজির! দলীয় পোস্টারের আলোকিত মুখগুলোর মধ্যে কত শত তুফান লুকিয়ে আছে, তা কি আমরা জানি! নিত্যনতুন পোস্টার দেখে শুধু বুঝি, তুফান তৈরির তুফান মেইল চালু আছে।
এই রাজনীতি শুধু তুফানই পয়দা করে না, ধোলাই করে তাদের অপরাধ মুছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করে। প্রখ্যাত ইয়াবা ব্যবসায়ী হন সেলিব্রিটি নেতা, জাহাঁবাজ মাফিয়া গডফাদার ধরেন ধর্মের লেবাস। তুফানেরও সেই সম্ভাবনা ছিল, শুধু স্ত্রী-শ্যালিকা যদি মা-মেয়েকে নির্যাতন ও ন্যাড়া না করতেন। এসব তুফানই তো সাদা পাঞ্জাবি পরে একদিন জনপ্রতিনিধি হয়ে যান। সব বড় রাজনৈতিক অপরাধীর প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে এ রকম অপরাধ মোছার গল্প।
খুটখাট মেরামত আর বাছাই ধরপাকড়ে তুফান মেইল থামবে না। সংকটের গোড়াটা রাজনৈতিক, রাজনৈতিক জাগরণ না হলে এসব তুফান দেশটারই মাথা ন্যাড়া করতে থাকবে, জনজীবনের ওপর ছুটে যাবে ক্ষমতার তুফান মেইল। হা-হুতাশ নয়, ভিত নড়ে যাওয়া জীবনের গোড়াটা বাঁধতে হলে রাজনৈতিক জাগরণই এখন উপায়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।