কাজ না পেয়েও পুলিশের পোশাক বানায় বেক্সিমকো

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতি ভর করেছে পুলিশের কেনাকাটায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারদলীয় প্রভাবশালী ঠিকাদারের হম্বিতম্বি। যে কারণে অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও কেনাকাটায় স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি তদন্তে ধরা পড়েছে কাজ না পেয়েও পুলিশের পোশাক তৈরি করছে বেক্সিমকো টেক্সটাইল। এছাড়া একজন প্রভাবশালী ঠিকাদার কাজ পেতে ব্যাংক সলভেন্সির জাল কাগজপত্র দাখিল করেন। এমনকি কাজ পেতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশরাফ আলী সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, তাকে কাজ না দিলে অন্য জায়গায় বদলি করে দেয়া হবে।

এদিকে সূত্র জানায়, বছরের পর বছর ধরে এভাবে জাল-জালিয়াতি করে নিন্মমানের পোশাক ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হলেও এসব প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। একাধিক প্রতিষ্ঠান ফৌজদারি অপরাধ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে সম্প্রতি তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধান ও পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, গত বছরের ১৬ মে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন বেক্সিমকো টেক্সটাইল লিমিটেডে বাংলাদেশ পুলিশের কাপড় রং করানো হচ্ছে। ওই দিনই আনোয়ার সাঈদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে বেক্সিমকোর সিনিয়র ম্যানেজার নিয়ামুল হাসানের উপস্থিতিতে ২২ হাজার গজ গ্রে কাপড় জব্দ করা হয়। ওই কাপড়ের গায়ে ইংরেজিতে নট ফর সেল/বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৫-১৫ লেখা ছিল। বেক্সিমকোর সঙ্গে কোনো চুক্তি না থাকার পরও কিভাবে তারা পুলিশের কাপড় রং করছেন জানতে চাইলে বেক্সিমকো কর্মকর্তা নিয়ামুল হাসান যুগান্তরকে জানান, সাউথ বেঙ্গল ট্রেডিং তাদের সঙ্গে দুই লাখ গজ কাপড় রং করতে ই-মেইলের মাধ্যমে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছে। সে অনুযায়ী এক লাখ ২০ হাজার গজ কাপড় ডাইং করে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে। বাকি ৮০ হাজার গজ কাপড় ডাইংয়ের কাজ চলছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (সাপ্লাই) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্যে দুই লাখ ৬০ হাজার মিটার সিটি টুইল ডার্ক ব্ল– ফেব্রিক (জেলা পুলিশের জন্য) সরবরাহ করতে সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। টেন্ডার ডকুমেন্ট দাখিল করার সময় সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং উল্লেখ করে তারা সানজানা ফেব্রিক লিমিটেড থেকে কাপড় ওয়েভিং ও ডাইং করবে। কিন্তু সানজানা ফেব্রিক থেকে ওয়েভিং ও ডাইং না করে পুলিশের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করেছে সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং।

নিয়মানুযায়ী এ ধরনের ঠিকাদারি কাজের আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র সিডিউল যাচাই করে নিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটি বেক্সিমকো করেনি। কিংবা জানলেও ব্যবসায়িক স্বার্থে সেটি আমলে নেয়নি।
সূত্রমতে, পুলিশের জন্য পোশাকসহ যে পরিমাণ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি সরবরাহের কথা তার চেয়ে কম সরবরাহ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং।

পুলিশের মোজার পরিবর্তে আনসার, ফায়ার সার্ভিসের মোজা সরবরাহ করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল এনে পুলিশ সদর দফতরে সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে কোথাও কোথাও হামলা করার ঘটনাও ঘটেছে। জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েল শোর সঙ্গে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং।

যুগান্তরের কাছে আসা পুলিশ সদর দফতরের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এ প্রতিষ্ঠানটি ফৌজদারি অপরাধ করেছে।’ কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো আরও কাজ দেয়া হয়। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আশরাফ আলী ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আশরাফ আলী নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পুলিশ সদর দফতর থেকে অনেক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। ‘শিগগিরই আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হব’- প্রায় সময় এমন তথ্য উপস্থান করে পুলিশ কর্মকর্তাদের তিনি ব্ল্যাকমেইলিং করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একটি টেন্ডারের মাধ্যমেই সাত কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার কাজ পায় সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং। তাছাড়া ডার্ক ব্ল– ফেব্রিক কাপড় সরবরাহ করা এক কোটি ১২ লাখ ৫৪ হাজার টাকার পৃথক কাজ দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর আগের অর্থ বছরে আড়াই কোটি টাকায় ৫৫ হাজার পিস মশারি, এক কোটি ২৭ লাখ টাকায় এক লাখ ৭০ হাজার জোড়া মোজা, এক কোটি ৮০ লাখ টাকায় ২০ হাজার পিস রেইনকোট, সাড়ে ছয় কোটি টাকায় ৬০ হাজার বুট এবং এক কোটি ৭০ হাজার টাকায় ১৫ হাজার কিটবক্স সরবরাহের সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক কোটি ৩০ লাখ টাকায় দুই লাখ ৮৬ হাজারের বেশি মোজা এবং পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ৬০ হাজার জোড়া বুট সরবরাহের সুযোগ দেয়া হয় এ প্রতিষ্ঠানকে।

সূত্রমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নানা কেনাকাটা করতে ইতিমধ্যে টেন্ডার আহ্বান করেছে পুলিশ সদর দফতর। ই-টেন্ডারিং হওয়ায় এবার এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই এ অর্থবছরের কাজ পেতে নানা অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রোপ্রাইটর আশরাফ আলী।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল করিমের রুমে গিয়ে আশরাফ আলী বলেন, ‘আমি তদবির করে আপনাকে পুলিশ সদর দফতরে এনেছি। আমাকে কাজ দিতে হবে। না হলে আপনাকে অন্য জায়গায় বদলির ব্যবস্থা করব।’

পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৭ জুন সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং ডিপ গ্রে জ্যাকেট সংক্রান্ত দরপত্রের সঙ্গে দুই কোটি ৯২ লাখ টাকা, লাইট অলিভ জ্যাকেট সংক্রান্ত দরপত্রের সঙ্গে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ডিপ গ্রে ও লাইট অলিভ জার্সি সংক্রান্ত দরপত্রের সঙ্গে ৯০ লাখ টাকার ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট দাখিল করে। এ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয় দি ফার্মার্স ব্যাংক পটুয়াখালী শাখা থেকে। বিষয়টি যাচাই করতে পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে দ্য ফার্মার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল আহসান চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয়, বিষয়টি তাদের জানা নেই। প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট ইস্যু করার ক্ষমতা পটুয়াখালী শাখার নেই। তাই প্রধান কার্যালয় এর দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবে না।

২০১৫ সালের ৯ জুলাই পুলিশ সদর দফতরের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির সভায় সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনের ৬৪ ধারা ও ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালার ১২৭ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার চিঠি চালাচালির ঘটনা ঘটলেও সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল করিম বলেন, ‘যেসব ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’

সাউথ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আশরাফ আলী জানান, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেসবের কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকলে তো ব্যবস্থাই নেয়া হতো। তিনি বলেন, ‘বর্তমান আইজির আমলে তিনি কোনো কাজই পাননি। তিনি দাবি করেন, ‘এখন পুলিশ সদর দফতরে যেসব কর্মকর্তা আছেন, তাদের বেশিরভাগই জামায়াতি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তারা বিপদে পড়বে। দুদক এবং প্রধানমন্ত্রীকে সব বিষয়ে অবগত করা হয়েছে। আমি ধরলে তাদের টেকার উপায় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *