যখন অনুকরণীয় ইন্ডিয়া
ওয়াসিম ইফতেখারঃ- Naga People’s Movement of Human Rights – মণিপুরের অধিবাসীদের গড়ে তোলা একটি সামাজিক মানবাধিকার সংগঠন। স্বাধীনতা বা কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে তাঁদের গভীর কোন সংযোগ আছে কি নেই, তা আমাদের বিবেচ্চ্য বিষয় নয়। ভারতীয় সামরিক পাণ্ডবদের হাতে প্রায় দুই যুগের অধিকাল সময় মণিপুরের বাসিন্দারা চরম নির্যাতিত হচ্ছিল। খুন, ধর্ষন, রাহাজনি, উস্কানি এইসব ছিল নিত্য দিনের স্বাভাবিক বিষয়। অঘোষিত মিডিয়া সেন্সর এবং গুম-খুন আতঙ্কে প্রথাগত প্রতিবাদের সুযোগ ছিল না। ঠিক এখন যেমন বাংলাদেশে চলছে। এহেন শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে ১৫২৮ জন মানুষের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বিস্তারিত বায়োগ্রাফ তৈরি করে Naga People’s Movement of Human Rights নামের সাহসী সংগঠনটি। সরকার ও সামরিক প্রশাসন সংগঠনটির কার্যক্রমে বাঁধা তৈরি করলেও একাগ্রতাতে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। উল্লেখিত ১৫২৮ জন ব্যক্তির সবাই অপহৃত অথবা নিখোঁজ। সংগঠনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সাহায্য নিয়ে ইন্ডিয়ার হায়ার কোর্টে ১৫২৮ জন মাষের বিস্তারিত ঘটনা ও তথ্য যথাযথ রেফারেন্স ও প্রমাণ সহ পেশ করে। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ে ঘটে যাওয়া গুম খুনের ঘটনা সমূহ লিপিবদ্ধ করা ও প্রমাণ যোগার করা মোটেও সৌখিন বুদ্ধিজীবিদের কাজ নয়।
Manipur Extra Judicial Killings: Allegation of excessive force by Police or Armed Forces must be thoroughly enquired into: SC
সারাংশে, ইন্ডিয়ার সুপ্রিম কোর্ট একটি বহুল আকাঙ্ক্ষিত ও ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে এই মাসের ১৪ তারিখে । রায়ে বলা হচ্ছে নিহত প্রতিটি ঘটনা নিয়ে পুংখানুপুংখু তদন্ত হবে। কোর্ট-কাচারি-আদালতে তদন্ত নির্দেশ খুব স্বাভাবিক ও অহরহ নির্দেশ হলেও এই আদেশের বিশেষত্ব হল মণিপুর পুলিশ/ সামরিক বাহিনী স্পেশাল অর্ডারের মাধ্যমে পাওয়া স্পেশাল অপারেশনের সময়কার কুকর্মের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করা। বিচারপতি মদন লোকুর ও উদয় উমেস ললিতের বেঞ্চ বলেন
“even while dealing with the ‘enemy’ the rule of law would apply”
উক্ত জাজমেন্টের এই লাইন দুটি ছিল মানবিক মূল্যবোধের জন্য আকাঙ্ক্ষিত। বেঞ্চের আরো একটা অভিমত ছিল চমকপ্রদঃ সেখানে বলা হচ্ছে
Therefore, even while dealing with the ‘enemy’ the rule of law would apply and if there have been excesses beyond the call of duty, those members of the Manipur Police or the armed forces who have committed the excesses which do not have a reasonable connection with the performance of their official duty would be liable to be proceeded against”
বেঞ্চের আরো একটা আইকনিক উক্তি ছিলঃ
“If members of our armed forces are deployed and employed to kill citizens of our country on the mere allegation or suspicion that they are ‘enemy’ not only the rule of law but our democracy would be in grave danger”
সম্পূর্ণ রাই পড়ে দেখতে পারেন। জাজমেন্টের লিঙ্ক ছেড়ে যাচ্ছিঃ
https://drive.google.com/file/d/0BzXilfcxe7yuQTd6dHB6X05zTkU/view
প্রতিবেশী রাস্ট্রের বিপরীতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান যথেষ্ট মজবুদ। হিল ট্রাকের বাইরে আর কোন অংশে সামরিক বাহিনীকে অবাধ অপারেশনাক্ষমতা প্রদান ও প্রয়োগের মত দুরাবস্থাতে আমাদের যেতে হয়নি। আলহামদুল্লিহা
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দালন, মুক্তিযুদ্ধ, কমিউনিস্টদের বিপ্লব বা উগ্র ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্টি বা এই ধরণের রক্তার্ত সংঘাত (ভারতে যেমন শিবসেনা বা বিজেপি) বাংলাদেশকে জাকিয়ে ধরেনি। (হলি আর্টিজেনের উদাহরণ টানবেন না , কারণ ঐ ধরণের ঘটনা কোন ক্ষেত্রে, কোন দেশে, কোন পন্থীদের কাছেই নিয়মিত প্রক্টিস নয়)।
বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার মত রক্তার্ত পরিস্থিতি নেই , মিলিটারি অপারেশন নেই অথছ ইন্টারেস্টিং হচ্ছে এই ১৭ সালের প্রথম আলো ও আসকের রিপোর্ট অনুযায়ী এনকাউন্টারের সংখ্যা ৯০ টি।
প্রথম আলোঃ http://bit.ly/2uKu2zJ
অন্যদিকে এই সময়ে সাদা পোষাকে তুলে নেওয়া ৫৪ জনের ভেতর ২ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছে এবং ৩ জনকে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং পরিবারের হাতে পুনঃরাই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে সৌভাগ্যবান সাত জনকে।
অর্থাৎ ইন্ডিয়াতে ১৯৭৯-২০১২ সাল পর্যন্ত ৩২ বছরে যেখানে ১৫২৮ জন এঙ্কাউন্টারে খুন গুমের স্বীকার হয়েছে, তাঁর বিপরীতে অর্ধ বছর বা ৬ মাসে বাংলাদেশে আইন বহির্ভূত পরলোক যাত্রা করেছেন ৯০ জন মানুষ।
অন্যভাবে হিসাব করলে ১০০ কোটি মানুষের ভারতে ৩২ বছরে নিহতের সাংখ্যা ১৫২৫ হলে, ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ৬ মাসে ৯০ জন নিহত হলে কোন দেশটি ব্যার্থ রাস্ট্রে পরিণত হতে কত দিন লাগবে?
এই বছরের পরিসংখ্যান থেকে হিসাব ধরলে ১২ মাসে ১৮০ জন মানুষের হারিয়ে যাবার কথা। ৫ বছরে ৯০০ জন , ১০ বছরে ১৮০০ জন এবং ভারতের সমান ৩২ বছরে ৫,৭৬০ জন খুন গুম বা নিখোঁজ হবার প্রজেকশন।
যে কারনে এত গুলো তথ্য উত্তাপ সংগ্রহ করাঃ
বিচারিক নিম্ন আদালতের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার ওপর। অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য, ব্যার্থতা, কার্যকরণ নির্ভর করে প্রশাসনে উপবিষ্ট সরকারের ওপর। সর্বোচ্চ্য নির্বাহী ক্ষমতার মালিকানা থাকার কারণে রাজনৈতিক সরকারের লাগান বিহীন স্বেচ্ছাচারিতা চেক এন্ড ব্যালান্স করার প্রধান শক্তি জনগণের ভোট প্রদানের অধিকারের মাধ্যমে পুরস্কৃত বা তিরস্কার করার। কিন্তু এই সুযোগ পাঁচ বছরের আগে পাওয়ার চান্স থাকে না, উপরন্তু কোন কিছু লাগামহীন হয়ে গেলে তা অন্তত সামনের নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত চলতে দেওয়া বড় ধরণের অসম্ভব কাজ।
এই ধরণের সন্ধিক্ষণেই বিচারালয়ের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ, গর্বিত হবার বড় সুযোগ, জনগণ থেকে দূরে অবস্থান করেও জনগণের মনের মণিকোঠাতে অবস্থান করার সুযোগ। দেশ রাস্ট্র সমাজকে মানবিক করার সুযোগ, রাজনৈতিক শঠতা ও চালাকীকে কান ধরে উঠবোস করানোর সুযোগ।
সুয়েমোটো নামের একটা বিষয় আছে, আমি বিস্তারিত না বুঝলেও এতটুকু বুঝি যে সুয়েমোটো হচ্ছে বিচারক ও বিচারালয়ের এক ধরণের অর্জিত অধিকার বা ক্ষমতা। বাঙালকে হাই কোর্ট দেখানোর সুযোগ নেই, কিন্তু কোর্ট চাইলেই বেশরম বাঙ্গালীর যেকোন অসামঞ্জস্যতে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিতে পারে। সুয়ে্মোটো এক ধরণের স্বপ্রণদিত অধিকার। তাঁদের অব্জারভেসনে কোন ভূল, অন্যায়, অধিকার হরণ , সংবিধান লঙ্ঘন বা দেশ রাস্ট্র জনগণের পক্ষে ক্ষতিকর কিছু ঘটলে আদালত নিজেই হস্তক্ষেপ করতে পারে সুয়েমোটোর মাধ্যমে। অনেক বিষয়েই আমরা দেখতে পাই সুয়েমোটো প্রয়োগ। জনগনের জীবনের এহেন পরিস্থিতি, মণিপুর গনহত্যা রায়ের উদাহরণ ভারতের চেয়ে কয়েকগুণ অধিক এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং – চলছে বাংলাদেশে। মাননীয় আদালত কি মনে করেন যে এ বিষয়ে স্বপ্রনোদিত রুল দেবার সময় এখনো আসেনি ?
লিঙ্কঃ বাংলাদেশে এক্সট্রা জুডিশিয়াল এক্টিভিটিজের কিছু রেকর্ড আছে। দূরবিন পত্রিকা ও সংশ্লিষ্ট লিংক সমূহ এখানে দিলাম।
https://www.evernote.com/pub/1977wasim/encounter
“সত্য উন্মোচিত হোক”
== ওয়াসিম ইফতেখার- লেখক ও গবেষক